নরওয়ের “নরভিক” পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় ও চমৎকার একটি শহর।সমুদ্র সংলগ্ন শহরটি উত্তর অবস্থান করায় স্বাভাবিকভাবেই এটি ঠাণ্ডা আবহাওয়ার শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাৎসি বাহিনীর Beisfjord-এ ক্যাম্প নির্মাণ হয়। আলোচিত ক্যাম্পটির নাম ছিল- স্টালাগ ৩৩০ (Stalag 330)। এটি ছিল উত্তর নরল্যান্ডের প্রধান ক্যাম্প।
নরভিক নাৎসি সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অঞ্চলটি রাশিয়া ও পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে কৌশলগত কারণে এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া সুইডেনের সবচেয়ে বড় খনির শহর কিরুনার নিকটে নরভিকের অবস্থান। তৎকালীন সময়ে নরভিকের রেল যোগাযোগও ছিল ভাল। এছাড়া আরও বিভিন্ন কারণে জার্মানির কাছে শহরটির ছিল গুরুত্ব। আজ এই মাটিতে সোভিয়েত ও যুগোস্লাভীয় বন্দিরা পাশাপাশি শুয়ে আছে যার নাম নরওয়েজিয়ান ভাষায়- Sovjetisk Minnelund and Jugoslavisk Minnelund.
এক.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নরওয়েতে প্রায় ৯৫ হাজার সোভিয়েত যুদ্ধবন্দি ছিল এবং এর মধ্যে ১৩,৭০০ মতন বন্দী ক্ষুধা, রোগে, অনাহারে ও নির্যাতনে মারা যায়। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে সোভিয়েত বন্দীরাও বন্দী অবস্থায় মানবিক সুযোগ সুবিধা পাওয়া অধিকার রাখতো কিন্তু জার্মানরা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তারা নুন্যতম সুযোগ সুবিধা পায়নি। কারণ জার্মানরা মনে করতো- সোভিয়েতরা আদর্শিক ও জাতিগতভাবে তাদের শত্রু।
১৯৪২ সালের ২৫ অক্টোবরে, জার্মান সেনা বাহিনীর স্পেশাল ফোর্স ভারমাশট (Wehrmacht,1921 To 1945) ক্যাম্পটি চালু করে। ১৯৪৪ সালে ক্যাম্পটির পতনের আগ পর্যন্ত এই ক্যাম্পটিতে ৬০০ জন যুদ্ধবন্দী ছিল। সবচেয়ে কমবয়সী বন্দীরবয়স ছিল ১৮ বছর। বন্দীদের মধ্যে অর্ধেক ছিল রাশিয়ান, এক-চতুর্থাংশ ছিল ইউক্রেনিয়ান। অন্যরা সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মানুষ। ট্রমস কাউন্টি (Troms county) ও উত্তরের নরল্যান্ডের (Nordland) জন্যে এটি ছিল প্রধান ক্যাম্প। পূর্ব ফ্রন্টে জার্মান সৈন্যদের হাতে যারা বন্দী হতো পরবর্তীতে নরওয়েতে তাদের শ্রমিক হিসেবে পাঠানো হতো।
১৯৪২-৪৫ সাল পর্যন্ত নাৎসি বাহিনী এই শহরে ১৬০০ জন সোভিয়েত সৈন্যকে বন্দী করে রাখে, যাদের মধ্যে ৩৪৭ জন মারা যায়। জার্মানরা এসব বন্দীদের অমানুষিকভাবে খাটাতো। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও বন্দীদের বিশ্রামের কোন ব্যবস্থা ছিল না।নাৎসি-বাহিনী যুদ্ধবন্দীদেরকে বেইসফিওড (Beisfjord) গ্রামে রাস্তা ও বাঙ্কার এবং নরভিক (Narvik) শহরে ব্যারাক এবং কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করতে বাধ্য করে। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে অপারেশন অ্যাসফাল্ট এর সময়ে সমাধিস্তম্ভ নরল্যান্ডের Tjøtta তে স্থানান্তরিত করা হয়।
দুই:
১৯৪২ সালের ২৪ জুন ৯০০ যুগোস্লাভীয় বন্দীকে এখানে আনা হয়। একই বছর ২৫ অক্টোবরে ১৫২ জন বন্দীকে অন্য কোন কয়েদখানায় পাঠিয়ে দেয়। মাত্র চার মাসের মধ্যে ৭৪৮ জন বন্দী জার্মান সৈন্য এবং নরওয়েজিয়ান নিরাপত্তাকর্মীদের হাত নিহত হন এবং ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের সময়কালে ৪০৪৯ জন যুগোস্লাভীয় বন্দি। ১৯৪২ সালের জুন থেকে ১৯৪৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জার্মান সংসদীয় নিরাপত্তা সংস্থা ‘শুৎজস্টাফেল’ বা এসএস কনসেনট্রেশন ক্যাম্প পরিচালনা করে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই ৭২ শতাংশ বন্দী অনাহারে মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নরওয়ের সবচেয়ে ভয়াবহ অত্যাচারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বেইসফোর্ড বন্দীশিবিরে মারা যায় প্রায় ৮২ শতাংশ বন্দী।
বন্দীদের বেশির ভাগই ছিল সার্বিয়ান। কিন্তু তাদের মধ্যে বসনিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান, এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও কম ছিল না। বন্দীদের মধ্যে অনেকেই ছিল নিরপরাধ বেসামরিক মানুষ এবং বাকিরা জার্মান দখলদার বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী যোদ্ধা। নরওয়েতে নাৎসি বাহিনীর হাতে ১৪ বছরের কিশোরও বাদ যায়নি। নাৎসি বাহিনী যুগোস্লাভীয় বন্দীদের সৈন্য হিসেবে মর্যাদা দেয়নি সুতরাং তাদের কপালে জোটেনি জেনেভা কনভেনশনের বন্দি সুরক্ষার আইন। নিরাপত্তাবাহিনীই ঠিক করে বন্দীদের ভাগ্যলিখন। বেশিরভাগ যুগোস্লাভীয় বন্দীদের দিয়ে রাস্তায় কাজ করানো হচ্ছিল তখন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নরওয়ের সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এখানেই ঘটে।
১৯৪২ সালের ১৮ জুলাই নাৎসি বাহিনীর হঠাৎ মনে হলো বন্দীদের মাঝে সংক্রামক টাইফাস জ্বর ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই নাৎসি বাহিনী একরাতেই ২৮৭ জন বন্দীকে হত্যা করে। বেশিরভাগকেই গুলি করে হত্যা করা হয় আর যারা অসুস্থ ছিল তাদেরকে হাসপাতালসহ জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়।
নরওয়ের বিয়েনফিয়েলে রাস্তা নির্মাণের উদ্দেশ্যে জীবিত বাকি ৫৮৮ জন বন্দীকে ওভরে ইয়ানভানের অস্থায়ী বন্দী শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়। পাঁচ সপ্তাহ যেতে না যেতেই অধিক শারীরিক পরিশ্রমের কারণে রাস্তা নির্মাণ করার সময়ে ২৪২ জন বন্দী মারা যান। তারপরেও যারা বেঁচে ছিল তাদেরকে আবার বেইসফিউডের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয় যেখানে বন্দীদের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন এবং হত্যা চলতেই থাকে। ১৯৪২ সালের অক্টোবরে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট বন্দীদেরকে অন্য একটি ক্যাম্পে পাঠানো হয় এবং সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুগোস্লাভীয় নিহতদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভের পাশেই ১৯৫৩ সালে মৃতদের কবরকে নরল্যান্ডের রোগনান গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়।
অপরূপ সৌন্দর্যের শহর নরভিক সেই ইতিহাস ভুলেনি। আজও ইতিহাসের মানুষগুলোকে কেউ না কেউ ঠিকই স্মরণ করে। আজও কেউ না কেউ এই কবরস্থানে এসে অচেনা নিহতের জন্যে ফুল দিয়ে যায়।
[…] নরভিকের বন্দী শিবির […]
নাৎসি নৃশংসতার কথা মানুষ নিশ্চই অনেক কাল ধরেই বলবে। আসলে বেশির ভাগ শাসকেরাই কোন না কোন ভাবে মানবতা বিরোধী হয়। নাৎসিরা ছিল ভয়াবহ গুলোর অন্যতম একটা। তথ্যসমৃদ্ধ নতুন দেখা লেখা পড়তে দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ শুভ।
আপনার কথাটা শতভাগ সত্য। মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ কাজী দা।