স্বার্থপরতা প্রাণীর একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সেই হিসাবে মানুষও স্বার্থপর প্রাণী। কিন্তু হিউম্যান জেনমের ঠিক কোন অংশটা স্বার্থপরতার জন্যে দায়ী সেটা বলা বেশ শক্ত। তবে প্রাণী তথা মানুষের এই স্বভাবটা যে তার দেহঘড়ির অভ্যন্তরে লুকিয়ে রয়েছে, সে কথা প্রকারান্তরে প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট বিবর্তন-বিজ্ঞানী জনাব রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জীন’ নামক গ্রন্থখানিতে। মানুষের জীনের একক ডিএনএ মূলত চারটা প্রোটিন, দুটো ফসফেট, চারটা ডিঅক্সিরাইবোজ নিয়ে যে মই-প্যাঁচানি দিয়েছে, সেই প্যাঁচের কোন এক ভাঁজে যে স্বার্থপরতা নামক গুণপনাটি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই হয়তো তাকে আলাদা করে আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে তা যে প্রতিটা ডিএনএ এককের সাথে আমূল প্রতিথ সেটা মোটামুটি বুঝা যায় ব্যবহারিক বাস্তবতায়।
স্বার্থপরতা কি কোন দোষ, নাকি গুণ? স্বার্থপরতা কোন দোষও না, কোন গুণও না। এটা একটা বৈশিষ্ট্য, প্রাণীজ বিমূর্ত বৈশিষ্ট্য। একটা দৃষ্টিগ্রাহ্য বস্তুবাদী উদাহরণ দেয়া যেতে পারে ব্যাপারটা বুঝাতে। আণবিক শক্তি কাজে লাগিয়ে যে বোমা তৈরি হয়, তা দিয়ে যেমন হিরোশিমা, নাগাসাকি গুড়িয়ে দেয়া যায়, তেমনি সেই একই আণবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় নিউক্লিয়ার মেডিসিন, যা দিয়ে বাঁচানো যেতে পারে হাজার হাজার মানুষের জীবন। স্থান-কাল-পাত্র ও মাত্রা ভেদে স্বার্থপরতাও তেমনি হয়ে যায় দোষ ও গুণের আঁকর। আণবিক শক্তির মতো স্বার্থপরতারও কি তাহলে ভাল কোন ব্যবহার রয়েছে? হ্যাঁ অবশ্যই রয়েছে।
জীবনের কোন মৌলিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের । স্বার্থপরতা একটা প্রাণীজ তথা মানবীয় মৌলিকতা। ইগো, সেন্স অব আই, আমিত্ব, অহম ইত্যাদি একই মানবীয় বৈশিষ্ট্যের ভিন্ন ভিন্ন নাম। তাকে যে নামেই ডাকা হোক, এর অস্তিত্ব ছাড়া মানুষের জাগতিক অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সেই অস্তিত্বের একটা বিশেষ প্রকাশের নাম স্বার্থপরতা। এই বৈশিষ্ট্যটা তার মূল অস্তিত্বেরই অংশ। ইগো দিয়ে সে নিজেকে চেনে, নিজের সম্পর্কে ধারণা নেয়, কোন কিছু করার তাগিদ অনুভব করে, নিজের জন্যে করে। স্বার্থপরতাই কাজের আদীম উৎসাহদাতা।
স্বার্থপরতা শব্দগতভাবে নেতিবাচক। তার ভাবমূর্তি নীতিহীনতার খোঁয়াড়ে বন্দী, যেখান থেকে শব্দটাকে মুক্ত করে আনা সম্ভব নয়। স্বার্থপরতার বশবর্তী হয়ে মানুষ নিজের জন্যে ক্রমাগত করতে থাকে বিরামহীন। নিজের জন্যে করায় দোষের কিছু নেই। তবে কতক্ষণ, কতদূর পর্যন্ত নিজের জন্যে করা যায়, সেখানেই রয়েছে মাত্রার বিষয়। এই মাত্রাজ্ঞানই মানুষকে তার স্বার্থ-উপায়ের উদ্দেশ্যকে ভিন্নমুখী করতে উৎসাহিত করে। যার দৃশ্যমান বস্তুগত স্বার্থ-উদ্ধার সম্পন্ন হয়েছে, সে তার স্বার্থকে অন্যস্রোতে প্রবাহিত করবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অমর হওয়ার অভিলাষও একটা বড় স্বার্থ। সেই স্বার্থ অর্জনে তার যা যা করা দরকার তা সে করে। তখন তাকে আপাতদৃষ্টিতে নিঃস্বার্থ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সে তা নয়। এই বড় স্বার্থপরতা হাসিলের ভিতর দিয়ে মানবতা উপকৃত হয়, অগুনিত জীবন স্বস্তি পায়। সুতারং স্বার্থপরতা মানেই খারাপ তা নয়। নিউক্লিয়ার মেডিসিনের মতন সেও মানবকল্যানে অবদান রাখতে পারে। ব্যক্তির স্বার্থ যত বড় হতে থাকে, যত মহৎ হতে থাকে তার ব্যক্তিগত বৈষয়ীক অর্জন ততো কমতে থাকে, তবে বিমূর্ত অমরতা প্রাপ্তির ঘরে জমতে থাকে প্রভূত পুঁজি। স্বার্থের বৃত্ত থেকে তাই মুক্তি নেই। ডিএনএ ছাড়া যেমন জীন হয় না, স্বার্থ ছাড়া তেমনি জীবনও হয় না।
আলোকিত আদেশ আছে- ডানহাতে দান করবে, বামহাত যেন তা জানতে না পায়। কেউ কি পারে তা, নাকি পেরেছে কেউ? হাজী মহসিন যদি গোপনে গোপনে দান করতেন, তাহলে মানুষ তা জানলো কিভাবে? কেউ তা পারে না। দানশীলতা প্রচারের সাপেক্ষে ক্ষুরধার যুক্তিও দাড়িয়ে যায়- তোমার দানকে গোপন করো না। কারণ তোমার দানশীলতা দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হবে দানে। দানশীলতা যে মহৎ একটা বিষয়, এটা কি কেউ জানে না? আমাকে কেন জানাতে হবে তা? এরও পিছনে সেই অনন্য, বিশিষ্ট হওয়া আর অমরতার অভিলাষ। সর্বশক্তিমানের কাছে মানুষ আজও কি পেরেছে পাঠাতে কোন নিঃস্বার্থ প্রার্থনা, পূজা, আঁচার? মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী অহিংসার বাণী কাজে-কর্মে বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করে হয়েছে মহাত্মা। নেলসন মেণ্ডেলা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে শ্রমে-ঘর্মে লড়ে পৃথবীর উদাহরণ হয়েছেন, অমর হয়েছেন। তাঁদের এই অর্জনে দেশ-কাল উপকৃত হয়েছে, উপকৃত হয়েছে মানবতা। স্বার্থপরতার অস্তিত্ব যদি ব্যক্তিদেহে না থাকতো তাহলে কিভাবে ঘটতো স্বার্থের এই রূপান্তর।
বড় স্বার্থের বিমূর্ত পুঁজির নেশায় বিভোর হয়ে আজকের দিনে কতজন মহতপ্রাণ কর্মসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েন? বর্তমানে দানবীরেরা হাতেমতাঈ হন না, হন বাফেট, বিল গেটস। আয় থেকে বিবেকের দায় শোধে তারা পারঙ্গম। যে প্রযুক্তিবিদ ডায়ালাইসিস মেশিন তৈরি করে তার পেটেণ্ট বাজারে বিকালো, সে কি পৃথিবীর স্বার্থে কিছুই করলো না? হোক একঢিলে দুইপাখি মারা, তবুও তো পাখি মরলো। সে নিজেও খেলো, অন্যকেও খাওয়ালো। এভাবেও পৃথিবী এগোয়। এই পুঁজির জামানায় গান্ধী আর মেণ্ডেলার মতন বস্তুস্বার্থত্যাগী আইডোলজিস্টদের দ্বারা শুধু সমাজ এগোবে, মানবতা উপকৃত হবে তা নয়, স্বার্থপর প্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের দ্বারাও এগোবে। তবে দুই অগ্রগামীতা দুই রকমের হবে, চরিত্র হবে ভিন্ন।
ঘরের বৌকে চার দেয়ালে বন্দী করে রাখলে যেমন একটা মানবসত্তার অপমৃত্যু ঘটে, তার স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের মরণ ঘটে, ঠিক তেমনি স্বার্থপরতাকে একটা দেহে বন্দী করে রাখলে মানবিক সত্ত্বার একটা বড় অংশের কবর রচিত হয়। স্বার্থপরতাকে তাই রূপান্তরের মাধ্যমে ব্যক্তিদেহ থেকে পরিবারে, পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রে, রাষ্ট্র থেকে মহাদেশে, মহাদেশ থেকে পুরা ধরণীতে প্রতিস্থাপিত করতে হয়। তার জন্যে স্বার্থের রূপান্তর ঘটে যায় ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে। এই ভাবে ব্যক্তিস্বার্থের সংকীর্ণতার অস্বীকৃতির ভিতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পায় বৈশ্বিক স্বার্থ বা গ্লোবাল ইন্টারেস্ট। সুতারং সীমানাহীন, পাসপোর্টবিহীন একপৃথিবী তৈরিতে স্বার্থপরতা হতে পারে একটা অনন্য উপাদান। আমরা চাই, পৃথিবীর সব মানুষই চায় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বড়মাপের কোন স্বার্থপরতা বুকে চেপে এগিয়ে আসুক একক পৃথিবী তৈরির অভিলাষ হৃদয়ে নিয়ে।
সবুজ রঙের এই গ্রহটায় যেদিন প্রথম একফোঁটা আঠালো এমিনো এসিডের জন্ম হয়েছিল, সেদিন থেকেই তার সাথে মনেপ্রাণে জড়িয়ে ছিল স্বার্থপরতার গ্লানি। কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তোলা যায়, বিষে যেমন হয় বিষক্ষয়, ঠিক তেমনি স্বার্থপরতা দিয়েই করা যায় স্বার্থপরতার গ্লানি মোচন। মানুষকে নীচ করে, হীন করে সাধ্য কার? আশাবাদী আমরা, একদিন সে ঠিকই স্বার্থপরতার ম্লানতা থেকে মুক্ত হবে, একপৃথিবী গড়ার দৃষ্টান্ত তৈরি করে মহিমান্বিত হবে ধনে, মনে, হৃদয়ে ও আত্মায়।
Leave A Comment