লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ
আধুনিক বিশ্বের নানা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অনেক সংগ্রাম সফল হয়েছে। এ সফল আন্দোলনগুলো পরবর্তীতে গণতন্ত্রের বিকাশকে ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত করেছে। কিন্তু কিছু আন্দোলন এমন আছে যেগুলো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও আন্দোলন হিসেবে ব্যর্থ হয়েছিল। হেরেও জিতে যাওয়া গণতন্ত্রকামী মানুষের এ আখ্যানের নাম দক্ষিণ কোরিয়ার “গোয়াংজু গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান” বা “১৮ই মে অভ্যুত্থান”। দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ জিওলা প্রদেশের গোংজু শহরে ১৯৮০ সালের ১৫-২৭ মে চালাকালীন গণতান্ত্রিক সংগ্রামই এ অভুত্থানের পটভূমি যার সবচেয়ে রক্তাক্ত দিনটি ছিল ১৮ই মে। এ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ৬০৬ জন নিহত এবং প্রায় ১০,০০০ মানুষ আহত হয়।
১৮ বছরের স্বৈরশাসনের পর প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং-হি ১৯৭৯ সালের ২৬ অক্টোবর গুপ্তহত্যার শিকার হন। ১২ ডিসেম্বর রক্তহীন সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অসীম ক্ষমতার অধিকারী জেনারেল চুন দু-হুয়ান ক্ষমতা দখল করেন। স্বৈরশাসনের এ আকস্মিক দিক পরিবর্তন দক্ষিণ কোরিয়াকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়। দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক উন্নয়ণে পার্ক চু-হি যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন চুন দু-হুয়ান তা পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৮০ সালের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক ও শিক্ষর্থীদের গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়। এর ফলে বহু ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন দাবি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সেগুলোর মাঝে অন্যতম ছিল- সামরিক আইন (যা পার্ক’কে হত্যার পর থেকে চালু ছিল) বাতিল করা, গণতন্ত্রায়ন, নূন্যতম মজুরী, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কার। এ সকল দাবির ভিত্তিতে গোয়াংজুতে ১৯৮০ সালের ১৫ই মে সামরিক আইন বিরোধী একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয় যাতে প্রায় এক লক্ষ সাধারণ নাগরিক ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট চুন দু-হুয়ান এ সকল কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সারাদেশে দমন-নিপীড়ন শুরু করেন। সামরিক শাসনের এ ব্যাপক রূপের কারণে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে আনা হয়। সামরিক আইন বাস্তবায়নের জন্য সমগ্র দেশে সেনা মোতায়ন করা হয়। এসময় সেনাবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো দল ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি সমাবেশে হামলা চালায় এবং দক্ষিণ জিওলা প্রদেশের স্থানীয় নেতা কিম দায়ে-জং সহ ২৬জন রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করে। সারাদেশে সেনা মোতায়েন করা হলেও সামরিক সরকারের মনোযোগ কিছু বিশেষ কারণে দক্ষিণ জিওলা প্রদেশ ও এর রাজধানী গোয়ংজু এর ওপর ছিল। দক্ষিণ জিওলা প্রদেশকে তত্কালীন সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার শস্যক্ষেত্র হিসেবে আখ্যা দেয়া হতো কেননা এটি ছিল প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। এ কারণে পর্যায়ক্রমে এ প্রদেশটি দেশি-বিদেশী শোষণের শিকার হতো নিয়মিতভাবে।
১৯৮০ সালের ১৮ই মে সকালে সাধারণ ছাত্ররা গোয়াংজু এর চোনাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বন্ধের প্রতিবাদে এর সামনে সমাবেশ করে। সকাল ১০:৩০ এ সাধারণ ছাত্র ও নাগরিকদের সাথে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সংঘর্ষ ধীরে ধীরে গোয়াংজু এর পার্শ্ববর্তী শহরগুলো ছড়িয়ে পড়ে। বিকেল নাগাদ প্রতিবাদী জনতার সংখ্যা তিন হাজার অতিক্রম করে। গোয়াজু এর গোয়ামনামনো শহরে এ সমাবেশ প্রতিহত করতে ৩৩ম ও ৩৫ম ব্যাটালিনের ৬৮৬ জন সৈন্যকে পাঠানো হয়। শুরু হয় হত্যা ও নির্যাতনের এক নতুন অধ্যায়ের। আহত অবস্থায় ৪০৫ জন সাধারণ নাগরিক সেনাবাহিনী আটক করে। ২০ মে পর্যন্ত সেনাবাহিনী ও নাগরিকদের মাঝে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ চলতে থাকে। ২১ মে সেনাবাহিনীর সহিংসতার বিপরীতে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন থেকে লুন্ঠনকৃত অস্র দিয়ে সশস্র প্রতিরোধ শুরু করে। সেদিনই তারা শহরের প্রভিন্সিয়াল হল দখল করে এবং আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার জন্য দুটি কমিটি গঠন করে। ২৩শে মে সামরিক সরকারের কাছে তারা সাত দফা দাবি পেশ করলে তা প্রত্যাখাত হয় এবং আন্দোলনকারীদেরকে দ্রুত আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয়া হয়ে। কমিটির একাংশ আত্মসমর্পণের পক্ষে মত দিলে তাদের বহিষ্কার করা হয় এবং ২৪শে মে আবারো আন্দোলনকারীরা চার দফা দাবি পেশ করে। কিন্তু তাদের সকল দাবি প্রত্যাখন করে ২৭শে মে ভোর চারটায় সেনাবাহিনীর পাঁচটি ডিভিশন মাত্র দেড় ঘণ্টায় ১৫৩ জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করে প্রভিন্সিয়াল হলটি দখলে নেয়। কিন্তু ততোদিনে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন প্রদেশ যেমন- হওসান, নাজু, হেনাম, মোকপো, ইয়োনগাম, গাংজিন ও মুয়ানে সরকার বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গোংজুর আন্দোলনটি ব্যর্থ হলেও তা দক্ষিণ কোরিয়ানদের ইতিহাসে গণতন্ত্রের চেতনা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় যা সেদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গতিশীল করে। ১৯৮৭ সালে গোয়াংজুতে ঘটে যাওয়া সেই হত্যাযজ্ঞের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদ গণশুনানীর আয়োজন করে। ১৯৮৭ সালে এ হত্যাকান্ডটি “Gwangju People’s Uprising” নামে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮মে দিনটিকে ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় দিবসের মর্যাদা দেয়া হয়। এ অভ্যুত্থনানের শহীদের স্মৃতিতে May 18 Memorial Foundation ২০০০ সাল থেকে বিভিন্ন মানবাধিকারমূলক কর্মের জন্য প্রতিবছর Gwangju Prize for Human Rights প্রদান করে আসছে।
গোয়াংজু অভ্যুত্থানটি সামরিক শাসনের জাঁতাকলে সফল হতে না পারলেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রভিন্সিয়াল হলে সেদিন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়ের পূর্বে সশস্র সিভিল মিলিশিয়ারা একটি ছোট ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণটির বাংলা অনুবাদ হলো,”আমার সঙ্গী নাগরিকগণ, সেনাবাহিনী এখন আমাদের শহরে প্রবেশ করছে। আমাদের প্রিয় ভাই ও বোনদের তারা বন্দুক ও বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করেছে। আমরা শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবো। চলুন আমরা শেষ পর্যন্ত একসাথে লড়াই করি। আমরা আমাদের গোয়াংজুকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবো। দয়া করে আমাদের মনে রাখবেন।”
শুধুমাত্র গণতন্ত্রের জন্য সেদিন গোয়াংজু শহরের মানুষগুগলো নিহত হয়েছিল। বিশ্বের শত শত সফল আন্দোলনের ভীড়ে এ আন্দোলনটি এজন্যেই অনন্য। কারণ এটি বিফল হয়েও দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য একটি আলোকিত ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পেরেছিল।
যদি একটু সুক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখতে পাবেন, যে কারণে একজন শাসককে আপনি স্বৈরাচার বলছেন ঠিক একই কারণে আমিও বলছি। আর কারণটি হচ্ছে নাগরিক হিসেবে মানুষের অধিকার হরণ করা। আপনি যে অধিকারগুলোর কথা বলছেন সেগুলো থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা যেমন অপরাধ ঠিক তেমনি গোয়াংজু এর ক্ষেত্রে নূন্যতম মজুরি, সামরিক আইন, গণমাধ্যম ও সমাবেশের স্বাধীনতা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করাও অপরাধ। একারণেই পার্ক ও তার উত্তরসূরি চুনকে আমি উপরে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছি। আপনার আর আমার প্রেক্ষিতটাই কেবল আলাদা।
ধন্যবাদ
বৃথা যায়নি গোয়ংজুতে প্রাণ হারানো মানুষদের আত্মত্যাগ! সামরিক জান্তা ভেবেছিল এভাবে হত্যাযজ্ঞ করেই ক্ষমতা পাকাপোক্ত করবে! কিন্তু আন্দোলনের মানুষগুলোকে হত্যা করা যায়, তাদের স্বপ্নকে নয়! মনে পড়ে গেল V for Vendetta সিনেমাটির বিখ্যাত সংলাপঃ