[ত্রিভুজদের মাঝেমধ্যেই বলতে দেখা যায়- রবীন্দ্রনাথ যেহেতু বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিলেন, সেহেতু তিনি পূর্ববঙ্গের তথা বংলাদেশ চেতনারই বিরোধী মানুষ ছিলেন। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী অবস্থান থেকে লেখা আমার সোনার বাংলা গানটিও বাংলাদেশের চেতনার সাথেই বিরোধাত্মক! সুর মিলিয়ে অনেককেই বলতে দেখা যায়- বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের স্বার্থেই ব্রিটিশ-রাজ করেছিল এবং এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করা মানেই পূর্ববঙ্গের উন্নতি না চাওয়া। বিবর্তনবাদীর একটি পোস্টে (http://www.somewhereinblog.net/blog/onujibblog/28762099) এ বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছি। মুসলমানরাও যে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন- সে ইতিহাসই এই পোস্টে তুলে ধরার চেস্টা করেছি।]

বঙ্গভঙ্গঃ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলেও এর ইতিহাস আরেকটু আগের। ১৮৭৪ সালে আসামকে বাংলার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক প্রদেশ গড়ে তোলা হয়। তখনই কাছাড়-গোয়ালপাড়া-শ্রীহট্ট বাংলা ভাষভাষী এই তিন জেলাকেও আসামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। এর আগে আসাম ‘বঙ্গ’ বা ‘বাঙলা’ প্রেসিডেন্সির অংশ ছিলো। ১৮৭৪ এর পরে ‘বঙ্গ’ প্রেসিডেন্সির অংশ ছিলো বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর। আয়তন ১,৯০,০০০ বর্গমাইল ও লোকসংখ্যা ৭ কোটি ৮ লক্ষ ৫০ হাজার। ১৮৯১ সালে কয়েকজন উচ্চপদস্থ আমলা এই প্রস্তাব করলেন যে, লুশাই পাহাড়-অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম বিভাগ আসামের সঙ্গে মিশে যাওয়া উচিত। ১৮৯২ তে এই সংযোগ সরকার বাহাদুর মেনে নিলেন; কিন্তু আমাদের ততকালীন চিফ কমশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮৯৬ সালে ঢাকা বিভাগকেও আসামের অংশ করতে চাইলেন, চাইলেন ময়মনসিংহকেও। আর্থিক, বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক সুবিধার ধুয়া তুলে এই সংযোগের প্রস্তাব করা হলেও তাঁর দুরভিসন্ধি মানুষ ধরতে পারে এবং প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবল গণবিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়, ফলে ওয়ার্ড সাহেব পিছু হটতে বাধ্য হন। ১৯০৩ সালে বাংলার ছোটলাট অ্যানড্রু ফ্রেজার বাংলাভাগের নতুন একটা খসড়া প্রস্তাব আনেন। তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব রিজলি’র মাধ্যমে পেশকৃত প্রস্তাবটিতে (রিজলির পরিকল্পনা বা পত্র নামে খ্যাত) চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সাথে যুক্ত হওয়ার কথাই বলা হয়। এটিও দিনের আলোয় আসার সাথে সাথেই চারদিকে প্রবল আলোড়ন শুরু হয়ে যায় এবং সরকার বাধ্য হয় পিছিয়ে যেতে। এবারে পরিকল্পনাটিকে ঢেলে সাজানো হয়। নতুন পরিকল্পনায় স্থির হয়-ঢাকা বিভাগ, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং পার্বত্য ত্রিপুরা, মালদহ জেলা ও দার্জিলিং, অর্থাত উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গকে আসামের সাথে যুক্ত করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি প্রদেশ গড়ে তোলা হবে, এই প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বয়ং লর্ড কার্জন মাঠে নামেন- ঢাকায় এসে মুসলমানদের বুঝানো আরম্ভ করেন- এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মুসলমানদের জন্য কত ভালো হবে। অনেক প্রতিবাদের মুখেও অবশেষে ১৯০৫ সালে অক্টোবরে বাঙলা ভাগ কার্যকর করা হয়।

বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্যঃ বাঙলাদেশ, বিহার ও উড়িষ্যার একটি প্রদেশ হিসাবে থাকার প্রশাসনিক দিক থেকে অনেক অসুবিধা ছিলো একথা সত্য। কাজেই সেই বিশাল প্রদেশকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুনভাবে গঠন করা কোনো দোষের ব্যাপার ছিলো না। বৃটিশ ভারতীয় সরকার প্রধানত এই কারণটিকেই বঙ্গভঙ্গের মূল যুক্তি হিসাবে উপস্থিত করেছিলো। কিন্তু প্রদেশ পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও সেটাই যে বঙ্গভঙ্গের মূল কারণ ছিলো না তা বৃটিশ সরকার ও বৃটিশ ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন নীতি, সরকারী ভাষ্য এবং দলিলপত্র থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়। বঙ্গ বিভাগের আসল কারণ ছিলো রাজনৈতিক। রিজলির নোটে আমরা দেখি, “ঐক্যবদ্ধ বাঙলা একটি শক্তি। …. আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরুধীদের দুর্বল করে তোলা”। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময় লর্ড কার্জন খুব পরিস্কারভাবে বলেন, “বাঙালীরা যারা নিজেদেরকে একটি জাতি হিসাবে চিন্তা করতে ভালোবাসে এবং যারা এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যেখানে ইংরেজদেরকে বিতাড়িত করে একজন বাঙালী বাবু কলকাতার গভর্মেন্ট হাউজে অধিষ্ঠিত হবে, তারা অবশ্যই সেই ধরণের যেকোন ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে তিক্ত মনোভাব পোষণ করে যা তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাঁধাস্বরূপ। এখন তাদের চিতকারের কাছে নতি স্বীকার করার মত দুর্বল হয়ে পড়লে আমরা আর কখনো বাঙলাকে বিভক্ত অথবা ছোট করতে সক্ষম হবো না এবং তার দ্বারা আপনারা ভারতের পূর্বদিকে এমন একটা শক্তিকে জমাটবদ্ধ ও কঠিন করবেন যে শক্তি ইতোমধ্যেই অপ্রতিরোধ্য হয়েছে এবং যা ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার নিশ্চিত উৎস হিসেবে বিরাজ করবে”।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানঃ নবাব সলিমুল্লাহকে দিয়ে শুরু করি। কেননা, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি ছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। কিন্তু প্রথম দিকে তিনিও বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব মেনে নেননি। ১১ জানুয়ারি ১৯০৪ নবাব সলিমুল্লাহ একটি সভা ডাকেন, এখানে তিনি ও অন্যান্যরা সরকারের তীব্র বিরোধীতা করেন- এমনকি এই প্রস্তাবকে Besatly বলতেও তিনি দ্বিধা করেননি। ‘দ্য মুসলিম ক্রনিকল’ পত্রিকা এক সম্পাদকীয়তে(জানুয়ারি ১৯০৪) স্বীকার করেছে যে, “জনগণ- সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে দেশবাসী এতখানি ঐক্যবদ্ধ আগে কখনও হয়নি, যতটা প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হয়েছে”। ১৭ জানুয়ারি ১৯০৪ ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত এক বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভায় উপস্থিত ৮০০০ শ্রোতার ৭৭০০ জনই ছিলো মুসলমান (অবশ্য এ সভায় উপস্থিত হওয়ার পেছনে অভিজাত হিন্দুদের চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আছে)। ২৫ জানুয়ারি ১৯০৪ মহমেডান ফ্রেণ্ডস ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের ডাকে ঢাকায় এক জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জমিদার কায়েসউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় আয়োজিত সেন্ট্রাল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশনের সভায় মৌলবি শামসুল হুদা ও মৌলবি সিরাজুল ইসলাম প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধীতা করেন। শামসুল হুদা দাবি করেন,

“মুসলিম সংগঠনগুলির ততখানি জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করা উচিত যতটা হিন্দু সংগঠন গুলি করছে, কারণ এতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের স্বার্থ জড়িত”।

সেন্ট্রাল মহমেডান অসোসিয়েশনের সম্পাদক আমির হোসেন সংস্থার পক্ষে ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারকে একটি চিঠি লিখে জানান,

“বাঙালি জাতির কোন অংশকে বাঙলা থেকে আলাদা করা উচিত হবে না,…… যদি প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোই বিভাজনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে সমগ্র বাঙলাকে মাদ্রাজ এবং বোম্বাইয়ের মতো নির্বাহী পরিষদ (Executive Council) গঠন করে গভর্ণরের শাসনাধীনে আনা হোক”।

মুনতাসীর মামুন কর্তৃক সংকলিত “উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র” গ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে আমরা দেখি- ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকাটির অবস্থান ছিলো স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে। ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ‘বেঙ্গল টাইমস’ (পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজী সাপ্তাহিক ও পরে দৈনিক) -এও অবিশ্রান্তভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও ‘বেঙ্গল টাইমস’ অতীতে সবসময় নবাব পরিবারের পক্ষাবলম্বন করেছে, কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বেলায় নবাব সলিমুল্লাহর পথ অনুসরণ করেনি ওই পত্রিকা। ৪ জানুয়ারি ১৯০৪, ঢাকার সদরঘাটের এক সভায় সভাপতিত্ব করেন একজন মুসলমান জমিদার। সভাতে যে আটাশজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন বঙ্গভঙ্গের সরকারি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অন্যান্য জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য, তার মধ্যে ৭ জন মুসলমান, ৪ জন ইঙ্গ-ভারতীয় এবং বাকিরা ছিলেন হিন্দু। নারায়নগঞ্জের এক জনসভায় বিভিন্ন প্রস্তাবের উত্থাপক ও সমর্থকের মধ্যে বেশ কয়েকজনই ছিলেন মুসলমান। ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ এ লর্ড কার্জন ঢাকা সফরে মুসলমানদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেস্টা করলেও তাঁর ফিরে যাওয়ার ঠিক পরেই, মার্চ মাসে, ঢাকার জগন্নাথ কলেজে হিন্দু-মুসলমানের এক যৌথ সমাবেশ হয় এবং তাতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এই মর্মে যে, “ভাইসরয়ের মিষ্টি কথাতে জেলার জনগণের মন ভোলেনি”। ২৭ অক্টোবর ১৯০৫ ‘ছোলতান’ পত্রিকায় একটি সংবাদে প্রকাশ, “কলকাতার মুসলমানের বেশিরভাগই ছিলেন স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক, শুধু কয়েকজন রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানহীন মুসলমান বাদে, যারা অন্যদের স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিতে বাঁধা দিচ্ছিলেন”। স্বদেশি আন্দোলনে মুসলিম অংশগ্রহণের সাক্ষ্য হিসাবে কিছু মুসলমান নেতার নাম বিভিন্ন আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে। এঁদের একজন হলেন খাজা আতিকুল্লাহ- নবাব সলিমুল্লাহর বৈমাত্রেয় ভাই, তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রবল বিরোধী। ডিসেম্বর ১৯০৬ কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করেন খাজা আতিকুল্লাহ। ওই প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

“পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা সকলেই বঙ্গভঙ্গের পক্ষে একথা ঠিক নয়। কিছু ধনী মুসলমান নিজেদের স্বার্থে সরকারের এই পদক্ষেপ সমর্থন করছে”।

নিজের পরিবার সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিলো,

“নবাব সলিমুল্লাহর মত গোটা খাজা পরিবারের মত নয়। এই পরিবারের অন্যরা বঙ্গভঙ্গকে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের প্রতি অবিচার বলে মনে করেন এবং চান যে তা রদ হোক”।

প্রসঙ্গত, এই সভায় আতিকুল্লাহ ছাড়াও ঢাকা নবাব বাড়ির আরো কিছু সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে অন্যান্যরা যাঁরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য-
* সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খান বাহাদুর মহম্মদ ইউসুফ- ১৯০৬ সালে ফেডারেশন হলের সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য ঐ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়,
* বরিশালের জমিদার সৈয়দ মোতাহার হোসেন- বঙ্গভঙ্গ-রদের আন্দোলনের বর্ষপূর্তির সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন,
* ফরিদপুরের উকিল আলীমুজ্জামান চৌধুরী- ১৯০৭ সালে নিজের জেলার এক হাজার মুসলমানের সইসহ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক স্মারকলিপি পেশ করেছিলেন,
* বর্ধমান জেলার কংগ্রেস নেতা আবুল কাসেম,
* কলকাতার আইনজীবী ও টাঙ্গাইলের জমিদার আবদুল হালিম গজনভি,
* ব্যরিস্টার আবদুল রসুল- হালিম ও রসুল মিলে মুসলিম লীগ বিরোধী ‘বেঙ্গল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন,
* যশোরের স্বদেশি নেতা দীন মহম্মদ,
* ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকার সম্পাদক মুজিবর রহমান,
* মৌলবি কাজেম আলি মাস্টার,
* মৌলানা মহম্মদ আকরাম খাঁ- আজাদ পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক,
* পাটনার আলি ইমাম ও তার সহোদর হাসান ইমাম,
* ব্যারিস্টার মজহারুল হক- সাদাকত আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা,
* মৌলানা আবুল কালাম আজাদ,
* কলকাতার শিক্ষক দেদার বক্স- স্বদেশি আন্দোলনের বক্তা হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন,
* ঢাকার শিক্ষক হেদায়েত বক্স, স্বদেশি প্রচারক দেদার বক্স ও ‘ছোলতান’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মৌলবি মনিরুজ্জামান ইসলামবাদি- স্বদেশি আন্দোলনে এই তিনজনেরও বক্তা হিসাবে সুনাম ছিলো,
* কবি সৈয়দ আবু মহম্মদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী- স্বদেশি করতে গিয়ে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে লাঞ্ছিত হন,
* অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির সক্রিয় সদস্য লিয়াকত হোসেন,
* হুগলির আবুল হোসেন এবং ‘হাবলুল মতীন’ পত্রিকার সম্পাদক প্রাক্তন ফারসি শিক্ষক আবদুল গফুর- দুই বাঙলায় এঁরা বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা করেন।…… প্রমুখ।
১৯০৭ সালের গোড়ায় যে স্মারকলিপি পেশ করেন আলিমুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর সহ-স্বাক্ষরকারী খানপাড়ার জমিদার রহমতজান চৌধুরি, তাতে তাঁরা বলেন,

“সরকার যদি চাকরি-বাকরির ব্যাপারে বিশেষ কিছু সুবিধা দিতে চায় মুসলমানদের তাহলে সেটা বাঙলা ভাগ না করেও দেওয়া যেত”।

১৯০৭ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক বিশাল জনসভা হয় দক্ষিণ মালদায়। তাতে শ্রোতাদের অর্ধেকই ছিলেন মুসলমান। মৌলবি মুহম্মদ সালেহ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্বনাথপুরের মুন্সি মুহম্মদ গুলজার। ১৯০৭ সালের অক্টোবর শেষ সপ্তাহে খুলনা জেলার সেনহাটিতে ঐ রকম একটি সভা হয়েছিলো প্রায় পুরোপুরি মুসলিম উদ্যোগে। শুধু অবস্থাপন্নই নন, অনেক মুসলমান চাষীও এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

উপসংহারঃ তবে এটা ঠিক, এ বঙ্গের অধিকাংশ মুসলমানই পরবর্তিতে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। কারণ কি? হিন্দুদের তুলনায় পশ্চাদপদ মুসলমানরা মনে করেছিলো এতে তাদের সমূহ উন্নতি সম্ভব- এবং এ প্রলোভনটিই প্রথম থেকে ব্রিটিশরা মুসলমানদের দিয়ে এসেছে। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সফরে লর্ড কার্জন বলেন,

“বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে এমন এক নতুন ঐক্য আনবে যা মুসলমান শাসকদের আমলেও তাঁরা পাননি”।

বাস্তবিকই এসময় ব্রিটিশদের কিছু উদ্যোগ দেখা যায়। বঙ্গভঙ্গের ঠিক পরেই পাট চাষে কৃষকরা লাভবান হন। এবং পরীক্ষামূলকভাবে বর্গা বা আধিয়ারি আইন প্রচলিত হওয়ায় কৃষকরা জমিদারের খাস জমিতে বর্গাচাষি হিসাবে স্বীকৃতি পেতে লাগলেন। শুধু ঢাকা জেলাতেই ৭০ হাজার কৃষক খাসজমির প্রজা হিসাবে নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করতে পেরেছিলেন। (অথচ- এই ইংরেজ সরকারই একদিন চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের মাধ্যমে- কৃষকদের জমি থেকে উতখাত করেছিলো!!), একে বঙ্গভঙ্গের সুফল মনে করে মুসলমান কৃষকরাও বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করতে আরম্ভ করেন। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নতুন গভর্ণর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার মুসলমানদের উন্নতির জন্য বিশেষ নজর দেন, এতে কিছু পরিবর্তনও খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে- যার মধ্যে মুসলমানদের শিক্ষা অন্যতম। ফুলার বলেছিলেন,

“হিন্দু-মুসলমান তাঁর দুই স্ত্রী এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতিই টান বেশি তাঁর”।

ব্রিটিশ সরকার এপর্বে নানাভাবে মুসলমান তোষণ চালিয়ে যেতে থাকে, নতুন প্রশাসনে মুসলমান ও হিন্দুর অনুপাত ২:১ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। নবাব সলিমুল্লাহর অবদানও কম নয়- বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলমানদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে। ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহকে দেনার দায় থেকে বাঁচাতে ১৪ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়া হয় সরকারি কোষাগার থেকে। কেননা, বৃটিশ সরকারের একথা অজানা ছিলো না যে, পূর্ববঙ্গের অভিজাত মুসলমান সম্প্রদায় এবং মুসলমান তালুকদার-ধনী কৃষক গোষ্ঠীর ওপরে নবাব সলিমুল্লাহর যথেস্ট প্রভাব আছে। নবাব সলিমুল্লাহর মদতপুষ্ট প্রচারকরা প্রচার করতে থাকে যে, নতুন গঠিত হওয়া প্রদেশটিতে মুসলমান কৃষকদের কোন রাজস্ব দিতে হবে না এবং বৃটিশদের শেষ হয়ে ইসলামের পুনরুত্থান আসন্ন, যে ইসলামি শাসনের কর্ণধার হবেন নবাব সলিমুল্লাহ।

অথচ, অসংখ্য আত্মমর্যাদাশীল মুসলিম নেতাই এভাবে উপঢৌকন নিয়ে বিভক্ত হয়ে উন্নত হতে আপত্তি জানিয়েছিলেন- বলেছিলেন-

“পিছিয়ে পড়া অবহেলিত অংশ হিসাবে আমাদের উন্নতিতে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি অবশ্যই যৌক্তিক ও এটা আমাদের ন্যায্য দাবিও, কিন্তু এহেন ঐতিহাসিক ক্ষণে বঙ্গমাতাকে দ্বিখণ্ডিত করার লক্ষে আমাদেরকে দাবার বড়ে হিসাবে ব্যবহৃত করতে- যতই আমাদের উন্নতি করা হোক না কেন- আমরা কি সেই উন্নতিকে সমর্থন জানাতে পারি? কেননা এতে যে ইতিহাসে আমরা মাতার অঙ্গচ্ছেদকারির তল্পিবাহক হিসাবেই চিহ্নিত হবো!”

প্রশ্নঃ যেসব মুসলমান বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিলেন- তাঁরাও কি বাঙলাদেশ চেতনার বিরোধী?

সূত্রঃ
১। বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি- বদরুদ্দীন উমর,
২। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন- শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ,
৩। উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র (অষ্টম খণ্ড)- মুনতাসীর মামুন সংকলিত,
৪। Swadeshi Movement in Bengal- Sumit Sarkar,
৫। উপনিবেশপূর্ব বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি – গোলাম রব্বানী,
৬। Bengal divided- জয়া চ্যাটার্জি

তারিখ: ০২ , ২০০৮ ১২:৩১ (সামহোয়ারইনব্লগ.নেট)[সামহোয়ারইনব্লগে ত্রিভুজ সহ বেশ কিছু জামাতী পেইড ব্লগার পুরোমাত্রায় একটিভ থেকে নানারকম বক্তব্য- ব্যাখ্যা হাজির করতো, ওয়াজ মাহফিলের মুফতি- মওলানা – হুজুরদের “হিন্দু রবীন্দ্রনাথ, হিন্দুয়ানি ভাষা, সংস্কৃতি” ধরণের সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের তুলনায় ভিন্ন ছিল, যেহেতু এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে সাম্প্রদায়িকতা থাকতো যুক্তি- ব্যাখ্যার আড়ালে, সেহেতু অনেক শিক্ষিত অংশই বিভ্রান্ত হয়ে যেত! ঐ সময়ে ত্রিভুজ গোষ্ঠীর সাথে আমরা অনেকেই অনেক তর্ক বিতর্ক করেছিলাম। ইদানিং ত্রিভুজ গোষ্ঠীর বক্তব্য, ভাষা বেশ কিছুর হুজুরের ওয়াজে স্থান পাওয়ায়- এসব বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে বিধায় পুরাতন কয়েকটি লেখাকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ** ত্রিভুজগোষ্ঠীকে আমরা ঐ সময়ে জামাতী পেইড ব্লগার বা ছাগুরাম হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলাম, এভাবেই তাকে চিনতাম ও সম্বোধন করতাম। পরে অবশ্য জানা গিয়েছে, ত্রিভুজ হিজবুত তাহরির এর সাথে জড়িত। হিজবুত তাহরিরের সংশ্লিষ্টতার কথা শুনে অবশ্য অবাক হইনি। কেননা, সাম্রাজ্যবাদ সহ নানা ইস্যুকে এড্রেস করার এট্রাক্টিভ, স্মার্ট ও বুদ্ধিদীপ্ত ভঙ্গির সাথে আমার আগেই পরিচয় ঘটেছিল। প্রাইভেট ইউনিগুলোতে কেবল হিন্দু হিন্দু করে চিৎকার করা, আর বেহেশতী হুরের প্রলোভন দেখানোই যথেষ্ট ছিল না নিশ্চয়ই!]