সন্ত্রাসীদের গতিবিধি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে কাজ করে এমন বিশ্লেষকগণ দাবি করেছেন যে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বর্তমানে কর্মরত তিন শতাধিক অফিসার এবং দুই হাজারের বেশি অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়ার আইসিস এবং সমমনা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। যারা মূলত ইরাক ও সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করছে। বিশ্লেষকগণ বলছেন, পাকিস্তান আর্মি এই প্রশিক্ষণের মূল উপাদান, যারা চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে পরিচয় গোপন করে ইরাক এবং সিরিয়াতে সন্ত্রাসীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
অতীতে জর্ডান, তুরস্ক এবং কাতারের মাটিতে এমন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর আম্মান, দোহা, আংকারায় সন্ত্রাসীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও আশ্রয়ের জন্য তাদের ভূমি ব্যবহার করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সাধারণত জঙ্গিদেরকে যোগাযোগের যন্ত্রাদি পরিচালনা, গোয়েন্দা সিগন্যাল, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক ব্যবহারের উপরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিশ্লেষকগণ মনে করেন অর্থের থেকেও এখানে আদর্শগত কারণে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাগণ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আইসিসকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যদিও কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ আইসিস, আল নুসরা ও অন্যান্য ধর্মীয় জঙ্গী সংগঠনকে প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করেছেন কিন্তু প্রশিক্ষণের সাথে সরাসরি যুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সামরিক কর্মকর্তাদেরকে জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতায় বিচার করার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ আশঙ্কা করছেন, যেখানে শত শত ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা এবং দশ হাজার অন্যান্য পদস্থ কর্মকর্তা আইসিস এবং ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠনের প্রতি সহানুভূতিশীল সেখানে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হলে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। এই কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আইসিসের যাবতীয় সন্ত্রাসী হামলায় কোন না কোনভাবে “নিঃসঙ্গ নেকড়ে” পাকিস্তানের যোগসূত্র দেখা দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেমন কিছুদিন আগে শোকাবহ ৯/১১ ঘটনার স্মরণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নিউ ইয়র্ক এবং নিউ জার্সির সন্ত্রাসী হামলা। অদ্ভুত হলেও সত্যি, দুই যুগ আগে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের প্রস্তাবিত সম্মিলিত চুক্তি বা জোট গঠনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি, বাস্তবায়ন তো সুদূর পরাহত। যদিও ধারণা করা হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীকে সন্ত্রাস নির্মূলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের নেতৃত্ব দেয়া হতে পারে।
আইসিসের বিরুদ্ধে বারাক ওবামা প্রশাসন এবং আঞ্চলিক জোটের নমনীয়তা স্বত্বেও সিরিয়া-ইরান-রাশিয়া ত্রয়ীর আক্রমণের মুখে নভেম্বরের মাঝেই আলেপ্পোতে আইসিস তাদের কর্তৃত্ব হারাবে। অগ্রগামী ইরাকি বাহিনী এবং অনিয়মিত বাহিনী মসুলের দিকে এগিয়ে আসার কারণে আতংকে আছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েব এরদোগান এবং মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর হস্তক্ষেপ আশা করে বসে আছেন। এদিকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় থেকে আইসিস সিরিয়াতে নিজেদের অবস্থান পালটে সরকার বিরোধীর তকমা লাগিয়ে নিরাপদে আছে। এই নিরাপত্তার ভিতরে থেকেই আইসিস তাদের সাম্প্রতিক ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান জোটের সাথে যুদ্ধের ময়দানে ফেরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ঠিক যেভাবে তালিবান বাহিনী আফগানিস্তানে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসাই) কর্তৃক কুন্দুজে শক্তি সঞ্চয় করে দুই বছরের মাথায় আবার যুদ্ধে ফিরে এসেছিল। গত পাঁচ মাসে এবং হোয়াইট হাউজের শেষ দিনগুলোতে প্রেসিডেন্ট ওবামা ফরেন পলিসি হিলারি ক্লিনটনকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন আর জন কেরি মনে করছেন সিরিয়া-ইরাক অঞ্চলে আইসিস ও অন্যান্য জিহাদি গ্রুপ থেকেও বড় হুমকি দামেস্ক-মস্কো-তেহরান জোট। যদিও জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা জুড়ে ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়ছে। আসন্ন ৮ নভেম্বর ২০১৬ নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জয়ী হবে এমনটা প্রত্যাশা করে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে রাশিয়া এবং পুতিনকে নিয়ে অপপ্রচার শুরু হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং সিনেটর থাকা স্বত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের মঞ্চে আমেরিকা-রাশিয়ার মধ্যে স্বল্প মেয়াদে একটা যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে। আমরা প্রত্যক্ষদর্শী হতে যাচ্ছি ভিয়েতনামের পরে আবার আমেরিকার রক্তক্ষয়। রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যকার যুদ্ধ একটা পর্যায়ে আইসিসকে পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার প্রাধান্য পাবে।
যাইহোক, ইরাক ও সিরিয়াতে আইসিসের কর্মকাণ্ড অনেক স্থবির হয়ে নভেম্বরে আমেরিকার নির্বাচনে কি ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটে এবং কে যাচ্ছে হোয়াইট হাউজে তার অপেক্ষায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যদি তারা ক্ষমতা যায় তাহলে ইরান এবং সিরিয়ার সাথে মিলিতভাবে আইসিসকে মোকাবিলা করবে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেমন জন কেরি বলছেন- আইসিসের সাথে যুদ্ধরত ত্রয়ী শক্তি আমেরিকার প্রাথমিক শত্রু। যদি তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ এবং ফ্রেঞ্চ নেতাগণ এডলফ হিটলার থেকেও বড় শত্রু মনে করত জোসেফ স্ট্যালিনকে। ঠিক তেমনি ট্রাম্পকে তুলনা করা যেতে পারে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টের সাথে যিনি তার শাসন আমলের শুরু থেকেই হিটলারকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং মস্কোর সাথে মিত্রতা করে নাৎসি আক্রান্ত বার্লিনে যুদ্ধ করতে আগ্রহী ছিলেন। আমেরিকার গণমাধ্যমে ট্রাম্প নাকি হিলারি কে বেশি আইসিস নির্মূলে কার বেশি অঙ্গীকার তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। রিপাবলিকান দলের নীতিনির্ধারকগণ মনে করছেন মস্কো বা তেহরান নয় বরং আইসিসই আমেরিকার নিরাপত্তার মূল হুমকি। পক্ষান্তরে হিলারি ক্লিনটনের নেতৃবৃন্দ ঠিক উলটো চিন্তা করছেন। ট্রাম্প বুশ বা বারাক ওবামার মত পাকিস্তান বিষয়ে নরমসুরে কথা না বলে সরাসরি বলে ফেলেছেন পাকিস্তানই বিশ্বের সন্ত্রাস কারখানা। দিল্লীর নীতিনির্ধারকগণের সাথে সুর মিলিয়ে বলছেন, ওয়াশিংটন ইসলামাবাদের বিপক্ষে।
পাকিস্তান-ভিত্তিক অনেক সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন যেমন জইশ-ই-মুহম্মদ, লস্কর-ই-তয়্যেবা, লস্কর-ই-জঙ্গি, তেহরিক-ই-জাফারিয়া, আল-কায়েদা, সিপাহি-ই-সাবা, আল-বদর, হরকাত-উল-আনসার, হাবিব-উল-মুজাহিদিন, তেহরিক-ই-নাফাজ, শরিয়ত-ই-মুহম্মদ, জামাত আল ফুকরা থাকার পরেও ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন পাকিস্তানের প্রতি সদয় ছিল এবং সেদেশের সামরিক বাহিনীকে বিভিন্নরকম সহযোগিতা ও সুরক্ষা দিয়ে আসছিল। পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিষদের পরামর্শদাতা সারতাজ আজিজ নিজেই স্বীকার করেছেন, ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে পাকিস্তানের আদিবাসী অঞ্চলে আফগানিস্তান থেকে আগত জঙ্গিতে ভরে গেছে। প্রত্যক্ষই তারা আদিবাসী নেতাদের খুন করে তাদের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে ফেলে, তার বোমা ও বিস্ফোরকের কারখানা বানায় এবং আত্মঘাতী জিহাদিদের প্রশিক্ষণ দেয়। সারতাজ আজিজ আরও বলেন, গত ১৫ বছরে জঙ্গিবাদের কারণে পাকিস্তানের ১০০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং হারিয়েছে প্রায় ১০০০০ নিরাপত্তাকর্মীর মূল্যবান প্রাণ। যাইহোক, জঙ্গিবাদ এমন এক একমুখী-পথ যার থেকে বেরোনোর উপায় নাই। এখন পাকিস্তান এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, সামরিক বাহিনী এমনকি গণতান্ত্রিক সরকার চাইলেও সর্বতোভাবে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পারছে না। কারণ সেই ১৯৭৯ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মুজাহিদ যোদ্ধাদের পাকিস্তানে প্রকাশ্যে প্রশিক্ষণ এবং এরপরে তারপরে ইন্ডিয়াতে জঙ্গি নাটকের নতুন মঞ্চায়ন। ১৯৮৯ পরবর্তী সময়ে আফগান যোদ্ধা পরে যাদের নাম হয় তালিবান আইএসআই’র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গিবাদের চাষাবাদ চলতে থাকে।
মসুল, আলেপ্পো, এবং তারপরে রাকাতে আইসিসের ভয়ানক পতনের পর তারা তুরস্কের কাছে সম্ভাবনা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের কাছে সম্ভাব্য কয়েকটা সমাধান আছে, প্রথমত তারা সরকার বিরোধী “মোডারেট ফাইটিং ফোরস” আত্ম প্রকাশ করতে পারে যা আসলে পরবর্তীতে মুখোশধারী আইসিস বা আল-নুসরার নামান্তর হবে মাত্র। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে বিকল্প হিসেবে তারা আইসিস জঙ্গিরা সমমনা জঙ্গি আদর্শের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে নিরাপদ আশ্রয় পেতে পারে ঠিক যেমন করে ৯/১১ এর পর থেকে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে ওসামা বিন লাদেন আমেরিকার “নেভি সিলস” এর ২০১১ সালের অপারেশনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিরাপদে ছিল। ইতিমধ্যেই ২৬ জন নেতৃত্ব স্থানীয় আইসিস সদস্য আফগান সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে নিশ্চিত খবর পাওয়া গেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ ভারতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছন, ভারতের সামনে এখন নতুন বিপদ, তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে পাকিস্তান আর্মির সরাসরি তত্ত্বাবধানে তাদের নিজস্ব নিরাপদ ভূখণ্ডে প্রশিক্ষিত আইসিস জঙ্গিদের মোকাবেলা করা।
(আর্টিকেলটি ‘সানডে গার্ডিয়ান লাইভ ডট কম’ প্রকাশিত ISIS leaders look to Pakistan for refuge আর্টিকেলের বাংলা ভাষান্তর)
Leave A Comment