ইউভাল নোয়া হারিরি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পিএইচডি এবং বর্তমানে ইসরাইলের জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। তার গবেষণার বিষয় বিশ্ব-ইতিহাস। ইতিহাস এবং জীববিজ্ঞানের আন্তঃসম্পর্ক, ইতিহাসে ন্যায়বিচারের স্থান আছে কিনা, ইতিহাস চর্চা থেকে মানব-জীবনের সমৃদ্ধি আসে কিনা তা নিয়ে হারিরি গবেষণা করে থাকেন। তার প্রথম বই ‘স্যাপিয়েন্স'(২০১১) ২৬টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ফ্রান্স, চীন, কোরিয়াসহ অন্যান্য অনেকে দেশে সবচেয়ে বিক্রীত বইয়ের তালিকার প্রথমে চলে আসে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় বইয়ের নাম ‘হোমো ডিউস’

৩১ জানুয়ারি, ২০১৫-তে লেখা এই ইউভাল নোয়া হারিরির এই লেখাটা (https://www.theguardian.com/books/2015/jan/31/terrorism-spectacle-how-states-respond-yuval-noah-harari-sapiens) এখনো বেশ প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী।

null

শব্দটার আভিধানিক অর্থ যেমনটা বলে আর কি, সন্ত্রাস (টেরর) একটা সামরিক কৌশল যেটা বস্তগত ক্ষতি করার চাইতে বরং ভয় ছড়িয়েই রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রায় প্রতিটা দুর্বল দলই এই কৌশলটা গ্রহণ করেছে, শত্রুদের সম্পত্তিগত ক্ষতি খুব একটা করার ক্ষমতা যারা ধরে না। প্রতিটা সামরিক আক্রমণেই যে ভয় ছড়ায় সেটাও মিছে নয়। কিন্তু প্রথাগত যুদ্ধবিগ্রহে, ভয় হল বস্তুগত ক্ষতির একটা উপজাত, আর সাধারণত ক্ষতিকারী শক্তির সমানুপাতিক। সন্ত্রাসবাদের বেলায়, মূল কাহিনিটাই হল ভয়, আর সন্ত্রাসবাদীদের আসল শক্তির সাথে তাদের সৃজিত ভয়ের বৈসাদৃশ্যটা বিরাট রকমের।
সহিংসতা দিয়ে রাজনৈতিক পটভূমি বদলে-দেওয়া খুব একটা সহজ নয়। সোমের যুদ্ধের প্রথম দিনেই, ১লা জুলাই, ১৯১৬, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নিহতের সংখ্যা ১৬,০০০ এবং আহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০,০০০। নবেম্বরে যুদ্ধটা যখন শেষমেষ খতম হয়, দুপক্ষের মোট হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় নিযুতাধিক, যার মধ্যে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। এই অকল্পনীয় রক্তক্ষয়ের পরেও ইউরোপের রাজনৈতিক ভারসাম্য বিশেষ বদলায়নি। শেষমেষ কিছু একটা হওয়ার জন্যে সময় লেগেছিল আরো দুবছর, ও লক্ষ লক্ষ বাড়তি হতাহতের।
সোমের ক্ষয়ক্ষতির সাথে তুলনা করলে, সন্ত্রাসবাদ তো নিতান্ত বালখিল্য একটা ব্যাপার। আজকাল বেশিরভাগ সন্ত্রাসবাদীই অল্প কিছু মানুষকে আক্রমণ করে। ২০০২ সালে, যখন ইসরায়েলের বিপক্ষে প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ তুঙ্গে, যখন প্রতিটা দিনই বাস আর রেস্টুরেন্টের ওপর নেমে আসছে আঘাত, বছরশেষে দেখা গেল ইসরায়েলে মারা গেল ৪৫১ জন। একই বছর, কার দুর্ঘটনায় মারা গেছিল ৫৪২ জন ইসরায়েলি। হাতেগোনা কটা সন্ত্রাসবাদী হামলায়, যেমন ধরা যাক ১৯৮৮-তে লকারবিতে প্যান অ্যাম ১০৩ নং ফ্লাইটে হামলার ঘটনাটাই, শখানেক প্রাণ দেয়। ৯/১-এর হামলায় নতুন রেকর্ড হয়, মারা যায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ। এমনকি এসবও সাধারণ যুদ্ধবিগ্রহের তুলনায় তুচ্ছ: ১৯৪৫ থেকে সন্ত্রাসবাদী হামলায় যেকজন মারা গেছে এবং আহত হয়েছে সবার সংখ্যা যোগ করলেও – ওতে জাতীয়তাবাদী, ধর্মীয়, বামপন্থী, আর ডানপন্থী সব দলেরগুলো থাকবে – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যেকোনো বিস্মৃতপ্রায় লড়াইয়ের হতাহতের অনেকানেক নিচেই পড়ে থাকবে সেটা, যেমন এইনের তৃতীয় যুদ্ধ (হতাহত ২ লক্ষ ৫০ হাজার) কিংবা ইসোনজোর ১০ম যুদ্ধ (২ লক্ষ ২৫ হাজার)।
তো সন্ত্রাসবাদীরা খুব বেশি কিছু হাসিল করার আশা কিভাবে করে? একটা সন্ত্রাসবাদী হামলার পর, শত্রুর সৈন্য, ট্যাঙ্ক, আর যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা একই থাকে। শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তা, আর রেলপথের অবস্থা প্রায় একই থাকে। এর কলকারখানা, বন্দর, আর ঘাঁটিগুলোতেও হাত পড়ে না তেমন। তবে সন্ত্রাসবাদীদের আশা হল কি যদিও তারা শত্রুপক্ষের স্থাবর অস্থাবর সম্পদ আর ক্ষমতায় তেমন দাঁত ফুটোতে পারে না, ভয় আর বিভ্রান্তি ছড়িয়ে শত্রুকে তার শক্তি অপব্যবহার করাতে তারা পারবে। সন্ত্রাসবাদীরা তাই-চি ‍ওস্তাদদের মতন লড়াই করে: তাদের লক্ষ্য হল শত্রুকে শত্রুর নিজস্ব ক্ষমতা দিয়েই হারিয়ে দেওয়া। তাই ১৯৫০ সালে আলজেরিয়ায় ফ্রান্স এফএলএন-এর (FLN-Front de Libération Nationale =National Liberation Front) হাতে পরাজিত হয়নি, হয়েছে এফএলএন-এর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেদের দিকভ্রান্ত প্রতিক্রিয়ার কাছে। ইরাক আর আফগানিস্তানে আমেরিকার ধরাশায়ী হওয়ার কারণ মার্কিনিদের নিজেদের বিপুল শক্তির ভ্রান্ত ব্যবহার, আল-কায়েদার পুঁচকে পেশিফোলানো নয়।
সন্ত্রাসবাদীরা হিসেব করে যে যখন সংক্ষুব্ধ শত্রুপক্ষ তার বিশাল শক্তি তাদের বিপক্ষে ব্যবহার করে, তাতে করে সন্ত্রাসীরা নিজেরা যতটুকু না করতে পারত, তারচে অনেকগুণে বেশি করে সহিংস সামরিক ও রাজনৈতিক ধুলোঝড় তৈরি হয়। করা হয় ভুল, নেমে আসে নৃশংসতা, দোলাচলে থাকে জনমত, উঠতে থাকে প্রশ্ন, নিরপেক্ষরা পাল্টায় তাদের অবস্থান আর নড়ে ওঠে ক্ষমতার ভারসাম্য। সন্ত্রা্সবাদীরা আগেভাগে বলতে পারে না ফলাফল কী আসবে, কিন্তু রাজনৈতিক সাগর শান্ত থাকলে যেমনটা হত তারচে এই ঘোলা জলে মাছশিকারের সম্ভাবনা তাদের অনেক বেশিই থাকে।
নতুন করে তাসভাঁজা
সন্ত্রাসবাদ সামরিক কৌশল হিসেবে খুবই অনাকর্ষক, কারণ সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোই রয়ে যায় শত্রুর হাতে। যেহেতু সন্ত্রাসবাদীরা বড়সড় কোনো বস্তুগত ক্ষতি করতে পারে না, তাই সন্ত্রাসবাদী হামলার আগে শত্রুপক্ষের যতটা সামর্থ্য ছিল, তার পরেও তাইই থাকে. এবং ওখান থেকেই কিছু বেছে নিয়ে পাল্টা হামলা চালাতে তার বাধা থাকে না। সাধারণত সেনাবাহিনী যেকোনো পরিস্থিতিতেই এই অবস্থাটা এড়াতে চায়। তারা যখন আক্রমণ করে, তখন তারা শত্রুপক্ষকে পাল্টা হামলায় প্ররোচিত করে না, বরং শত্রুর প্রতিহিংসার ক্ষমতা ছেঁটে ফেলতে চায়, এবং বিশেষত, তার সবচে ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র আর ক্ষমতাগুলো ধ্বংস করে দিতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপানিরা পার্ল হারবারে ইউএস প্যাসিফিক নৌবাহরে হামলা চালায়, তারা একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল: মার্কিনিরা আর যাকিছুই করার সিদ্ধান্ত নিক না কেন, ১৯৪২ সালতক তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আর কোনো যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে পারছে না।
শত্রুর অস্ত্রশস্ত্র বা সুযোগগুলো উড়িয়ে না-দিয়ে তাদের যুদ্ধের আহ্বান জানানো খুব মরিয়া একটা পদক্ষেপ, তখনই এটা নেওয়া হয় যখন বাকি আর কিছুরই সুযোগ থাকে না। যখনই খুব বড়সড় কোনো বস্তুগত ক্ষতি করা সম্ভব, কেউই স্রেফ সন্ত্রাস করবে বলে সেটা ছেড়ে দেয় না। জাপপক্ষ যদি পার্ল হারবারে প্যাসিফিক নৌবহর অক্ষত রেখে একটা বেসামরিক যাত্রীবাহী জাহাজ টর্পোডো মেরে ডুবিয়ে আমেরিকাকে হামলার উস্কানি দিত সেটা হত পুরো পাগলামো।
সন্ত্রাসের দিকে লোকেরা ঝুঁকে পড়ে কারণ তারা জানে যুদ্ধবাধানো তাদের সাধ্যে নেই, তাই তারা এর বদলে বরং একটা রঙ্গমঞ্চের দৃশ্যের অবতারণা করে। সন্ত্রাসবাদীদের চিন্তাভাবনা সেনা জেনারেলদের মতন নয়; তাদের চিন্তা নাট্যশালার প্রযোজকদের মতন। ৯/১১-এর হামলার জনস্মৃতিই এর প্রমাণ: মানুষজনকে যদি প্রশ্ন করেন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঠিক কী হয়েছিল, তারা প্রায় সবাইই বলবে যে সেদিন আল-কায়েদা ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ‍টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু হামলা শুধু ওই টাওয়ারগুলোয় হয়নি, হয়েছে আরো দুটো জায়গায়, বিশেষ করে পেন্টাগনের ওপর হয়েছে একটা সফল হামলা। এমনটা কেন হয় যে এটা মনে রেখেছে খুব অল্প লোকই? যদি ৯/১১ একটা রীতিমাফিক সামরিক আক্রমণ হত, হয়ত পেন্টাগন হামলার ওপরেই নজর যেত সবার। এই হামলায়, আল-কায়েদা শত্রুর প্রধান হেডকোয়ার্টারের কিছু অংশ ধ্বংস করে দেয়, নিহত এবং আহত করে বেশ কিছু উঁচুসারির সেনাপতি ও বিশ্লেষকদের। কেন এমনটা হয় যে জনস্মৃতি দুটো বেসামরিক দালানের ওপর বেশিমাত্রায় মনোযোগ দেয়, দেয় দালাল আর হিসেবরক্ষকদের হত্যার ওপর?
এর কারণটা হল পেন্টাগন একটা তুলনামূলকভাবে সমতল ও নজরে তেমনটা না-পড়ার মতন ভবন, আর ওদিকে ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টার একটা লম্বা, পুংলিঙ্গাত্মক টোটেম যেটা ধ্বসে পড়লে একটা বিরাট রকমের দৃশ্যশ্রাব্য প্রতিক্রিয়া হয়। ওই ধ্বংসের ছবি যারা দেখেছে তারা জীবনে আর সেটা ভুলতে পারবে না। ভেতরের বোধবুদ্ধিতেই আমরা বুঝে যায় যে সন্ত্রাসবাদ হল একটা রঙ্গমঞ্চ, আর তাই বস্তুগত প্রভাবের চাইতে আমরা বরং এর আবেগি দিকটা দিয়েই বেশি বিচার করি। আজ যদি পেছনে ফিরে তাকাই, হয়ত পেন্টাগনে যে-বিমানটা আছড়ে পড়েছিল, তারচে বরং আরো নজরকাড়া কোনো লক্ষ্যে, যেমন স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে পড়াটা ওসামা বিন লাদেন বেশি পছন্দ করত। হ্যাঁ, তাতে লোক মারা যেত কমই এবং কোনো সামরিক সম্পদও উজাড় হত না, কিন্তু ভাবুন তো একবার কী শক্তিশালী মঞ্চাভিঘাতই না তৈরি হত।
সন্ত্রাসবাদীদের মতন, যারা সন্ত্রাসবাদ দমন করছে তাদেরও মঞ্চনাটকের প্রযোজকদের মতন বেশি করে আর সেনা জেনারেলদের মতন কম করে ভাবা দরকার। সত্যি বলতে কি, যদি আমরা সন্ত্রাসবাদের সাথে সমানে সমানে টক্কর দিতে যাই আমরা অবশ্যই বুঝব যে সন্ত্রাসবাদীরা যা-ই করুক না কেন, তাতে আমাদের হার কখনোই হবে না। আমাদের হারাতে পারি একমাত্র আমরাই, যদি আমরা সন্ত্রাসবাদী উস্কানিতে একটা বিভ্রান্ত পথে অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাই।
সন্ত্রাসবাদীরা নেমেছে একটা অসম্ভব লক্ষ্যে: হাতে সামরিক শক্তির পরিমাণ সীমিত থাকলেও রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে ফেলা। তাদের লক্ষ্যে পৌঁছুতে গেলে, তারা রাষ্ট্রের দিকে নিজেদের একটা অসম্ভব চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়: প্রমাণ করো দিকিনি যে তুমি তোমার নাগরিকদের রাজনৈতিক সন্ত্রাস থেকে যেকোনোখানে, যেকোনো সময়ে বাঁচাতে পারবে। সন্ত্রাসবাদীরা আশা করে যে যখন রাষ্ট্র এই অসম্ভব লক্ষ্য পূর্ণ করতে চাইবে, সে রাজনৈতিক তাসগুলো আবার ভেঁজে নেবে, আর তার হাতে তুলে দেবে কোনো না-দেখা টেক্কা।
সত্যি বটে, যখন রাষ্ট্র রাজনৈতিক সন্ত্রাস থেকে এর নাগরিকদের রক্ষার চ্যালেঞ্জটা নিয়ে বসে, প্রায়ই এর সাফল্য আসে সন্ত্রাসবাদীদের একদম গুঁড়িয়ে দিয়ে। নানা রাষ্ট্রই গত কয়েক দশকে শতাধিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের গোড়া একদম উপড়ে ফেলেছে। ২০০২-২০০৪-এ, ইসরায়েল প্রমাণ করেছে যে বর্বর বলপ্রয়োগ করে একটা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দমিয়ে দেওয়া যায়। সন্ত্রাসবাদীরা খুব ভালো করেই জানে যে এরকম সংঘর্ষে তাদের পক্ষে পাল্লা একদমই ঝুঁকে নেই। কিন্তু যেহেতু তারা ভারি দুর্বল, এবং অন্য কোনো সামরিক বিকল্প তাদের নেই, হারানোর তাদের তেমন কিছু নেই আর পাওয়ার আছে অনেককিছুই। সন্ত্রাসবাদীদের সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রম কালেভদ্রে সন্ত্রাসীদের ঝুলিতে কিছু ভরে দেয় বটে, তাইই এই জুয়োখেলাটার অর্থ মেলে। একজন সন্ত্রাসবাদী হল এমন এক জুয়োড়ি যার হাতের দানগুলো ভারি ছোটো, যে তার প্রতিপক্ষকে বোঝাতে পেরেছে তাসগুলো আবার ভাঁজার জন্যে। হারানোর তার কিছু নেই, কিন্তু হয়ত সবটাই সে জিতে নিতে পারে।
বড় খালি কৌটোয় ছোট্ট একটা পয়সা
রাষ্ট্র তাহলে তাসগুলো আবার ভাঁজতে রাজি হয় কেন? যেহেতু সন্ত্রাসবাদের বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি উপেক্ষণীয়, রাষ্ট্রগুলো তাত্ত্বিকভাবে এসব নিয়ে তেমন কিছুই করে না, অথবা ক্যামেরা বা মাইক্রোফোনের বহুদূর অন্তরালে শক্ত হাতে কিন্তু বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ নেয়। বলতে কি, তারা প্রায়শই ঠিক ওটাই করে। কিন্তু প্রায়ই রাষ্ট্র মেজাজ হারিয়ে বসে, আর খুব জোর খাটিয়ে আর লোক দেখিয়ে কিছু করতে যায়, আর তাতে করে তারা সন্ত্রাসীদের চাহিদামাফিক নিয়মেই খেলতে বসে।
তারা সন্ত্রাসী উস্কানিতে এতটা সংবেদনশীল কেন? কারণ আধুনিক রাষ্ট্রের বৈধতা এই প্রতিশ্রুতির ওপরে যে তারা জনাঞ্চলগুলো রাজনৈতিক সংঘর্ষমুক্ত রাখবে। কোনো সরকারের মেয়াদে ভয়াবহ কোনো দুর্যোগও সামলে ওঠা সম্ভব, কিংবা এড়িয়ে-যাওয়াও, শর্ত থাকে যে এসব ঠেকানোর ওপর তার বৈধতা নির্ভর করছে না। অন্যদিকে, যদি বৈধতার ক্ষতিকারক সামান্য কোনো সমস্যাও থাকে, তবে তাতেই গণেশ ওল্টাতে পারে সরকারের। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ থেকে অর্ধেকই ব্ল্যাক ডেথে (প্লেগ) উজাড় হয়ে যায়, কিন্তু তাতে করে কোনো রাজার সিংহাসন থেকে পদচ্যুতি ঘটেনি, যদিও কোনো রাজাই ওই প্লেগ সারাতে তেমন কিছু করেছেন বলে প্রমাণ মেলে না। তখন কেউ ভাবত না যে প্লেগঠেকানো রাজার কাজ। অন্যদিকে, যেসব শাসকেরা তাঁদের শাসনাধীন এলাকায় ধর্মীয় সমালোচনার অনুমতি দিয়েছেন, ঝুঁকি থেকেছে তাঁদের মুকুট, এবং এমনকি তাঁদের মাথাটিও হারানোর।
আজকাল, ঘরোয়া আর যৌন নির্যাতনের ‍উঁচু মাত্রার দিকেও কোনো সরকার দিব্যি চোখ বুজে থাকতে পারে, কারণ তাতে করে তার বৈধতায় আঘাত পড়ে না। ফ্রান্সের কথা ধরি, প্রতি বছর কর্তৃপক্ষের কাছে ১ হাজারেরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়, এমনি হাজারো ঘটনা থাকে অগোচরে। ধর্ষক এবং অত্যাচারী স্বামীরা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যে একটা সঙ্কট হিসেবে গণ্য হয় না, কারণ, ঐতিহাসিকভাবেই, রাষ্ট্র যৌন নির্যাতনের প্রতিশ্রুতির ওপর গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে, সন্ত্রাসবাদের তুলনামূলকভাবে কম ঘটনাও জানকবজকরা হামলা হিসেবে দেখা হয়, কারণ গত কয়েক শতাব্দী ধরে আধুনিক পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের বৈধতা গড়ে তুলেছে তাদের সীমান্তের ভেতর শূন্য রাজনৈতিক সংঘর্ষ বজায় রাখবে বলে।
মধ্যযুগে যদি ফিরি, জনাঞ্চলগুলো রাজনৈতিক সংঘর্ষে সয়লাব ছিল। বলতে কি, রাজনৈতিক ক্রীড়াঙ্গনে ঢোকার টিকেটটাই ছিল সহিংসতা, আর যার হাতে এই ক্ষমতা ছিল না সে কোনো রাজনৈতিক আওয়াজ তুলতেই পারত না। অনেক অভিজাত পরিবারেরই যে শুধু সামরিক বাহিনী ছিল তা নয়, ছিল শহর, সংঘ, গির্জা, আর মঠের কাছেও। এক মঠাধ্যক্ষ যদি মারা যেতেন এবং তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে দেখা দিত বিবাদ, বিবদমান অংশগুলো – যাতে সন্ন্যাসীরা, স্থানীয় পেশিবাজেরা, আর কোণঠাসা প্রতিবেশীরা – প্রায়ই সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে ব্যাপারটার ফয়সালা করত।
ওইধরনের দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদের বিশেষ জায়গাই ছিল না। যে বড়সড় বস্তুগত ক্ষতি করতে পারত না তার কোনো দামই ছিল না। যদি ১১৫০ সালে অল্প কিছু মুসলিম উগ্রপন্থী জেরুসালেমে বেশকিছু বেসামরিক লোক মেরে ফেলে দাবি করত, পুণ্যভূমি ছাড়তে হবে ক্রুসেডারদের, তবে ভয়ের চাইতে প্রতিক্রিয়া হত বরং ঠাট্টারই। নিজেকে ভারিক্কি কেউকেটা হিসেবে দাবি করতে চাইলে, কমপক্ষে একটা কি দুটো মজবুত দুর্গের মালিক আপনাকে হতেই হত। সন্ত্রাসবাদ আমাদের মধ্যযুগীয় পূর্বপুরুষদের বিশেষ উচাটন করত না কারণ মাথাঘামানোর মতন অনেক বড় বড় সমস্যা ছিল তখন।
আধুনিক যুগে, কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের সীমান্তের ভেতর রাজনৈতিক সহিংসতাটা ধীরে ধীরে কমিয়ে এনেছে, আর শেষ কয়েক দশকে তো পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মোটের ওপর রাজনৈতিক সহিংসতাটার মাত্রা নামিয়ে এনেছে শূন্যে। এদের নাগরিকেরা শহর, কর্পোরেশন, সংগঠন এবং এমনকি সরকারের ওপরও বিন্দুমাত্র বর্বর বলপ্রয়োগ ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। শতসহস্র বিলিয়ন ইউরোর, লাখো লাখো সৈন্যের, এবং হাজারে হাজারে যুদ্ধজাহাজ, বিমান, আর পারমাণবিক মিসাইল একদল রাজনীতিবিদের হাত থেকে অন্যদের হাতে চলে যায় মালিকানা বদলে একটিও গুলি ছোঁড়া ছাড়াই। জনসাধারণ দ্রুতই এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এবং এটা তাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাতে করে হয় কি, বিচ্ছিন্ন কটা রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় অল্প ডজনখানেক মানুষ মারা গেলেও সেটা বৈধতার জন্যে প্রাণঘাতী হুমকি হিসেবে দেখা হয় এবং এমনকি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ওপরও। একটা বড় খালি কৌটোয় একটা ছোট্ট পয়সা পড়লে কিন্তু অনেক শব্দ হয়।
এতে করেই সন্ত্রাসের রঙ্গমঞ্চ এতটা সফল হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র রাজনৈতিক সহিংসতাবিহীন একটা বিশাল খালি জায়গা তৈরি করেছে। এই খালি জায়গাটা শব্দঢোলের কাজ করে, যেকোনো সশস্ত্র হামলার প্রভাবটা বড় করে তোলে অনেকগুণে, তা সে যতটাই খুদে হোক। কোনো একটা রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সহিংসতা যতই কম, সন্ত্রাসের ধাক্কাটা জনসাধারণের ওপর ততই বেশি। নাইজেরিয়া বা ইরাকে শখানেক লোক মারা গেলেও প্যারিসে ১৭জন লোক মারা গেলে তারচে নজর অনেক বেশি পড়ে। ব্যাপারটা গোলকধাঁধা, আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক সহিংসতা ঠেকানোর সাফল্যই তাদের সন্ত্রাসবাদের কাছে বেশি জিম্মি করে তোলে। মধ্যযুগীয় কোনো রাজ্যেন যে-সন্ত্রাসটা চোখেই পড়ত না সেটা আধুনিক অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের অন্তরাত্মাও ভয়ানকভাবে কাঁপিয়ে দিতে পারে।
রাষ্ট্র এতবার জোর দিয়ে এ-কথাটা বলেছে যে সে তার সীমানার ভেতরে কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা বরদাশত করবে না, তাতে করে সন্ত্রাসবাদের ঘটনাটা তার অসহনীয় না-ভেবে উপায়ই নেই। আর নাগরিকেরা নিজেদের দিক থেকে রাজনৈতিক সহিংসতাহীনতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তাই সন্ত্রাসের রঙ্গমঞ্চ তাদের ভেতর নৈরাজ্যের আত্মাকাঁপানো ভয় ধরিয়ে দেয়, তারা ভাবে সামাজিক বিন্যাসটা বুঝি এই পড়ল ধ্বসে। শতাব্দীর পর শতাব্দীর রক্তাক্ত লড়াইয়ের পর, আমরা সহিংসতার কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়েছি হামাগুড়ি দিয়ে, কিন্তু আমাদের ভাবনা এই যে কৃষ্ণগহ্বরটা বুঝি ওখানটায় আছে এখনো, ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের আবার গ্রাস করবে বলে। অল্পকটা জঘন্য নৃশংসতা এবং আমরা কল্পনা করি যে আমরা আবারো গড়িয়ে যাচ্ছি পড়ে।
এই ভয় তাড়াতে গিয়ে, রাষ্ট্র প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তার নিজস্ব নিরাপত্তার রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে তোলে। সন্ত্রাসবাদের সবচে যোগ্য প্রত্যুত্তর হয়ত ছিল দক্ষ গোয়েন্দাগিরি এবং সন্ত্রাসবাদের অর্থের উৎসের পেছনে যে সংযোগ আছে গোপনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু ওসব তো আর নাগরিকেরা টিভিতে দেখতে পাচ্ছে না। নাগরিকেরা যখন একবার ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বসে-পড়ার সন্ত্রাসবাদী নাটক দেখে ফেলেছে, রাষ্ট্র বাধ্য হয় ঠিক তেমনিই চমকদার আরেকটা পাল্টা নাটক করতে, যাতে থাকবে আরো বেশি আগুন আর ধোঁয়া। তাই নীরবে আর দক্ষভাবে কাজসারার বদলে, একটা বড়সড় ঝড় অবমুক্ত হয়, তাতে করে সন্ত্রাসবাদীদের সবচে দিলখুশ স্বপ্নই হয় বাস্তবায়িত।
সন্ত্রাসবাদ যখন পারমাণবিক
তা পারমাণবিক সন্ত্রাসবাদ বা জৈবসন্ত্রাসের কী হবে? যদি মহাপ্রলয়ের ভবিষ্যদ্বক্তারা সত্যিই ঘোষণা করে থাকেন, আর সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো গণবিধ্বংসী অস্ত্র হাতে পায়, যা প্রথাগত যুদ্ধের সমপরিমাণ বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম? যদি এবং যখন সেই সময় আসবে, আমাদের পরিচিত রাষ্ট্র হয়ে যাবে বাসি। যদিও আমরা সন্ত্রাসবাদ বলতে যা বুঝি, অবসান ঘটবে তারও, যেমনটা পোষকের মৃত্যুতে মরণ হয় পরজীবীটিরও।
যদি কোনো খুদে সংগঠনের হাতেগোনা কটা উন্মাদ পুরো একটা শহর ধ্বংস করে লাখোকোটি মানুষ মারার ক্ষমতা রাখে, তখন হেন কোনো জনাঞ্চল থাকবে না যা রাজনৈতিক সহিংসতামুক্ত থাকবে। রাজনীতি আর সমাজের ঘটবে আমূল পরিবর্তন। সেসময় রাজনৈতিক সংগ্রাম কিভাবে হবে, সেটা জানাটা কঠিনই হবে, কিন্তু সেটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচারণা থেকে আলাদাই হবে বেশ। যদি ২০৫০-এ পৃথিবী পারমাণবিক- আর জৈব-সন্ত্রাসীতে ভরে ওঠে, তাদের শিকারেরা আজকের পশ্চিমা জগতের দিতে তাকাবে অবিশ্বাসমাখা হাহাকারে: এত নিরাপদ জীবনে বেঁচে-থাকার পরও তারা কিভাবে এত হুমকির মুখোমুখি ভাবত নিজেকে?