লিখেছেনঃ ফাহিম আহমেদ
মৃত্যুদন্ডাদেশ একটি নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অধঃপতিত শাস্তি। বর্তমান বিশ্বের অর্ধশতকেরও বেশি রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম একটি ধরণ হলো রাষ্ট্র কর্তৃক সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হিসেবে মৃত্যুদন্ডাদেশের আইন। ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পর মাত্র ৮টি দেশ অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধানকে বাতিল করে। ১৯৭৭ সাল
নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ তে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৪০টি দেশ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হিসেবে মৃত্যুদন্ডের আদেশকে বাতিল করে যা বিশ্বের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ দেশের সমপরিমাণ। তবে এ দেশগুলোর মধ্যে কেবল ১০২টি দেশ সকল প্রকার অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের আইনকে বাতিল ঘোষণা করেছে।
মৃত্যুদন্ডের শাস্তি মানেই রাষ্ট্র কর্তৃক একজন নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা। এটি সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের দুটি বিধানকে সরাসরি লঙ্ঘন করে। প্রথমটি হল, জীবন ধারণের অধিকার এবং দ্বিতীয়টি, অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। মৃত্যুদন্ডের বিধান একটি চূড়ান্ত ও অনড় শাস্তি। এর মাধ্যমে নিষ্পাপদের শাস্তি দেয়ার সম্ভাবনা সর্বদা রয়ে যায়। ১৯৭৩ পরবর্তী আমেরিকা-যুক্তরাষ্টে ১৫০ জন বন্দীকে
মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় যারা পরবর্তীতে নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। আইনের মাধ্যমে যে সকল দেশ মৃত্যুদন্ডের বিধান কার্যকর করে তাদের বিচার ব্যবস্থা নানা সময়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান মোতাবেক, ২০১৫ সালে হওয়া মৃত্যুদন্ডগুলোর মাঝে ৮৯% হয়েছে বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশে (চীন, ইরাক ও ইরান)। অনেক মৃত্যুদন্ডের ক্ষেত্রে স্বীকরোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রধান ভূমিকা পালন করে যা অত্যাচারের মাধ্যমে গ্রহণ করার অভিযোগে জর্জরিত। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণী কিংবা জাতিগত, বর্ণভিত্তিক অথবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অধিক মৃত্যুদন্ডের শিকার হয় বিচারিক নিরপেক্ষতার অভাবে। মৃত্যুদন্ডের বিধানকে ইরান ও সুদান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক্ষেত্রে তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে। এগুলো হলোঃ বিশ্বের যে সকল দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে তা রহিত করা, যে সকল দেশে মৃত্যুদন্ডাদেশ রহিতকরণ সম্পন্ন হয়েছে সে সকল দেশে এ বিধান চিরতরে বাতিল করা এবং সকল প্রকার মৃত্যুদন্ডের শাস্তিকে কারাদন্ডে রূপান্তরিত করা।
যেসকল আন্তর্জাতিক আইন যুদ্ধাপরাধ ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের বিধানের বিরোধিতা করে সেগুলো হলো- The Second Optional Protocol to The International Covenant on Civil and Political Rights, Protocol No: 6 to The European Convention on Human Rights, The Protocol to The American Convention on Human Rights to Abolish Death Penalty; তবে যুদ্ধাপরাধসহ সকল ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে “Protocol No: 13 to The European Convention on Human Rights” আইনটি। বিভিন্ন দেশের আইন হত্যার মত অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধানের প্রয়োজনীয়তার যুক্তি দেখালেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে এটি কোন সমাধান নয়। রাষ্ট্রে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্য যে সকল পদ্ধতি গ্রহণ করা হয় তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ফাঁসি, শিরচ্ছেদ, ইলেক্ট্রিক শক, রাসায়নিক ইনজেকশন, ফায়ারিং স্কোয়াডের দ্বারা মাথার পিছনের অংশে গুলিবর্ষণ ইত্যাদি। ২০১৫ সালে সমগ্র বিশ্বে (চীন ব্যতীত) ১৬০০ টিরও বেশী মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ঘটনা দেখা যায় যা ২০১৪ সালের চেয়ে ৫৪% বেশী। মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সনদ ৬২/১৪৯ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০০৮ সালে এ সনদটি প্রয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে মৃত্যুদন্ডের শাস্তির ওপর স্থগিতাদেশ দিতে অনুরোধ করা হয় যা এ শাস্তির বিলুপ্তির লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মৌলিক অধিকার সনদের ২(২) ধারা মোতাবেক সকল প্রকার মৃত্যুদন্ডাদেশের বিরুদ্ধে ইইউ রাষ্ট্রগুলো অবস্থান নেয়। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে কাউন্সিল অব ইইউ “European Day Against Death Penalty” প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয় যা ২০০৮ সালের ১০ই অক্টোবর থেকে পালিত হয়ে আসছে। “World Coalition against Death Penalty” কর্তৃক একই বছর থেকে একই দিনে “আন্তর্জাতিক মৃত্যুদন্ডাদেশ বিরোধী দিবস“ পালন শুরু হয়।
যে জীবন রাষ্ট্র দিতে পারে না সে জীবন কেড়ে নেয়ার অধিকারও রাষ্ট্রের নেই। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তি হিসেবে নাগরিকদের অপরাধে নিরুত্সাহিত করার ক্ষেত্রে এ দন্ডটি ব্যবহারের কথা বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যেসকল দেশে মৃত্যুদন্ডের আইন প্রচলিত আছে সেসকল দেশে অপরাধের মাত্রা নিম্নগামী না হয়ে বরং ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তবে মৃত্যুদন্ডাদেশ নিষিদ্ধ করার জন্য সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম যা মানবাধিকারের পক্ষে লড়ই করতে সক্ষম। দেশে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও মৃত্যুদন্ডের আইন
কার্যকর রাখা মানবিক আদর্শের পরিপন্থী।
ফাহিম আহমেদ
৪র্থ বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সবক্ষেত্রেই যে উন্নত দেশগুলোই মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ করেছে তা কিন্তু নয়। উজবেগিস্তান, বুরুন্ডি, টোগো, গ্যাবন, লাতভিয়া এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আজ হোক কাল হোক সব দেশেরই এটি নিষিদ্ধ করতে হবে। কেননা, “যে জীবন রাষ্ট্র দিতে পারে না সে জীবন কেড়ে নেয়ার অধিকারও রাষ্ট্রের নেই”।
বাংলাদেশে মৃত্যুদন্ড আইনতঃ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়া একজন শিশু-ধর্ষনকারী মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে- এমনকি ফিক করে খানিকটা হেসে- ভাবতেই পারে, ‘আর যাই করুক মেরে তো ফেলবে না’। ওয়েল, লেখক অবশ্য এই ধারার যুক্তি খন্ডন করেছেন তার লেখায় এভাবে, “কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যেসকল দেশে মৃত্যুদন্ডের আইন প্রচলিত আছে সেসকল দেশে অপরাধের মাত্রা নিম্নগামী না হয়ে বরং ক্রমেই বেড়ে চলেছে।” খুবই সত্য কথা। তো এই সত্য কথাটাকে এদিক থেকে না দেখে অন্য আরেক দিক থেকে দেখার চেষ্টা করি। যেসব দেশে মৃত্যুদন্ডের আইন প্রচলিত নেই সেসব দেশে কি যাবজ্জীবন কারাদন্ড (মৃত্যুদন্ডের সমতুল্য শাস্তি) দেবার মত অপরাধ খুব ফ্রিকোয়েন্টলী ঘটে? বোধহয় না। বরং আমরা দেখতে পাই সেসব দেশ সভ্যতার এমন একটা চূড়ায় উঠে গেছে যে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দূরে থাক কারাগার জিনিসটাই অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। বহু কারাগার বন্ধ করে দিতে হচ্ছে কয়েদীর অভাবে। আমার পোড়া স্বদেশ কি সভ্যতার মানদন্ডে সেই সব দেশের ধারেকাছে কোথাও আছে? এবং ধারেকাছে যাবার আগেই মৃত্যুদন্ড তুলে দিয়ে এক লাফে ‘সভ্য দেশ’ হয়ে যাওয়ার চিন্তা কি আদৌ যৌক্তিক?
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সকল প্রকার মৃত্যুদন্ডের শাস্তিকে কারাদন্ডে রূপান্তরিত করতে চায়। কারন সম্ভবত, মৃত্যুদন্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডকে আইনের চোখ সমান বিবেচনা করে। কিন্তু অপরাধী মনও কি সেভাবে বিবেচনা করে? মনে পড়ে কাদের মোল্লার সেই ভি সাইনটা?
মৃত্যুদণ্ডের ঘোর বিরোধী অনেক মানুষই। কাজের একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। লেখাটিতে দেখলাম শুধু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রেফারেন্স টানা হয়েছে একাধিকবার, আরো কিছু ভিন্নসূত্র থাকলে ভালো হতো মনে হয়। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভূমিকাতে অনেকেই অসন্তুষ্ট আছেন।
তৃতীয় বিশ্বে আসামীদের উপর রিমান্ড সম্পর্কে সামান্য যা জানি, তাতে মনে হয় একেকটা রিমান্ড মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। এটা বন্ধ হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড বন্ধ হওয়ার আগেই। এমন কি একজন ক্রিমিনালের উপরও এমন রিমান্ড হতে পারে না।