লিখেছেন: ফাহিম মুন্তাকিম

আজ এখানে আমি বার্গম্যান’এর স্তুতি বাক্য গাইব না । বরং তার বিরুদ্ধে প্রচলিত কিছু সমালোচনার উপর নিজস্ব ( একজন উঠতি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে) মতামত তুলে ধরব। যা তাকে আঘাত বা তার কোন কাজের প্রতি অসম্মান করে নয়। নিছক সিনেমা সমালোচনার ভঙ্গিতে ।

ইঙ্গমার বার্গম্যান। সিনেমা প্রেমীদের কাছে তিনি নতুন কেউ নন। প্রখ্যাত পরিচালক উডি এলেন এর কাছে তিনি বিংশ শতাব্দীর সেরা পরিচালক। যিনি হচ্ছেন গ্র্যান্ডফাদার অফ দি মরডান সিনেমার একজন। প্রথাবিরোধী চিত্র শৈলী , নিঃসঙ্গ , অসহায়ত্বকে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলায় তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি ই আমাদের দিয়েছেন পারসনা, ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস, দি সেভেন্থ সিলের মত অসাধারণ সব সিনেমা। ১৯১৮ তে সুইডেনে উপ্সালাতে জন্ম নেয়া এই পরিচালক ছিলেন শুরুতে ছিলেন একজন মঞ্চ
শিল্পী । সুইডিশ স্টেট অপেরা তে রেজিসিউর হিসেবে কাজ করতেন। পরে মঞ্চ নির্দেশক হিসেবে ও কাজ করেছেন । তো এই ছিল তার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরন । বার্গম্যান প্রেমিরা এসব আগেই জানেন ।

এখন আমি আমার আসল কথায় আসি। মূলত বার্গম্যান এর বিরুদ্ধে বা তার সমালোচনায় তীর’টি ছুঁড়েছিলেন এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত পরিচালক এবং কালচারাল এক্টিভিষ্ট ঋত্বিক ঘটক। তিনি এক সাক্ষাত্কারে বার্গম্যান কে নকল-নবিশ এবং আরও অনেক উপমায় ভূষিত করেছিলেন । এবং তিনি এর কারন হিসেবে বলেছিলেন বার্গম্যান তার সিনেমা আমেরিকানদের কাছে বিক্রির জন্য খানিকটা ভাইকিংস দের ফিলসফি মিলিয়ে চালাবার চেষ্টা করেন । এবং পরবর্তী’তে বার্গম্যান এর সব সিনেমা দেখার ( কারণ এই সাক্ষাতকার পড়বার আগে সব দেখা ছিলনা) পর আমারও কিছু নিজস্ব চিন্তা জাগে মনের ভিতর ।

এবার আমার কথায় আসি। বার্গম্যান এর চলচ্চিত্র গুলো ভাল ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তিনি আসলেই সিনেমাতে আমেরিকান বা একটি গোষ্ঠী বা যাদের চিন্তাধারা সেইরকম তাদেরকে খুশি করবার জন্য কিছু সিনেমা বানিয়েছেন । সবগুলো নয় । যেমন উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক তার ভার্জিন স্প্রিং সিনেমার একটি দৃশ্য। যেই শটে দেখা যায় দাসী মেয়েটি থ্রাসিং ফ্লোরের মাঝখানের কাঠটাকে ধরে উপরের দিকে মুখ করে চেঁচাতে থাকে “ওডিন কাম” ওডিন কাম” । বস্তুত ওই কাঠের খণ্ড’টি একটি সিস্টেমের প্রকাশ। যিনি হচ্ছেন প্রাচীন নোমোডিক সভ্যতার দেবতা। আর সমস্ত লড়াইটা হচ্ছিল প্যাগন আর খৃষ্ট সভ্যতার মধ্যে। আর আমরা হয়ত জানি সুইডেন হচ্ছে ইউরোপের প্রায় শেষতম দেশ যেখানে শেষ পর্যন্ত খৃষ্ট ধর্ম জয়ী হয়। এবং তার ই প্রেক্ষিতে বার্গম্যান ব্যাপারটাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন । সুতরাং এখানে বোঝাই যায় বার্গম্যান দৃশ্য’টি দিয়ে একটি চিন্তার পক্ষে কথা বলেছেন । তার অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্র “দি সেভেন্থ সিল” যেখানে একজন ক্রুসেড ফেরত সৈনিক মৃত্যুর দেবতা বা যম তার সাথে দাবা খেলায় লিপ্ত হয় এই চুক্তিতে যে দাবা’তে হারলে সে তাকে যমের কাছে সঁপে দেবে আর সে জিতে গেলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। আর এর মধ্যেই এগিয়ে চলে সিনেমার কাহিনী । কিন্তু ভাল ভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যাবে এখানে বার্গম্যান ধর্ম’এর সাথে একটু চাটুকারিতা এবং নাটুকেপনা মিশিয়েছেন । কারণ সেভেন্থ সিল হচ্ছে বাইবেলের প্রতিবোধন গ্রন্থের একটি কাহিনী যেখানে বলা আছে, যীশু যখন প্রতিবোধন গ্রন্থের ৭টি সিলমোহরের একেকটি খুলতে থাকবেন তখন পৃথিবীতে একেকটি বিপর্যয় নেমে আসবে, সবশেষে সপ্তম সিলটি খোলার পর স্বর্গের ৭জন দেবদূত তাদের শিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার জন্য প্রস্তুত হবেন।

সিনেমার শুরুতে সেই গ্রন্থের একটি উক্তি পড়া হয়: “এবং যখন মেষপালক সপ্তম সিলটি খুললেন তখন স্বর্গের সবকিছু আধঘণ্টা ব্যাপী একদম নীরব ছিল”। এখানে নিরবতা বলতে ঈশ্বরের নিরবতার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যা সিনেমাটির মুখ্য বিষয়বস্তু। এবং এর দ্বারাই বার্গম্যান গড়ে তুলেছেন একটি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান সাগার পটভূমি। এ ছাড়াও এই ছবির অন্যতম বিষয়বস্তু হচ্ছে নাইট এবং ব্ল্যাক ডেথ । যা মূলত প্লেগ রোগ। এই নাইট তখন সুইডেনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যার কারনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম। এবং এই নাইটকে বার্গম্যান মিশিয়েছিলেন একটি সামাজিক অজ্ঞতার সাথে । যার প্রদর্শন করেন তিনি একটি দৃশ্যে যেখানে একজন নারী কে ডাইনি ভেবে পোড়ানো হচ্ছিল কিন্তু নাইটের উত্তর না দিয়ে তার মৃত্যু নেই। এখানে কি ধর্মীয় একটি নাটুকেপনা প্রদর্শন হচ্ছে না? এভাবে এই পুরো সিনেমা তে বার্গম্যান সুইডিশ দের বিদ্রোহ এবং ক্রুসেডের একটি স্বল্পায়ু সংমিশ্রণ তৈরি করেছিলেন । যা প্রকৃতপক্ষে নিছক নিরর্থতা, নিছক অনুপস্থিতি ভয়ঙ্কর অকার্যকর । তিনি ধর্মোপদেশ বিতরণ’এর মাধ্যমে ইউরোপিয়ান দের কাছে তাদের ই চিন্তাধারা বজায় রেখে এই সিনেমা গুলো চালাবার চেষ্টা করেছেন।

আমি শুধু দুইটি সিনেমার কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ঘটক বাবুর সমালোচনার নিজস্ব দৃষ্টি প্রকাশ করলাম। বার্গম্যান সাহেবের আরও সিনেমাতেও তার তৎকালীন সিনেমার সাথে নিজের সিনেমাকে বিক্রি করার (সাথে মঞ্চের নাটুকেপনা মিশিয়ে এবং কিছু ধর্মোপদেশ সহ) চেষ্টা করেছিলেন। তার সিনেমাগুলো’কে এর জন্যই ঘটক বাবু বলেছিলেন “শিল্প- চলচ্চিত্র বহির্ভূত ব্যাপার” ।