মূর্ত্তি-এর মানে কী?
ঠাকুর-এর মানে কী?
প্রতিমা-এর মানে কী?
ভাস্কর্য্য-এর মানে কী?
একই অঙ্গে এত রূপ দিতে গেলেন কেন আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ? তাদেরতো মনে রাখা উচিত ছিল, এমন একদিন আসবে, যেদিন তাদের একাংশ ধর্ম্মান্তরিত হয়ে গিয়ে, সব অর্থ গুলিয়ে ফেলবে । শিল্প নয় , সবকিছুতে খুঁজে বেড়াবে পাপ ।
“ঠাকুর ঘরে কে রে?
আমি কলা খাই না।“
না, কথাগুলো কোন হিন্দুর কাছে শুনিনি। গ্রামের মুসলমানদের মুখে শুনেছি। আমাদের গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ কৃষককূল স্বাভাবিক প্রাকৃতিক গুণে গুণান্বিত বলে, অভিধান না দেখেও মূর্ত্তিকে , মূর্ত্তি না বলে বলত ঠাকুর।
অতীতের স্মৃতি থেকে যায় দৈনন্দিন কথনে-চলনে-বলনে। যেমন রয়ে গেছে, গাড়ীঘোড়া, টাকাকড়ি ( ঘোড়ার গাড়ীর দেখা যদিও মেলে না), টাকাকড়ি (কড়ির চল শেষ হয়ে গেছে সেই কবে)। গ্রাম সেই অতীতকে যতটা ধরে রাখে, শহুর ততটা পারে না, বরং খুন করে; অথবা, বিকৃত করে । কেন করে, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এই যে ঠাকুর ঘর বলা হল, ওখানে আসলে কী থাকে? মূর্ত্তি (যদিও এখন লেখা হয় মূর্তি ) থাকে। কেউ কিন্তু বলেনি, মূর্ত্তির ঘরে কে রে? অথবা প্রতিমা ( প্রতি, প্রতিম, প্রতিমা – লক্ষ্য করুন ) আদতে সেই মূর্ত্তি । কেউ কিন্তু বলে না, মূর্ত্তি বিসর্জ্জন। আমাদের দুষ্টু পূর্ব্ব পুরুষগণ কেন যে আবার ‘ভাস্কর্য্য’ – আমদানি করল, শহুরে নব্য জ্ঞানীগুণীগণ, একটু তথ্য-তালাশ না করেই রায় দিলেন, মূর্ত্তি আর ভাস্কর্য্য এক কথা নয়। যেন মূর্ত্তি অচ্ছুৎ, আর ভাস্কর্য্যের মধ্যে একটা ভারী ভারী ভাব আছে বলেই তা গ্রহণযোগ্য।
মূর্ত্তি শব্দটির মানে কি জানা আছে কারও? নাকি শব্দটিকে আরবির আদলে, ভাবতে গিয়ে, এর অর্থটারই বিনাশ করে দেয়া হয়েছে? মূর্ত্ত (মূর্ত) হয়ে উঠছে, বুঝি, মূর্ত্তি বুঝি না। কিছুটা কি আভাস পাওয়া গেল। আজ্ঞে, শ্রীহরিচরণ বন্দোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষে, এর অর্থ যতগুলো লিপিবদ্ধ করে গেছেন, প্রথমটি হল, ‘যাহা বাড়ে’। দেখুন তো, মূর্ত্ত (মূর্ত) -এর সাথে কোথাও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় কিনা? যায়। দেহ ও মানসিক – এই দুই জগতেই বাড়ন চলতে পারে। এক্ষেত্রে ভাবমূর্ত্তি শব্দটির প্রয়োগ সার্থক।
খান-চক্রবর্তী সরল শব্দার্থকোষে জানাচ্ছেন, ‘যাহা প্রকাশিত হওয়ার জন্য ঘুরিয়া মরিতেছিল (দ্র মূর্চ্ছ – ক্রিয়ামূল) তাহা তারিত বা প্রকাশিত হয় যাহাতে।
একজন শিল্পীর মনোলোকের অব্যক্ত ভাবের মূর্ত্ত (মূর্ত) প্রকাশ ঘটে মূর্ত্তিতে। এখন এটি কোন অর্থে নিন্দনীয়? এই মূর্ত্তিকে যখন কোন আলয়ে বা মন্দিরে স্থাপন করে, কেউ পূজা করে, তখন তা হয়ে যায় প্রতিম (সদৃশ) > প্রতিমা (সদৃশের আধার)। কী সেই সদৃশের আধার? অদৃশ্য শক্তির। সেই অদৃশ্য শক্তিকে সদৃশ করে, যে কেউ পূজা করতে পারে। অন্যান্য বিশ্বাসের মত এটিও একটি বিশ্বাস। এই বিশ্বাস সক্রিয় হয়ে গেলে, তখন ‘যাহা বাড়ে’ অর্থাৎ মূর্ত্তি মূর্ত্ত হয়ে উঠে প্রতিমায়।
কথা হল, মূর্ত্তি, প্রতিমা, ঠাকুর, ভাস্কর্য্য এতগুলো শব্দের কি দরকার ছিল?
ঠাকুর শব্দটির অর্থ খান-চক্রবর্তীর সরল শব্দার্থকোষে দেয়া, ‘যিনি আধার মাত্রকে (দেহ, গৃহ, পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি, সমাজ, জগৎ, …কাঠামোকে) আধেয়দান পূর্ব্বক জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করিয়া রাখেন। প্রতীকী অর্থ দেবপ্রতিমা, শ্রীকৃষ্ণ, পাচক-ব্রাহ্মণ, পিতা, গুরুদেব। প্রদত্ত অর্থ থেকে, আমরা বুঝে নিতে পারি, জগতের পিতাকেও ঠাকুর বলা যায়। জাগতিক ও অজাগতিক – উভয় ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ লক্ষণীয়। অ অর্থাৎ শব্দটির শব ব্যবচ্ছেদ না করে, এর বহুমাত্রিক ব্যবহার আড়াল করে দেয়। শব্দটি কখন, কোন প্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, অর্থাৎ তীর্থযাত্রী, কখন সতীর্থ হয়ে উঠে, আমরা জানি না’।
ভাসা শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। ভাস্কর্য্য অর্থাৎ ভাস্করকর্ম্ম (দীপ্তিকরকর্ম্ম), খোদাই-এর কাজ (বঙ্গীয় শব্দকোষ) ভাস্কর্য্যের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ, (খান-চক্রবর্তী ভাস্কর > ভাস (বাহ্যরূপে প্রকাশন) করে যে; অথবা, অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয় সত্তাকে ভাস (দৃশ্যরূপে মূর্ত্ত) করে যে। অর্থাৎ ভাস্কর্য্য-এর অর্থঃ যাহাতে ভাস্কর-এর ভাস-কর্ম্ম কৃত হইয়াছে।
কোন কাঠ বা পাথর খোদাই করে, ভাসিয়ে আনা মূর্ত্তিকে আমরা ভাস্কর্য্য বলতে পারি। এর সাথে শিরকের কী সম্পর্ক, কোনভাবেই মাথায় আসছে না। হয়ত মাথাটাকে সৌদিতে নিয়ে গিয়ে, একরৈখিক ভাবনায় তারিত করলে, পাপাতঙ্কের উৎস মিলতে পারে। কিন্তু এ দেশটা, এদেশের ভাষাটা তো সৌদির মত নয়। ইরান, ধর্ম্মীয় বিশ্বাস নিয়েছে, ভাষা নেয়নি। ওটা নিলে সর্ব্বনাশ। অনেককিছু গোলমেলে হয়ে যেতে পারে। একটা উদাহরণ দেই, আমরা অনেকেই স্ত্রীলোককে সম্বোধন করতে গিয়ে, ‘জনাবা’ লিখি। অথচ এর মানেটা যে গৌরবের নয়; অশুচির, তা জানাই নেই আমাদের।
মূর্ত্তি, ভাস্কর্য্য, ঠাকুর, প্রতিমা – এগুলোর কোনটাই স্ট্যাচুর সাথে যায় না। তবুও আমরা মূর্তি’ (মূর্ত্তি) দেখলেই মূর্চ্ছা যাই।
লেখক কে ধন্যবাদ, খুব সুন্দ্র ভাবে ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু আর একটু সরল ও ব্যাখ্যা হলে খুব ভালো হতো।
এখানে একটা ঘটনার কথা বলছি, সত্তর দশকের গোড়ার কথা, আমাদের গ্রামের স্কুলে একজন ইংরেজীর শিক্ষক ( M.A. in English) আসেন। তার বাড়ী স্কুল থেকে ২ মাইলের মধ্যে। তিনি স্কুলে আসার কিছুদিন পর সরস্বতী পূজা ছিল। আমাদের স্কুলে হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা খুব কিমি. হওয়ায়, সরস্বতী পূজা হতো না। তিনি তা জানতেন না। পূজার কোন রূপ আয়োজন না দেখার জন্য তিনি পূজার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করেন। তখন ক্লাসের ফাস্ট-বয় বলে, আমাদের স্কুলে হিন্দু ছাত্র খুব বেশী হলে ১৫/২০ জন হবে। তারা কেন পূজা করবে? ইস্লামে পূজা করা নিষেধ, তার উপর মূর্তি পূজা চলবে না। তখন উনি বলেন, যে, পূজা করবে তো হিন্দু ছেলেরা, তোমরা তো করবে না। তাদের ধর্ম তারা পালন করবে, তাতে তোমাদের কিছু যাবে-আসবে না। এতে স্কুলে বিরাট আকারে একটা আলোরন হল। তারপর হেডমাস্টারের হস্তক্ষেপে কিছুটা ঘটনা টা প্রশমিত হয়, কিন্তু তাকে (শিক্ষক) অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। কারন তিনি মুসলমান হয়ে কেন তা বললেন।
তখন ছোট ছিলাম, মূর্তি পূজা সম্বন্ধে সাম্যক জ্ঞান ছিল না। বড় হয়ে কিছুটা জেনেছি। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, তবে আপনার লেখা সবাই পড়ুক সেটা চাই। আজ আপনার লেখে পড়ে কেবল ই সেই শিক্ষকের কথা মনে পরছে।
পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ। সাধুবাদ জানাচ্ছি, একখণ্ড অতীত আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। শান্তিপূর্ণভাবে যে যার ধর্ম্ম পালন করলে , কোন সমস্যা হবার কথা ছিল না। কিন্তু এরা তো তা করে না। নিজেরটা পালন করবে, অন্যেরটার পথে কাঁটা হবে। কখনও কখনও শুধু কাঁটা নয় , ঘাতক হয়ে যায়, হচ্ছে।
আবারও ধন্যবাদ, ভাল থাকুন, আনন্দে থাকুন।
একটু প্যারা ঠিকঠাক করে দিলে পড়তে আরাম হত স্বপন। শক্ত লেখা।
দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ধন্যবাদ দাদা।
যা শুনতে পাচ্ছি, জানতে পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে, এখনও ধর্ম্ম নিয়ে রাজনীতিই হচ্ছে। কিছু সংগঠিত শক্তি মানুষের বিশ্বাসকে আশ্রয় করে , এই কর্ম্মে তৎপর। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সাধারণ মানুষ, কৃষক শ্রমিক – এরা ধর্ম্ম নিয়ে এত মাথা ঘামায় না, কিন্তু বিশ্বাস করে। সমস্যা হল, যে দিকে রাজনীতির পাল্লা ভারী সেদিকে মধ্যবিত্তের বিপুল অংশ ঝুঁকে পড়ে। এরাই তখন জেনে, না-জেনে ওদের কাণ্ডারী হয়ে উঠে। রাজনীতিতে এখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রাধান্য, তাই ধর্ম্মীয় রাজনীতির রমরমা বাণিজ্য ।
লেখাটি পড়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য, অশেষ ধন্যবাদ। ভাল থাকুন। শুভ কামনা।
হয়ত এখন অবস্থাটা আগের চেয়ে আরও খারাপ। আমার নিজের গ্রামে সবাই জানত, আমরা কয়েকটা না-মানাদের দলে। এ নিয়ে হাসাহাসি হতো, ঠাট্টা হত, আমরাও প্রকাশ্যে ওদের নিয়ে ঠাট্টা করতাম, সেটা কখনও কলহের পর্যায়ে যায়নি। আর আমি সৌভাগ্যবান যে আমার ঘরে, এসব পালন-টালনে কোন বিধিনিষেধ ছিল না। বাবা বা দাদাকে জীবনেও দেখিনি, নামাজ রোজা করতে , যদিও মা দাদী, কাকী , জ্যাঠিরা করতেন।
মারা যাবার কিছুদিন আগে, গ্রামের এক মোল্লা এসেছিলেন, দাদার কাছে। তওবা পড়াবার জন্য। মনে আছে, দাদা তওবা না করে, উনাকে বিদায় করে দিয়েছিলেন , বলেছিলেন, জীবনে পাপ করিনি, আমার তওবা করা লাগবে না। মনে হয়, আমরা সেই অবস্থান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। ভাবনাগুলো নাড়িয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকুন, আপদ থেকে দূরে থাকুন। কল্যাণ হোক।