‘মরা না জুটলি কেমনে বাড়ি যাই! লাশটা কেউ পেড়ি দাও, পায়ে পড়ি। আল্লা গো, এ তুমার কেমুন বিচার?’ বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কাঁদে দু’জন মা। নির্মাণাধীন হাজী রহমত টাওয়ারের আটতলায় ঝুলে আছে লাশটি। তৃতীয়দিনে পড়ল। প্রথম প্রথম পরিবারটির বেশ ক’টি দাবী ছিল। এখন দাবি একটাই- খালি লাশটা চায় তাদের। দাফন-কাফনের যা খরচ হয় তার সবটাই যোগাবে তারা। লাশ নামাতে যদি কোনো খরচ হয়, তাও দিতে রাজি আছে লাশটির পরিবার। পরিবার বলতে আছে শুধু লাশের বৃদ্ধ মা, শাশুড়ি- সে আরও বৃদ্ধ, কমবয়সী বৌ আর কোলের মেয়েটা।
এই হলো লাশটির গুষ্ঠীশুদ্ধ লোকজন- গুষ্ঠীতে একজনই পুরুষ ছিল তাও এখন প্রাণহীন ধড় নিয়ে ঝুলে আছে। এই পরিবারে পুরুষরা বরাবরই টেকেনি। ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ নাটকটির মতো। তোমরা যারা নাটকটি পড়োনি, তাদের বলি- সেখানে, একটি পরিবারে একজন বৃদ্ধ মা আর তার দুই মেয়ে শেষপর্যন্ত টিকে থাকে- গুনে গুনে ন’জন পুরুষকে সাবাড় করে রাক্ষুসে সমুদ্র। বৃদ্ধ মা কাঁদতে কাঁদতে নির্বাক হয়ে যান। শেষপর্যন্ত তিনি নিজেকে সান্ত¦না দেন এই বলে যে, তাকে আর কারো জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে না। সে এখন সুখী যেহেতু তার হারানোর আর কেউ থাকল না। গল্পটা এমনই মর্মস্পর্শী এবং একপেশে। রোমান্স আর সাসপেন্স বলতে ছিটেফোটাও নেই। কিন্তু আমার এই গল্পে কিছুটা হলেও বৈচিত্র্য আছে। ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ নাটকটিতে একক ভিলেন সমুদ্র, কিন্তু এখানে আমরা ভিলেন হিসেবে কয়েকটি পক্ষকে খাড়া করতে পারি, চরিত্র কখনো কখনো নিজেই ভিলেন হয়ে আমাদের সামনে এসেছে। যারা অদৃষ্টবাদি তারা অদৃষ্টকেও দোষ দিতে পারে।
ফিরে যাচ্ছি গল্পে। লাশটির বাবা মাটিকাটার কাজ করতো। একদিন না খাওয়া শরীর নিয়ে মাটি কাটতে কাটতে হঠাতই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, খিদেয় শরীরটা প্যাঙটা হয়ি আসছি। পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লো সে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওখানেই শেষ। নীল হয়ে যাওয়া শরীর দেখে কেউ কেউ সন্দেহ করছিল- খিদে নয়, সাপের দংশনে মারা গেছে সে। সাপের দেখা কিন্তু শেষপর্যন্ত মেলেনি। তারপরও আপনারা সাপকেই ভিলেন হিসেবে ভাবতে পারেন, আর খিদেকে দায়ী করতে হলে, বের করতে হবে তার খিদের পেছনে দায়ী কারা? সেক্ষেত্রে আবার কেচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সাপই দায়ি- কি বলেন?
লাশের ভাইটার সখ জাগলো বাংলা সিনেমার নায়ক হবে। গরীবের ঘোড়া রোগ আর কি! কে যেন কবে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল, ‘ছেলিটা দেখতি বোম্বের হিরু অক্ষয়ের মতো- যেমনি গতর তেমনি সুরুত!’ পাকা আমে ঢিল মারলো তার এক পড়ালেখা জানা বন্ধু। কোথা থেকে যেন সে আমদানি করলো- অক্ষয় কুমার হোটেলে বাসন-কোসন মাজার কাজ করতে করতে নায়ক বনে গেছে! তারপর সে ক’দিন বাড়িতে থালাবাসন ভেঙে গাঁ ছাড়লো। সেই যে গেলো আর ফেরেনি। বেচারা মা-টা টেলিভিশনে টেলিভিশনে কত সিনেমা দেখলো, আজও ছেলের সন্ধান পেল না। এখনো ফিল্মের পোস্টার দেখলে তাকিয়ে দেখে, চেহারায় মিললে রাস্তায় লোকজন জড় করে নামটা জিজ্ঞেস করে। লাশটির ভাইটার নিরুদ্ধেশের পেছনে নির্দিষ্ট করে কাউকে দায়ী করা যাচ্ছে না। একবার অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছে বলে খবর হয়েছিল, আর একবার শোনা গেল র্যাবের ভুল ক্রসফায়ারে পড়েছে, ঐ শোনা পর্যন্তই, কোনো দফারফা হয়নি।
লাশের শশুরটা গেছে ওপারে- পরপারে নয়, অন্য এক নারীর হাত ধরে ভারতে। আর ফেরেনি। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কেউ পড়লেই পরিবার কান খাড়া করত; একবার একটা লাশের বর্ণনা হুবহু মিলেও গিয়েছিল, কিন্তু অন্য এক পরিবারের দাবি বেশি পোক্ত হওয়াই লাশের পরিবার আর এগুতে পারেনি। আর লাশের দাদার সম্পর্কে যা শোনা যায় সবটাই শোনা কথা। সৌদিতে কাজ করতে গিয়ে বছর বছর আসার কথা থাকলেও আর আসেনি। সে নিয়ে আবার কত কেচ্ছা! কেউ বলে সৌদিতে চুরি করতে গিয়ে হাত কাটা গেছে, কেউ বলে ফিলিপাইন এক নারীর সাথে প্রেম করে ধরা পড়েছিল, সৌদি আইনে যা হওয়ার তাই হয়েছে! শেষ আপডেট ছিল, তাও অবশ্য বছর পঁচিশেক আগে, এলাকার একটি ছেলে তাকে জেদ্দায় দেখেছে, একটি ফলের দোকানে কাজ করছে, বয়সের ভারে নতজানু; কিন্তু ছেলেটিকে সে চিনতে পারেনি, বাংলা বুঝতে পেরেছে, কিন্তু উত্তর দিয়েছে আরবিতে। দোকানের সহকর্মীদের কাছে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তারা বলেছে যে বৃদ্ধ সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। হঠাৎ হঠাৎ আসে কিছুদিন কাজ করে আবার গায়েব হয়ে যায়।
লাশের বৌয়ের পেটেও একটা পুরুষ বাচ্চা ধরেছিল। অপুষ্টিতে কুড়ি অবস্থাতেই ঝরে গেছে। এখন এই দুই বংশ মিলে বাকী ছিল খালি লাশটা। তখন তো আর সে লাশ ছিল না! ছিল জলজ্যান্ত-শক্তসামর্থ মানুষ। ঢাকায় ভবননির্মাণ শ্রমিকদের সাথে কাজ করতো। এই শহরের প্রায় অর্ধশত বহুতল ভবনের ফিটফাট দাঁড়িয়ে থাকার পেছনে তার অবদানের কথা কেউ না জানলেও তার জালি বৌটা জানে। জানে কারণ, লাশ আর তার সাঙ্গপাঙ্গ মিলে একটা একটা করে ভবন নির্মাণ করে আর লাশটা তার বৌয়ের কাছে সেই বাড়ির কত কেচ্ছা বনে! এ নিয়ে তাদের সংসারটাও চলছিল বেশ। অর্ধেক বস্তি গুড়িয়ে যে ভবন নির্মাণ হলো কিছুদিন আগে, সেখানেও কাজ করেছে লাশটা। নিজের ঘর ভেঙ্গে অন্যের ঘর গড়াতে হাত লাগিয়েছে সে। কোলের মেয়েটার তখন বল ফুটতে শুরু করেছে। বস্তিপাড়ার ছেলেবুড়ো যার কোলেই ওঠে, খানিকটা ভাষা, খানিকটা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে, এটা তার বাড়ি, বাবা তৈরি করছে যে! তারপর ও বাড়িটা হলে আরেক বাড়িতে হাত দিয়েছে লাশটা। মেয়েটা আস্তে আস্তে বুঝে নিয়েছে- শহরে তাদের মেলা বাড়ি; কিন্তু ওখানে থাকলে আর সব বাড়ি বানাবে কে? তার বাপের বাড়ির খিদা, মেলা বাড়ি চায় তার! তার মতো এতো এতো বাড়ির মালিক এই শহরে দুটো নেই। লাশটি বোঝায়, মেয়েটিও বোঝে। এমনই সম্পর্ক তাদের।
লাশের যেদিন জন্ম হয় বাংলাদেশের বয়স সেদিন পাঁচ মাস পূর্ণ হল। লাশ যখন পেটে, লাশের বাবা তখন যুদ্ধে। লাশের মায়ের ফেঁপে ওঠা পেট দেখে কত মানুষের কত কথা! মা সব নীরবে সয়েছে আর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছেছে। যুদ্ধফেরত বাবা এসে যেদিন সবার দিকে বন্ধুক-নলা তাক করে ঘোষণা দিল- এ আমার সন্তান, আমার রক্ত, কার সাধ্য দেখি কথা বলে- সেদিন থেকে সবার মুখ বন্ধ। আর কোনোদিন সে মুখ খোলেনি। তবে গাঁয়ে এই মরার খবর পৌঁছালে কয়েকজন বয়স্ক মহিলা ইশপিষ করে কি যেন বলতে চেয়েছিল। সেও পরিস্কার করে কোনোকিছু না। আপাতত তাদেরও শঙ্কা- গায়ে মাটি পড়বে তো!
মেয়েটি ঘাড়ের ব্যথাটা একটু প্রশমিত হলেই ফের তা বাড়িয়ে তুলছে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে। লাশের মা এখন যাকে পাচ্ছে তারই হাত পা ধরে বলছে- স্যার, একটা ব্যবস্থা করেন না! ছেলি আমার শুকি গেল। আল্লামাবুদের নাম নি, ওর গায়ি ক’টা মাটি দেবো গো সাহেব। ও সাহেব! দোহাই লাগে…।’ শাশুড়িরও জনে জনে একই আবদার। আর কচি বৌটা টাওয়ারের যেখান দিয়ে মিস্ত্রিরা নেমে আসে ওখানটাই চুপ করে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, সে কারো জন্যে অপেক্ষা করছে যে যেকেনো সময় এই পথ ধরে নেমে আসতে পারে। এই লাশের সাথে তার কোনোই লেনাদেনা নেই।
এই ঘটনার পর থেকে মালিকপক্ষের লোকজন আর এদিকটাই আসছে না। সাথের শ্রমিকরাও আপাতত কাজ বন্ধ করে চলে গেছে। পুলিশি ঝামেলার কারণে লাশটি ছুঁয়েও দেখেনি তারা। প্রতিদিন জনতা জড় হচ্ছে, বদলাচ্ছে, থেকে যাচ্ছে শুধু চারটি চার বয়সের নারী আর ঐ বাঁশের মাথায় বাদুর ঝোলার মতো করে ঝুলে থাকা লাশটা।
পুলিশের লোকজন এসে তদন্ত করে গেছেন। তদন্ত মানে এটাওটা জিজ্ঞাসা। লাশটির সঙ্গে উপস্থিত মানুষগুলোর সম্পর্ক, তাদের বাড়ি কোন অঞ্চলে, লাশটি কতদিন থেকে এসব কাজ করছে, তাদের আর কে কে আছে, লাশটির ভালো নাম কি, তারা কাউকে সন্দেহ করছে কিনা, সঙ্গের কারো সাথে তার বিবাদ ছিল কিনা–এইসব দরকারি জিজ্ঞাসা! সাথের শ্রমিকরা আগেই জানিয়েছে যে, কাজ করতে করতে দশতলা থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়ে নিচের আট তলার বাঁশের সঙ্গে গেঁথে গেছে। সব শুনে অফিসার পান চিবোতে চিবোতে মহাপ-িতের মতো বলেছেন, ‘সেই!’ আর কোনো কথা তিনি বলেননি। তারপর গাড়ি হাঁকিয়ে ফিরে গেছেন থানাতে। মালিকপক্ষের লোকজনের সাথে যা কথা হওয়ার ওখানেই হয়েছে। সরকারি পক্ষের আর কেউ আসেনি এদিকটাই। প্রথমদিনই লাশের শাশুড়ি গিয়েছিল থানাতে।
‘হুজুর, হেই আমাদের পেট চালাতুক। ওইটুকুন একটা মেয়ি। এখুন কি করি চলবি আমাদের? হাতে কুনো টাকা কড়িও নেই যে গাঁয় ফিরি যাব।’ পুলিশ শুনে বলেছেন- ‘ঠিক আছে, হাজি রহমান সাহেবকে বলে কিছু টাকা নিয়ে দেবো, যাও। ওদিকটাই থাকো। আমরা দেখছি কি করা যায়।’ তারপর তিনদিন হলো আর তাদের খোঁজ নেই। আজ সকালে আবার থানায় গিয়েছিল লাশের মা। এখন দাবী একটাই- ‘হুজুর, ছেলিটা খালি নামানুর ব্যবস্থা করেন। নামি দেন, আমরা গাঁয়ি চলি যাই। আর আপনাগো জ্বালাতন করবু না। মেলা কাজ আপনাদের। খালি একবার নামানুর হুকুমটা দেন।’ পুলিশ বুঝিয়ে বলেছে- ‘অত ওপরে লাশ! চাইলেই তো আর নামানো যায় না। অনেক বন্দোবস্ত করতে হবে। আমাদের তো আর একটা কাজ না। আর তাছাড়া, আজকের আবহাওয়াটা বিশেষ সুবিধার না। তুমি যাও, একটু বাতাস হলে পড়েও যেতে পারে।’
দুপুর গড়িয়ে রাত নেমে এলো; বাতাস আর হয় না। পুলিশ মিথ্যে বলেনি, হালকা মেঘ আকাশে ছিল। একটা ঝটকা বাতাস হলে হতেও পারতো- কিন্তু হয়নি। ঝড়েরও দোষ না, শীতকালে এমন অল্পবিস্তর মেঘে সে চাইলেই আসতে পারে না। সবখানেই একটা নিয়ম আছে। মানুষের সুবিধে অসুবিধে বুঝে সেই নিয়মের অদল-বদল হয় না। তবে এও ঠিক- শীতকাল না হলে এতক্ষণ লাশের গন্ধে এখানে টেকা মুশকিল হয়ে পড়তো। রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। এ বাঁশ সে বাঁশ চুয়ে রক্ত খানিকটা মাটিতে এসে পড়েছে। লাশটির মা ঐ কালো জায়গা আগলে বসে প্রলাপ বকছে- ‘আমার তাজা ছেলিটা! আমার নিস্পাপ ছেলিটার একি হাল হলু খুদা! এ কুন পাপের সাজা রে মাবুদ?’
কাঁদতে কাঁদতে আর না খেয়ে খেয়ে নিচের মানুষগুলোরও প্রায় লাশের দশা। এ কয়দিনে কে বলবে কচি মেয়েটার বয়স বিশ না চল্লিশ! বাচ্চাটাকে রাস্তার এ ও এটাসেটা কিনে দেয়, সে তার বাপজান, মা, দাদি, নানি সবার জন্য ভাগ করে আর একটা একটা করে খায়। নানি তার মাথায় হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তোর বাপ আর আইবো নারে মুখপুড়ি! এখুন থেকি তোকে লোকের কাছে ভিক্ষি করিই খেতি হবি। কি পুড়া কপাল নি জন্মালিরে…! পেটেই মরি যেতি পারলি নি? এসব দেখার আগে আমার কেনে মরণ হলু না, মরি গেলি এই আমি মাগি তো বাঁচতাম।’
‘মরি গেলি কেউ বাঁচে নাকি নানি?’- বাচ্চা মেয়েটা পাকা বুড়ির মতো বলে।
‘বাঁচে বাঁচে, গরীব মরি গেলিই বাঁচে’- কান্না মিশিয়ে উত্তর দেয় নানি।
চারদিনে পড়েছে। আজ বিকেলে ব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল। ওদিকে আবার এয়ারপোর্টে ডেডবডি এসেছে বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সাবেক মন্ত্রী ড. নুরুল উদ্দিনের। দেশ বিদেশের যত ডাক্তার মিলেও আর শেষ রক্ষা করা গেল না। এ পথ দিয়েই নিয়ে যাওয়া হবে তাঁর মরদেহ। রাস্তাজুড়ে কড়া নিরাপত্তা। দুদিন জুড়ে জানাযা হবে স্থানে স্থানে। দেশবাসীর শ্রদ্ধানিবেদন শেষ হলে তবেই তাঁর দাফন হবে। ঢাকার পুলিশ-প্রশাসনের কত কাজ ওখানে! লাশের বৌ ওপরে ওঠার পথে মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটির মাথা আটকে গেছে ওপরেই, এখন নীচে তাকালেই তার ব্যথা করছে ঘাড়জুড়ে। দুই বৃদ্ধা কুকুরের মতো জড়ো হয়ে জমে আছে। অদ্য শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে, চলবে আরও ক’দিন। এখন খালি বাড়ি ফিরতে চায় ওরা, কিংবা কোথাও ফিরতে চায় না আর। লাশকে নিয়ে ওদেরও আর ভাবনা নেই।
গল্পটি আমি এখানেই শেষ করতে পারতাম, বস্তুত সেটাই আমি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা অল্পবয়সী ছোকড়া এসে বাধ সাধল। তাই আরো কিছুটা টানতে হচ্ছে। ছেলেটির নাম মো. আব্দুল গণি। একালের ছেলের সেকেলে নাম। আব্দুল গণিকে চেনে না, এমন মানুষ এখন দেশে দুটো পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আব্দুল গণি এক সাবেক রিকশা চালকের ছেলে। ওর বাবার নাম মীর আক্কাস আলী। বর্তমানে সিএনজি চালায়। থাকে মিরপুরে। আমি চাইলে বাড়ির নম্বরটাও বলে দিতে পারি, কিন্তু সেটার আর দরকার আছে বলে মনে করছি না। আব্দুল গণি পড়ছে মিরপুর বাংলা কলেজে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স। ছাত্র ভালোও না, খারাপও না। আবার মাঝামাঝি বলেও উল্লেখ করেনি কোনো শিক্ষক। ‘তয় নেক বান্দা’, আব্দুল গণির মাধ্যমিকের ধর্ম শিক্ষক জানিয়েছেন। ভাবছেন, লাশের গল্পে আবার আব্দুল গণি এলো কি করে? এলো কারণ, গল্পের এ পর্বের নায়ক এই আব্দুল গণি। ও সেদিন ফিরছিল চন্দ্রিমা উদ্যাণে ডেটিং শেষ করে, বেশ খোশ মেজাজে। মেয়েটির নাম-? না থাক, অন্তত এই প্রাইভেসিটুকু থাকা উচিত! যাওয়ার সময় গিয়েছিল সিএনজিতে, এখন ফিরবে লেগুনাতে। তার আগে একটু হালকা হওয়া দরকার। ঝুলে থাকা লাশটির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। মাঝপথে একটু উদাস হয়ে ওপরের দিকে ঘাড় তুলে তাকাল। কিছু একটা ঝুলে আছে। দু-তিনটা কাক বসে মাতামাতি করছে। একটা বিদঘুটে গন্ধ এতক্ষণে নাকে এলো। বেশি কিছু না ভেবে, জিপারটা আটকে পকেট থেকে পকেট-মারের কাছ থেকে সদ্য কেনা সিমফোনির সেটটা বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। ভাবনাটা এলো লেগুনার চাপাচাপিতে। পকেট থেকে আবারো মোবাইলটা বের করে ফেসবুক ওপেন করে ছবিটা একটা ক্যাপশনসহ পোস্ট করে দিলো। ক্যাপশনটা ছিল বেশ আবেগের, বাংলিশে লেখা- haire Shohor! Akta lash jhule ache, othocho karo kono mathabetha nai. Bechara! এটা পোস্ট করার কিছুক্ষণ পর তার নতুন একটা ক্যাপশন মাথায় এলো, রিপোস্ট করলো নয়া ক্যাপশনে- Amra boli Shobvota toiri hoi mojurer rokte. Akhon dakchi mojurer lashe! এই ক্যাপশনসহ ছবি শেয়ার দেয় আব্দুল গণির বন্ধুতালিকায় থাকা প্রায় সকলে। সেখান থেকে আবার আরো অনেকে। সংবাদ হয়ে যায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে। কেউ কেউ গণির পোস্ট করা ছবি ও ক্যাপশন ব্যবহার করে। দুপুর তিনটার ঘটনা। সন্ধ্যে ৭টার মধ্যে লাশটির নিচে, ওপরে, ডানে, বামে ক্যামেরায় ভরে যায়। লাইভ টেলিকাস্ট হতে থাকে চ্যানেলগুলোতে। মনের মাধুরী মিশিয়ে রিপোর্ট করতে থাকেন সাংবাদিকরা। কয়েক সেকেন্ডে ঘটনাটা রাষ্ট্র হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক গুমাধ্যমের আঞ্চলিক বিভাগেও খবরটি আসে। তবে তাদের খবরের বিষয় ছিল লাশটি নিয়ে নয়, একটি লাশ নিয়ে যে দেশজুড়ে মাতম তা নিয়ে। একটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম ছিল- A Hunging Body, Whole Country after it। আর একটা সংবাদমাধ্যম ডাবল মিনিং করে শিরোনাম করেছে- Bangladesh is Hunging with a Body।
লাশটির মা-বৌ-মেয়ে-শাশুড়ি বাড়ি ফিরছিল। তখন গোয়ালন্দ ফেরিঘাটে। একটি চায়ের দোকানে টেলিভিশনে বলতে শোনে। তারা বুঝে উঠতে পারে না–যাবে, না ফিরে যাবে। সামনে বা পিছনে–কোনদিকে পা বাড়ানোরই পর্যাপ্ত টাকা তাদের হাতে নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে সাংবাদিকদের অদৃশ্য চোখ উদ্ধার করে তাদের। দেশবাসী ফেরিঘাট থেকে লাইভ দেখে মা-বৌ-মেয়ে-শাশুড়ির শুকনো চেহারা। ভয়ে ভয়ে তারা কথা বলে, যেন কিছু একটা অপরাধ হয়ে গেছে। এদিকে টেলিভিশনের টকশো নায়ক তখন আমাদের সেই আব্দুল গণি। গণিকে এই ঘটনার উদ্ধারকর্তা হিসেবে ডাকতে শুরু করেছে চ্যানেলগুলো। গণি জানিয়েছে, লাশটি নামানোর ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করলে, একটি অজ্ঞাত মহল থেকে তাকে হুমকি দেয়া হয়। ফলে পুলিশ তার সিকুইরিটির ব্যবস্থা করবে বলে জানিয়েছে।
ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে লাশটির মা-বৌ-মেয়ে ও শাশুড়িকে। রাত দুটোই পুলিশ ও র্যাব বাহিনির উপস্থিতিতে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন লাশটি নামিয়েছে। বিকাল থেকেই আনকাট লাইভ চলছে। কিছু কিছু চ্যানেল গিয়ে অবস্থান নিয়েছে নির্মিতব্য ভবনটির মালিকের বাসভবনের গ্যেটে। সরকারীভাবে লাশটি দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন লাশটির পরিবারের দাবি-দাওয়া নিয়ে বাম ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন, লেবার ইউনিয়নের একটা খ-াংশ রাজপথে দাঁড়িয়েছে। টকশোতে বুদ্ধিজীবীরা এর চুল চেরা বিশ্লেষণ করছেন। এর আগে এ ধরনের যত ঘটনা ঘটেছে সেগুলো টেনে এনে এর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ চলছে। লাশটির পরিবারের নারীগুলোকেও টেলিভিশনে ডাকা হয়েছে। মুখে পাউডার লাগিয়ে পর্দার সামনে কান্নাকাটি করছে তারা। সত্যিই কাঁদছে নাকি কাঁদতে হচ্ছে, সেটি বোঝা যাচ্ছে না। একসময় তাদের কান্না কেউ শোনেনি, এখন গোটা দেশবাসী শুনছে। তাই কান্নাটা যাতে ভালো দেখায় সেদিকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। তাদের স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করিয়ে সেটের সামনে আনা হচ্ছে। এক একটি চ্যানেলের স্ক্রিপ্ট আবার এক এক রকম, এক এক রকম এজেন্ডা তাতে। ওত সব না বুঝে, হাতে কটা নগদ টাকা পেয়েই খুশি থাকতে হচ্ছে লাশটির পরিবারকে। সরকার থেকেও কিছু দেয়া হবে বলে ঘোষণা এসেছে। যেহেতু ভবনটি ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার। তাই বিরোধীদল এটিকে ইস্যু করে সরকার পতনের আন্দোলনে নামা যায় কিনা তা নিয়ে দফায় দফায় মিটিং করছে। তারা বিবৃতি দিয়ে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে–এই সরকার মানুষ মারার সরকার। এদেশের জনগণ এমন সরকার চায় না। যে সরকার পরিকল্পনা করে মেহনতি মানুষকে হত্যা করে, সেই সরকারের পতন অনিবার্য। এরপরও যদি সরকার গদি থেকে স্বেচ্ছায় সরে না দাঁড়ায়, তবে লাগাতার হরতাল কর্মসূচি দেয়া হবে।
এদিকে ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে, এই নির্মম-নৃশংস খুনের পেছনে বিরোধীদলের হাত আছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি থামাতে তারা পরিকল্পনা করে শ্রমিকদের টাকা দিয়ে এই হত্যা করেছে। জনগণ এমন জালিম ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলকে ভবিষ্যতে কখনোই ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, অচিরেই তাদের মুখোস উন্মোচন করা হবে।
আমরা আবার ফিরে যাবো আব্দুল গণির কাছে। সে এখন ভীষণ খুশি, আবার ভীষণ অসুখী। তার হাতে এখন স্যামসাং স্মার্টফোন। প্রেমিকাকেও কিনে দিয়েছে সেইম সেট। ফুলটাইম সিএনজিতে ঘোরে। সাবধানে থাকতে হয় তাকে, মাঝে মাঝেই হুমকি আসে উড়োভাবে। সে এখন নিজেকে ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। এই পরিচয়টা তার নামের সাথে কারা যেন একটু একটু করে জুড়ে দিয়েছে। শঙ্কামুক্ত ব্লগার আন্দোলনেও এখন তাকে ঘটা করে দাঁড়াতে হচ্ছে।
লাশটির পরিবারের শেষ অবস্থার কথা জানিয়েই গল্পটির ইতি টানছি। তারা এখন নিজ বসতভিটায়–সর্বশান্ত হয়ে পথে বসার অবস্থায়। টাকা পয়সা যা কিছু হয়েছিল, দুর্বৃত্তরা বাড়ি ঢুকে ছিনতাই করে নিয়েছে। অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করেছে লাশটির বৌকে, গণধর্ষণ। বাকি তিনজন নারী ধর্ষণের অনুপযুক্ত বলে দৃশ্যপট ছেড়েছে নিরুপায় দুর্বৃত্তরা। এসব খবর অবশ্য লোকমুখে শোনা। কারণ, কথিত দুর্বৃত্তরা এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে গায়েব করে দিয়েছে লাশটির পরিবারের অবশিষ্ট গল্প।
কি সুন্দরভাবে একটা কুৎসিত ঘটনার বর্ণনা দিলেন।
আমার খুব আক্ষেপ হচ্ছে, লাশের জন্যে না।
আরো কত লাশ হবে এমন, তাদের জন্য।
ঠিক বলেছেন। সন ধার্মিকরাই মনে করে যে, তাদের সব কিছুই ঠিক। তারা যদি শুধুমাত্র ১টি বার ভেবে দেখতো তারা কি করছে…!