লিখেছেন: জীবন

নিষ্কাম-নির্লোভ-নির্বেদ। প্রথম দুইটি শব্দ বিশেষন পদ ভূক্ত। তৃতীয়টি বিশেষ্য পদভূক্ত। আমি বলিনা, বাংলা অভিধান বলে। তবে এই গোত্রভূক্ত আরো অনেক শব্দ আছে। ঠিক এই মুহুর্তে মনে করতে পারছিনা। এই তিনটি শব্দকে যাপিতজীবন-চিন্তার জগত থেকে এড়ানোর-তাড়ানোর সাধনা চেষ্টা করলাম। এখানে “সাধনা” শব্দটা ঠিক যায়না। মূলতঃ বলা যেতে পারে “চেষ্টা করলাম”। তবে এই সাধনা-চেষ্টা খুব বেশী দিন নয়। মগ্নতায় দূর্বলতা-ঐতিহাসিক কিছু কারণ এবং বৈজ্ঞানিক কিছু সূত্র-তত্ত্বও ডাব্বা মারার পিছনে ক্রিয়ানক হিসেবে কাজ করেছে তা অনেকটা নিঃশঙ্ক চিত্তেই বলে দেয়া যায়। যদি পরিষ্কার করে বলি, রক্তে-মগজে-মননে-মানসে যে পুরুষতান্ত্রিকতা হাজার বছর ধরে চালকের আসনে বসে আছেন তাকে এড়ানো এতো সহজ নয়। নিদেনপক্ষে আজকের দিন পর্যন্ত তো তাই মনে হচ্ছে। তবে এই সাধনা কিন্তু “অসম্ভব” নয়। সাবুদ আছে আমার কাছে। গৌতম বুদ্ধ থেকে হাজারো মহামানবগণ তা প্রমাণ করে গেছেন। এখন এই “হাজারো মহামানব” শব্দ দ্বয়ে কোন কোন নাম যুক্ত হবে, তা আমার পক্ষে বলে দেয়া সঠিক হবে না। তাইতো সেই পুরাতন বাক্য “Man Can Do Everything” । হ্যাঁ- গৌতম বুদ্ধ নিজেও আজন্ম নিজেকে “মানুষ” হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। যদিও বৌদ্ধগণ এখন তাঁকে দেবতা-অবতার-ভগবান-ঈশ্বর হিসেবে পূজা-আরাধনা করেন। কেন করেন? তা আমি জানিনা।

আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন গর্বিত “কর্মচারি”। গর্বিত বলছি এই কারণে যে, মাসের প্রথম সপ্তাহেই আমার “বেতনাদি” ব্যাংক হিসাবে চলে আসছে। সে টাকায় আমার পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করছি। বেতন নেয়ার বিপরীতে কাজ কি করছি একমাত্র “তিনি”-ই জানেন। বিচারের ভার তাঁর হাতেই দিলাম। যদিও তাঁর হাতে দিলাম কিন্তু তিনি তো আবার নিরাকার। আহারে !!! ভুলে গেছি আমাদের (কর্মচারিদের) ওপরে আরেকটা বিশেষ শ্রেণি আছেন। তাঁরা হচ্ছেণ “কর্মকর্তা”। ভগবানের একটু নীচেই যাঁদের অবস্থান। ব্যতিক্রমকে আড়ালে রেখে গত ১৫ বছরের চাকুরি জীবনের অভিজ্ঞতার দিব্যি দিয়ে বলছি। আর যাই হোন “কর্মচারী” অবশ্যই নয়। এই শ্রেণিটা যে কি পরিমান গ্লানিময়-কষ্টের-দ্বিধার-স্বপ্নভঙ্গের তা উপলব্দিতে আনার জন্য ১৫ বছর অবশ্যই যথেষ্ঠ সময়। তাই আমার মন্তব্যে-অভিজ্ঞতায় বিশ্বাস রাখা যেতে পারে।

মূল কথায় আসি। গত ১৪.০৫.২০১৮ দিনব্যাপী একটি বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন বেশ কয়েকজন গর্বিত “কর্মকর্তা”। তন্মধ্যে ২৩-২৫ বছরের একজন “ভদ্রমহিলা”-ও আছেন। তো, আমাকে যে কম্পিউটারটা সরবরাহ করা হয়েছে তা ঠিক মতো কাজ করছিলোনা। কাছাকাছি ঐ “ভদ্রমহিলা” উপস্থিত থাকায় আমি তাঁকে (সম্মানিত ব্যক্তির বেলায় তাকে এর ওপর চন্দ্রবিন্দু দিতে হয়) বল্লাম “আপা”-আমার কম্পিউটারটা ঠিকমতো কাজ করছেনা। উত্তরে উনি আমার দিকে না তাকিয়েই গম্ভির গলায় বললেন- “আমি কিন্তু আপনার আপা নই”। আমার বয়স-অবয়বে বয়সের ছাপ-২৭ বছর আগে এসএসসি-২১ বছর আগে মাষ্টার্স কমপ্লিট করার বিষয়টি মাথায় নিয়ে উনি আমাকে-“আমি কিন্তু আপনার আপা নই” বল্লে সব ঠিক ছিলো। কেননা উনি আমার ভাতিজি টুম্পারও ছোট হবেন। কিন্তু বিষয়টি কিন্তু তা নয়। উনি আমাকে আমার শ্রেণিটাকে (কর্মচারী) স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য এই কথাটি বলেছেন। উনি চাচ্ছিলেন আমি ওনাকে “ম্যাডাম” বা অন্য কোন সম্মান সূচক সম্বোধণে সম্বোধণ করি। আমার অবশ্য বুঝতে সময় লাগেনি। আমিও চাকরি বাঁচানোর তাগিদে ত্বরিতগতিতে বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। উনি এরপর খুব নরম সুরে আমার কম্পিউটারের প্রবলেম শুনলেন, কিন্তু সমাধাণ করতে পারলেন না। তা অন্য বিষয়। এবার একটু ইংরেজী টু বাংলা অভিধাণ থেকে ঘুরে আসা যাক। Sir =(noun) মহাশয়/জনাব। অপরদিকে Madam=(noun), ভদ্রমহিলা; সম্ভ্রান্ত রমণীকে ভদ্রতাসূচক সম্বোধণ; ঠাকরুন। কেও যদি কোনদিন কানের নীচে চপেটাঘাত না খেয়ে থাকেন তবে এই বঙ্গে কোন “কর্মকর্তা”-কে মহাশয় বা ভদ্রমহিলা বলে দেখতে পারেন। কপাল মন্দ থাকলে ৫/৭ দিনের পুলিশ রিমান্ডও পেতে পারেন।

এবার একটু ইতিহাসের দিকে যাই। এই বাংলায় মোঘল পূর্ব আমলে “সম্মান” ছিলো পুরোটাই বর্ণাশ্রিত। ব্রাহ্মণগণ সবচেয়ে বেশি সম্মাণ পেতেন। আদপে তাঁরাই এ বিধান তৈরী করেছিলেন। তবে তাঁরা বিদ্বান ছিলেন। শ্রাস্ত্র-শ্লোক চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতেন। অবশ্য ভুলভাল বললেও ধরার কেও ছিলো না। এই ব্যবস্থাটি টিকে ছিলো মোটামুটি ১০০০ বছর। অতঃপর, মোঘল শাষকগণ ধর্ম বিশ্বাসে মুসলমান হলেও শাসনকার্যের প্রশাসন দিকটি ঐ নাকউঁচু হিন্দুরের দখলেই ছিলো প্রায় ৭০০ বছরই। সম্রাট-সুলতান-নবাবগণও তাঁদের বেশ সমীহ করতো। এরপর বাঁশ হাতে নিয়ে আসেন মহামান্য ইংরেজগণ। আরো নিয়ে আসেন গর্ভনর, ম্যাজিষ্টেট-মাইলড, স্যার, ম্যাডাম, ইয়েস, নো, ভেরিগুড সহ আরো কতো বাহারি শব্দ-পদবী-শ্রেণি। আমার একটা লেখায় মোঘলদের আয়েশি জীবনের বদনাম করতে গিয়ে ইংরেজ কর্তৃক এই বাংলায় সভ্যতা দানের বিষয়টি আলোচনায় এনেছিলোম। আমার কিছু কাছের বন্ধু পারলে আমাকে রিমান্ডে দেয়। আমি তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। আজকে বুঝতে পারছি। নূণ্যতম ১ মাসের রিমান্ড পাওনা হয়ে গেছে আমার।

এই অধমের কিছু বন্ধু বান্ধব তাঁদের স্বীয় যোগ্যতা বলে বেশ কিছু উন্নত-আধুনিক-সভ্য-ভব্য-পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাষ্ট্রে-রাজ্যে থাকেন। এবং থাকেন বেশ সুনামের সাথেই। তাঁদের বরাতে বলতে পারি যে, অফিসে-রাস্তায়-বাসে-ট্রেনে-বারে-ডিসকোতে নো স্যার, নো ম্যাডাম। তবে সেখানে সম্মান আছে। তার জন্য আলাদা ভাষা-ভঙ্গিমা আছে। অথচ আমরা দিব্যি প্রতিদিন বাপের বয়সী রিক্সাচালক-গাড়িচালক-কর্মচারী-দোকানদার-শ্রমিকদেরকে কারণে-অকারণে “চুতমারানি”-সহ আরো কত শব্দচয়নে সম্মান দেখাচ্ছি। ব্যতিক্রমও আছে। আমি যতদূর জানি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে “আপা” না বল্লে উনি বেশ রাগ-অভিমান করেন। অথচ ২৩-২৫ বছরের একজন “ভদ্রমহিলা” এবং অবশ্যই “শিক্ষিত” আমার সাথে রক্তচোষা বৃট্রিশদের দেখিয়ে দেয়া পথে যে আচরণ করেছে তা আমাকে বেশ পীড়া দিয়েছে। ভীষন কষ্ট পেয়েছি !!!

সান্তনা এই যে, এটা আমার পাওনা ছিলো। কেননা গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:

যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে

যা হচ্ছে তা ভালোই হচ্ছে।

যা হবে তা ভালোই হবে।

 

যৌবনে বিখ্যাত একজন লেখলেক একটি জনপ্রিয় একটি বই এর ব্যাক পেজে পড়েছিলাম- ইহ জগতে নারীগণের অসাধ্য কিছু নাই, তাহারা অগ্নি হতে জল এবং জল হতে অগ্নি সৃজন করিতে পারেন।

 

নারীগণকে সম্মাণ তথা তাঁহাদিগগণের মধ্যে যে অপার প্রাকৃতিক সম্ভবনা রহিয়াছে প্রকৃতপক্ষে তাহা জানানোর জন্যই উল্লেখ করিলাম। দয়া করিয়া কেহ ইহার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতাকে টানিয়া আনিবেন না।