এই লেখায় তিন অংশ। (১) ইমরান এইচ সরকাকে নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা। (২) তার সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্টসমূহ নিয়ে সুনির্দিষ্ট ব‍্যাখ‍্যা এবং (৩) তার ভুল ও করণীয় বিষয়ে বিশ্লেষণ।

লেখাটি একটু বড়। আগেই বলে রাখলাম। এত বড় লেখা লিখতে অভ‍্যস্ত নই। কিন্তু মনে হলো এই বিষয়ে একটু বিশ্লেষণ করে রাখার দরকার আছে। ভবিষ‍্যতে কাজে লাগবে।

তো, ঠিক আছে। এবার তাহলে লেখাটি পড়ুন।

ইমরান এইচ সরকার কে?
এখানে ইমরান হচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অহিংস গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (গণজাগরণ মঞ্চ) মুখপাত্র। এই আন্দোলনের চরিত্র ছিলো জাতীয়তাবাদী, মানবতাবাদী, ধর্মনিরেপক্ষ ও সংশোধনবাদী। মুখপাত্র নিজেও তার সমস্ত বক্তৃতা বিবৃতিতে এসব চরিত্র ধারণ করেছেন, প্রকাশ করেছেন।

ইমরান যেভাবে ইমরান হলেন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব‍্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার লঘু যাবজ্জীবন রায়। রায়ের দিন বিকেলে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে একটি প্রতিবাদী ইভেন্ট। হাজার হাজার মানুষের আগমণ। তারপর লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাংলার বুকে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি বাঙালির একাত্মতা। যে ছোট্ট ইভেন্ট থেকে এই বিশাল আন্দোলনের জন্ম, সেই ইভেন্ট ডেকেছেন ইমরান এইচ সরকার। এই সূত্রে এবং ইভেন্ট পরবর্তী ভূমিকার কারণে তিনিই হন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র। মাইক আর ক‍্যামেরার সামনে আনকোরা অন‍ভ‍্যস্ত এক যুবক সারা দেশের প্রগতিশীল, শান্তিপ্রিয় মানুষের আস্থা অর্জন করলো। কারণ এই লোকের কথা বলার ভঙ্গি, শব্দ চয়ন খুব অচেনা মনে হয় না, পর পর মনে হয় না, দীর্ঘদিন শুনে আসা কানে জ্বালা ধরানো বক্তৃতাবাজদের মত মনে হয় না।

যাইহোক, আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে ইমরানের অপরিহার্যতা বাড়ে। দীপ্ত উচ্চারণ, স্পষ্ট ভাষণ, সাহসী পদক্ষেপ তাকে উঁচু থেকে উঁচুতে নিয়ে যায়। এর মাঝে জঙ্গিদের হাতে খুন হলেন ব্লগার রাজীব হায়দার (থাবা বাবা)। মানুষ দেখেছে রাজীব যেন ইমরানের সহোদর, বাল‍্যবন্ধু, যেন একমাত্র অবলম্বন। ইমরানের কণ্ঠে আগুন ঝরে। ইমরানের গর্জে উঠা তার অপরিহার্যতা আরো বাড়িয়ে দেয়। এই ধারাবাহিকতায় অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয়সহ একের পর এক ব্লগার প্রকাশক খুন এবং খুনের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে আসা ইমরানকে আরো বেশি ইমরানে পরিণত করে। মানুষের স্বপ্ন, আশা, রক্ত, প্রাণের বিনিময়ে এই ইমরান।

ইমরানের প্রতি প্রত‍্যাশা
কেউ প্ল‍্যান করে যেচে গিয়ে গায়ে পড়ে প্রত‍্যাশা নির্মাণ করেনি। দীর্ঘ ঘটনাপ্রবাহ কিছু প্রত‍্যাশার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বধ‍্যভূমির উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষ মনে মনে নতুন কোন নেতা খুঁজছে। এ নেতা এমন নেতা, যে নেতা নতুন নেতা, পুরোনো এবং পুরাতন নয়। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক নেতাই যেন এক। একই মূর্তির উপর ভিন্ন ভিন্ন মেকআপ। এই প্রতারণা থেকে বের হওয়ার জন‍্য আপ্রাণ চেষ্টারত এ দেশের মানুষ। ইমরান যেন উঁকি দেয়া সূর্য ছিলো। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম ব‍্যবসার বিরুদ্ধে সবচে সমসাময়িক সোচ্চার কণ্ঠ। সে যেন তোতাপাখি। কোটি কোটি মানুষ ইমরানকে তাদের মনের কথা কানে কানে শুনিয়ে দিয়েছে, আর ইমরান সেসব কথা গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। মানুষ শোনে আর বলে, ‘আরে এ’তো আমারই কথা। আমরই মনের কথা!’

মানুষ বন‍্যাকবলিত। তাদের নিয়ে রাজনীতি চলে। মন্ত্রী এমপিরা হেলিকপ্টার নিয়ে দূর্গতের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। কিন্তু ইমরান এইচ সরকার দলবল নিয়ে বাসে, ট্রলারে চেপে পৌঁছে যায় দূর্গতদের কাছে। সবার আগে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, নির্যাতন। সবাই চুপ। রাজনৈতিক মুখগুলো কলুপ এঁটেছে। সঙ্গী সাথী নিয়ে ইমরান নির্যাতিতদের পাশে। জনস্রোত স্বাগত জানায় তাদের কল্পিত নেতার বাস্তব মূর্তিকে। আশা জাগে। প্রত‍্যাশা জাগে। ইমরান কথা বলেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, লুটপাটের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক বেয়াদবির বিরুদ্ধে। ইমরান বলেছে এই দেশ সকল ধর্মের, সকল মতের, সকল জাতের মানুষের। ইমরান বলেছে বাহাত্তরের সংবিধানের কথা।

ইমরান কেন গুরুত্বপূর্ণ
আপনি চাইলে চাল থেকে পাথরকনা আলাদা করতে পারবেন, সাদা ফুলের মাঝ থেকে হলুদ ফুল আলাদা করতে পারবেন। আলাদা করে মুছে ফেলতে পারবেন। কিন্তু সময় এমন বিষয়, একটা সেকেন্ড, একটা ঘটনা, একটা উপাদান বাদ দিতে পারবেন না। ভুলে যেতে পারবেন না। ভুলে যাওয়া, অস্বীকার করার ভান করতে পারবেন, কিন্তু আসলে পারবেন না। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে গণজাগরণ মঞ্চ মুছে ফেলতে পারবেন না, মঞ্চের মুখপাত্রকেও আঠা দিয়ে ঢাকতে পারবেন না। তাই আপনি যতই বলুন ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন চ‍্যাটের বাল, আসলে সে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। আপনি যদি বলেন পুতিন কোন হনু, আসলে সে পৃথিবীর বড় একটা ভূখন্ডের নেতা। ঠিক সেভাবে আপনি যতই বলুন ইমরান কেউ না, আসলে ইমরান হচ্ছে একটি বৃহৎ আন্দোলনের মুখপাত্র। সে অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতিটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব অস্বীকার করে বর্তমান সময়টুকু বিচার করা যাবে না।

ইমরানের মুসলিম পরিচয় কি নাস্তিক ব্লগারদের জন‍্য সমস‍্যা?
একদমই না। ইমরানের মুসলিম পরিচয় নাস্তিক ব্লগারদের জন‍্য কোন সমস‍্যাই না। এমনকি হেফাজতের ভয়ে গণজাগরণ মঞ্চে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করানোর পরও কোন সমস‍্যা হয়নি। নিয়মিত মঞ্চে মোল্লা তুলে বক্তব‍্য দেয়ার ব‍্যবস্থা করার পরও নাস্তিকরা মঞ্চ থেকে সমর্থন তুলে নেয়নি। ইমরান নিজেকে মুসলিম প্রমাণের জন‍্য টুপি পরে ফেসবুকে ছবি শেয়ার করার পর হয়তো একটু হাসি তামাশা করেছে, কিন্তু ইমরানকে ছেড়ে যায়নি। এমনকি মঞ্চের সমাবেশ থেকে ‘গণজাগরণ মঞ্চে নাস্তিকদের ঠাঁই নাই’ আওয়াজ আসার পর নাস্তিকরা মনোক্ষুন্ন হলেও আন্দোলনের সাথেই ছিলো। কারণ আমরা মাটিতে পা রেখেই চলি, ঘোরগ্রস্থ উন্মাদ না। মানুষের প্রতি, মানবিক আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রতি আমাদের কোন বিদ্বেষ নেই।

সরকারের সমস‍্যা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের সমস‍্যাতো জানেনই, নতুন করে বলার কিছু নেই। সৌম‍্য সরকারের সমস‍্যা হচ্ছে সে ভালো খেলে কিন্তু টিকে থাকতে পারে না। ইমরান সরকারের সমস‍্যা খুবই ভয়াবহ। তার সর্বশেষ সমস‍্যা অত‍্যন্ত করুণ, নিদারুন।

জঙ্গিবাদ ইস‍্যুতে সেকুলার নেতা হিসেবে ভূমিকায় সমস‍্যা
এ দেশে সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তার মানে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগ মুসলমান। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণ আদালতে যোগ দেয়া বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান। গণজাগরণ মঞ্চের লাখো মানুষের বেশিরভাগ মুসলমান। এই জনস্রোতে ক্ষুদ্র হোক, তবু একটা বড় অংশ আছে যারা অন‍্য ধর্মের এবং ধর্মে অবিশ্বাসী। কিন্তু শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে শতভাগ সবাই মুসলমান। অতশী কাঁচ দিয়েও এক ডজন অমুসলিম রাজাকার খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো দু’একজন পাবেন, কিন্তু সেই অমুসলিম অখন্ড পাকিস্তান রক্ষায় রাজাকারি করেনি। হয় স্ত্রী কন‍্যাকে ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচাতে, না হয় প্রাণ বাঁচাতে, ভিটা বাঁচাতে অথবা অর্থের লোভে রাজাকার হয়েছে। যাইহোক, বাংলাদেশে যেহেতু মুসলিমের সংখ‍্যা বেশি, ভালো মন্দ সবকিছুতে মুসলিমদের অংশগ্রহণও সমানতালে বেশি। এটা স্বাভাবিক।

যেকোন দেশে সংখ‍্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। আবার তারা চাইলে একটি দেশ ধর্মনিরেপক্ষ হয়। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশে মুসলিম জঙ্গিদের হাতে শুধু নাস্তিক বা অন‍্য ধর্ম-মতের মানুষ মরছে না। মুসলমানরাও মরছে এবং সামনের দিকে শুধু মুসলমানই মরবে। জঙ্গিরা সেদিকে যাচ্ছে। এখন সংখ‍্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সাথে নিয়েই জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে হবে, যদি কোন সেকুলার নেতা জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে চায়।

কিন্তু ইমরান ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছে ধর্মের পিঠ রক্ষায়। যেটা ধর্মীয় নেতারা করে থাকেন। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেসব ধর্মীয় নেতারা কোন ভূমিকা রাখে না, কিন্তু কোথাও জঙ্গি হামলা হলে “ইসলাম শান্তির ধর্ম, জঙ্গির কোন ধর্ম নেই” বলে মুখে ফেনা ধরিয়ে ফেলেন, ইমরানও তাদের মতো করে কথা বলছেন। একটি সূর্যমূখী আন্দোলনের সামনে থেকে তার যে পরিচয় নির্মিত হয়েছে, সে পরিচয় ভুলে ধর্মীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

এই ইস‍্যুতে তার বক্তব‍্যের সুনির্দিষ্ট সমস‍্যাসমূহ
১.
আলোচিত সমালোচিত এই ইস‍্যুতে ইমরান প্রথম পোস্ট দেন ১৮ মার্চ ২০১৭ তারিখে।

তিনি প্রশ্ন করেছেন ‘যারা মুসলিম নাম দেখলেই জঙ্গি মনে করে, তারাই কি বড় জঙ্গি নয়?’ তিনি হ‍্যাঁ অথবা না জানতে চেয়েছেন। প্রশ্নের ভঙ্গিতে তার জবাবটি পাওয়া যায়। “হ‍্যাঁ তারাই বড় জঙ্গি” তিনি এটাই বলতে চান। অর্থাৎ কাউকে হত‍্যা না করে, একটা বোমা না ফাটিয়ে, দাঙ্গা না লাগিয়ে, কাউকে আক্রমণ না করে, হত‍্যার হুমকী না দিয়ে, ব‍্যাকপ‍্যাকে চাপাতি নিয়ে না ঘুরে শুধু মুসলিম নামের প্রতি ভয় আছে বলে সেই ব‍্যক্তি ‘সবচেয়ে বড় জঙ্গি’ হয়ে যাবে?! অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত! সারা পৃথিবীজুড়ে মুসলিম নামের অধিকারী জঙ্গিরা মনের সুখে মানুষ মেরে যাবে, আর একজন মানুষ এসব নামের প্রতি ভীত হতেও পারবে না। সেই বাধ‍্যবাধকতা একজন মুসলমান দিয়ে দিচ্ছে। অথচ তার একমাত্র ভূমিকা হওয়ার কথা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া।

যাহোক, মওদুদ আহমদের ভাষায়, এটি একটি রাজনৈতিক বক্তব‍্য। মিথ‍্যা, বানোয়াট, অস্পষ্ট সব কথাকে “রাজনৈতিক বক্তব‍্য” বলে চালিয়ে দেয়া যায়। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিটাই এমন। বক্তা মনে করেন এ ধরনের বক্তব‍্যের ফলাফল তার পক্ষে যায়। যদিও মাঝে মাঝে পক্ষে যায়, কিন্তু বেশিরভাগ সময় যায় না। ইমরানের এই বক্তব‍্যের ক্ষেত্রেতো নয়ই। এই বক্তব‍্যটা কোন টুকটাক হেফাজত কর্মীর মুখে মানায়। একটি অসংলগ্ন, অস্পষ্ট অভিযোগ। কোথায় কবে এমন মহামারি লেগেছে যে মানুষজন মুসলিম নাম দেখলেই জঙ্গি মনে করে? তাও ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে!

ইমরানের এই রাজনৈতিক বক্তব‍্যের গ্রাহক, দেশের সকল মুসলমান। এভাবেই তিনি জঙ্গি নির্মূলের প্রয়াস পেয়েছেন।

২.

একইদিন অতিসতর্কতার কারণে তিনি আরো একটি স্ট‍্যাটাস ফাটিয়ে ফেলেন। তিনি আসলে গরীব কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের সুনজরে আসতে জিনিসটা ফাটিয়েছেন। তার অভিযোগ মাদ্রাসা ছাত্ররা জঙ্গি হলে সোজা ক্রসফায়ার, আর ইংলিশ মিডিয়াম হলে পুরস্কার। এবং গরীবের পোলাদের ফ‍্যামিলিসহ আটক করে, বড়লোকদের জন‍্য নাটক। এক্ষেত্রে তিনি কী চান, জানি না। এর উল্টোটা চান? গরীবদের জন‍্য নাটক আর বড়লোকদের জন‍্য সোজা ক্রসফায়ার? নাকি তিনি উভয়ের জন‍্য ক্রসফায়ার চান? নাকি উভয়ের জন‍্য নাটক চান? নাকি কোনটাই চান না? শেষে প্রশ্ন রেখেছেন, “এর নাম জঙ্গি দমন?” আরে ভাই, আমরাতো সেটাই জানতে চাই, কিভাবে জঙ্গি দমন করা যাবে?

হোয়াটস অন য়‍্যুর মাইন্ড, লিডার?

তার এই বক্তব‍্যটির গ্রাহক শুধুই গরীব মুসলমান এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বড়লোকেরা। এই পদ্ধতিতে তিনি জনসম্পৃক্ত হচ্ছেন।

৩.
উপরের দু’টি বক্তব‍্যের সময় তিনি গর্তের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিলেন। এবার গর্তে দুই পা একসাথে নামিয়ে দিয়েছেন।

সংগৃহীত এক খ্রিস্টান দম্পতির মুখ দিয়ে বের করিয়েছেন জঙ্গিরা যদি কোরআন পড়তো, তাহলে জঙ্গি হতো না!

কথাটা কে বললো? – এক খ্রিস্টান ভদ্রলোক।

ইমরান কিভাবে জানলেন? – না না, এটা সংগৃহীত।

এর আগে এমন জিনিস কোথায় পাওয়া গেছে? – বিভিন্ন ইসলামিক প্রপাগান্ডা সাইটে ইংলিশ ভার্সন দেখা গেছে। আর বাংলা ভার্সন রেডিও মুন্না, রেডিও মুন্নি জাতীয় ফেসবুক পেইজে দেখা গেছে।

এধরনের গল্পগুলো কারা বানায়? – ইসলামের প্রচারের জন‍্য বিভিন্ন মুসলিম স্কলার এসব স্পিরিচুয়াল অদ্ভুত গল্প বানায়। যেমন ইসলাম নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে, অন‍্য ধর্মের প্রতি সহনশীল থাকতে বলেছে, ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম, এক পতিতা ওড়না ভিজিয়ে কুকুরকে জল খাইয়ে বেহেশতে গেছে, আরেক ডাকাত কঠিন শীতে তার কম্বলের নিচে বিড়ালকে ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে বেহেশতে গেছে… এরকম অনেক গল্প আছে। এটা শুধু ইসলাম না, প্রায় সব ধর্মেরই এধরনের ভাবগাম্ভীর্য ও ভাবমূর্তিময় চেতনাপ্রদায়ক গল্প আছে।

ইমরান কি মুসলিম স্কলার? – না, উনিতো সেকুলার মুভমেন্টের নেতা।

তাহলে তিনি ধর্ম প্রচারকের মত কথা বলছেন কেন? – সেই প্রশ্নতো আমারও!

মুফতি হান্নান, মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি, এরা কি কোরআন না পড়ে মুফতি হয়েছে? – কীসব আবোল তাবোল বলছেন, মুফতি হতে হলে শুধু কোরআন পড়লেই হয় না, বুঝতেও হয়।

সাঈদী কি কোরআন পড়েছে? – সে তো কোরআনের তাফসীর (বিশ্লেষণ) করে। না পড়ে ক‍্যামনে?

তার মানে তুমি বলছো কোরআন পড়লেই মানুষ জঙ্গি হয়? – এটা কখন বললাম? আজিব! বরং ইমরান সরকারের সংগৃহিত খ্রিস্টান ভদ্রলোক বলেছেন জঙ্গিরা কোরআন পড়েনি, পড়লে জঙ্গি হতো না। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি জঙ্গিরা অবশ‍্যই কোরআন পড়ে। কোরআন হাদিসের কথার আলোকে মানুষ মারে। এটা প্রমাণিত। রাহমানির বই পড়লেই বুঝবেন। আইএস এর বই, পেপার পড়লেও বুঝবেন।

তোমার কাছে কোন প্রমাণ আছে? – অনেক প্রমাণ আছে। দুইটা স‍্যাম্পল নিচে দেখেন।

ব্লগারদের হত‍্যা করতে মুসলমানদের উৎসাহ দিতে গিয়ে হাদিস ব‍্যবহার করেছে জঙ্গি নেতা মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি


বড় করে দেখার জন‍্য ক্লিক করুন

ব্লগারদের হত‍্যা করতে মুসলমানদের উৎসাহ দিতে গিয়ে হাদিস ব‍্যবহার করেছে জঙ্গি নেতা মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি


বড় করে দেখার জন‍্য ক্লিক করুন

ব্লগারদের হত‍্যা করতে মুসলমানদের উৎসাহ দিতে গিয়ে কোরআনের আয়াত ব‍্যবহার করেছে জঙ্গি নেতা মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানি


বড় করে দেখার জন‍্য ক্লিক করুন

৪,
খ্রিস্টান দম্পতির গল্পের পর ফেসবুকজুড়ে দারুন হাস‍্যরস, সমালোচনার সৃষ্টি হয়। আসলে এই হালকা ক‍্যাম্পেইন স্টোরিটি কোন ইসলামিক পেইজে পাবলিশ করলে নাস্তিকরা কিছু বলতো না। কিন্তু ইমরানের প্রোফাইলে পাবলিশড হওয়াতে সমস‍্যা। অথচ ইমরানের মুসলিম পরিচয়ও কোন সমস‍্যা নয়। এই মুসলিম ইমরানের প্রতিই নাস্তিকরা আস্থা রেখেছিলো। সমস‍্যার জায়গা আগেই বলেছি। ঠিক জঙ্গি হামলার সময় ইসলামের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা এবং গল্পের মেরিট। উনাকে কেন হঠাৎ করে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের পক্ষে ক‍্যাম্পেইনে নামতে হলো? মানুষজন সমীকরণ খুঁজতে লাগলো। একেকজন একেক সমীকরণ বের করে আনছে। এমপি ইমরান, মন্ত্রী ইমরান, গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা ইমরানসহ বেশ কিছু সমীকরণ। ইমরান এসব সইতে পারেননি। সইতে না পারে তিনি বাজারে আনলেন ‘উগ্র নাস্তিক’ লজিক। খুবই ঝামেলার কথা। উগ্র নাস্তিক কী? উগ্র নাস্তিক কারা?

বাংলাদেশে কোন নাস্তিক কখনো মসজিদে মন্দিরে হামলা করেছে? কখনো কোন ধার্মিককে আক্রমণ, আহত বা নিহত করেছে? উগ্র (!) আস্তিকদের তালিকা বানিয়ে প্রকাশ করেছে? সামরিক আস্তানা বানিয়েছে? কোথাও দাঙ্গার ডাক দিয়েছে? – প্রত‍্যেকটি প্রশ্নের জবাব ‘না’। তাহলে উগ্র নাস্তিক কারা? ইমরানের বক্তব‍্যে পাওয়া যায়, যারা ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ায় তারা উগ্র নাস্তিক, যারা ছড়ায় না তারা শুধু নাস্তিক অথবা ভালো নাস্তিক। এবার একটু ক্লিয়ার হওয়া যায়। ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়ানো। খুবই ভয়ংকর জিনিস। ধর্মের বিষয়ে নাস্তিকদের কোন কথাটি ধার্মিকরা পছন্দ করবে? যেমন, ‘মুহম্মদ শিশু বিয়ে করেছে। সে চরিত্রহীন।’ মুহম্মদ শিশু আয়েশাকে বিয়ে করেছে এটা সত‍্যি কথা। আমাদের সমাজে কোন বৃদ্ধ লোক শিশু বিয়ে করলে আমরা তাকে চরিত্রহীন বলি, লম্পট বলি। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। এখন মুহম্মদের ক্ষেত্রে এই সত‍্য কথাটি ঠিক কতজন ধার্মিক ঘৃণা এবং বিদ্বেষ হিসেবে দেখবে না? ইমরানের উগ্র নাস্তিক সংজ্ঞার কোন তলা নেই। নাস্তিকরা ধর্ম নিয়ে কথা বললে ধার্মিকদের কাছে সেটা ঘৃণা আর বিদ্বেষ হিসেবে ধরা দেয়। এটা ইমরানও জানে। তবুও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন‍্য তিনি এই টার্মটি নিয়ে আসেন।

৫.
পরপর একাধিক ভুল করে মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে এবার অনেক ভুল করে বসলেন। অনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে আসলেন।

উনার আবিষ্কৃত উগ্র নাস্তিকরা নাকি বলে ‘ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ মানেই জঙ্গি এবং ধর্মগ্রন্থ পড়লেই নাকি মানুষ জঙ্গি হয়।’ তারপর বললেন উগ্র নাস্তিক আর জঙ্গিদের বক্তব‍্য স্পন্সর, লক্ষ, উদ্দেশ‍্য সব এক। এমনকি উনার ধারণা উৎপাদনের কারখানাও এক!

‘ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ মানেই জঙ্গি এবং ধর্মগ্রন্থ পড়লেই নাকি মানুষ জঙ্গি হয়।’ কয়জন নাস্তিক এ কথা বলেছে, উনার কাছে প্রমাণ চাইলে কয়টা দিতে পারবেন, সন্দেহ আছে। নাস্তিকদের এমন কথাবার্তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কোন আড়োলন সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানি না। বরং সিলেটের শিববাড়িতে জঙ্গি হামলা এবং অভিযান নিয়ে তুমুল আড়োলন সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে তিনি হঠাৎ নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ব‍্যয়বীয় অভিযোগ আনতে ব‍্যস্ত হলেন কেন?

ঠিক কিভাবে নাস্তিক আর জঙ্গিদের বক্তব‍্য এক হয় আমার মাথায় আসে না। স্পন্সর হয়তো এক হতে পারে। যেমন উনি যদি একই সাথে একজন জঙ্গি ও আরেকজন নাস্তিককে টাকা দিয়ে সাহায‍্য করেন, তাহলে ওই নাস্তিক ও জঙ্গির একই স্পন্সর হলো। কিন্তু লক্ষ‍্য ও উদ্দেশ‍্য? জঙ্গিদের উদ্দেশ‍্য ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। নাস্তিকদেরও একই উদ্দেশ‍্য?!

নাস্তিকরা ইসলামি খিলাফত চাইছে আবার খিলাফতের লোকরা নাস্তিকদের মারছে, ইমরান এটা বলতে চান? – মনে হয় এটা বলতে চান না।
তাহলে কি বলতে চান? – তিনি আসলে কিছুই বলতে চান না। খ্রিস্টান দম্পতিকে দিয়ে গল্প বলিয়ে যে প‍্যাঁচে পড়েছেন, ওই প‍্যাঁচ থেকে বের হতে চান।
বের হতে পেরেছেন? – উপুর্যপরি প‍্যাঁচ খেয়ে যাচ্ছেন।

ইমরানকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে সমস‍্যা

ইমরান এইচ সরকার তার সংগৃহীত খ্রিস্টান দম্পতিকে দিয়ে বলিয়েছেন জঙ্গিরা কোরআন পড়ে না। কিন্তু সরকারকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে তার ঘনিষ্ঠ কর্মী সঞ্জীবন সুদীপ জনতার কাছে প্রশ্ন রেখেছেন “আপনাদের কি মনে হয় কোরআন জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়?” এই পোস্টের কমেন্টের ঘরে কমেন্টকারীদের ত‍্যানা না পেঁচাতে অনুরোধ করেছেন। অথচ তার পোস্টটিই একটি ত‍্যানা। ‘জঙ্গিরা কোরআন পড়ে না, পড়লে জঙ্গি হতো না’ এই কথার সমালোচনা মানে কিন্তু ‘কোরআন পড়ে মানুষ জঙ্গি হয়’ নয়। ইমরান এইচ সরকারের গল্পের সমালোচনার অর্থ হচ্ছে ‘জঙ্গিরা কোরআন পড়ে এবং কোরআন কারো জঙ্গি হওয়া ঠেকাতে পারে না।’ ইমরান এইচ সরকার তার তলাহীন গল্পের ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন যে, ‘নাস্তিকরা দলে দলে বলে বেড়ায় ধর্মগ্রন্থ মানুষকে জঙ্গি বানায় এবং মুসলিম মানেই জঙ্গি!’ এটা এক ধরনের ব‍্যর্থ চালাকি।

এখানে সুদীপের প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, জঙ্গিরা কোরআন পড়ে। কোরআন যেহেতু কারো জঙ্গি হওয়া ঠেকাতে পারে না এবং জঙ্গিরা যেহেতু কোরআনের আয়াত, হাদীস উল্লেখ করেই মানুষ খুন করে, সেহেতু অবশ‍্যই ধর্মগ্রন্থ (কোরআন) জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়।

এতক্ষণে কাজের কাজ হয়েছে। উগ্র নাস্তিকের উদাহরণ পাওয়া গেছে এবং ডেফিনেশনের প্রসঙ্গ এসেছে। সুদীপের এই বক্তব‍্যে ইমরান এইচ সরকার একমত, নিচে লাইক দেখা যাচ্ছে। তো, আমরা জানতে পারলাম অভিজিৎ রায় উগ্র নাস্তিক নয়, আসিফ মহিউদ্দিন উগ্র নাস্তিক। শফি হুজুরের ডেফিনেশনে অভিজিৎ রায় উগ্র নাস্তিক হলেও ইমরানের ডেফিনেশনে অভিজিৎ রায় উগ্র নাস্তিকের মধ‍্যে পড়েন না। ভাগ‍্যিস, অভিজিৎ রায়কে ইমরান তার ডেফিনেশনের বাইরে রেখেছেন। নইলে কী যে হতো! ইমরানের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। তিনি অভিজিৎ রায়ের মান সম্মান রক্ষা করেছেন।

অথচ অভিজিৎ রায় সেই ২০০১ সালে মুক্তমনা সাইট প্রতিষ্ঠা করেছেন, যে মুক্তমনার হাত ধরে বাংলা অনলাইন অবিশ্বাসীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে। বিষয়টা এমন নয় যে, মুক্তমনা না থাকলে অবিশ্বাসীদের পদচারণা হতো না। বরং বিষয়টা এমন যে মুক্তমনা এই মুখরিত অগ্রযাত্রায় সহায়তা করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। এই মুক্তমনা সাইটে শুধু বিজ্ঞান, বিবর্তন, ইতিহাস, সমাজ এবং বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়ে নয়, বরং নবী এবং অন‍্যান‍্য ধর্ম প্রবর্তক, প্রচারকদের যৌন জীবন থেকে শুরু করে, হত‍্যা, খুন, লুটপাট, ধর্ষনের ইতিহাস বর্ণিত ছিলো। মুহম্মদকে লম্পট বললে ক’জন মুসলিম সহ‍্য করতে পারে? খুনী, লু্টপাটকারী, ধর্ষক বললে ক’জন মুসলিম সহ‍্য করতে পারে? অভিজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত সাইটে এসব সত‍্য প্রকাশিত হয়েছে। নিজেও লিখেছেন। তবুও ইমরান অভিজিৎ রায়কে উগ্র নাস্তিক বলছে না। এখন শফি হুজুরের ডেফিনেশনে ইমরান এইচ সরকারও উগ্র নাস্তিক হয়ে যাচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে এক মুসলমান অপর মুসলমানক উগ্র নাস্তিক বলবে!

আসিফ মহিউদ্দিন উগ্র নাস্তিক, কারণ তিনি কাবা শরীফে রং লাগিয়েছেন! কিসের রং লাগিয়েছিলেন? সাম‍্যের রং, মানবতার রং। সমকামী, উভয়কামী এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সারা বিশ্ব সেদিন রঙিন ছিলো। আসিফ মহিউদ্দিনের প্রত‍্যাশা কাবা শরীফও যদি রঙিন হতো! হ‍্যাঁ ইসলাম যদি LGBT অধিকার মেনে নেয়, তাহলে পৃথিবীর বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাঝে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। পৃথিবীর মোট জনসংখ‍্যার ২৩ শতাংশ মুসলমান। প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ!

মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আশায় কেউ যদি কাবা শরীফকে ফটোশপে রঙিন করে তোলে, তবে সেটা উগ্রতা নয়। সুন্দর ও সাম‍্যের আহবান।

তো, উগ্র নাস্তিকের সংজ্ঞা কিংবা উদাহরণ শফি হুজুর দিক আর নন হুজুর ইমরান দিক, গন্ডগোল আছে। সুদীপের এমন স্পষ্ট উদাহরণের মাধ‍্যমে একটি অস্পষ্ট শংকায় শংকিত হলাম। ইমরান কি ভবিষ‍্যতে উগ্র নাস্তিকদের তালিকা প্রকাশিত করে প্রতিরোধের ডাক দিবেন? শফি হুজুরদের ডেফিনেশন আছে, ইমরানেরও আছে। হুজুরদের ডেফিনেশন অনুযায়ী তাদের বানানো উগ্র নাস্তিকের তালিকা আছে, ইমরানের কেন থাকবে না!

নাস্তিকতা কি আসলেই জঙ্গিদের সমান্তরালে?
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নাস্তিকরা ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়ে কোন ধর্মের লোকদের উপর হামলে পড়েছে? কারো বসতি জ্বালিয়েছে? মসজিদ মন্দির ভেঙ্গেছে? নিদেনপক্ষে কাউকে একটা ধাক্কা দেয়ার ঘটনা শুনেছেন? না, শোনেননি। নাস্তিকরা এসব করেনি, করছে না, করবেও না। এসব কাজ ধার্মিকদের। হুমায়ুন আজাদ কথাটি খুব সুন্দর করে বলে গেছেন, “মসজিদ ভাঙে ধার্মিকেরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকেরা, তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক, আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক।”

তাহলে কেন ‘উগ্র নাস্তিক’ আর জঙ্গিকে একই সমান্তরালে দেখছেন ইমরান এইচ সরকার? আচ্ছা, তবুও যদি উনি তুলনা করার গোঁ ধরেনই ধরেন, তাহলে উনার জন‍্য একটা সংগৃহীত তুলনা আমি সরবরাহ করতে পারি। ফেসবুকে দেখেছি একজনকে এই তুলনাটা করতে, উনার নাম মনে নেই। তিনি বলতে চেয়েছেন, “ধর্মের প্রতি নাস্তিকদের ঘৃণা বা বিদ্বেষ জঙ্গিদের সাথে তুলনা করা যায় না। বড়জোর মোল্লাদের ওয়াজে ছড়ানো ঘৃণার সাথে তুলনা করা যায়।” এই তুলনাটা ইমরান এইচ সরকারকে সাহায‍্য করতে পারে। তিনি খুশি হবেন।

তবুও, নাস্তিকদের লেখালেখির কারণেই কি বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা হচ্ছে?
জঙ্গিরাতো এমনটি বলছে না। বলছে না সামরিক বিশেষজ্ঞরা। এসব কথা বলার চেষ্টা করেছেন রাজনৈতিক ব‍্যক্তিরা। ওই যে, ব‍্যারিস্টার মওদুদের ভাষা “এটা রাজনৈতিক বক্তব‍্য।” অন‍্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর স্বভাব।

কয়েকজন প্রয়াত নাস্তিকের নাম বলি। আরজ আলী মাতুব্বর, আবুল মনসুর আহমদ, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ। এরা প্রত‍্যেকেই নিজ সময়ের সেরা চিন্তাবিদ। আরজআলী মাতুব্বর তার প্রশ্নের আঘাতে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করেছেন ধর্মের দেয়াল। আবুল মনসুর আহমদ ধর্ম নিয়ে কত ঠাট্টা মশকরাই না করলেন! জোরালো সব যুক্তির মাধ‍্যমে প্রচলিত সমাজ, ধর্ম বিশ্বাসকে দৃঢ়কণ্ঠে অস্বীকার করেছেন বাংলা সাহিত‍্য সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে উজ্জ্বল নক্ষত্র আহমদ শরীফ। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মোল্লাদের চরিত্র নিয়ে জ‍্যোতির্ময় সমালোচক হুমায়ুন আজাদের চেয়ে কড়া কথা আর কেউ বলেনি। এবার বলেন উপরোক্ত ব‍্যক্তিদের কার সময়ে কয়টি জঙ্গি সংগঠন ছিলো? এখন কয়টা আছে?

কিভাবে জঙ্গি সংগঠন মাথাচড়া দেয়, কিভাবে এর সংখ‍্যা বাড়তে থাকে, এটা কারোরই অজানা নয়। আমারতো মনে হয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ মাথাচড়া দিয়ে উঠার ফলে ধর্মের অসারতা ঠেলে বেরিয়ে আসার কারণে ধর্মের প্রতি মানুষের ঘৃণা বিদ্বেষও বাড়ছে। আগে দূর দেশে এসব হতো। মানুষ বিবিসি ভয়েস অব আমেরিকার খবরে শুনতো। এখন চোখের সামনে ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে দিনে দিনে বাংলাদেশে ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ‍্যা বাড়তেই থাকবে এবং বেশ জোরেশোরেই বাড়বে। এত অনাচার, হত‍্যা, খুন, রক্তারক্তি মানুষ কতদিন পর্যন্ত সইতে পারবে?

তারপরও যদি মনে করে নাস্তিক ব্লগারদের কারণেই জঙ্গিরা হামলা করতে উৎসাহবোধ করছে, তাহলে একটু মনে করার চেষ্টা করুন ১৯৯৯ সালে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলার সময়, ২০০২ সালে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলার সময়, ২০০৫ সালে ৬৪ জেলায় বোমা হামলার সময় নাস্তিক ব্লগাররা কোথায় ছিলো? বাংলা ভাইরা কি ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে উত্তরবঙ্গে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলো? তারপর থেকে এই পর্যন্ত কিভাবে এই জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে, কিভাবে আজ জঙ্গিরা র‍্যাব, সোয়াট, সেনাবাহিনীকে ৪ দিন ধরে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর শক্তি অর্জন করেছে, এর পেছনে কার কতটুকু দায় এটা বুঝতে পারা খুব কঠিন কিছু নয়। এই দৈত‍্য দানব নির্মাণে ব্লগারদের কোন দায় নেই, বরং এই দানব নির্মূলে নাস্তিক ব্লগারদের ভূমিকা অগ্রগণ‍্য।

ইমরানের সমসাময়িক এসব তৎপরতা ভুল
ইমরান কেন ধর্ম প্রচারকের ভূমিকায়? কারণ বিষয়টা রাজনৈতিক। তিনি রাজনীতিতে আসবেন, এটা পুরোনো কথা। রাজনীতিতে আসার ঘটনাটা হয়তো নিকট ভবিষ‍্যতেই ঘটবে। তার জোর প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু প্রস্তুতির অবস্থা খুব খারাপ, বুঝা যাচ্ছে। তিনি হয়তো ভেবেছেন জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা এবং হাসিনার কথা। প্রত‍্যেকেই ধর্মের কার্ড খেলেছেন এবং সফল হয়েছেন। হাসিনা প্রথমবার খেলে ব‍্যর্থ হলেও এবার মোটামুটি সফল বলা যায়। জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ স্বৈর শাসক। খালেদা এক স্বৈর শাসকের বানানো দোকানে দোকানদারি করছেন। শেখ হাসিনা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সন্তান। তাদের প্রত‍্যেকের প্লাটফর্ম এবং ব‍্যাকগ্রাউন্ড শক্তিশালী।

ইমরানের একমাত্র পরিচয় তিনি গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র। যে গণজাগরণ মঞ্চ ইসলামি রাজনৈতিক দল জামায়াতের নেতা কসাই বিরোধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠেছিলো। যে গণজাগরণ মঞ্চকে দমিয়ে দিতে হেফাজতে ইসলাম রাজপথে ত্রাস সৃষ্টি করেছে। যে গণজাগরণ মঞ্চকে এই দেশের ইসলামি রাজৈনিতক দল ও সংগঠনগুলো নাস্তিক, মুরতাদ আখ‍্যা দিয়েছে। তো, এখন ইমরান এইচ সরকার খেলবে ধর্ম কার্ড? ধর্ম খেলে তিনি রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন? এটা কল্পনারও অতীত। হ‍্যাঁ, স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকা আওয়ামীলীগও এখন ধর্মের লেবাস পরেছে। সফলও (!) হয়েছে। এই সফলতা দলটিকে ক্ষমতার স্থায়িত্ব দিয়েছে। আর দেশকে কী দিয়েছে? কয়েক ডজন সক্রিয় জঙ্গি গোষ্ঠী। দেশটাকে জঙ্গির খামারবাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে জিয়ার রোপন করা মৌলবাদের রাজনীতি এরশাদের হাত ঘুরে খালেদার হাতে এসে জঙ্গিবাদে রূপ নেয়া সেই দানব শেখ হাসিনার প্রত‍্যক্ষ আশ্রয় প্রশ্রয়ে সারা দেশে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে।

এখন নতুন কেউ রাজনীতিতে এসে যদি একই কাজ করে, তার সুর যদি নিকট অতীতের খালেদা হাসিনার সাথে মিলে যায়, তাহলে সেই নতুন নেতাকে মানুষ কেন স্বাগত জানাবে। অলরেডি বিএনপি আওয়ামীলীগের মত দুই সফল খামারিতো আছেই! ইমরানকে মৌলবাদীরা যেমন বিশ্বাস করবে না, প্রগতিশীলরাও কাছে ঘেঁষতে দিবে না। হ‍্যাঁ এরশাদের মত গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা কিংবা খালেদা হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করে যেতে পারবেন। এটা যদি ইমরানের স্বপ্ন হয়, তাহলে তিনি সেই স্বপ্নের দরজার একেবারে সামনে আছেন। কড়া নাড়লেই খুলে যাবে।

ভুল অবস্থান নেয়ার কারণ
কারণ তিনিই ভালো জানেন। আমরা শুধু অবস্থার বিচারে সম্ভাব‍্য কিছু কারণ ধারণা করতে পারি।
প্রথমত একজন তাজউদ্দিনের অভাব। তাজউদ্দিন আহমেদ শুধু একজন ব‍্যক্তি নন, একটা অধ‍্যায়ের নাম। নিজের নেতাকে সঠিক পথে রাখার জন‍্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছেন এই ব‍্যক্তি। যতটা না শত্রুর সাথে লড়তে হয়েছে, তারচে বেশি শ্রম দিতে হয়েছে নেতার চলার পথ ঠিকঠাক করার কাজে। ইমরান এইচ সরকারের দুর্ভাগ‍্য, তিনি একজন তাজউদ্দিন পাননি। হয়তো আশেপাশে ছিলো, চিনতে পারেননি। চিনতে পারলেও রাখতে পারেননি, অথবা রাখেননি। এমনও হতে পারে এই সময়ে তাজউদ্দিনের মত কেউ নেই। থাকলে গুটিসুটি মেরে হলেও সম্ভাবনাময় এই নেতার পাশে থাকতেন।

দ্বিতীয়ত সাহসের অভাব। ইমরানের শুধু আকাংখা আছে, সাহস নেই। সাহসের অভাবে সবচে সহজ এবং খেলো অথচ নিশ্চিত ব‍্যর্থ উপায় বেছে নিয়েছেন।

তৃতীয়ত আওয়ামী ব‍্যাকগ্রাউন্ড। ইমরান এইচ সরকার আওয়ামী রাজনৈতিক বলয় থেকে উঠে আসা মানুষ। যে বলয়ে শেখ হাসিনা ছিলেন ইমরানের রোল মডেল, মাতৃতুল‍্য মহিয়সী। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের কলরব থেমে যাওয়ার পর, ধীরে ধীরে মানুষজন যার যার কাজে ফিরে যাওয়ার পর ইমরানের মন ও মনন আবার আওয়ামী বলয় ঘিরে ধরেছে। শেখ হাসিনার দেখানো পথই ইমরানের পাথেয় হয়েছে।

এটা জাস্ট ব‍্যাখ‍্যা বিশ্লেষণের চেষ্টা মাত্র। আমি জানি না ইমরান ঠিক কী কারণে জঙ্গিবাদের এই সময়ে ধর্ম প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

সঠিক অবস্থান কী হতো?
এতক্ষণ ধরে একটা মানুষের ভুল নিয়ে কত রকমের কথা বলেছি, সুতরাং সঠিকটা কী হতো সেটা বলে দেয়া উচিত। এটা আমার দায়। কিন্তু আমিতো আর এই লেখায় উল্লেখিত ইমরান এইচ সরকারের ৫টি ফেসবুক স্ট‍্যাটাসের বিকল্প লিখে দিতে পারবো না। শুধু বলতে পারবো তার বক্তব‍্য বিবৃতি ঠিক কেমন হওয়া উচিত ছিলো। উচিত ছিলো মানে তার স্বপ্ন এবং মানুষের প্রত‍্যাশার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতো।

যেহেতু তিনি তার মুসলমান পরিচয়কে বড় করে দেখছেন এবং নিজে একজন জঙ্গিবাদ বিরোধী মুসলমান, সেহেতু তার উচিত বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ মুসলমানদের সাথে নিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার চেষ্টা করা। টাইমিংটা ছিলো খুব সুন্দর। মুসলমানদের চোখের সামনে জঙ্গিবাদের তান্ডবলীলা। রক্তপাতের এই সময়ে মানুষকে বুঝানো অপেক্ষাকৃত সহজ। এমনিতেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা নাস্তিকদের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। তারা সহায়তা করতে পারে। কিন্তু কাজটা করতে হবে মুসলমানদেরকেই।

এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বরং বেটার কাজ করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সকল ধর্ম মতের মানুষের প্রতি ঐক‍্যের ডাক দিয়েছেন। যদিও এটা জয়ের দলের কর্মকান্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবুও তিনি তা করেছেন। কিন্তু ইমরান এইচ সরকার সেই কাজটি করতে ব‍্যর্থ হয়েছেন, অথচ জঙ্গি হামলার সময় এমন ঐক‍্যের ডাক দেয়ার মত ব‍্যাকগ্রাউন্ড তার ছিলো।

ইমরানকে কেন ছাড় দেয়া উচিত নয়
ইমরানের প্রতি নানান ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকা সত্বেও, কিংবা বিভিন্ন কারণে ইমরানকে অপছন্দ করার পরও অসংখ‍্য মানুষ মনের ভেতর একটু আশা রেখেছিলেন এই ভেবে যে, ইমরান রাজনীতিতে আসলে হয়তো প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক মানুষদের কথা বলার একটা প্লাটফর্ম হবে। এই আশাটুকুন বর্তমান বাংলাদেশের জন‍্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমরান সেই আশায় থোড়াই কেয়ার করবেন কিনা, এটা তার ব‍্যাপার। ইমরান যদি পূর্ববর্তী রাজনীতিবিদদের মত আপোষ আর ধর্ম নিয়ে খেলায় মেতে উঠতে চায়, তাকে সাথে সাথে থামানো উচিত। নইলে আশা মরে যায়। এজন‍্যই ইমরানকে ধর্ম প্রচারকের ভূমিকায় দেখে প্রচুর মানুষ বিরক্ত হয়েছে, শংকিত হয়েছে। তাই ইমরানকে চেপে ধরেছে। ইমরানের সাথে এসব মানুষের কোন ব‍্যক্তিগত বৈরিতা নেই, সম্পত্তির ভাগাভাগির প্রশ্ন নেই, প্রেমিকা ভাগিয়ে বিয়ে করে ফেলার ঘটনাও নেই। মানুষ কেবল তাদের প্রত‍্যাশার মৃত‍্যু ঠেকাতে একটা ঝাঁকি দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে ইমরান যে পথে যাচ্ছে, সেটা ইমরানের পথ নয়। মানুষ এটা মনে করে না।

ইমরান ভাগ‍্যবান যে, তিনি বিটিভি যুগের নেতা নন। তার সময়ে সামাজিক গণমাধ‍্যম আছে। ইমরান যদি নিজেকে রক্ষা করতে চায়, তাই এই সামাজিক গণমাধ‍্যম ইমরানের রক্ষাকবচ। এর উল্টোটাও সত‍্যি। ইমরান হারিয়ে যেতে চাইলে এখানেই হারিয়ে যেতে পারে। হারিয়ে যাওয়ার জন‍্য বিশাল দিগন্ত খোলা পড়ে আছে।

নাস্তিক ব্লগারদের নিয়ে লুকোচুরি খেলা উচিত নয়
নাস্তিক ব্লগারদের পরিচয় এবং লেখালেখি নিয়ে লুকোচুরি খেলা উচিত নয়। শাহবাগে ব্লগার রাজীবের জানাযাকে আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শন হিসেবে দেখার সুযোগ আছে। ধার্মিকরা যদি একজন নাস্তিককে এই রীতিতে সম্মান জানাতে চায়, এতে অসুবিধার কিছু দেখি না। কিন্তু রাজীব নাস্তিক ছিলো না, এমনটি বলার ক্ষেত্রে মারাত্মক অসুবিধা আছে। একইভাবে অভিজিৎ রায় থেকে শুরু করে ওয়াশিকুর বাবু, সব নাস্তিককে অনাস্তিক বা ভালো নাস্তিক বানিয়ে দেয়ার মাধ‍্যমে বাক স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার ভয়াবহ ক্ষতি হয়।

শাহবাগে যদি বলা হয় রাজীব নাস্তিক ছিলো না, তাহলে প্রমাণিত হয় নাস্তিকতা আসলেই খারাপ। বাক স্বাধীনতার একটা মাপকাঠি সৃষ্টি হয়ে যায়। ধর্মের সমালোচনা করাটা সামাজিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। নইলে রাজীবের নাস্তিকতা কেন অস্বীকার করা হচ্ছে? কেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা নামক শাক দিয়ে নাস্তিকতা নামের মাছটিকে ঢেকে দেয়া হচ্ছে? নিশ্চয় নাস্তিকতা খুব খারাপ! মানুষের মাঝে এমন ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

এরকম লুকোচুরি খেলা যাবে না। বলতে হবে নাস্তিক হোক আর আস্তিক হোক, কোন মানুষের মত প্রকাশের জন‍্য কাউকে খুন করা যাবে না, আক্রমণ করা যাবে না। আইনের শিকলে চিন্তা চর্চা বেঁধে রাখা যাবে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে এটাই বলতে হবে, একমাত্র এই গানই গাইতে হবে।

নাস্তিকদের নামে স্মৃতিফলক নির্মাণে নৈতিক জোর নেই
যে স্থানে অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন, গণজাগরণ মঞ্চ সেই স্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে কিছুদিন আগে। যাদের স্মরণে এই ফলক নির্মাণ করতে যাচ্ছে, তারা প্রত‍্যেকেই ইমরান এইচ সরকারের ডেফিনেশন অনুযায়ী উগ্র নাস্তিক। তার কয়েক ডজন প্রমাণ আছে। ইমরানের যুক্তি অনুযায়ী তারা সবাই জঙ্গি সমতূল‍্য। ইমরান এইচ সরকার কিভাবে জঙ্গিতূল‍্য মানুষদের জন‍্য ফলক নির্মাণ করবেন? এটা কি উচিত?

আরেকটি বিষয়। নিজের প্রয়োজনমত তলাহীন সংজ্ঞায় কোন নাস্তিক ব্লগারকে ভালো নাস্তিক বানিয়ে প্রগতিশীলদের সামাল দিবেন, আবার কোন নাস্তিককে উগ্র নাস্তিক বানিয়ে ধর্মান্ধদের বুকে টানবেন, এই চেষ্টা আত্মঘাতি। দয়া করে এমনটি করবেন না।

আলুপোড়া খাওয়াদের ভূমিকা
এবার আসি আলুপোড়া খাওয়াদের ভূমিকায়। ইমরান এইচ সরকারের সংগৃহীত খ্রিস্টান দম্পতির গল্পের অবতারণা হওয়ার পর প্রচুর মানুষের দেখা পাওয়া গেছে, যারা ইমরানকে অনেক আগেই ‘চিনেছে’ তাই ইমরানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন যারা ‘চিনছে’ তারা বোকা। কারণ দেরিতে চিনেছে। এসব কথা যারা বলে বেড়াচ্ছে, ব্লগের ভাষায় তাদেরকে বলা হয় আলুপোড়া খাওয়া। এসব আলুপোড়া খাওয়া কয়েকজনকে ব‍্যক্তিগতভাবে চিনি। উনাদের একেকজন একেক কারণে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছিলো। সেসব কারণের কোনটির সাথেই প্রগতিশীলতা জড়িত ছিলো না। তারা যেভাবে ইমরানকে চিনেছেন, আর এখন ইমরান যে কারণে সমালোচিত হচ্ছেন, দু’টোর সাথে কোন মিল নেই। সুতরাং মুখে লেগে থাকা পোড়া আলু মুছে ফেলুন। একটু দম নেনঅ

আরেকপক্ষ আছেন। উনাদের নাম দিয়েছি “তালিবাদী।” উনারা খালি তালি বাজান। আর কোন কাজ নেই। অন‍্যরা কাজ করে, উনারা তালি বাজান। অন‍্যরা সফল হয়, উনারা তালি বাজান। অন‍্যরা ব‍্যর্থ হয়, উনারা তালি বাজান। অন‍্যরা বিশ্রাম নেয়, তারা তালি বাজান। তাদের কোন বিশ্রামও নেই। অক্লান্ত তালিবাদক। কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে উনাদের তালির শব্দে টেকা মুশকিল।

শেষ করি
আপনি পুরোনো পলিটিশিয়ান হোন আর নতুন হোন, মুসলিম দেশে নেতৃত্ব দেয়া স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কঠিন। তবে বাংলাদেশের জন‍্য একটু সহজ। কারণ অতীতে অনেক মুসলিম দেশ ধর্মীয় প্রভাব ও জঙ্গিবাদের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। শিক্ষা নেয়ার সুযোগ আছে। ক্ষমতায় থাকার জন‍্য মোল্লাদের হাতে হাত মিলিয়ে কার কী পরিণতি হয়েছে জানুন, ইতিহাস পড়ুন।

কমিউনিস্ট নজিবুল্লাহকে সরানোর জন‍্য আফগানরা মৌলবাদীদের বুকে জড়িয়ে এখন কী পরিণতি ভোগ করছে দেখুন।

পাকিস্তানের সামরিক সরকারগুলো ক্ষমতায় থাকার জন‍্য ধর্মকে রাষ্ট্রীয়করণ করে এখন কোন আগুনে জ্বলছে দেখুন।

সিরিয়ার বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ সেক্যুলার সরকার হয়েও মোল্লাদেরকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তিনি ভেবেছেন মোল্লারা বিষহীন সাপ। তাদেরকে দিয়ে প্রতিপক্ষ সেক্যুলারদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। এখন সেই সিরিয়া আজ যুদ্ধবিধ্বস্ত এক বধ‍্যভূমি। যার আগুনের উত্তাপ ইউরোপেও লেগেছে। শরণার্থীর ঢল নেমেছে।

বাঙালি কোথায় যাবে? যশোর রোড আজ ইতিহাস। ভারত নাকি এখনই সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা করছে। বঙ্গোপসাগরের পলিমাটি মেশা ঘোলাজলে রক্ত মেশাতে না চাইলে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। রাজনীতিতে ধর্মের গুটিবাজি করার চিন্তা ভুলেও করবেন না। একদমই না।

———
নোটঃ
পোস্টে উল্লেখেতি সকল তথ‍্য #সংগৃহীত