সবাই এখন আমেরিকার নির্বাচন আর ট্রাম্পের অনাকাংখিত বিজয় নিয়ে আলোচনা মুখর। বিশ্ব শান্তি ও অশান্তির মুল কারন এই দেশটির প্রেসিডেন্ট, তাই নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের সকল মানুষের মাঝে এ ধরনের আলোচনা সমালোচনা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যেদিন নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয় সেদিন সন্ধ্যায় আমি এক বৃদ্ধের সাথে বসে অন্য একটা প্রসঙ্গে আলাপ করছিলাম । আলাপের মাঝখানে আমেরিকা প্রবাসী মেয়ের ফোন। ট্রাম্পের বিজয়ে মেয়ের কন্ঠে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়। বাবার কাছে অনাসয়ে সে সেসবের কারন একে একে ব্যাখ্যা করছিল। বাবার সরাসরি ক্ষেদোক্তি,”একটা দেশে সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে কী রকম লাগে দেখ!” এবার আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ে মনে হয় বাংলাদেশী সংখ্যাগুরুদের এটাই বড় দার্শনিক উপলব্ধি। কিন্তু এই উপলব্ধির কী কোন বাস্তব প্রতিফলন আছে?
আমেরিকার নির্বাচনের ডামাডোলের কারনেই হোক অথবা নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ীঘরে আক্রমণের কারনেই হোক , কাছাকাছি সময়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের উপর পুলিশ প্রশাসন, চিনি কল মালিক ও স্থানীয় মাস্তানদের ত্রিমুখী আক্রমনের ফলে হত্যা, নির্যাতনের খবর তেমনভাবে আলোচিত হয়নি।একেকদিন একেকটি লাশ পাওয়া যায় ধান ক্ষেতে নয়তো কোন ঝোপের আড়ালে। কেউ মরছে হাসপাতালে । কাউকে মেরে হাতকড়া লাগিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়েছে। জীবিতরা অনাহারে দিনাতিপাত করছে।
কয়েকজন নাগরিক প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গেলে প্রশাসনের লোকজন বাধা দিয়ে বলে, প্রশাসন জাতীয় পরিচয় পত্র দেখে বিতরন করবে। কার ত্রান কে দান করে ।ভাত দেয়ার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই। সর্বশেষ প্রশাসনের খাদ্য সাহায্য সাঁওতালরা প্রত্যাখ্যান করে। এটা তাদের আত্নসম্মানবোধের বড় পরিচয়। সবার আপ্রান চেষ্টা যে করেই হোক সাঁওতালদের উচ্ছেদ। কিন্তু তারা যাবে কোথায় সেই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
আসুন দেখি এবার আমাদের সংবিধানে এদের কী ধরনের রক্ষা কবচ আছে।
জাতীয় সংস্কৃতি ২৩৷ রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন৷
উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ১৭
[ ২৩ক। রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।রাষ্ট্র কী সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছে? স্পষ্টতঃ এ দুটি ধারার লংঘন। খবরে দেখা গেছে মেজিস্ট্রেট সাঁওতালদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। ম্যজিস্ট্রেটের গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া মত কিছু কী হয়েছিল? এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রখ্যাত লেখক অন্নদাশংকর রায়ের একটি অভিজ্ঞতার কথা স্মরন করা যেতে পারে। তিনি তখন যশোরের কোন এক এলাকার ম্যজিস্ট্রেট । জনতা উগ্র, পুলিশ বলছে গুলির নির্দেশ দেয়ার জন্য। তিনি জনতাকে আলোচনার জন্য ডাকলেন, তাদের কথা শুনলেন। তাদের থামাতে পারছেন না দেখে হঠাত টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য করা শুরু করে দিলেন। উম্মত্ত জনতা অবাক হল। অন্নদাশংকর সবাইকে অনুরোধ করলেন,ঘরে ফিরে যাও বাপু। জনতা শান্ত হয়ে ঘরে ফিরে গেল। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সাঁওতালরা কী ভয়ংকর কোন জাতি যে তাদের বন্দুকের মুখে শান্ত করতে হবে? তাহলে পাকিস্তানীদের সাথে পার্থক্য কী থাকলো?
২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল প্রনয়ন করে। বাংলাদেশ ১৭ টি ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পুরন করবে বলে অংগীকারবদ্ধ হয়। এর মধ্যে একটা হলো –peace justice and strong institutions। এতে বলা হয়েছে-
Without peace, stability, human rights and effective governance, based on the rule of law – we cannot hope for sustainable development. We are living in a world that is increasingly divided. Some regions enjoy sustained levels of peace, security and prosperity, while others fall into seemingly endless cycles of conflict and violence. This is by no means inevitable and must be addressed.
High levels of armed violence and insecurity have a destructive impact on a country’s development, affecting economic growth and often resulting in long standing grievances that can last for generations. Sexual violence, crime, exploitation and torture are also prevalent where there is conflict or no rule of law, and countries must take measures to protect those who are most at risk.
The SDGs aim to significantly reduce all forms of violence, and work with governments and communities to find lasting solutions to conflict and insecurity. Strengthening the rule of law and promoting human rights is key to this process, as is reducing the flow of illicit arms and strengthening the participation of developing countries in the institutions of global governanceএজন্য বাংলাদেশকে বছর বছর জাতিসংঘে রিপোর্ট পাঠাতে হবে। এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে বাংলাদেশ কী রিপোর্ট দেয় তা দেখার বিষয় কিংবা ভালো রিপোর্ট করার মত কিছু থাকে কি না তাও আমাদের দেখতে হবে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা কি খুব বেশি? সর্বশেষ ২ জুন ২০১৪ সাংসদ ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীর প্রশ্নের জবাবের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর জানান, “ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠির সংখ্যা ২৭ ।” তিনি ২৭ টির তালিকা প্রকাশ করেন। ১৯৯১ সালের আদমশুমারীতে ছিল ২৯। মোট জনসংখ্যা ১২,০৫,৯৭৮। তবে আদিবাসী ও গবেষকদের দাবী বাংলাদেশে ৪৫ বা তারও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি ছিল। পাটিগনিতের সহজ হিসাব মতে প্রতি ৪৫ বছরে কমছে ১৮। সেই হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রাখা বাদবাকী নৃগোষ্ঠির বিলুপ্তি হতে আরো ৬৫ বছর লাগার কথা। কিন্ত গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে আমরা 2030 সালের মধ্যে SDG র লক্ষ্যমাত্রায় পৌছতে না পারলেও তার আগেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উচ্ছেদে জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে যাব। জাতীয় সংসদে “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০” পাশ হয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্টানকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু তাদেরকেই যদি রক্ষা করা না যায় প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করে কি হবে?
সুত্রঃ http://www.undp.org/content/undp/en/home/sustainable-development-goals
ঘর পুড়িয়ে ছাই দান।
এই ব্যাপারে সংস্কৃতি-মন্ত্রী সাহেবের বক্তব্য কী?
না তাদের কারোই এখনো দৃশ্যমান কিছু চোখে পড়েনি। বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও বিষয়টা গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছে, তাই তারাও চুপ। বিদেশী সাহায্যপুস্ট আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করা করা এনজিওগুলোও চুপ।যারা বিভিন্ন ইস্যুতে রীট করছে তারা নেতাগোছের কেউ না, সাধারন আইনজীবী।