অভিজিৎ রায়দের মত মুক্ত চিন্তার মুক্ত মনের মানুষদেরকে খুন করে ফেললেই কি প্রশ্ন করা থেমে যাবে? ভাববে না মানুষ? খুঁজবে না উত্তর?
নিজের বুদ্ধি বিবেচনা ও জ্ঞান ব্যবহার করে যে মানুষ তাঁর জীবনকে চালায় সে’ই সার্থক মানুষ।
যে মানুষ তাঁর নিজের পছন্দ মত জীবন চালাতে পারে না সেই মানুষের জীবন অর্থহীন, নয় কি?
জ্ঞানকে অর্জন করতে হয়, সচেতন ভাবে, তা হলেই সেই অর্জন বুদ্ধি বিবেচনা করে ব্যবহার করা যায়। সেটি কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। এগিয়ে যাওয়াই হলো প্রগতি অর্থাৎ পরিবর্তন, নতুনকে দেখা, পুরনোকে আঁকড়ে থাকা নয়। পুরোনো অভিজ্ঞতার যা কিছু ভালো, নতুন আলোয় দেখা যা কিছু সুন্দর এবং আরো নতুন কোন মৌলিক ভাবনাকে নেড়েচেড়ে দেখবার নামই এগিয়ে যাওয়া। যারা এগিয়ে যেতে চাইবে না তারা নিতান্তই অলস, মঙ্গলে অনাগ্রহী এবং এই পৃথিবীকে অর্থবহ করতে কিছুই দিয়ে যাবে না, ওরা জঞ্জাল-প্রেমি। এগিয়ে যাবার জন্য সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হল কৌতূহল, মনে যেসব প্রশ্ন আসে তার উত্তর খোঁজা আর এই উত্তর খুঁজবার ইচ্ছেটাই জ্ঞান অর্জনের শুরু। এখানে কোন সোজা রাস্তা নেই, উত্তর জানতে হলে প্রশ্ন করা জানতে হবে আগে, তারপর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।
শুধু বসে বসে, শুনে শুনে জ্ঞানার্জন হয় না, এর জন্য ভাবতে হয়, প্রশ্ন করতে হয় এবং উত্তর খুঁজে বের করবার জন্য নিজ থেকে চেষ্টা করতে হয়। উত্তরগুলো ঠিক ঠিক অথবা সত্যের কাছাকাছি কি না তা’ও দেখতে হয়। উত্তরকেও প্রশ্ন করতে হয়। বিশ্লেষণ করতে হয়। ঠিক ভুল যাঁচাই করতে হলে অবশ্যই সাহায্য নিতে হয় যুক্তির। হতে হয় যুক্তিবাদী। হতে হয় মুক্ত মনের মুক্ত চিন্তার মানুষ। বুঝতে হয় যেহেতু ধর্মগ্রন্থের কথা বদলানো যায় না সেহেতু ওটা এগিয়ে যেতে সাহায্যও করে না। এগুতে হলে নতুন নতুন জ্ঞান বিদ্যা অর্জন করে নিজের বুদ্ধি বিবেচনা ব্যবহার করতেই হয়।
হাজার হাজার বছর ধরে স্বার্থপর শাসকরা বহু মুক্তচিন্তার কৌতূহলী প্রশ্নকারী মানুষদের খুন করেছে, বন্দি রেখেছে, নির্বাসনে দিয়েছে নয়ত গুম করে ফেলেছে। তাই বলে জ্ঞানচর্চা থেমে যায়নি। বদলানো থামেনি। লোভী শাসকরা ভয় দেখিয়েছে, অন্যায় অত্যাচার করেছে কিন্তু এগিয়ে যাওয়া থেমে যায়নি। ভন্ড জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া, প্রতারণা করে তৈরী করা শাসকদের দেখানো পথে কি মুক্তি হয়? মুক্তি হয় আত্মসম্মানে, কৌতূহলে, জ্ঞানের অন্বেষনে এবং সত্যের চর্চায়। ভালো কিছু করবার চেষ্টায়। শাসকের পায়ের নিচে যারা আলস্যে সমর্পণ করে চলেছে আপন জীবন, তাদের মুক্তি নেই।
অভিজিৎদের মত মুক্তচিন্তকরা জ্ঞানের পথ দেখায়, দেখায় আলোর পথ। এদেরকে মেরে ফেললে কার বা কাদের লাভ হয়? তাঁদেরই লাভ যারা জ্ঞান এবং আলোর পথ পছন্দ করে না। যারা চায় না নাগরিক শিক্ষিত হোক, জ্ঞানী হোক। কারণ নাগরিক যখন জ্ঞান নিয়ে জেগে ওঠে, নিজের অধিকার চেয়ে বসে ঠিকঠাক, তখন শাসক ভয় পেয়ে যায়। সামলাতে পারে না মানুষদের ন্যায্য অধিকারের দাবি। ভয়ে থাকে শাসক। তাই নাগরিককে অজ্ঞান বা কম শিক্ষিত করে রাখতে জ্ঞানী ও শিক্ষিতদের চুপ করিয়ে দেয়, দরকার হলে কোন না কোন ভাবে মেরে ফেলে। অভিজিৎ রায় একজন জ্ঞানী ও শিক্ষিত মানুষ ছিলেন ও তিনি তার শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো অন্যদের মাঝে বিলিয়ে যাচ্ছিলেন এবং খুন হয়ে গেলেন সেই জন্যই।
অভিজিৎ রায় এবং তাঁর মত মানুষরা নিজের চেয়ে অন্যদের নিয়েই ভাবে অনেক বেশি। ওরা উত্তরকেও প্রশ্ন করে তাই যে কোন উত্তরই একবারে ঠিক আছে বলে ধরে নেয় না, আরো তলিয়ে দেখে। এভাবেই যেতে হয় সত্যের কাছাকাছি, যতটা সম্ভব। প্রশ্ন করতেই হয়। প্রশ্ন না করলে ঠিক না ভুল না জেনেই অন্যের দেখানো পথে চলে যায় জীবনের অনেকটা সময়।
যখন কিছুই শেখেনি মানুষ; ভাবনা ছাড়া,
দিনরাত ধরে
পশুর মতই গিলেছে বনবাদাড়ের ঐ যাচ্ছেতাই।
মরতে মরতে,
একসাথে হওয়া কাকে বলে-জানলো বাঁচতে।
বেঁচে দেখলো,
কিছু দাঁতাল শুয়োর; মত্ত পশুরাই প্রতিপক্ষ,
এবং মুলত
খাবারের তরে দাগ কেটেছে পেশল জন্তু।
তখনও মানুষ
বেঁচেছে, মুক্ত মেধাবী অস্তিত্বে ভর করে।
অথচ আজকে,
হিংস্র ক্ষমতাপেশল পূজারী জন্তুমানব, উলঙ্গ উল্লাসে,
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে,
ঈশ্বরভীত কম্পমান নোয়া মানুষগুলোকে ছিঁড়ে খায়,
অবিরাম বারবার ….
জাতিকেটে দাগ টানে, লোভী, মৌ-লোভী মানুষ,
শুষে খেতে,
ভয় দেখিয়ে শূন্যে বানায় স্বরচিত স্বর্গ-নরক,
লুটেরা স্বার্থমানব।
অযত্ন অবহেলায়
গাছ পোড়ে মাঠ পোড়ে, পোড়ে বরফ
কালের অপেক্ষায়।
অনিয়মের নিয়মে,
তবুও কোথাও অল্প কিছু ঘাড়ত্যাড়া মানুষ।
নিজের মনেই
অগস্ত্য রঁদ্যার ভাস্কর্যের মত ভাবতে বসে।
সাগর আকাশ
একাকার করে উত্তর খোঁজে, আলোর তরে,
বাইরে ছুঁড়ে
বাঁধাই খাতা, ভালোবাসে জিজ্ঞাসা, নিবিড় কৌতূহলে,
একান্তে, মুক্তমনে।
যারা যথেষ্ট প্রশ্ন করে না তাদের কাছে অভিজিৎদের মত মানুষের কথা মনে হবে যেন ভিনগ্রহবাসীদের ভাষা। নিজ গ্রহের, নিজ দেশের মানুষের ভাষা বুঝতে চায় না যারা তাদের বোঝাতে মুক্তচিন্তার মানুষেরা নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত্ বিলিয়ে দিচ্ছেন। ভাবছেন মানুষ হয়ত একদিন ইউরিকা বলে চেঁচিয়ে ঊঠবে, বলবে ভালোবাসো। মানুষকে ভালোবাসো। এদের ভালোবাসলে অন্যের কোন ক্ষতি নেই।
অভিজিৎ এবং মুক্ত চিন্তার মানুষেরা সবসময়েই চেয়েছে দেশ সীমানার উর্ধে থেকে পৃথিবী গ্রহকে ভালোবাসুক সবাই, মানুষ হয়ে ভালোবাসুক এখানকার মানুষদের। ভালোবেসে শুধু দিয়েই যায় তাঁরা। বিনিময়ে কিছুই চাইবার নেই তাঁদের। হয়ত নিভৃতে একান্তে কখনো কখনো নিজেকেই প্রশ্ন করে,
আর কতবার ধূলো হবো জলের প্রয়োজনে,
আমিই কেন, আর কতবার কাদা হবো,
আমিই কেন গড়বো আমায়,
কিসের আয়োজনে?
দুই পা এগুই এক পা পেছাই, আবছা আলো,
সম্ভাবনার শিকার বলো, আমিই কেন?
সেই পুরোনো তারার ধূলো, সেই খেলাতে,
কেন, আমিই কেন, কাদের নিমন্ত্রনে?
আমিই কেন, আমিই কেন, হে মহাকাল?
আমার মত ক’জন আছে? হে মহাকাল?
আমায় কেন ঠিক করেছো, এমন কাজে?
আলোখেকো শুষে নিলো, নিকষ কালো;
হে মহাকাল, আমিই কেন?
আমিই কেন তোমার প্রিয়?
এমনি কেন ফাঁদ পেতেছো?
দায়’টা কেন বুঝতে পেলাম?
আমি এবং আর ক’জনা,
কেন, কেন, কেন, কেন?
জানি আমি, আরো আছে, টুকরো ধূলো,
আমার মতো, অনেক মানুষ, অনেক কণা,
আমরা অনেক, অনেক অনেক, তার পরেতেও,
মানুষ আমি, চ্যাঁচাই আমি, ওহে, আমিই কেন?
দুই পা এগুই এক পা পেছাই, হে মহাকাল, আমিই কেন?
বাতিঘরের আলো জ্বেলেছে অল্প ক’জনাই। সব কালেই এমন হয়েছে। অল্প কয়েক জনেই নিয়ন্ত্রিত থেকেছে মুক্তচিন্তকদের আপোষহীন সমাজ। এদের সংখ্যা খুব সতর্কতার সাথেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। শাসক শোষকরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই মানুষকে জ্ঞানচর্চায় বাধা দিয়েছে। মেরেছে জ্ঞানপিপাসুদের, আলোর পথের যাত্রীদের। বহুকাল ধরে সাধারণ নাগরিকদের বোকা বানাবার এই খেলা নাগরিকপ্রিয় হয় কি করে সেটা ভেবেই কুল কিনারা পাই না।
“অনিয়মের নিয়মে,
তবুও কোথাও অল্প কিছু ঘাড়ত্যাড়া মানুষ।
নিজের মনেই
অগস্ত্য রঁদ্যার ভাস্কর্যের মত ভাবতে বসে।”…
যথার্থই বলেছেন। অভিজিতের মতো এমন বীরের মৃত্যুই তো কাম্য। আর দেখুন, জীবিত অভিজিতের চেয়ে মৃত অভিজিৎ কতো শত্তিশালী ও জীবন্ত। সে অর্থে তাই অভিজিতদের মরণ নেই।
#iamavijit
যারা সত্যিই মানুষ-পৃথিবীকে ভালোবাসে তারা বাঁধাই খাতায় লেখা নিয়মে চলে না। নিয়ম ভেঙে অনিয়মের নিয়মে, নতুন চোখে যাঁচাই করে এগিয়ে যায়, অন্যকে পথ দেখায়। অভিজিৎদের মত মানুষ তাই পথ দেখানোর মানুষ। অন্যের লেখা শাসনের, নিয়মের খাতা ছুঁড়ে ফেলা মানুষ। পৃথিবীতে মঙ্গলের মানুষ। এদের মেরে ফেলা যায় না।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ বিপ্লব। নিরাপদে থাকুন।