লেখকঃ সাইফুল ইসলাম

গত ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া এমনকি কিছু খবরের কাগজেও এমন খবর দেখা যাচ্ছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই জয়ের ব্যাপারে নাকি আরও প্রায় ১৫ বছর আগে সিম্পসন কার্টুন সিরিজের একটা পর্বে ভবিষ্যতবানী করা হয়েছিল । অন্য সব কন্সপাইরেসি থিওরির মতোই এটাও সারা বিশ্বের মানুষই লুফে নিয়েছে । ফেসবুকের এক সেলিব্রেটি লেখকও এটা নিয়ে লিখে (সূত্রঃ ১) ছয় হাজারেরও অধিক লাইক এবং হাজারের উপরে শেয়ার এবং কমেন্ট কামিয়ে নিয়েছেন । তিনি আরও এক ডিগ্রি বেড়ে এখানে ইলুমিনাটি, বুশ, এইডস, ইবোলা, দাজ্জাল, ইমাম মেহেদি সব টেনেটুনে ছ্যাড়াব্যাড়া লাগিয়ে দিয়েছেন । আজ আমরা বহুল প্রচারিত এই মিথ্যা তথ্যটাকে ডিবাঙ্ক করার চেস্টা করবো ।

১) ভুল ভাঙ্গানোর মিশনেই যেহেতু নেমেছি, প্রথমেই একটা বোমা মেরে বিতর্কে জল ঢেলে দেই । বোমাটা হলো, সিম্পসনের যে পর্বটার ব্যাপারে বলা হচ্ছে, সেটা ২০০০ সালে না, প্রচারিত হয়েছে ৭ জুলাই ২০১৫ তে (সূত্রঃ ২), ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতার খবর কনফার্ম হওয়ার পর । সিম্পসন সব সময়ই সমসাময়িক ট্রেন্ড টপিকের উপর কার্টুন বানিয়ে থাকে । এটাও তার ব্যতিক্রম না । যেমন ধরেন, ১৯৯৯ এ এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়ে আশা প্রকাশ করেছিল এবন সিম্পসন সেই সুযোগও ছাড়েনি । তখন তারা ট্রাম্পকে “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প” আখ্যায়িত করে একটা পর্ব বানিয়ে ফেলেছিলো 😀 (সূত্রঃ ৩) যেটা প্রচারিত হয়েছিল ১৯ মার্চ, ২০০০ সালে (সূত্রঃ ৪) । একটা ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার যে, মার্কিন নির্বাচনের আগে ট্রাম্প আমাদের কাছে হয়তো একটা অপরিচিত নাম ছিল, কিন্তু আমেরিকায় সে মোটেও অপরিচিত না । ফ্যামিলিগতভাবেই তারা প্রচন্ড ধনী এবং বর্তমানে সে বিলিয়নিয়ার ।
২) এস্কেলেটর দিয়ে নামার সময় তার হাতের ভঙ্গীর যে ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেটা মোটেও ২০০০ সালের কোন ভিড়িও না, এমনকি ট্রাম্পের ফুটেজটাও নির্বাচনে জয়ের পরে না । তার মানে, এই ক্ষেত্রে তারা দুই দিকেই মিথ্যা কথা বলেছে (পুরাই মীর জাফর :p) । এই ছবিটাও সিম্পসনের ২০১৫ সালের সেই পর্ব থেকেই নেয়া এবং ট্রাম্পের ফুটেজটাও ২০১৫ সালের.
null

৩) কন্সপাইরেসি থিওরি ভিড়িওতে আরেকটা ব্যাপার ফোকাস করা হয়েছে সেটা হলো ট্রাম্পের জয়ী আসনগুলার ম্যাপ, যেই ম্যাপটা তারা নিছে “Mr. Burns Endorses Romney” নামক এপিসোড থেকে যেটা প্রচারিত হয়েছে নভেম্বর ১, ২০১২ তে (সূত্রঃ ৫) । এই পর্বের সাথে ট্রাম্পের বাপ-দাদা কারোই কোন সম্পর্ক নাই এবং সেখানে কারও জয় নিয়ে ভবিষ্যতবানীও করা হয়নি। এই এপিসোডে কথা বলা হইছিলো মার্কিন নির্বাচন ২০১২ নিয়ে, যেটাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন বারাক ওবামা এবং মিট রমনি । মনে রাখা ভালো, ২০১২ সালের মার্কিন নির্বাচন হয়েছিলো নভেম্বরের ৬ তারিখে ।

null
আর, ম্যাপটা । মিলে যায়? হুম, আসলেই প্রায় মিলে যায় ট্রাম্পের জয়ী ম্যাপের সাথে । তবে হতাশার কথা হলো, মিলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক । ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদের কিছু শক্ত ঘাঁটি আছে, যেগুলাতে তারা সব সময়ই জিতে । তাই, গত ২০০৮, ২০১২ এবং এই ২০১৬ সালের ইলেক্টোরাল ভোটের ম্যাপ দেখলে দেখা যাবে যে, হালকা এদিক ওদিক বাদে প্রতিটা নির্বাচনেই দুই দলের জয়ের ম্যাপ প্রায় একই রকমই আছে ।

null
২০০৮ মার্কিন নির্বাচনের ম্যাপ

null
২০১২ মার্কিন নির্বাচনের ম্যাপ

null
২০১৬ মার্কিন নির্বাচনের ম্যাপ

আমাদের দেশেও কি ব্যাপারটা একই রকম না? অল্প কয়েকটি আসন বাদে বেশিরভাগ আসনেই যে জিতবে, সেটা আগে থেকেই বলে দেয়া যায় । এটার একটা ভালো দিকও আছে । যেমন ধরেন, গোপালগঞ্জ শেখ হাসিনার আসন, সেখানে আওয়ামী লীগ জিতবে এবং ফেনী খালেদা জিয়ার আসন, সেখানে বিএনপি জিতবে, এটা মোটামুটি ধরেই নেয়া যায় । এখন কোন কারণে যদি গোপালগঞ্জে বিএনপি জিতে যায় এবং খালেদা জিয়া গোপালগঞ্জের নামই বদলিয়ে দিয়ে নিজের নামের সাথে মিলিয়ে “ল্যাদাগঞ্জ” রেখে দেয়, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে বলেন তো !!

সেলিব্রেটি ভাইয়ের পোস্টে আরও বেশ কিছু হুদামুদা থিওরি দেয়া হইছে যার কয়েকটার উত্তর জানা আছে এই মুহূর্তেই । তবে পোস্টটা আর লম্বা করতে ইচ্ছা করতেছে না, আইলসা মানুষতো ! শুধু উত্তরটা দিয়ে রাখি, কয়েকটা ভুল তথ্যের ব্যাপারে । জনসংখ্যা ৭ বিলিয়ন থেকে ম্যাস ম্যাসাকারের মাধ্যমে ২ বিলিয়নে নামিয়ে আনার আইডিয়াটা নেয়া হয়েছে “Twelve Monkeys” মুভির প্রোলোগ থেকে । ইবোলা ভাইরাস ১৯৯৭ সালে মোটেও অপরিচিত ছিলো না, প্রথম ইবোলা ব্রেকডাউন হয় ১৯৭৬ সালে, দক্ষিন সুদানে (সূত্রঃ ৬) । আর, উনি যে ভিড়িও থেকে এই সবগুলা তথ্য নিয়েছেন, সেটা এইটাঃ সূত্রঃ ৭

untitled
Screenshot from Movie ”Twelve Monkeys”

কন্সপাইরেসি থিওরি বিশ্বাস করায় এক ধরণের আরাম আছে । এটা বিশ্বাস করতে হলে কোন পড়ালেখা করা লাগে না, নিজের যেভাবে পছন্দ, সেভাবে বিশ্বাস করা যায় । কথা, অর্থ, তারিখ, নাম্বার হালকা এদিক ওদিক করেই নিজের মনমতো তথ্য বের করে ফেলা যায় । যদি কিন্তু তবে দিয়ে যেকোন কিছুকেই জায়েজ করে ফেলা যায় । এবং মানুষও নিজের মনের মতো থিওরি পেয়ে সেটা বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করে ফেলে । আর যদি কোনভাবে লেখার আগে “গবেষনায় দেখা গেছে/According to Science” শব্দত্রয় যোগ করে দেয়া যায়, তাইলেই তো সারছে । গবেষনায় দেখা গেছে যে, কোন বাক্যের আগে “গবেষনায় দেখা গেছে” শব্দত্রয় যোগ করলে সেই বাক্যের বিশ্বাসযোগ্যতা ৬৯.৪২০ ভাগ বেড়ে যায় ।

কন্সপাইরেসি থিওরি ছড়ানো মানুষগুলার জন্য ঘৃণা এবং এই অবাদ তথ্য প্রযুক্তির যুগেও সেই থিওরি যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করে ফেলা মানুষগুলার জন্য করুণা ।

সূত্রসমূহঃ

১) https://www.facebook.com/moynuddinarif/posts/1012049245524407
২) https://www.youtube.com/watch?v=oz7_JP7ROvA
৩) https://www.youtube.com/watch?v=ZtparSnQhFc
৪) https://en.wikipedia.org/wiki/Bart_to_the_Future
৫) https://www.youtube.com/watch?v=ltCIEbLMaQg
৬) http://www.who.int/mediacentre/factsheets/fs103/en/
৭) https://www.youtube.com/watch?v=iZyaDKaun7w