সাম্প্রতিক কালে কোটা-প্রসঙ্গ নিয়ে সমাজের চিন্তাশীল ও যাঁরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা ভাবেন তাঁদের নানান মতামত আমার নজরে এসেছে। সেই সাথে এসেছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চলমান চালচিত্র! শ্রদ্ধার সাথে সকলের মতামত বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের সাথে আমার যৎসামান্য অভিমত সন্নিবেশের চেষ্টা রইলো। আওয়ামী-লীগ কে আমরা দেখি ‘৭৫-পরবর্তীকালে মুখথুবড়ে পড়া বাংলাদেশকে মানবিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বলয়ের একটি স্তরে ঠেলে নিয়ে আসার সম্ভাবনাময় প্রত্যয়ী দল হিসেবে। বহু চড়াই উৎরাই পেরুনো এবং এক অর্থে বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে মিশে যাওয়া একীভূত অঙ্গ-সৌষ্ঠবের শক্তি হিসেবে, এ-দলটির বিকল্প এখনো নেই। বাংলাদেশের গণ-মানুষের মানসিক আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হলে তার পরিণতি সম্পর্কে জ্ঞান ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে! মনে রাখতে হবে, এদেশের মানুষের পলিমাটির মতো নরম হৃদয় যেমন আছে, ঠিক তেমনি অধুনা শিক্ষা-ব্যবস্থার ত্রুটি, সাথে যুক্ত অশিক্ষা ও কুসংস্কারের বাড়-বাড়ন্ত এদের নিয়ে যেতে পারে আমাদের চিরকালীন বাঙ্গালী সংস্কৃতির সৌম্য-শান্তির বাইরে। সেও সাময়িক কালে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় ঐ একই কারণে! সাম্প্রতিক কালের পত্র-পত্রিকার সংবাদই এর যথার্থ উদাহরণ! তৃতীয় একটি ধারাও এখানে শক্তিশালী এবং মূলতঃ আমাদের অগ্রগতি, সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নাড়িয়ে দেবার মতো ধীশক্তি, যুক্তি-বোধ এবং সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধের উদাহরণ হবার মতো যথেষ্ট দীপ্যমান, মূলতঃ আজকের তরুণ প্রজন্মের একাংশ।
পাক-জামানায় বাঙ্গালী মানসের বিপরীতে প্রশ্রয়-পুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রের তোরজোড়ে যখন বেসামাল জাতি, তখনই ঐ ভেঙেপড়া সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতার পদলেহী বিত্তবান ও কল্পিত ধর্মাহঙ্কারের কোটারী স্বার্থ ভোগী কিছু তস্করের হাত থেকে জাত্যভিমানকে গৌরবের পীঠস্থানে পুন-স্থাপনের নিমিত্তেই ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন আওয়ামী-লীগ নামের উদারপন্থী অসাম্প্রদায়িক মানসের দলটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
তারপরের ইতিহাস আমাদের কম-বেশী জানা। সময়ের দাবীতে গঙ্গা বিধৌত এ পাললিক ভূমিতে যেনো উটকো ভাবনার লূতার সুতাজালে জড়িয়ে কীটের মতো নিঃসহায় মৃত্যুর ভাগ্য আমাদের বরণ করতে না হয়, তার জোরদার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ভিত গড়ে উঠতে থাকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী অভিব্যক্তির উন্মেষের মধ্য দিয়ে। যার প্রথম এবং সুস্পষ্ট স্ফুরণ ঘটেছিলো আরোও আগে আমাদের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের অমলিন ইতিহাসের পথ বেয়ে। সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের পথ বেয়েই আমরা শেষে এসে পৌঁছিয়েছি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে। বর্বর পাকিস্তানের তৎকালীন কোটারী স্বার্থের সুবিধাভোগী এবং একচক্ষু দানব পাকবাহিনী এবং তাদের ইসলাম-ধর্ম ব্যবসায়ী ধূর্ত রাজনৈতিক শাহী অমাত্য বর্গের কখনোই মনে হয়নি এদেশের মানুষ, এদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান. আদিবাসী, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসহ সবাই সম্পর্কিত পারষ্পরিক ভাবে এবং স্বল্প-দূর সম্পর্কে হলেও জ্ঞাতি। শুধু মাত্র ধর্মের লাল কাপড়ে ভেতরের পশুত্বকে জাগিয়ে তুলে পলল ভূমির নতুন চিন্তার সবুজ সদ্য খোলা পাতা গুলোকে দলিত মথিত করে বিরান-বিবর্ণ করে দিতে চেয়েছিল একদল শকুন। সুদীর্ঘ নয়টি মাসের আত্মত্যাগ, একনদী রক্ত, অগণিত ভাস্বর চিন্তার বিসর্জন, সম্ভ্রম, অনেক অনেক সৃষ্টির ধ্বংসলীলা আর শেষতম বাঙ্গালীর প্রত্যয়-দীপ্ত রক্তের বিনিময়ে অবশেষে আমাদের বাংলাদেশ পাওয়া।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি আসলে পেয়েছে বাংলাদেশ? ঊনিশ’শো পঁচাত্তর সালে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে টেনে নামানো হয়েছে পুরানো পঙ্কিল পথে। ধারাবাহিক কতিপয় সভ্যতা বিবর্জিত ও মননে ধূর্ত সামরিক স্বৈরশাসকের ঘৃন্যতম তান্ত্রিক সাধনে শিশু বাংলাদেশের মানসিক বৈকল্য সাধন করেছিলো শৈশবেই। গণ-মানসের সচেতন প্রচেষ্টা, সাংস্কৃতিক জাগরণের তৎকিঞ্চিৎ উন্মেষের মধ্যদিয়ে আশি থেকে নব্বইয়ের দশকে সামরিক বর্বরদের জগদ্দল পাথর ঠেলে মাতৃভূমির বুক ভারমুক্ত করেছিলো নুর হোসেন, ডাক্তার মিলন, দীপালী সাহারা। নব্বই-এর গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আবার ফিরে পেলেও এর আদর্শিক রূপ গণতন্ত্রের জায়গায় ভর করেছিলো পাকিস্তানের প্রেত। স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে নিয়ে একটি রাজনৈতিক ধারার ক্রমরূপান্তরে আদর্শিক ভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দাঁড়াতে থাকে। এরা চেহারা-সুরতে এ-দেশীয় বটে তবে ভেতরের নাট-শেলে থেকেছে পরিত্যক্ত পাকিস্তানের ফেলে যাওয়া বর্জ্য! বাঙ্গালী মুক্তি যোদ্ধারা তখন নিয়মিত পদাঘাতে হতো জর্জরিত। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ তো আসলে মুক্তিযোদ্ধা নয় তখন, পরিণত হয়েছে একটি মূর্ত শব্দের উপাধিতে। নানা রাজনৈতিক অনাকাঙ্খিত ট্যাগে আমাদের মহান স্বাধীনতা আর এর রূপকার মুক্তিযোদ্ধাদের করে তোলা হয়েছে বিতর্কিত। পণ্যের গায়ে আঁটা লেভেলের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের ব্র্যান্ডিং হয়েছিলো! আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা, বাম-মুক্তিযোদ্ধা! পাড়ার কুমোরের পোড়া মাটির কলশী, লালসালু, কলমি-শাপলা কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের সবুজে ভরা গা বেয়ে বয়ে চলা ছোট ছোট চঞ্চল নদীরা আর রইলো কোথায়? কামারের লোহিত-তপ্ত লোহায় আঘাতে আঘাতে কিংবা গলানো সোনার খাঁজে খাঁজে জহুরীর স্বপ্ন-দিয়ে বোনা কিংবা তাঁতি-বাড়ির মাকুর সশব্দ চঞ্চলতায় যে বৈচিত্র্যময় শিল্পের উন্মেষ ঘটে, তাদের বিলুপ্তির মতো আমাদের পলল ভূমিতে জন্মানো কাদা-মাটির ভাঁজে ভাঁজে ঋজুতার ক্ষিপ্রতায় জেগে উঠা সেদিনের সেই শিল্পী-সত্ত্বার মুক্তিযোদ্ধারা আর শেষ পর্যন্ত টিকলো না! জাতির মননের দৈন্যতায় ওঁরা বেদনায় কুঁকড়ে উঠা মুখ লুকালো যেনো! জাতির কাঁধে ভর করলো নতুন করে সংজ্ঞায়িত, বিভ্রান্ত, কদাকার, লোলুপ এক শ্রেণীর রূপান্তরিত বিজ্ঞতাপূর্ণ মানুষ, আর সেই সব বিজ্ঞতার কেন্দ্রে ছিলো আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার রূপকার মুক্তিযোদ্ধাদের কতোটা বিতর্কিত করে তোলা যায় তার প্রতিযোগীতা। এভাবেই বিতর্কের কালিতে নির্বাপিত ও সমগ্র জাতির কাছে ম্লান করে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, এমন কি বিতর্কিত করে তোলা হলো আমাদের মহান স্বাধীনতার ইতিহাস। এর ধারাবাহিকতায় জাতির সামনে উদিত হলো চেতনার ব্র্যান্ডিং। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও এখন নানান ব্র্যান্ড, পণ্যের মতো। অর্থনৈতিক মার্কেটে কার কতো বড় মূলধন! গ্লোবালাইজেশনের যুগ বলেই হোক, কিংবা কর্পোরেট যুগের পর্বতপ্রমাণ পয়সার চাপেই হোক, আমাদের বাঙ্গালীর আত্মত্যাগে, অনেক মূল্যে পাওয়া বাঙ্গালী জাতীয়তার জন্য অর্জিত নব ভূখণ্ড সমেত জন্মকালীন মূল্যবোধই ভেসে গেছে স্রোতে! সেই মূল্যবোধ যারা প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে যাবেন রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে প্রগাঢ় মহিমায়, জ্ঞানে, তপস্যায় ও দৃঢ়তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতে! তা আর হলো কোথায়! ওপর থেকে তাকালে রাজনীতির ময়দানে আদর্শিক বিরোধ কি আর চোখে পড়ে? সব মিলে মিশে কেমন যেনো ঘোট পাকিয়ে রয়েছে! চোখে পড়ে দস্তুর মতো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী-গত সস্তা দরের জেদ, মূল্যবোধ দুরস্ত। মন্ত্রের মতো উচ্চারিত কিছু বোধ্য কিংবা দুর্বোধ্য শব্দের জালে আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ আর তার অন্তরাত্মা আজ সত্যিই নির্দয় ভাবে বন্দী! অযুত-নিযুত ময়ূরপুচ্ছ-ধারী কাকের ভিড়ে আসল ময়ূর হারিয়ে গেছে! সৃষ্টির শাশ্বত সৌন্দর্যয়ের ভেতর দিয়ে সবার উপড়ে মানুষের সত্য হয়ে উঠাকে যেমন ভর্ৎসনা করে ব্যক্তিগত অন্ধ বিশ্বাস, ঠিক তেমনি গোটা জাতির সম্মিলিত আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় কর্পোরেট রাজনীতির অনাদর্শিক বেলেল্লাপনা! আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে ওরা রাজনৈতিক ভাবে ব্র্যান্ড করার দুঃসাহস দেখায়! অথচ হবার কথা উল্টো। ওদের রাজনীতির ব্র্যন্ডিংয়ের জন্যেই আসবার কথা মুক্তিযুদ্ধের কাছে, আসবার কথা আমাদের জাতির পিতার কাছে! আর এর ফল স্বরূপ আমরা দেখি, যখন যে আসে ক্ষমতার বলয়ে, পুচ্ছে পালক আর শীর্ষে ঝুঁটি বেঁধে ময়ূর সাজার চেষ্টা করে! বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা, যেনো আদর্শ নয়, পণ্য মাত্র! মাদকের মতো! নয় তো কি? সেই জন্যেই বিএনপি নেত্রী যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ চেতনার পরিপন্থী সাজে দুই পার্শ্বে টুপী ও ছাগ-শ্মশ্রু-শোভিত জামায়াতী কীট বগলদাবা করে উন্মত্ততার শিখণ্ডী হয়ে খুন-সন্ত্রাসের বড়ি বিক্রি করেন আর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির নামে আওয়ামী নেত্রী সেকুলার রাজনীতির মোড়কে আরোও একটু ডানে টান টান হবার ইয়াবা নিয়ে হাজির! দুইই নেশা! জাতিতো নেশায় বুঁদ! আর সেই সুযোগে জঙ্গলের দাঁতালেরা ভেড়ার লোমের উত্তরীয় গায়ে এসেছে বেরিয়ে আশে পাশে। আম-পাবলিকে খাবি খায়, আর ওরা গাছেরও খায় তলারও কুড়োয়! খেয়ো-খেয়ির রাজনীতির এমন সুসদৃশ্য ব্যবস্থাপনা জগতে আর আছে কোথায়?
সেই জন্যেই কোটা নিয়ে কুট-নামীতে স্বল্প-বুদ্ধির সবটুকুই খুইয়ে বসেছে সেকুলার রাজনীতির দাবীদারেরা! আমজনতার করার কি আছে? যেখানে জাতির বিবেক বলে খ্যাতিমান মান্যবরদের পক্ক-কেশের কেউ কেউ আত্ম-বিক্রিত! মহারথীদের রথ চালনার এইরূপ বিপর্যস্ততা কার্যতঃ জাতির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয় মাঝপথে যেখানে হয়তো এক সম্মিলিত উল্লম্ফন দরকার ছিলো! এখন এ-মেরুর কথা বলেন তো একটু পরেই বিপরীত সুরে দিয়ে বসেন ফুঁ, এ-কূলও রইলো, রইলো ওকূলও! ঝোপ বুঝে কোপ মেরে রাখা দাও, সুবিধা-মতো মাতোয়ারা হয়ে খাও! না হয়েই বা উপায় কি, সায়াহ্নে কিছুটা খুদ-কুড়ো তো চাই! বুদ্ধির বিভ্রাটে রাষ্ট্রের বুদ্ধি সংকটের লক্ষণ! এ-সময় লক্ষ্যস্থির করাই তো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু আর জাতির পিতার নামে মাজারের খাদেমের মতো দিন-রাত উপড়ে-নীচে-সামনে-পেছনে-ডাইনে-বায়ে কেউ কেউ মাথা দুলিয়ে জিকির করলেই কি আর বঙ্গবন্ধুর মনন-মেধা আয়ত্তে আসে? বঙ্গবন্ধু উনিশ’শো পঞ্চাশে বসে দু’হাজার পঞ্চাশের কথা ভাবতেন। ঊনিশ’শো বাহাত্তরের জাতীয় সংবিধানের চার মূলনীতি সেই ইঙ্গিতই দেয়। আর আজকের নেতারা এক ঠেলাতেই মদিনা সনদে আশ্রয় খোঁজেন! কি কপাল আমাদের! এইসবে আমাদের জাতীয় চেতনা আঘাতপ্রাপ্ত হয় না, অপমানিত হয় না মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন! মুক্তিযুদ্ধ অপমানিত হয় তখন, যখন যৌক্তিকতা-বোধে আজকের তরুণেরা কোটা ব্যবস্থার সংস্কার দাবী করেন। নেতারা জাতীয় সংসদের পবিত্র অঙ্গনে দাঁড়িয়ে তখন সিংহভাগ তরুণ-প্রজন্মের উদ্ভুত বোধের দিকে আঙ্গুল তোলেন। আঁধার যাত্রার আঁচ পেয়ে যারা প্রতিবাদ করেন, সংশোধনের আর্জি জানান, তাদের বলেন রাজাকার! নেহাত দুর্ভাগ্য-বান না হলে মহান জাতীয় সংসদের ফ্লোর থেকে ভাগ্যে এমন পদবী জোটে?
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অব্যবহিত পরেই গিজ গিজ করতে থাকে সার্টিফিকেট প্রত্যাশী মুক্তিযোদ্ধার ঢলে। সে ঢল কখনোই আমাদের ইতিহাসে থামেনি! আজও প্রত্যাশী! সরকার বদলায় সাথে বদলায় সারণী, বড্ড দৃষ্টিকটু! অথচ সহজ হিসেবে এটা কেউ একবার ভাবলই না যে, এদেশে একমাত্র চিহ্নিত রাজাকার ছাড়া আর সবাই কোন না কোন ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। কারণ, শুধু মাত্র অস্ত্রহাতে যুদ্ধ মানেই মুক্তিযোদ্ধা নয়। নিরাপদ আশ্রয়ে পালাতে গিয়ে যে কৃষক, জেলে, তাঁতি, মজুর, মুটে, কুলি মায় কি পথের ভিখিরিটিও, যাঁরা সেদিন শত্রুর আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, বলি হয়েছেন, এদেশে তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা! যুদ্ধের ময়দানে লড়াকু কিশোর-যুবকটিকে যে এক আঁজলা জল এগিয়ে দিয়েছিলো সেও! পথ দেখিয়েছিলো সেও! শত্রুর আ্যম্বুস থেকে ফিরে আসা একজনকে যে আশ্রয় দিয়েছে, লুকিয়ে রেখেছে, চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে শত্রুকে বোকা বানিয়েছে সেও! যে পালিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে নয়টি মাস জীবন-সংগ্রাম করেছে, কিংবা আত্মীয়-বাড়িতে পরবাসী হয়ে বেঁচে ছিলো সেও! লড়াকু মুক্তিযোদ্ধাদের যারা সাহস যুগিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন নানান উপায়ে, তাঁরাও এদেশে মহান মুক্তিযোদ্ধা! সোজা কথা হলো আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যাঁরা সেদিন বুকের ভেতরে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে কাঁপন অনুভব করতেন তাঁরাই মুক্তি যোদ্ধা! দেশ শত্রু-মুক্ত হবার সাতচল্লিশ বছর পরে এদেশে থাকার কথা শুধু মাত্রই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তর প্রজন্মেরই, স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের স্বরূপ আদর্শকে ধারণ করে! কিন্তু বাস্তবতা হলো, তা নেই। এই না থাকার কারণ অন্য আর এক উপাখ্যান! তবে এইটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে এদেশে রাজাকার ও তাদের উত্তরাধিকার যারা আজও বাংলাদেশকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিতে পারেনি, কিছু নব্য রাজাকার ও কিছু বিভ্রান্ত ও পরিবর্তিত রাজাকার ছাড়া তাবৎ জাতিই মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তর প্রজন্মের নির্মিলিত প্রাণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেই যে কাজটি আমাদের জরুরী ছিলো, তা হলো পুনর্বাসন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশে এই পুনর্বাসনের কাজটি নেহাত সহজ নয় বলাই বাহুল্য। সে এখন ইতিহাস, যা তখন ঘটেছিলো। তবে সদ্য স্বাধীন দেশে মহান শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও সন্তানদের, সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও সন্তানদের, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাঁদের পরিবার বর্গের যথাযথ দায়িত্ব তখন রাষ্ট্রের উপড়েই বর্তায়। সমাজের অগ্রসর অংশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানের লক্ষ্যে সরকারী দপ্তরের পদে তাদের যথাযথ ও যুক্তিগ্রাহ্য যোগ্যতা সাপেক্ষে অংশগ্রহণ ছিলো অত্যাবশ্যকীয়, এবং তা অবশ্যই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই। সেই জন্যেই বঙ্গবন্ধুর সরকারের নেয়া ঐ সময়ের সিদ্ধান্তটি মোটেও অযৌক্তিক নয় যে, তাঁদের জন্যে বরাদ্দ থাকবে তিরিশ শতাংশ কোটা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে সেই বিধিব্যবস্থায় লক্ষ্য অর্জনের অবসান ঘটেছিলো। তারপরে প্রায় তিন দশক ধরে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অবহেলিত। রোগে-শোকে, অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, অপমানিত হয়ে, তাচ্ছিল্যের ভারে, নির্যাতনে, দখলে-বিতাড়িত হয়ে, বিনা বিচারে, অন্তর্ঘাতে একে একে তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন আমাদের গর্বের অর্জিত, পৃথিবীর মানচিত্রে অঙ্কিত নতুন অবয়বের দেশের নাগরিকের একাংশের হৃদয় থেকে! সেই কোটায় পুনর্বাসিত হয়েছিলো চিহ্নিত এবং বর্ণচোরা রাজাকারেরা, বাংলাদেশ বিরোধীরা এবং তাদের দুর্মুখ স্বজনেরা। সামান্য কয়েকজন স্বনামধন্য মুক্তি যোদ্ধা ছাড়া আজও মাঝে মাঝেই পত্র-পত্রিকার পাতায় দেখা মেলে আমাদের অহংকারের মুক্তিযোদ্ধার অগোচরে বিদায়ের করুণ ও বিষাদে ভরা গাঁথা! ইত্যবসরে প্রান্তিক মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের অনেকেই নিজেকে হারিয়েছেন পঙ্কিলতার পথে, হয়তো বাধ্য হয়েছেন জীবন-জীবিকা ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার স্বার্থে। অথচ জীবনের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার কোনটিতেই তাঁদের অভাব থাকবার কথা ছিলো না। উল্লেখিত তিন দশকের অবহেলার পরেও রাষ্ট্র তাঁদের পুনর্বাসনে কি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছিলো? আজও কেনো তবে সংবাদ হবে একজন প্রৌড়-কিংবা অশীতিপর বৃদ্ধ মুক্তি যোদ্ধার বিনা চিকিৎসায় অসহায় মৃত্যুর? অথচ হয়। তিরিশ শতাংশ কোটা বরাদ্দ থাকার পরেও হয়! এর কারণ অন্যত্র, কোটার অপ্রতুলতা নয়! যে ত্রিশ শতাংশ কোটা বরাদ্দ ছিলো মহান মুক্তি যোদ্ধাদের জন্যে, পঁচাত্তর পরবর্তী তিন দশকে তার ব্যবহার হয়নি যথাযথ ভাবে। তার পরে সেই কোটা বলবত রেখে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে উন্মুক্ত হলো। কিন্তু হায়, ততদিনে যা হবার সে সর্বনাশ হয়ে গেছে! যে অনগ্রসর মুক্তি যোদ্ধাদের সুবিধা পাবার কথা ছিলো, সুবিধা বঞ্চিত হয়ে তাঁরা পিছিয়ে যেতে যেতে এতোটাই পেছনে যে, আজ আর তাদের কোটার ন্যূনতম যোগ্যতায় দাঁড়াবার সামর্থ্য পর্যন্ত নেই! সামর্থ্য নেই তাঁদের পরবর্তী দু দুটি প্রজন্মেরও। সেই জন্যেই আজ পত্রিকায় খবর হয় ভিক্ষাবৃত্তির পেশায় নিয়োজিত মুক্তি যোদ্ধার! এ আমাদের জাতীয় কলঙ্ক বই কিছু নয়। যাঁদের থাকবার কথা মাথার উপড়ে তাঁরা আজ সুনিপুণ ভাবে অবহেলিত! সূক্ষ্মভাবে এবং সুচারুভাবে নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের অভাবে। অবহেলিত বঞ্চিত হয়েও তাঁরা আপোষ করেননি, তিল তিল করে নিজেকে পুড়িয়েছেন! যারা অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান এবং খেতাবি মুক্তিযোদ্ধা তাদের অনেকেই আপোষের খেলায় রত, দিবস-যামিনী বাঙ্গালী জাতীয়তা আর জাতির পিতার নিকুচি করে বেড়ান! নির্লজ্জতার পরাকাষ্ঠা দেখান, বিকৃত করেন ইতিহাস! উদাহরণ চাই? টেলিভিশনের মুক্ত আলোচনায় তাদের অনেকেই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ান, ইতস্ততঃ করেন শহীদের বোধগম্য পরিসংখ্যান নিয়ে! এই তো চেতনা! এই জন্যে বরাদ্দ রাখতে হবে তিরিশ শতাংশ? এদের জন্যে? এদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে? হায় মাতৃভূমি, তোমার বুকে দাঁড়িয়ে এ ছলনার দুঃসাহস এইসব বিপথগামীরাই আজও পায় তাহলে! তাই বুঝি তুমি সর্বংসহা মা?
কোটা সংস্কারের জন্যে আজকের তরুণেরা যে দাবী তুলেছেন, তার যৌক্তিকতা এখানেই। কোন অবস্থাতেই কোটা বাতিলের কথা তারা কোথাও বলেন নি, বলেছেন সংস্কারের কথা। আর এই সংস্কারটি হতে হবে যৌক্তিকতার নিক্তিতেই। পঁচাত্তর পরবর্তী তিন দশকে যে সব রাজাকার এবং রাজাকার শাবকেরা ঐ কোটার বদৌলতে প্রশাসনে, তারাই তাদের আগামীর কথা ভেবে সরকারকে করে চলেছে বিপথগামী। স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরে মুক্তি যোদ্ধাদের পরবর্তী দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চেতনা প্রবাহের যেমন কোন সুনিশ্চিত কারণ নেই, তেমনি আমাদের দেশ ও জাতীয় জীবনের অগ্রগতির জন্যে আধুনিক মননের বুননে চৌকশ জাতীয় স্বার্থ ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত মূল্যবোধের ধারাবাহিকতা রক্ষায় পারঙ্গম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত আদর্শের ভিতের উপড়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্কাঠামোর উপযুক্ত কর্মকর্তাদের বিন্যাসও ও সমাবেশও প্রয়োজন। আর সেই জন্যেই স্বার্থান্বেষী মহলের হাতে কোটার অপব্যবহার রোধ করা জরুরী। আর সংস্কারটির প্রয়োজন সেখানেই।
সেই জন্যেই আজ দাবী উঠেছে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের প্রশ্নে। আর এই দাবীটি উঠেছে যথাযথ সরকারের কাছেই। এই জন্যে যে, এ সরকারের কাছেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আবর্তিত প্রজন্ম যথাযথ সংস্কার আশা করতে পারে। যেহেতু কোটার একটি বড় অংশ বিদ্যমান রয়েছে, অন্যকথায় বলতে গেলে বলতে হবে যে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বরাদ্দ রয়েছে। এই সংস্কারের সাথে নতুন করে আমাদের মনোযোগ দেবার সময়ও এসেছে অন্যান্য খাত গুলোতে, যেমন –
১। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা
২। নারীদের জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা
৩। জেলা ও পিছিয়ে পরা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা
৪। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা
৫। আদিবাসী-উপজাতীয় সম্প্রদায়ের জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা
৬। অটিষ্টিকদের জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা
৭। ট্রান্সজেন্ডারদের জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা
৮। দুর্ঘটনা বা কারণবশতঃ শারীরিক বা মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গদের জন্যে বরাদ্দকৃত কোটা।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার কৌতূহল কাজ করে। আমরা জানি বাংলাদেশ আওয়ামী-লীগ দেশের একেবারেই তৃনমূল পর্যায় থেকে উঠে আসা একটি রাজনৈতিক সংগঠন। অর্থাৎ, আওয়ামী-লীগের তরফে যা বলা হয়, ধরে নেওয়া যায় যে সেই বক্তব্য দেশের গণ-মানুষের অভিব্যক্তির প্রকাশ, অন্ততঃ তা হওয়া উচিৎ। কিন্তু সেই সাথে একথাটিও মনে রাখতে হবে যে সরকার ও রাজনৈতিক দল এ-দু’য়ের মাঝে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। সে ব্যবধান থাকতেই হবে, কম অথবা বেশী। কিন্তু যদি কখনো এমনটি দেখা যায় যে, দল ও সরকারে বস্তুত কোন ব্যবধান নেই, তাহলে দলের আভ্যন্তরীণ গনতান্ত্রিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। একটি অগণতান্ত্রিক আভ্যন্তরীণ কাঠামোর দলের কাছে সেই অর্থে দেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় পাবার মতো কিছু আসলে থাকে না। সেই ক্ষেত্রে চাপিয়ে দেয়া বিধি ও বিধানেই দেশের আর্থ-সামাজিক ও পরি-কাঠামোগত উন্নয়নের রোড-ম্যাপ নিশ্চিত হয়ে পরে। এর ফলাফল কখনোই ইতিবাচক হয় না বরং অতি সহজেই তা কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের একক কিংবা গোষ্ঠী-স্বার্থ চরিতার্থের কার্যকর যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দাবার চালের ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। সরকার ও দলে দেশের আদর্শ ও অর্থনীতির স্বচ্ছতার প্রশ্নে বোঝাপড়ার কিছু থাকে না। বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশকে সীমিত পরিসরে যে কয়টি সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটি সম্পূর্নতঃই সরকারে বিলীন হয়েছে!। বর্তমানের ক্ষমতাসীন আওয়ামী-লীগের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই কোন ভাবেই। বরং এ অবস্থায় দল সরকারের ভাষ্যের উপড়ে, সরকারের দেয় সিদ্ধান্তের উপড়েই নির্ভরশীল হয়ে পরে। অধুনা এ দৃশ্যটিই চোখে পড়বার মতো! এর অর্থ হলো গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা দলে তো নেইই এমনকি সরকারের কোন পর্যায়েই গনতান্ত্রিকতার ন্যূনতম কোন চর্চা নেই। সরকারের সিদ্ধান্তই এক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। বরং সরকার থাকে ভীত ও তটস্থ সবসময়ে, যেকোন ফোরামে উচ্চারিত অধিকার, ন্যায়বিচার ও বৈষম্যের স্বাভাবিক প্রতিবাদে। তারা ষড়যন্ত্র খুঁজতে থাকে। অতীতেও এর উদাহরণ আছে বিস্তর। আর এই পণ্ডশ্রমে পথে পথে যে খাঁদ সৃষ্টি হয়, সেই খাঁদে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকাটি যায় আটকে! এর ফলাফল বিচ্ছিন্ন করে দেয় জনগণ থেকে সরকারকে এবং সরকারের মধ্যস্থতাকারী রাজনৈতিক সংগঠনকে। অর্থাৎ আওয়ামী-লীগ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক টেনে নিয়ে চলা একটি অন্তঃসার শূন্য কাঠের ঘোড়া। এতোটাই শূন্য যে ঘোড়াটির স্বগতির কোন সুযোগ নেই! কথা গুলো স্পষ্ট হবে কতগুলো ঘটনা থেকে। কোটা নিয়ে তোলপাড়ের দ্বিতীয় পর্যায়ে এই রাজনৈতিক দলটির ছাত্র-সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী জড়িত ছিলেন। অনেকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েও এখানে আন্দোলন সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এরা বেশীর ভাগই তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী। অর্থাৎ কোটা প্রশ্নে আওয়ামী-লীগের তৃণমূল পর্যায়ের ভাবনা এবং শীর্ষ-পর্যায়ের ভাবনার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ের ভাবনাটি তৃণমূলের বাস্তব উপলব্ধি থেকেই উদ্ভূত। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের ভাবনাটি সরাসরি সরকার কর্তৃক আরোপিত। সরকারের শীর্ষ পর্যায়টি নির্ভর করে প্রশাসনের প্রশাসনিক নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তের উপড়ে। একথা মোটেও অবিবেচনা প্রসূত নয় যে দেশের প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পঁচাত্তর পরবর্তী বিগত তিরিশ বছরের জামায়াতী করনের কণ্টকময় বিষ-ফল বহাল তবিয়তেই বসে আছে। কিছু কিছু বৃহৎ বিষবৃক্ষের নিধন হয়তো হয়েছে, তবে ঝড়ে পড়া বীজ ও দশ-পনের বছরের চারা গুলো এখন বনানীতে মিশে যাওয়া বৃক্ষই বটে। আওয়ামী-লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে সরকারের আঙ্গুলে ট্রিগার টিপছে এখন তারাই। লক্ষ্মণ গুলো কি খুবই স্পষ্ট নয়? এটি কি বিশ্বাস যোগ্য যে আওয়ামী-লীগের মতো একটি দল যখন রাষ্ট্র পরিচালনায়, তখন মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকার বেছে নেবে গুপ্ত হত্যার পথ, গুম-খুনের পথ? যেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বড় অপরাধী, রাজাকার-আলবদরের বিচার হচ্ছে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে, সেখানে কিনা ছিঁচকে মাদক সেবী কিংবা খুচরা ব্যবসায়ীদের করা হচ্ছে বিনা বিচার হত্যাকাণ্ড? বাড়ি থেকে, পথ থেকে, কর্মক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়ে গুম-খুন? এ সবই পত্র-পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদ। এসবের দায়মুক্তি যেভাবেই দেওয়া হোক না কেনো দিন শেষে জন-মানুষে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের দায় শেষপর্যন্ত বইতে হবে আওয়ামী-লীগকেই।
আসি কোটা প্রসঙ্গে। সাধারণ ছাত্র-অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের ছাত্ররা কোটা সংস্কারের দাবীতে যখন সোচ্চার, যেখানে ঐ একই ব্যানারে সরকারী ছাত্র-সংগঠনের সদস্যদের একাংশের অংশগ্রহণও ছিলো কিংবা আছে। আবার সেখানে সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে সাথে সরকার দলীয় ঐ ছাত্র-সংগঠনটির নেতৃতাংশ যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে এবং যেভাবে তা সৃষ্টি করেছে তার ভয়াবহতা ও নৃশংসতার সাথে কি নিকট অতীতের কারো সাদৃশ্য আছে? আমি বলবো আছে, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের নৃশংসতার সাথে এর সাদৃশ্য আছে। যে জন্যে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ এখন ‘হাতুড়ী লীগে’ রূপান্তরিত! রগকাটা শিবিরের মতোই বটে! এ কথা গুলো বললাম এই জন্যে যে সরকারের সাথে জনগণের সেতুবন্ধ হিসেবে দলের যে ভূমিকা থাকে, এই ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত, কেননা সরকার ও দলের আলাদা অস্তিত্ব এখানে নেই। ফলে আওয়ামী লীগ ক্রমশঃ এখন জন-বিচ্ছিন্নতার পথে। স্বাভাবিক ভাবে সরকারও! কারণ সরকারের সাথে জনগণের সম্পর্কটি দূরতম। প্রশাসনিক স্তর-বিন্যাসে সরকার ও জনগণের সম্পর্কটি মূলতঃ প্রশাসনের আইনি, প্রোটোকলের দেয়ালে বন্দি। আর এই ক্ষেত্রে সরকারের একমাত্র অবলম্বন হলো দলের সাথে জন-সম্পৃক্ততা নতুবা বিকল্প হাতিয়ার হলো ক্ষমতার দম্ভ যা স্বৈরাচারের একমাত্র অবলম্বন। সরকার হয়তো এখন দ্বিতীয়টিই বেছে নিয়েছে অতি নির্ভরতার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে, অথবা হয়তো বুদ্ধি-বিভ্রাটে! যা সাম্প্রতিক কালে সরকার একে একে দেখিয়ে চলেছে! সেই সাথে বশংবদ দলের সম-পাতিত প্রতিক্রিয়া! কারণ দলই এখন সরকার। আর সেই কারণেই সরকার-কে ব্যবহার করতে হয় হাতুড়ী লীগ কে ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী হিসেবে!
এ কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিকতার ঊচ্চমাধ্যমিক স্তর! তারপরে উচ্চস্তর, আর সব শেষে পতন! আরশিতে অশুভের বিম্ব তবে কি এটিই? সাধু সাবধান ……!
ভালো লেগেছে