কয়েকদিন যাবৎ “ডুব” সিনেমাটি নিয়ে মাঠ গরম হয়ে আছে। ভেবেছিলাম পক্ষে বিপক্ষে কোন ধরনের মন্তব্য করবো না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এটার প্রকাশের পক্ষে। আর আমি এটার প্রকাশের বিপক্ষে। সবার চিন্তাধারা এক হবে, সবার চিন্তার কোণ এক হবে তা আমি মানি না। তাদের যুক্তিটাও সঠিক! বাক স্বাধীনতার জন্য সিনেমাটির মুক্তি হোক, কোন একজন ব্যক্তির জন্য সিনেমাটা থেমে থাকতে পারে না। বিশেষ করে যখন পরিচালক মশাই, ১৭ লক্ষ ডলার লগ্নি করেছেন। বাংলা সিনেমার বাজারে, এই সিনেমাটি ক্ষতির মুখে পড়লে, একই সাথে অনেকেই সিনেমা বানাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তবে পরিচালক মশায়ের সিনেমা শুরুর আগেই, বুঝা উচিত ছিল, কতটা সামলে উঠিতে পারবেন তিনি?
তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, যে কোন সিনেমা, যদি কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে ৮০-৯০% মিলে যায়, তাহলে সাধারণ দর্শক কিন্তু ঐ ব্যক্তির কাহিনী হিসেবেই এটাকে মনে করবে। একজন ব্যক্তির জীবনী নিয়ে সিনেমা হতেই পারে। এবং বিখ্যাত ব্যক্তি হলে, সবার সেটা জানা বা দেখা উচিত। কিন্তু একজন ব্যক্তি জীবনীর মত করে সিনেমা বানিয়ে ভুল ইনফরমেশন গেলে, তাতে ব্যাক্তির পরবারের জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে! শুধু তার পরিবার না, মানুষের কাছে চলে যাবে ভুল তথ্য। যেগুলো মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।
ব্যক্তি হুমায়ুন আহমেদকে আমি পছন্দ করি আর নাই করি, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যপার। কিন্তু ব্যক্তি হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন! তার জীবনীর থিমে কেউ গল্প লিখলে, সেটাকে তার জীবনীই বলবে সবাই। যতই না করা হোক না কেন? আবার এই ছবির একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী ‘রোকেয়া প্রাচী’ও বলেছেন, এটা হুমায়ুন এর জীবনী নিয়েই করা। পরিচালক যতই না করুক, না বলুক, সেটা কেউ বুঝবে না। বরং না করলেও মানুষ আরও বেশি ভাববে। কারন, ‘কেন একজন ব্যক্তিরই নাম বারবার আসতেছে, অন্য কারোর নাম না।’
ছবি যদি করতেই হয়, তবে সেক্ষেত্রে ১০০% মিল রেখেই করা উচিত ছিল। আমি মনে করি, যেকোন বিখ্যাত লোকজনদের কাহিনী নিয়ে সিনেমা হতেই পারে। কিন্তু সেটা যেন সত্যিকারে জীবনী নিয়েই হয়। তথ্য কম থাকুক, কিন্তু যেন ভুল তথ্য না থাকে! আর তাছাড়া অনেক বিষয়ে তার দুই পরিবারের আপত্তি থাকতেও পারে। সেটা যেকোন বিষয়েই। যেমন ধরুন, আমি মদ খাওয়াকে কোন বিষয় মনে করি না। এটা স্বাভাবিক ব্যপার। কিন্তু এই দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে মদ খাওয়া মানেই অনেক বাজে ব্যপার। এখানে পরিচালক যদি সেটা দেখায়, তাহলে পরিবারের আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। একই সাথে লেখকের ইমেজ অন্য দিকে মোড় দিতে পারে। কিন্তু দেখা গেল বাস্তবতার সাথে কোন মিলই নেই। শুধু থিমটা ছাড়া। তাহলে সেটা কি সঠিক হবে? তাছাড়া স্পর্শকাতর কোন কিছু মনে হতেই পারে পরিবারের কাছে, যেটা সেই পরিবারের (যে কোন একটি) ভবিষ্যৎ এ চলার জন্য সমস্যা হতে পারে।
ধরুন, হুমায়ুন আহমেদ না, তসলিমা নাসরিন কিম্বা হুমায়ুন আজাদের, কিম্বা বঙ্গবন্ধুর জীবনীর কাহিনী দিয়ে কেউ সিনেমা বানালো। ব্যক্তির নাম আলাদা, কিন্তু মূল থিম এক। তবে ভিতরে অনেক ভুল তথ্য। তাহলে কি কেউ সহজ ভাবে মেনে নিবে? তাহলে হুমায়ুন আহমেদ এর জীবনী নিয়ে “ডুব” সিনেমাটা কেন মেনে নিবেন?
বাক স্বাধীনতা মানেই না,
‘বিশেষ কোন ব্যক্তির জীবনী পাল্টে দেওয়া!’
‘কোন পরিবারের অনুমতি বিহীন তাদের পরিবারের বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে ছবি করা!’
অনেকেই বলেছেন, সিনেমার কাহিনী তো কোন না কোন মানুষের, পরিবারের কাহিনী নিয়ে করা। কিন্তু “হাজার বছর ধরে” মন্টু মিয়ার কাহিনী কিম্বা ব্যক্তি তাহসিবের কাহিনী আর হুমায়ুর আহমেদের কাহিনী এক না। মন্টু মিয়া ঘরে ঘরে আছে। তাহসিব কাহিনীও কেউ জানে না, কেউ সেভাবে চিনে না, যে কোন প্রভাব পরবে। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের সাথে তাহসিবের তুলনা চলে না।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে, হতেই পারে। কিন্তু সেটা অনুমতি নিয়েই হয়েছে। অথবা বহু আগে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে। তারপরও ‘হাছন রাজা’র জীবনী নিয়ে বানানো সিনেমা নিয়েও আপত্তি হয়েছিল তার পরিবার থেকে। যদিও তার আসল পরিবার বেঁচে নেই। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়েও অনেকেই কিছু করতে গেলে খিলখিল কাজীর অনুমতি নিয়ে নেয়।
আরেকটি বিষয়, একজন লেখক মারা যাবার পর প্রায় ৫০ বছর (বছরে সংখ্যাটা মনে আসছে না, ৫০ নাও হতে পারে। তবে সংখ্যা নেহাত কমও না) তার লেখক স্বত্ব থাকে। তার জীবনীও সেই স্বত্বের মাঝেই পরে। সেক্ষেত্রেও শাওন বাধা দিতে পারেন। একজনের লেখায় দেখলাম, শাওন নাকি ‘হুমায়ুন আহমেদ’কে বেচে (বিক্রি করে) চলেন। কথা সত্য হলেও সেই ক্ষমতা কিন্তু আমি আপনি দেই নাই। লেখক হুমায়ুন আহমেদ স্বয়ং দিয়ে গেছেন, তাহলে আমি আপনি কে? আমিও তো বাপের কেনা জমি বিক্রি করে খাই, আর উনি লেখা বিক্রি করে খান। পার্থক্য তো রইল না! আমার বাবা বা অন্য কেউ যদি লেখক হতেন, তাহলে কি আমিও তাই করতাম না? এটা কি আমার অধিকার হত না?
ফারুকীর ঢেঁড়স চাষ, আর মুক্তমনা, মুক্তচিন্তা নিয়ে কথা নিয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। রবং তিনি আলোচিত হবার জন্যই এসব করেন। যত জনপ্রিয় হবেন, ততই তার ব্যবসায়িক লাভ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুক্তমনাদের না জেনেই খারাপ চোখে দেখে, সেটা তিনি জানেন। তাই এই সুযোগ সম্ভবত তিনি নিয়েছেন। আর সিনেমার ক্ষেত্রেও তিনি সম্ভবত, সমলোচনা আলোচনা যতই হবে, ততই সুযোগ গ্রহণ করে নিবেন। তিনি জানেন, তাতে সিনেমার হিট বাড়বে বই কমবে না। সবাই যেহেতু এই নিয়ে লিখছেন, ফেসবুকেও অনেক আলোচনা হচ্ছে। তাই আমিও লিখলাম। আমি তাহসিব লেখায়, সিনেমাটির হিটে কোন প্রভাব পরবে না, বরং যা হবার তা হয়েই গেছে। আমি জানি, আজ অথবা কাল এই সিনেমা মুক্তি পাবেই। এবং ব্যপক হিটও হবে এই ছবি। যেটাই ফারুকী চেয়েছিলেন।
এই ছবিটির সম্ভাব্য গর্ভপাতের জন্য বোধহয় ফারুকী নিজেই দায়ী। তিনি ফেসবুক পিকেটিং -এর বদলে শুরু থেকেই ছবি নিয়ে আরো সচ্ছতা অনুসরণে মন দিলে হয়তো চলতি জটিলতা এড়ানো যেতো।
ব্যতিক্রমী ভাবনার জন্য তাহসিব হাসানকে সাধুবাদ। বানানের প্রতি যত্নশীল হতে বিনীত অনুরোধ জানাই।
মুক্তমনায় আরো লিখুন।
ডুব চলচ্চিত্রটি নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক আমার চোখে পড়েছে। যতটুকু বুঝতে পারছি, ছবিটির কাহিনী হুমায়ুন আহমেদ এর জীবন থেকে ধার করা হলেও পরিচালক ফারুকী এটি হুমায়ুন আহমেদ এর বায়োপিক হিসাবে চালাতে চাননি। সত্য ঘটনা-নির্ভর বহু চলচ্চিত্র দেশে-বিদেশে তৈরী হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে পরিচালক/কাহিনীকার নিজের পছন্দমত গল্পে পরিবর্তন এনেছেন। আমরা যে নবাব সিরাজুদ্দৌলা বা মুঘল এ আযম কিংবা হালের দঙ্গল ছবি দেখেছি তা মূল চরিত্রগুলোর হবহু বাস্তব জীবন-কাহিনী নয়। তারপরেও মনে রাখতে হবে যে এই মুভিগুলো যেভাবে সরাসরি বাস্তব চরিত্রগুলোর নাম, পরিচয় ব্যবহার করেছে, ফারুকী তা করেন নি, তিনি ডুবের গল্পকে কাল্পনিক ঘটনা হিসাবেই তুলে ধরেছেন। এসব বিবেচনায় আমার মতে ডুব ছবির অবশ্যই মুক্তি পাওয়া উচিত।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর পড়ে এও মনে হয়েছে যে ছবির পরিচালক কোন ‘বিশেষ’ কারনে চেয়েছিলেন যে ছবি মুক্তির আগে এ নিয়ে বিতর্ক হোক। ছবি তৈরীর সাথে যারা জড়িত তারা সতর্ক থাকলে এভাবে ছবির গল্প মিডিয়ায় আসার কথা না। এমন না যে ছবিটির গল্পের মত ঘটনা আমাদের সমাজে বিরল। হটাৎ হুমায়ুন আহমেদ এর জীবন কাহিনী হিসাবে ডুব এর প্রচার উদ্দেশ্যমূলক বলেই মনে হয়।