আগে সুখ লাভ করা ছিল সহজ। ৭০০ বছর আগের একজন কৃষককে আপনি মাত্র একটি রুটি দিয়েই হয়তো সুখী করতে পারতেন। কিন্তু আজকের একজন মোটা, বিরক্ত ও প্রচুর টাকা পয়সাওয়ালা প্রকৌশলীকে আপনি কী দিয়ে সুখী করবেন? জৈবিকভাবে, সুখ নির্ধারণ হয় আমাদের দেহের বায়োক্যামিস্ট্রি দ্বারা। বিভিন্ন হরমোন, নিউরোট্রান্সমিটার বা ড্রাগের কারণে। পদোন্নতি পেলাম, কোটি টাকার লটারি জিতলাম বা প্রকৃত ভালোবাসা পেলাম- এগুলো বোগাস। মনে করুন, আপনি মারিও গটজে। ২০১৪ এর ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে জার্মানির মিডফিল্ডার। ১১৩ মিনিট শেষ। আর ৭ মিনিটের মধ্যে কোন গোল না হলে পেনাল্টি শুট শুরু হবে। ৭৫০০০ দর্শক মারাকানায় খেলা দেখছে, আর কয়েক কোটি পৃথিবী জুড়ে। হঠাৎ সুরলে আপনার দিকে একটি পাস দিলো। আপনি বুক দিয়ে ঠেকিয়ে আর্জেন্টাইন জালের দিকে অসাধারণ একটি কিক করলেন। পুরো পৃথিবী একসাথে চিৎকার করে উঠলো- গোললললল। আপনার মানসিক অবস্থা তখন কী? আপনি উন্মাদনায় ভাসছেন। বিদ্যুৎ বয়ে যাচ্ছে আপনার মেরুদণ্ড দিয়ে। আপনি হয়ে গেছেন The man on the moon. একই অনুভূতি পাওয়ার জন্য আপনার গটজে হওয়া লাগবে না। চাকরিতে অপ্রত্যাশিত একটি পদোন্নতি পেলেই আপনি একইরকম অনুভূতি পাবেন। আপনার শরীর ফুটবল বা চাকরি সম্পর্কে কিছুই জানেনা। দেহ শুধু বুঝে তার মধ্যে বয়ে যাওয়া ইলেক্ট্রিক সিগনাল। আপনি চাকরি হারিয়েও বা খেলায় হেরেও একই সুখের অনুভূতি পেতে পারেন। যদি আপনি জানেন ঠিক কোন ড্রাগটা খেতে হবে। কিন্তু আমরা মানুষরা এমনভাবে ডিজাইন করা যেন আমরা বেশিক্ষণ এই অসাধারণ সুখ অনুভব করতে না পারি। কিছুক্ষণ পরেই নিউরোট্রান্সমিটার, ইলেক্ট্রিক সিগনাল শেষ হয়ে যাবে, সুখও কমে আসবে। বিশ্বকাপে এরকম গোল করেছেন মানেই মারিও গটজে সারাজীবন সুখি থাকবেন ভাবা ভুল। একটি পদোন্নতি পেয়ে আপনি সারাজীবন সুখি থাকবেননা। একই সুখ অনুভব করতে আপনার হয়তো আরো একটা পদোন্নতি লাগবে। এই যে আমরা বেশিক্ষণ সুখে থাকতে পারি না, এর জন্য দায়ী বিবর্তন। বিবর্তন আমাদের দেহকে সুখী হওয়ার জন্য নয়, বরং টিকে থাকার জন্য এমনভাবে তৈরী করেছে। যে কাজ করলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে, যেমন ক্ষুধা লাগলে খাওয়া, বা বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ে, অর্থাৎ সেক্স, সেই কাজে আমরা সুখ অনুভব করি। খাবারের স্বাদ, কিংবা অর্গাজমের সুখ যদি সারাজীবন থাকতো সম্ভবত মানবজাতি বলে কিছু থাকতো না। ধরুন, মিউটেশনের কারণে কোনভাবে একটি কাঠবেড়ালি তৈরী হলো যা একটি বাদাম খাওয়ার আনন্দ সারাজীবন অনুভব করতে পারে। টেকনিক্যালি, ডিএনএ রিরাইট করে এরকম কাঠবেড়ালি তৈরী করা সম্ভব। এরকম কোন কাঠবেড়ালি যদি তৈরি হয়ও, তার জীবন হবে খুব সংক্ষিপ্ত। চরম আনন্দে সে আর খাবার খুজতেও যাবে না, সেক্সের কথা বাদই দিলাম। অন্যদিকে যাদের দিনে পাঁচ বার ক্ষুধা লাগে, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যেমন বেশি, বংশবৃদ্ধি করার সম্ভাবনাও ততো বেশি। ঠিক একই কারণে, মানুষ চাকরি, বড় বাড়ি, সুন্দর পার্টনার ইত্যাদি দিয়ে বেশিক্ষণ সুখী থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক উন্নতি, রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, সামাজিক সংস্কার- এগুলোর কথা ভুলে যান। এগুলো মানুষকে সুখী করে না। যদি বায়োক্যামিস্ট্রিই মানুষের সুখের কারণ হয়, সুখী হওয়ার জন্য বায়োক্যামিস্ট্রিতেই ধাক্কা দেয়া দরকার। কিছুদিন আগেও সাইকায়াট্রিক ড্রাগ ছিল ট্যাবু। আজ প্রচুর মানুষ প্রতিদিন প্রচুর ড্রাগ নিচ্ছে- ভালোর জন্য হোক বা খারাপের জন্য হোক। মানুষ অ্যালকোহল খায় ভুলে থাকার জন্য, গাঁজা খায় শান্তি পাওয়ার জন্য, কোকেইন নেয় আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য। এলএসডি তাকে নিয়ে যায় আকাশে। পড়াশোনা, পরিবারের মাধ্যমে কিছু মানুষ যা অর্জনের চেষ্টা করে, অন্যরা করে তা ড্রাগ নেয়ার মাধ্যমে। ফলে মাদক আসক্তি সমাজের অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকী। এই কারণে সকল দেশ মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সব ড্রাগের বিরুদ্ধে না। যুদ্ধে পাশাপাশি দুইজন সৈন্য একটি অ্যামবুশে পড়লো। একজন হয়তো ভয়ে স্থির হয়ে গেলো, সাহস হারিয়ে ফেললো। আরেকজন দেখা যাবে একই অবস্থা সাহসের সাথে মোকাবেলা করলো। পাঁচজন শত্রুকে গুলি করে মেরে মেডেলও পেয়ে গেলে। দুইজনের দুই রকম প্রতিক্রিয়ার কারণ তাদের বায়োক্যামিস্ট্রি। যদি এই ক্যামিস্ট্রি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে আমরা পাবো আরো সুখী ও একই সাথে সাহসী সৈনিক। পুজিবাদ আমাদের শেখাচ্ছে সুখই হচ্ছে আনন্দ। একারণেই হয়তো, প্রচুর গবেষণাগারে প্রচুর ড্রাগ তৈরী হচ্ছে- আইনি ও বেআইনি দুইভাবেই। Homo deus দের পরবর্তী এজেন্ডা সম্ভবত হবে “সুখের অধিকার”। ‘সুস্থ করা’ (Healing) আর ‘উন্নত করা’ (Upgrading) এর মাঝে কোন সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নেই। মেডিসিন সবসময়ই শুরু হয় অসুস্থ মানুষকে স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে। সেই একই মেডিসিনের জ্ঞান পরে ব্যবহৃত হয় স্বাভাবিক মানুষকে স্বাভাবিকের উপরে তোলার জন্য। সিলডেনাফিন যখন প্রথম আবিষ্কার হয় তখন তা উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরে আবিষ্কার করা হয়, সিলডেনাফিন রক্ত চাপ কমায়, কিন্তু পিনাইল আর্টারিতে রক্ত চাপ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ইমপোটেন্সি বা পুরুষত্বহীনতায় অসাধারণ কাজ করে। লাখ লাখ পুরুষ নিজেদের স্বাভাবিক যৌন জীবন ফিরে পায় এই এন্টিহাইপারটেনসিভের জন্য। যেই ঔষধ এতোদিন ব্যবহার করা হয়েছে স্বাভাবিক যৌন জীবন পেতে, এখন তা ব্যবহার করা হয় অধিক যৌণ ক্ষমতা পেতে। সিলফেনাফিনকে আপনি ‘ভায়াগ্রা’ নামে চেনেন। সার্জন হ্যারল্ড গিলিজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মুখে আঘাত পাওয়া সৈন্যদের চিকিৎসা শুরু করেন, তখনই আধুনিক প্লাস্টিক সার্জারি শুরু হয়। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সার্জনরা আবিষ্কার করেন, একই পদ্ধতিতে একটি পুরোপুরি ভালো কিন্তু দেখতে খারাপ নাককে সুন্দর নাকে পরিণত করা যায়। প্লাস্টিক সার্জারি যদিও অনেক অসুস্থদের ভালো করছে, এর বর্তমান প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, “সুস্থকে উন্নত করো, আর ধনীদের সুন্দর করো”। একই জিনিস জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এও হতে পারে। কোন কোটিপতি আর তার বউ ডিএনএ টেস্ট করে দেখলেন ডিএনএতে খারাপ মিউটেশন আছে। তারা টেস্ট টিউব বেবি বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনে গেলেন। সব কিছু যদি ঠিক থাকে ওকে। না হলে ভ্রূণ ধ্বংস করে ফেলো। সকল মানুষের ডিএনএতে কিছু খারাপ মিউটেশন থাকে। যৌণ প্রজনন অনেকটা লটারির মতো। কেউ জানেনা, সন্তান খারাপ মিউটেশন সহ জন্মাবে, না ছাড়া। এই লটারি নিয়ে একটা গল্প আছে। এনাতোলি ফ্রান্স ১৯৩২ সালের নোবেল লরিয়েট। অসাধারণ মেধাবি। ইসাডোরা ডানকান অসাধারণ সুন্দরী নৃত্যশিল্পী। একবার তাদের দেখা হলো। ইউজেনিক্স মুভমেন্ট নিয়ে কথা বলছিলেন তারা। ইসাডোরা বললেন, “এমন একটা সন্তান চিন্তা করুন, যে আমার সৌন্দর্য আর আপনার মস্তিষ্ক নিয়ে জন্ম গ্রহণ করবে।” ফ্রান্স উত্তর দিলেন, “ঈশ্বর না করুক, যদি উল্টোটা হয়? আমার সৌন্দর্য আর তোমার মস্তিষ্ক।” তাহলে কেন আমরা লটারি নিয়ে খেলবো? তার চেয়ে বরং একাধিক ডিম্বানু নিষিক্ত করি টেস্ট টিউবে। তারপর যেটা ভালো সেটা রাখি। অথবা ডিএনএ পরীক্ষা করে খারাপ জিনগুলো ভালো জিন দিয়ে পরিবর্তন করে দেই! এই জিন পরিবর্তনের একটা চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। মানুষের কোষের নিউক্লিয়াসে এক সেট ডিএনএ থাকে, আর মাইটোকন্ড্রিয়ায় তার নিজস্ব একসেট ডিএনএ থাকে। ডিফেক্টিভ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ অনেক ভয়ঙ্কর রোগের জন্ম দেয়। ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে এই মাইয়োকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পরিবর্তন করা সম্ভব Three Parent Baby তৈরির মাধ্যমে। নিউক্লিয়ার ডিএনএ আসবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে, মাইয়োকন্ড্রিয়াল ডিএনএ আসবে ৩য় ব্যক্তির কাছ থেকে। ২০০০ সালে আমেরিকায় এরকম একজন শিশুর জন্ম হয়েছে। ২০০১ সালে অবশ্য সরকার এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যদি পরিবর্তন করা সম্ভব হয়, পরের ধাপ হবে সংশোধনী। খারাপ জিনগুলোর কোড রিরাইট করা। যদি লিথাল জিনগুলো ঠিক করা যায়, তারপর ননলিথাল জিনগুলো ঠিক করে অটিজম বা অবেসিটির মতো রোগও সারানো সম্ভব। এই সকল ইঞ্জিনিয়ারিং এর নৈতিক দিক নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। সরকার ডিজাইনার বেবির বিপক্ষে। মনে করুন, আমেরিকায় সরকার চাইল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিষিদ্ধ করলো। কিন্তু নর্থ কোরিয়া এই কাজ করে অসাধারণ রেজাল্ট পাওয়া শুরু করলো। তখন কী হবে? হ্যাঁ, আমরা বেবি ক্যাটালগের পথে হাটা শুরু করেছি। এখনই সময় আমাদের চারপাশে কী ঘটছে তা ভালোভাবে বুঝার এবং এই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার। না হলে পরে হয়তো, সিদ্ধান্তই আমাদের নেয়া শুরু করবে। #Homo_Deus_ইয়োভাল_হারারি | ভাবানুবাদ | চ্যাপ্টার ১ কিস্তি ৪ ও ৫ Homo Deus চ্যাপ্টার ১ কিস্তি ৩
Homo Deus চ্যাপ্টার ১ কিস্তি ১ ও ২
[ইয়োভাল নোয়াহ হারারির নতুন বই Homo Deus – A Brief History of Tomorrow এর ভাবানুবাদের একটি প্রচেষ্টা হচ্ছে নিচের এই সিরিজ। এটি পুরো বইয়ের ভাবানুবাদ নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ ও বেশিরভাগ অংশের সারসংক্ষেপের একটি প্রচেষ্টা]
টিকে থাকা আর সুখে থাকাদের মধ্যে প্রচলিত অর্থে টিকে থাকাদের পূনঃজন্ম হবে আর সুখে থাকাদের চিরমুক্তি ঘটবে।
লেখাটির বিষয়বস্তু আকর্ষনীয় ও প্রয়োজনীয়। নৈতিক চিন্তার বিষয়ও বটে।
:good: অনেক কৌতুহলী ছিলাম,মুক্তমনা আসলে কী? কেন এটার এত আলোচনা সমালোচনা হয় জানার জন্য। আজকে পুরো মুক্তমনা ঘেটে দেখলাম। অসম্ভব ভালো লাগল এটা দেখে,এখানে সবাই যুক্তিবাদী, ধর্মীয় গোড়ামির কোনো ছিটে ফোটা নেই। আপনার লেখা চমৎকার লাগল। মানুষ কত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হচ্ছে, আপডেট হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো লাগল সুখের সংজ্ঞাটা।
সুখের ব্যাখ্যা সন্ধান ভালো লাগলো।
:rose: