monsoon-one
জন্মভূমিকে কে না ভালবাসে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমার দেশপ্রেম অত উচ্চকিত নয় তবে তা একেবারেই নেই তাও নয়। এখন দূর প্রবাসে চিরদিনের জন্য স্থায়ী হয়ে গেলেও প্রায়ই মনে হয় দেশে থেকে গেলে কি খুব খারাপ হত? যখনি বৃষ্টির দুএক ফোঁটা গায়ে এসে পড়ে তখনি মনে পড়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতুত বর্ষাই ছিল। হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনে প্রায় দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেতের ওপর অবিশ্রান্ত বর্ষণ ত আমাকেও দিশাহারা করে দিত। কালবৈশাখীর যে রুদ্ররুপ আমি দেখেছি তার বর্ণনা কি কোনো ভাষায় সম্ভব? সাহিত্য কি সত্যিই অতটা শক্তি ধারণ করে? আকাশে ক্রমঘণীভূত ভয়ংকর সুন্দর কালো মেঘের মাদকতাও ত আমাকে স্পর্শ করে গেছে। আমার কাছে তখন মনে হত মৃত্যুর পর এই একটা জিনিসের অভাবই হয়ত আমি বোধ করব। অন্ধকার রাতে গ্রামের বাড়ির টিনের চালে অবিরাম বৃষ্টির শব্দের জন্য যেকোনো অপরূপা মোহনীয়া নারীর ডাকও বোধহয় অগ্রাহ্য করতে পারতাম। অবশ্য এ ব্যাপারে সামান্য সন্দেহ আছে, কারণ ওই সৌভাগ্যটি আমার হয়নি। তবে হলেও সাড়া দিতে যে দেরী হত তাতে সন্দেহ নেই।
দেশ ছাড়ার আগে আমার সর্বশেষ পোস্টিং ছিল হাওরের মধ্যে অবস্থিত একটি হাসপাতালে। সেখানে যাওয়ার পথে সাগরসম হাওরের ভালবাসায় হাবুডুবু খেয়েছি তাওত মিথ্যে নয়। শেষবারের মত যখন সেখান থেকে চলে আসি সেদিন প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। এক একেকটা ঢেউ আমাদের ট্রলারটিকে নিয়ে যেন লোফালুফি খেলছিল। ভয়ত পাচ্ছিলামই সাথে এও মনে হচ্ছিল আর কখনোত দেখা হবে না। যেই হাওরে পোস্টিংকে সবাই অভিশাপ মনে করত আমার কাছে তা পুরস্কার বলেই মনে হত। অবশ্য যার ভরা পূর্ণিমার রাতে বিশাল মালবাহী নৌকার ছাদে বসে হাওরের রূপ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার পক্ষে এর মর্মোদ্ধার করা কঠিন।
আর শীতের কুয়াশাঢাকা সকালের কথাই বাদ দিই কি করে? কুয়াশার পর্দা ভেদ করে মাটির উঠোনে ভেসে আসা একফালি রোদ তাও কি আর কোথাও খুঁজে পাব। আদিগন্ত শিশিরভেজা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ায় যে সুতীব্র ভাললাগা তা কি ভোলা সম্ভব? আর আমার দেশের অনেকটা অপরিচিত মানুষেরও যে সহজ,সরল আন্তরিকতার পরিচয় হামেশাই পেয়েছি তাও ত অনুল্লেখ্য নয়। অবশ্য এটা একমুখী নয়। এর শ্রেণীগত দিকও আছে। আমার শ্রেণীগত অবস্থানও হয়ত আমাকে এই সুযোগ করে দিয়েছিল।
এতকিছু যেখান থেকে আমি পেয়েছি সেখানে এই ‘কিন্তু‘ কেন? কারণ আমি মনে করি আমি যে দেশে জন্ম নিয়েছি তার এত অসামান্য সৌকর্য্য থাকা সত্ত্বেও তার গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেই দেশের মানুষও তার ব্যতিক্রম নয় তাদের অনেক অতুলনীয় গুণ থাকলেও। কারণ আমি কোনো অবাস্তব স্বপ্ন,অলীক আশার তরীতে উঠতে রাজি নই। কোনো তথাকথিত হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যে নামক ভাবালুতায় গা ভাসিয়ে দিতে রাজী নই। আমি জানি দেশ বর্তমানে যে অবস্থানে আছে সেখান থেকে তার সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি হতে পারে। কিন্তু তার চিন্তা,মননশীলতা ও বৌদ্ধিক জগতে যে প্রকট বন্ধ্যত্ব বিরাজমান তার কোন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখি না। মুক্তচিন্তার যে নিদারুন সংকট তার উত্তরণ নিয়েও কোনো কল্পনার জগতে ভেসে যেতে রাজী নই।
তাহলে কেন আমি এরকম ভাবতে বাধ্য হচ্ছি? এর একটাই কারণ আমাদের দেশটা প্রায় সম্পূর্ণ মুসলিম অধ্যুষিত। পৃথিবীর গত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে একটি মুসলিম রাষ্ট্র বা রাজ্যও নেই বা ছিল না যারা এর ব্যতিক্রম ছিল। আমাদের দেশ তার অন্যথা হবে ভাবার ত কোনো কারণ নেই। আমি কি মুসলিম বিদ্বেষী? অবশ্যই না। আমি একজন অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর মানুষ হওয়ার পরও নানা কারণে আমার বন্ধু,পরিচিত,স্বল্পপরিচিত এমনকি অপরিচিত মানুষের কাছ থেকেও যে স্নেহ ভালবাসা পেয়েছি তা খুব মানুষই পায়। তারা প্রায় সবাই মুসলমান। তাদের প্রতি বিদ্বেষ এর প্রশ্নই আসে না। তবে আমি যে নাস্তিক ও যেকোনো ধর্মের সমালোচনার অধিকারে বিশ্বাস করি তা জানলে তাদের আচরণ কি হত তা নিয়ে কিন্তু আমি যথেষ্ট সন্দিহান। তাছাড়া তাদের পূর্বপুরূষেরাই যে সম্পূর্ণ ধর্মীয় কারণে পাকিস্তান তৈরী করেছিলেন তাই বা ভুলি কি করে। যার ফল প্রায় একতরফাভাবে সংখ্যালঘুদেরকেই ভোগ করতে হয়েছে। এই তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেও যে প্রক্রিয়া এখনো চলমান। তাই সে ধর্মটির যে অসহিষ্ণু রুপ আমি তার তীব্র বিরোধী। অনেকেই বাংগালীর সহজ,সরল মানসিকতার কথা বলবেন, ধার্মিক হয়েও অনেকেই অপর ধর্মের প্রতি কত শ্রদ্ধাশীল সেই প্রসঙ্গ টেনে আনবেন। কিন্তু এর সাথে ধর্মের কোনো সম্বন্ধই নেই। এটা আদিম সাম্যবাদী টোটেমভিত্তিক সহজিয়া সমাজের ধ্বংসাবশেষ। যা বহু হাজার বছর পেরিয়ে নাথ, যোগী সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সহজযান, বৈষ্ণবদের হাত ধরে আমাদের সমাজে আশার সলতে হয়ে টিমটিম করে জ্বলছে। বাউল সম্প্রদায় যার সরাসরি উত্তরাধিকারী। তবে সেই ম্রিয়মাণ ও ক্ষীণকায় বাউল গোষ্ঠীর ওপর যে অসহিষ্ণুতার তান্ডব দেশজুড়ে চলছে, তার কারণ খুঁজলেও ত সেই ইসলাম ধর্মই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেকেই ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন রূপের কথা বলেন। আমি বলি সবই এক খালি পরিবেশনের পাত্রটিই আলাদা।
protest-ramkrishna-organization-samanta-against-esplanade-uniform_10a72c52-9795-11e6-89e7-7a6d6b3d3438
ইসলাম ধর্ম যেখানেই তার প্রভাব বিস্তার করেছে সেখানেই তার লোকজ সংস্কৃতির মূলোৎপাটনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। এখানে আফগানিস্তানের সুপ্রাচীব কালাশ সম্প্রদায়ের কথা বলা যায়। তারা সেই দেশের কাফিরিস্তান প্রদেশে বসবাস করত। প্রদেশের নামটি খেয়াল করতে অনুরোধ করছি। যাই হোক এখন কিন্তু এই নামে কোনো প্রদেশ বা কালাশ নামে কোনো সম্প্রদায় আপনি সেখানে খুঁজে পাবেন না। আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে সেই দেশের তৎকালীন রাজা আব্দুর রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অভিযানের মাধ্যমে তাদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। যেহেতু তারা তখন আর কাফের নয় প্রদেশের নাম রাখা হয় নূরীস্তান। এখনো কিছু কালাশ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ পাকিস্তানের চিত্রল উপত্যকায় বসবাস করেন। তবে আর কিছুদিন পরেই যে এই অতি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী গোষ্ঠীটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। না তারা মরবে না তাদেরকে শুধু মুসলমান বানানো হবে। যে প্রক্রিয়া এখন চলমান। সম্প্রতি শুধু ইসলাম থেকে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার জন্য সুদানে একজন মহিলাকে ফাঁসীর আদেশ দেয়া হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীতে চিরদিনের জন্য তাকে দেশ ছাড়ার শর্ত দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এছাড়া মালয়েশিয়ায় একজন নারীর পিতা মুসলমান ছিলেন বিধায় তাকে অবশ্যই সেই ধর্মই পালন করতে হবে বলে হাইকোর্টে রায় দেয়া হয়। এখন যেটি সুপ্রীম কোর্টে বিচারাধীন। সেই নারী জন্মের পর তার মায়ের বৌদ্ধধর্মই পালন করে আসছিলেন। তার মায়ের সাথে তার পিতার বিয়ে হয়নি এবং সেই পিতাকে তিনি কোনোদিন চোখেও দেখেননি। সন্তানের জন্ম হবার আগেই যেই পিতা তার সমস্ত দায়িত্ত্ব ত্যাগ করেছেন। এই উদাহরণগুলো তাদের উদ্দেশ্যে দেয়া যারা ইসলামের বিভিন্ন রূপ আর বিভিন্নমাত্রার সহনশীলতার কথা বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলবার চেষ্টা করেন।
তাই ইসলাম ধর্মে যে সমন্বয়ের কোন জায়গা নেই তা বলাই বাহুল্য। বিশ্বের প্রতিটি ধর্মই তার প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় লোকজ ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে সমন্বয় করতে বাধ্য হয়েছিল। আমেরিকা মহাদেশের রেড ইন্ডিয়ানদের কথা এখানে বলা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ গণহত্যা ও অত্যাচারের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের ধর্ম পুরোপুরি লোপ পায়নি। যদিও প্রাথমিক যুগে খ্রিস্ট ধর্ম সরাসরি এসবের সাথে জড়িত ছিল। চীন ও জাপানে যথাক্রমে কনফুসীয় ও শিন্টো মতবাদের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের সম্মিলনের কথাও এখানে বলা যায়। ভারতবর্ষ ও তিব্বতে তান্ত্রিক মতবাদের সাথেও এই ধর্মের মিথস্ক্রিয়া সম্ভব হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে এরকম একটা উদাহরণও কি খুঁজে পাওয়া যাবে?
ioj
আধুনিক মানবসভ্যতায় যদি ফিরে আসি, এখন পর্যন্ত কেন একটা মুসলিম দেশেও ইউনিফরম সিভিল কোড চালু হয়নি,তার দোষ কি শুধু ওয়াহাবী আর সাম্রাজ্যবাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে পার পাওয়া যাবে? কেন কোন মুসলিম দেশে ধর্ম সমালোচনার অধিকার নেই? কেন বিধর্মী,অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিতদের বা অবিশ্বাসীদের চরম লাঞ্ছনা বা হত্যার সম্মুখীন হতে হয় মুসলিম দেশগুলোতে? একই কথা খাটে সমকামীদের ক্ষেত্রেও। অনার কিলিং জিনিসটি কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কেন শুধু মুসলিম দেশগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়? এমনকি পশ্চিমা দেশে অবস্থানরত মুসলিম পরিবারগুলোতে এর ভয়ংকর প্রাদুর্ভাবের উৎসমুল কোথায়? এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য মূল উৎস পাশ কাটিয়ে শুধু আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করে কোনো লাভ হবে? এর জন্য যতদিন না সরাসরি ধর্মকে দায়ী করে এর সংস্কার সাধন করা হবে ততদিন শুধু ধন্য আশা কুহকিনী বলেই দিন কাটাতে হবে। অবশ্য আদৌ এর সংস্কার সম্ভব? যেখানে একে সর্বকালের সব মানুষের জন্য আদর্শ ও নির্ভুল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইসলামের কোনো কোমল রূপের আশায় বসে থাকলে তা মেঘের উপর প্রাসাদ রচনা করবার মতই হবে।
maxresdefault
তাই পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই বাংলাদেশ হয়ত একদিন আর্থিকভাবে বা বৈষয়িক দিক দিয়ে বা নিদেন পক্ষে মানব উন্নয়ন সূচকেও অনেক উন্নতি লাভ করবে,এমনকি তুলনামূলকভাবে টেকসই গণতন্ত্রও হয়ত ধারণ করবে; কিন্তু একটি পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ উদার সহনশীল রাষ্ট্রে পরিণত হবে তা নৈব নৈব চ। অন্তত ইসলাম ধর্ম যতদিন পৃথিবীতে আছে ততদিন নয়। যে দেশে ঘরের ভেতরে অবিশ্বাস বা নাস্তিকতার চর্চা দূরে থাক ক্ষেত্রবিশেষে নামাজ,রোজা পালন না করলে বিশ্বাসীদেরই নিগ্রহ পোহাতে হয় সেখানে এর অন্যথা আশা করা নেহাতই বোকামি। তাই আমার জন্মভূমির প্রতি ভালবাসার কোনো শেষ না থাকলেও তাতে একটু আধটু অভিমানের ছোঁয়া চিরকালের জন্যই থাকবে। ভালবাসার নি:সীম আকাশে চিরকালই থেকে যাবে গাঢ় বিষাদের মেঘের আনাগোনা।