বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা স্বাধীনতার পরে, মুক্তিযুদ্ধের প্রামান্য ইতিহাস তৈরী করার চেষ্টা করে নি বহুদিন। আমরা ভারতীয়রা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানি না-এটা যদি লজ্জার হয়-তাহলে ভাবুন ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত, সরকারি ভাবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল-যা চলত তাও সরকারি ভাবে বিকৃত। বাংলাদেশে যারা বড় হয়েছে ঐ সময়টাতে, তারাও জানেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। কারন সরকারি বইগুলো এমন ভাবে লেখা হত, যাতে শেখ মুজিবর রহমান, আওয়ামী লীগের ভূমিকা এবং ভারতের মিলিটারি ও ইন্দিরা ভূমিকা সম্পূর্ন অজ্ঞাত থাকে।
আমি মাস খানেক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান নিয়ে একটা পোষ্ট দিই। বিষয়টা এই, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অতি সক্রিয় ছিলেন। এতটাই যে আমেরিকার নির্দেশে সৌদি আরব, জর্ডন এবং ইরান পাকিস্তানকে ফাইটার প্লেন দিয়ে সাহায্য করছিল- ইরান ত তার বিমান ঘাঁটিও ব্যবহার করার অনুমতি দেয়। শুধু তাই না নিক্সন চিনকে সঙ্গে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ানের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেন জাতি সঙ্ঘে-তাতে কাজ না হলে ইন্দিরাকে ফোন, ফ্যাক্স হুমকি কিছুই বাকী রাখেন নি। একসময় সোভিয়েত ও ভারতে জানিয়ে দেয়, আমেরিকা ভারত আক্রমন করবে বাংলাদেশ ইস্যুতে । তবে তারাও নৌবহর পাঠাচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল ম্যকেনশকে প্রশ্ন পর্যন্ত করেছিলেন আমেরিকা আক্রমন করলে কি হবে? ম্যাকেনশর উত্তর ছিল, তার আগেই বাংলাদেশ মুক্ত হবে। চীন এবং আমেরিকার সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে নার্ভ ঠিক রেখে ইন্দিরা গান্ধী গোটা পৃথিবী চষে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের সমর্থনে। জানাচ্ছিলেন কিভাবে খুন ধর্ষন এবং জেনোসাইড চালাচ্ছে খান সেনারা। ইউ টিউবে তার অসংখ্য ইন্টারভিঊ পাওয়া যাবে কখনো বিবিসি, কখনো ফরাসী টেলিভিশনকে দেওয়া ( যা ফ্রেঞ্চেই দিয়েছিলেন ইন্দিরা) । পুরো ব্যপারটা পড়ার পরে আমার মনে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী না থাকলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয় হত আরো বেশী- হয়ত বাংলাদেশ স্বাধীন হত-কিন্ত রক্ত ঝড়ত আরো আরো অনেক। শেখ মুজিব যদি জাতির পিতা, ইন্দিরাকে বাংলাদেশ নামক জাতির মাতা বললে ভুল হবে না। এটা শুনে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী আমাকে জানালেন, আমি নাকি ইতিহাস ফ্যাব্রিকেট করছি বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধকে ছোট করার জন্য! আসল সত্যটা হচ্ছে এই-এরা সেই ১৯৭৫-৯৬ এর বাংলাদেশের প্রোডাক্ট। যেখানে আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব, ইন্দিরা, ইন্ডিয়া সব কিছুই অস্বিকার করা হত।
১৯৮৫ সালের একটা ঘটনা বলি। তখন রাজশাহী রিলে স্টেশনের দৌলতে মুর্শিদাবাদ নদীয়াতে বাংলাদেশের সরকারি টিভি চ্যানেলের সব অনুষ্ঠান আমরা দেখতে পেতাম। ১৬ ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে ভারতের দূরদর্শনে এমনিতেই অনেক কিছু হয়। আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশে দূরদর্শনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারী দেখাবে। করিমপুরের মতন ভারতের এক প্রান্তিক মফঃশহরে টিভি তখন সবে এসেছে। পাড়ার বয়স্ক লোকেরা একাত্তর নিয়ে অনেক কিছু জানতেন। কারন একাত্তরের যুদ্ধে গোটা করিমপুরেই আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় চার লাখের বেশী শরনার্থী। অনেক আশা নিয়ে ১৬ ই ডিসেম্বর তারা বাংলাদেশ টিভির সামনে বসেছিলেন।
অহ-কোথায় কি। টিভিতে দেখায় শুধু জেনারেল এরশাদের কবিতা। বাংলাদেশে তখন এরশাদের ডিক্টেটরশিপ। এই এরশাদ মুক্তিযোদ্ধাও নন। একাত্তরের যুদ্ধে তার পোস্টিং ছিল পাকিস্তানে। ফলে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৭৩ সালে সিমলা যুক্তির জন্য মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তাকে মিলিটারীতে উচ্চ পজিশনে পুনঃবাসন দেন শেখ মুজিব নিজে।
অথচ এই এরশাদ মালটা নিজের ডিক্টেটরশিপের সময়,এই ১৬ ই আগস্ট বিজয় দিবসে টিভিতে শুধু কবিতা চালাত-সাথে যুদ্ধের ফটো ভিডিও। দেখে মনে হতে পারে জাস্ট এরশাদের শব্দের জোরে স্বাধীনতা এসেছে। ব্যাচারা কিই বা আর করবে! কারন ওই দিন ইতিহাস ঘাঁটলে গেলে দেখা যেত, এরশাদ মুক্তিযোদ্ধাই না! কে আর টিভিতে নিজের প্যান্ট খোলে! না ওই সময় বাংলাদেশের মুক্তযুদ্ধের চর্চা প্রায় নিশিদ্ধই ছিল। শুধু তাই না। যদিও বা কখনো সখনো মুক্তযুদ্ধের সিনেমা আসত বাংলাদেশ টিভিতে- সেখানে সিনেমার চরিত্ররা যদি কখনো সখনো মুজিবের নাম মুখে আনতেন, সেখানে অডিও সাইলেন্স করা হত। এই সময়টাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস মোছার সব চেষ্টা হয়েছে যঘন্য ভাবে।
এটা এখন কিছুটা বদলেছে। শেখা হাসিনার শাসনকালে স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আবার ফেরানো হয়। অনেক ব্লগার ইতিহাস রক্ষায় সচেতন হয়ে অনেক নতুন দলিল তৈরী করেছেন। ফলে এখন গুগল করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই আমরা জানছি।
আমি অবশ্য বই এর অভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে জেনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেই। আমেরিকাতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অভিবাসন নিয়েছেন। তাদের সাথেই নানান পার্টিতে গল্প করে জেনেছি কিভাবে তারা জেলে সেজে নৌকা নিয়ে রেইড করতেন -কিভাবে থানা রেইড হত। খান সেনারা ভয়ে সেনা ছাউনির বাইরে ট্যাঙ্ক ছাড়া বেড়ত না। এত বীরত্ব এবং আত্মহুতির গল্প আমি নিজেই জানি সেগুলো লিখলে ডজন খানেক সিনেমার স্ক্রিপ্ট তৈরী। আমার ধারনা, মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাগুলো যদি সেলুলয়েডে বন্দি করার চেষ্টা হয়- অন্তত দুশো সিনেমা নেমে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এখনো হলিউড ফি বছর তিনটে চারটে সিনেমা নামাচ্ছে। কিন্ত বাংলাদেশে কালে ভদ্রে একটা আধটা সিনেমা নামে মুক্তি যুদ্ধের ওপরে। আমার কোন সন্দেহই নেই মুক্তিযুদ্ধই বাঙালীর ইতিহাসের সব থেকে গৌরবজ্জ্বল অধ্যায়। মুক্তযুদ্ধে ঘটনা সিনেমা বন্দী না করলে, আবার এরেকটা এরশাদ আসবে না কে বলতে পারে?
শুনেছি ইন্দিরা গান্ধী নাকি সংসদে দাঁঁড়িয়ে বলেছিলেন, “হাজার সালকা বদলা লিয়ে” অর্থাৎ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিতে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছেন। এগুলো কি সাম্প্রদায়িকতা নয়?
ধন্যবাদ বিপ্লব পাল লেখাটির জন্য। আমি সেসময়টায় প্রাথমিকের ছাত্র যখন শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। এরপর আমরা বড় হই এমন এক ইতিহাস পড়ে যেখানে শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনদের কোন স্থান ছিল না। সময় পালটেছে, কিন্তু এখনও কি আমরা সঠিক ইতিহাস পাচ্ছি? মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও জীবিত; তাঁদের সাহায্য নিয়ে খুব সহজেই বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা যায়, সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। কিন্তু বাঙ্গালী বলেই হয়তো বারবার আমাদের অতিরিক্ত আবেগের শিকার হয় বাস্তব। আমরা পারি না নিরাসক্ত বা নির্মোহ থেকে নিজেদের ইতিহাস লিখে রেখে যেতে।
ভারতের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাওয়া কঠিন ছিল। ভারত, বিশেষত ইন্দিরা গান্ধীর সক্রিয় ভূমিকা আমাদের মাত্র ন’মাসের যুদ্ধে স্বাধীনতা পেতে সাহায্য করেছে। আমার পরিবার ভারতে শরণার্থী হয়ে গিয়েছিল। ভারত এই যুদ্ধে না জড়ালে আমিও হয়তো কোন রোহিঙ্গা বালকের মতই ক্যাম্পে ক্যাম্পে দিন কাটিয়ে বড় হতাম, হয়তো কোন অপরাধী হতাম, বা যুদ্ধে প্রাণ হারাতাম, কে জানে!? আজকের এই দিনে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্যের জন্য সবিনয়ে কৃতজ্ঞতা জানাই!