লিখেছেনঃ সাত্যকি দত্ত
শ্রীনিকেতন অনেক গুলো বছর ধরে এলম্হার্স্টের প্রদত্ত অর্থে পরিচালিত হয়ে আসছিল – একটা সময় দেখা দিল , যখন শ্রীনিকেতনের ভবিষ্যত সম্পর্কে সকলেই অনিশ্চিত ।
মার্চ মাস , সালটা ১৯৩৫ – অবশেষে বিশেষ শঙ্কিত হয়েই রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবী ইংল্যাণ্ড যান এবং এদের সঙ্গ দেন শিক্ষাভবন ও পাঠভবনের অধ্যক্ষ ধীরেন্দ্রমোহন । রথীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য কর্মসচিবের এবং সুরেন্দ্রনাথ কর শান্তিনিকেতনের সচিবের কাজ করেন । গৌরগোপাল ঘোষ ছিলেন শ্রীনিকেতনের সচিব ।
ইংল্যাণ্ড গিয়ে তারা মিঃ এলম্হার্স্টের সাথে আলোচনা করেন এবং শ্রীনিকেতনের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করেন । সুতরাং , এর পর থেকে শ্রীনিকেতন এলম্হার্স্টের দানেই আগের মতো করে চলতে লাগলো এবং উপরি পাওনা হল , Dartington Trust -থেকে গ্রামের অর্থনৈতিক গবেষণার জন্য অতিরিক্ত অর্থের ব্যবস্থা – এটাও মিঃ এলম্হার্স্টের দান । রবীন্দ্রনাথও অনেকদিন ধরে এমন একটা কিছু সুন্দর ব্যবস্থা চাইছিলেন , সুতরাং বলাই যায় এলম্হার্স্ট সাহেব রবীন্দ্রনাথের সেই স্বপ্নপূরণ করেন ।
এই সময়টায় রথীন্দ্রনাথ – প্রতিমা দেবীর অনুপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ একা হয়ে পড়লে – জোড়াসাঁকোতে ফিরে যাবার জন্য সকলে মিলে কবিকে অনেক অনুনয় করলেও , কবি সেই সময়টা ( ৪ মার্চ – ১২ মে ) শান্তিনিকেতন ছেড়ে আর কোথাও যান নি । উত্তারায়ণে তাঁর বিশেষ অভিভাবক রূপে দেয় দিল ছোট্ট মেয়ে পুপে বা নন্দিনীকে । রবীন্দ্রনাথ আপন মনে বসে শেষ সপ্তকের গদ্যছন্দের রচনা গুলো লিখছেন এবং তার ফাঁকে ফাঁকে রং তুলি নিয়ে বসছেন । এদিকে সুরেন্দ্রনাথ আর নন্দলালের মাথায় এসেছে নূতন ছন্দে বাড়ি করবার আইডিয়া !
ইতিমধ্যে কবি নিজে থেকেই তাঁদের দুজনকে ডেকে একটা মাটির বাড়ি নির্মান করার ফরমাশ করে বললেন – ” এবারের যে বাড়ি হবে তাতে মেঝে থাকবে সব সমান , ঘরে চৌকাঠ বলেও কিছু থাকবে না , সিঁড়িও নয় , পথ আর ঘরের তফাতই বোঝা যাবে না – পথ যেন আপনি এসে ঘরে ঢোকে ! ” মাটির বাড়ি নির্মানের যুক্তি হিসাবে কাছের সকলকে বলছেন – ” তোদের সকলেরই বাড়ি আছে , ঘর আছে , থাকবার একটা আলাদা স্থায়ী বাসস্থান আছে । আর আমার ? নিজের বাড়ি বলে কিছুই নেই , আমি তো বেশি কিছু চাই নে ; একখানা শুধু মাটির ঘর – এমন আর কি ? তোমাদের মতো বড়লোকি চাল তো আমার নেই । দালানকোঠা তোমাদেরই মানায় । আমি গরিব মানুষ ; মাটির কুড়েঘরই আমার ভালো । আর দুদিন পরে তো মাটিতেই মিশব । সম্বন্ধটা এখন থেকেই ঘনিষ্ঠ করে রাখি । ” রবীন্দ্রনাথ বরাবরই ছোট ঘর ভালোবাসতেন – বেশ ছোট ছোট ঘর হবে , এক জায়গায় বসে হাত বাড়িয়ে এদিককার ওদিককার জিনিস নাগাল পাবে । তিনি বলছেন , ” ঘরের জিনিসপত্র কাছে কাছে থাকলে মনে হয় যেন ঘরটি আমার আপন ঘর । নিচু ছাদ কাছে নেমে আসে , চারদিকের দেয়াল কাছে কাছে ঘিরে থাকে , বড়ো আরাম লাগে মনে । নয় তো কি সব বড় বড় ঘর , উঁচু উঁচু ছাদ , জিনিসপত্র ঐ কোণে সেই কোণে , একটি বই দরকার তো উঠে গিয়ে শেলফ থেকে পেড়ে আনো – সে যেন নিজেরঘরেই পর হয়ে থাকা ।” এই জন্যেই মাটির ঘর – যার ছোট ছোট ঘর হবে সব !
নতুন নতুন বাড়ি তৈরি করে তোলা রবীন্দ্রনাথের একটা শখ ছিল । বৈচিত্র্যলিপ্সু কবির এই শখের জন্য একের পর এক বাড়ি তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে । কোনদিনই একটানা এক বাড়িতে বেশি দিন থাকতে পারতেন না , এটাতে কিছুদিন – ওটাতে কিছুদিন থাকতেন । শান্তিনিকেতন আশ্রমে এমন বাড়ি খুব কমই আছে যেটা তাঁর ব্যবহারে লাগেনি । কবি যখন দেহলীতে থাকতেন , গ্রীষ্মের ওই প্রচন্ড দাবদাহ উপেক্ষা করে বারান্দায় বসে কবিতা লিখে যেতেন । কবির যুক্তি সেই রোদের ঝাঁজ আর হা-হা করা গরম হাওয়ায় লেখার আবেশ নাকি গাঢ় হয়ে ওঠে । দরজা জানালা বন্ধ , আরামে সবাই বিশ্রাম করছে , শুধু তিনি তাঁর ঘরে লিখে চলেছেন , হাতে একখানা হাত পাখা ; এই ছিল কবির প্রথম দিকের ধারা । সবসময় যখন নতুন নতুন বাড়িতে ওঠা সম্ভব হত না – তখন উনি বরাবই একটি কল্পিত বাসভবন বা স্টুডিয়োরুম গড়ে তুলতেন মনে মনে এবং সেখানেই মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করতেন , কল্পজগতের সেই সব বাসভবন বা স্টুডিয়োরুম কবির মনে যে ছবি সৃষ্টি করত তারি ছায়া পাওয়া যায় ১৯৩০ সালে ১৮-ই আগষ্ট জার্মানি থেকে প্রতিমা দেবীকে লেখা একটি চিঠি থেকে –
” … থেকে থেকে মনে আসছে তোমার সেই স্টুডিয়োর কথাটা । ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে , শালবনের ছায়ায় – খোলা জানালার কাছে । বাইরে একটা তালগাছ খাড়া দাঁড়িয়ে , তারি পাতাগুলোর কম্পমান ছায়া সঙ্গে নিয়ে রোদ্দুর এসে পড়েছে দুপুরবেলা , নদীর ধার দিয়ে একটা ছায়াবীথি চলে গেছে , কুড়চি ফুলে ছেয়ে গেছে গাছ , বাতাবি নেবুর ফুলের গন্ধে বাতাস ঘন হয়ে উঠেছে , জারুল পলাশ মাদারে চলছে প্রতিযোগিতা , সজনে ফুলের ঝুরি দুলছে হাওয়ায় , অশথগাছের পাতাগুলো ঝিলমিল করছে – আমার জানলার কাছ পর্যন্ত উঠেছে চামেলি লতা । নদীতে নেবেছে একটি ছোট ঘাট লাল পাথরে বাঁধানো , তারি এক পাশে একটি চাঁপার গাছ । একটার বেশি ঘর নেই । শোবার খাট দেওয়ালের গহ্বরের মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায় । ঘরে একটিমাত্র আছে আরাম – কেদারা , মেঝেতে ঘন লাল রঙের জাজিম পাতা , দেয়াল বাসন্তী রঙের , তাতে ঘোর কালো রেখার পাড় আঁকা । ঘরের পুবদিকে একটুখানি বারান্দা , সূর্যোদয়ের আগেই সেইখানে চুপ করে গিয়ে বসব , আর খাবার সময় হলে লীলমনি সেইখানে খাবার এনে দেবে । … ”
কল্পিত এইসব ভাবনার সাথে বাস্তব-জগতের মিল হত না কোনোদিন , তাই তো তিনি চিঠির শেষাংশে আক্ষেপ করে লিখছেন –
“ওদিকে ভারতসাগরতীরে অপেক্ষা করে আছে বিশ্বভারতী – তার অনেক দাবি , অনেক দায় – ভিক্ষা করতে হবে দেশে দেশান্তরে । অতএব থাক আমার স্টুডিয়ো । কতদিনই বা বাঁচব , ইতিমধ্যে কর্তব্য করতে করতে ঘোরা যাক , রেলে চড়ে , মোটরে চড়ে , জাহাজে চড়ে , ব্যোমযানে চড়ে , সভ্যভব্য হয়ে । অতএব আর সময় নাই । ”
রবীন্দ্রনাথের সেই কল্পনারই খানিকটা যেন বাস্তব রূপ পেল শ্যামলী বাড়ির তৈরির মধ্যে দিয়ে , শুধু মধ্যিখানের পাঁচটা বছর কাটল কী ভাবে সেই বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব সেই ভাবনায় । ১৯৩২ সালের জুন মাসে রানুকে লেখা চিঠিতেও ভবিষ্যতের শ্যামলী বাড়ি নির্মানের আকাঙখার ভাব স্পষ্ট –
” শান্তিনিকেতনের এ জায়গাটা তোর চেনা নয় । তুই আমাকে এখানকার নানা বাসায় দেখেছিলি । – একে একে কত বাসাই বদল হল । শিলঙের সেই বাড়ি মনে পড়ে ? জোড়াসাঁকোয় তেতলার সেই ঘর ? শান্তিনিকেতনের কখনো এ কুটীরে কখনো ও কুটীরে । এখন এখানকার চেহারা আর একরকম । আগেকার সমারোহ অনেক বেড়ে গেছে । কিন্তু আগেকার সাদাসিদে সেই সংসারটা ছিল ভালো । যদি কোনো একদিন আর একবার শান্তিনিকেতনে এসে দেখে যাওয়া তোর পক্ষে সম্ভব হয় হয়তো তোর ভালো লাগবেনা । ( কিন্তু ১৯৩৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শ্যামলী মাটির ঘরে বসে রানুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আবার লিখলেন , আমি আজকাল বাস করি আমার নতুন মাটির ঘরে -এই বাসাটা তোর সম্পূর্ণ অজ্ঞাত । যদি কখনো আসা সম্ভব হয় এটা দেখতে পাবি – ভালো লাগবে ) সেই সব চেনা জায়গাগুলোও এখন অচেনার মুখোষ পরে আছে । কেবল সেই আকাশ , সেই মাঠ , সেই রাঙা মাটির পথ তেমনই আছে । …
… নিজেকে নিয়ে এতখানি ছড়ছড়ি আর ভালো লাগেনা । কাজ খাটো করে ছোট একখানি জায়গায় আসন পেতে বসতে ইচ্ছে করে – একটুখানি ছবি আঁকি , গান বাঁধি , বাগান করি , আর সঙ্গে কিছু দেখাশুনা গল্প হাসি তামাসা । কিন্তু সে আর ঘটে উঠবেনা । একেবারে রাস্তার চৌমাথায় চৌকি পড়েচে – ঘোর হট্টগোলের মাঝখানেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটবে । ”
এই সকল উক্তি পড়বার সাথে সাথে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে , রবীন্দ্রনাথের কাছে কিন্তু সরল জীবন যাপন ও সৌন্দর্যহীনতা একার্থক নয় । তখন দেশের মধ্যে গান্ধীজির সরল জীবনাদর্শের অনুকরণে এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে কৃত্রিম গরিবানার ঢং দেখা দিয়েছিল ; সৌন্দর্যকে অবজ্ঞা করা যেন তাদের আধ্যাত্মিকতার একটা অঙ্গ । চারি দিকের pseudo-asceticism এর চিত্র দেখে ১৩৪২ বঙ্গাব্দের নববর্ষের ভাষণে বললেন ,
” সুন্দরকে অবজ্ঞা করার শিক্ষা আজ এ দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্প্রতি দেখা দিয়েছে । যে অসুন্দরে প্রকাশের পূর্ণতা ভ্রষ্ট হয় , তাকে স্পর্ধাপূর্বক বরণ করবার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে ; দারিদ্র্যের অনুকরণ করাকে কর্তব্য বলে মনে করছি ; ভুলে যাচ্ছি দারিদ্র্যের বাহ্য ছদ্মবেশে আত্মার অবমাননা করা হয় । ঐশ্বর্যই বীরের । ঐশ্বর্য মহৎ , ঐশ্বর্য দাস নয় … ঐশ্বর্যকে প্রকাশ করতে চায় বীর্যশালী … ।”
মাটির বাড়ি নির্মাণ যে শুধুমাত্র বৈচিত্র্যলিপ্সু কবির শখের জন্য এটা ভাবলে অনেকখানি ভুল ভাবা হবে । শুকনো দেশ বীরভূম , সেকালের ঘরবাড়ি গুলো ছিল সবই মাটির দেয়াল আর খোড়ো চালের । সেই জন্য সে অঞ্চলে অগ্নিকান্ড সাধারণ ঘটনা ছিল , এদিকে জলাভাবে সে আগুন নেবাবারও পথ ছিল না । এক এক বার লোক সর্বস্বান্তও হয়ে যায় । এর থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় – ইটের ছাদ তোলা । কিন্তু সে অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র , তাদের পক্ষে তা সহজ ছিল না । রবীন্দ্রনাথ এই সমস্যাটা নিয়ে খুবই চিন্তা করতেন । এ নিয়ে তিনি শিক্ষা-প্রসঙ্গেও আলোচনা করেছেন । শেষে তিনি নিজেই এর পথ বের করে করলেন – দেয়াল তো মাটির থাকেই , ছাদটিকেও মাটির করে নিলে আগুনেরও ভয় থাকে না , আর সহজেও কাজ চলে – অথচ দেশীয় উপকরণে দেশীয় মজুরের দ্বারা কাজটা হওয়ায় পয়সাও বিদেশে যায় না । আবার বীরভূমের অসহ্য গরমের হাত থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যায় । চরকা – খদ্দরের ধারাতেই অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও এতে রয়েছে । খেটেখুটে সাধারণ লোক নিজেরাই অবসর সময়ে বাড়ির সংলগ্ন জমি থেকে মাটিটা তৈরি করে ছাদ গেঁথে নিতে পারে ।
এর পরে আর দেরি করা চলে না , শুধু যে পথের কথা চিন্তা করলেই হবে না – হাতে কলমে সেটা করে দেখালে লোকের যদি গরজ হয় । আগের বছর নন্দলাল অনেক মাথা খাটিয়ে ভোজনশালার সম্মুখে রাস্তার মোড়ে একটি মঞ্চ তৈরি করেছিল – সুরেন্দ্রনাথের সেটি বিশেষ পছন্দ হয় । সুরেন্দ্রনাথ নন্দলালকে নিয়ে সেই মঞ্চ তৈরির অনুরূপ উপাদানে মাটির বাড়ি তৈরি করবে বলে বিস্তর ভাবনা চিন্তা শুরু করে দিল , অনেক পরামর্শও চলল রবীন্দ্রনাথের সাথে । ঠিক হল , পনেরো বছর আগে যে পর্ণকুটির মাঠের ভিতর নির্মত হয় তাকে কেন্দ্র করে উত্তরায়ণের প্রাসদোপম বাড়ির পাশেই নূতন বাড়ি তৈরি হবে । রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা অনুসারেই বাড়ির ছাদও হবে মাটির এবং তাকে আলকাতরা মিশিয়ে শক্ত করা হবে – ঘরের মেঝেও একই ভাবে তৈরি হবে । পাশের গাঁ ভুবনডাঙা থেকে গৌরদাস মণ্ডল এল মিস্ত্রী – তাঁর নির্দেশ মতো সাঁওতালী মাঝি – মেঝেনের একদল লেগে গেল মাটি কাটতে , একদল মাটি মাখতে । রবীন্দ্রনাথ সকাল বিকেল শিমুলতলায় বসে বসে দেখেন , আর খুশিতে বলেন – ” মাটির দেওয়াল কি কম শক্ত হয় ভেবেছিস ? কত ঝড় – ঝাপটা বৃষ্টির ধারা এর উপর দিয়ে যায় , ভাঙে কি ? তবে ছাদই বা মাটির হতে পারে না কেন ? একটু ঢালু করলেই তো হল , জলটা গড়িয়ে যাবে , ভয়ের কিছু থাকবে না । সুরেন বলেছে সেই রকমটিই হবে । এ যদি সাকসেসফুল হয় , তবে কত লোকের উপকার হবে । গ্রামের লোকেরা কত সহজে বাড়ি তুলতে পারবে , বাঁশ খড়ের জন্য ভাবতে হবে না । ”
মাটির বাড়ির কথা মুখে মুখে রটে যায় । হাটের পথে যেতে আসতে গাঁয়ের লোক এসে থামে সেখানে – দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাটির বাড়ি তৈরি হওয়া দেখে – কত জিজ্ঞাসা তাদের , নন্দলাল সুরেন্দ্রনাথরা উত্তর দেন – সকালেরই কৌতূহল মাটির ছাদ কেমন হয় তা দেখার ।ওরা যে এই আসা যাওয়ার পথে আগ্রহ ভরে ক্ষণিকের জন্য হলেও দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির সামনে , তা দেখে মনে মনে ভীষণ আনন্দ পান রবীন্দ্রনাথ – বলেন , ” কত উৎসুক ওরা, বাড়িটা কতক্ষণে শেষ হবে – মাটির ছাদ উঠবে । একটা যেন কি আশা ওদের মনে । ” তারপর নব নব উৎসাহে সুরেনকে ডেকে নির্দেশ দেন , ” যেমন করে হোক মাটির ছাদ টেকসই করে তুলতেই হবে । ” আবার কখনো বা পরামর্শও দেন , “মাটিতে গোবর মেশালে , কাঁকর মেশালে , তুষ মেশালে – চাই কি আলকাতরাও মেশালে চলে ; উই ধরবে না তবে । এই সব মেশানো মাটিতে ছাদ মজবুত হবেই । “একবার ছুটিতে বাইরে থাকার সময় কবি চোখে পড়েছিল একটি ঘর যার দেওয়ালে হাঁড়ির গাঁথনি । ঘর ঠাণ্ডা রাখার এই অভিনব প্রণালীটি মনে ধরে তাঁর , এরপর থেকে উনি বহুজনকে বহুবার বুঝিয়েছেন , ” গ্রীষ্মকালে ঘর গরম হয়ে যায় বল তোমরা , একটা কাজ করলেই তো পারো ; অতি সহজ উপায় । ঘরের চার দিকে মাটির হাঁড়ি সাজিয়ে তার উপরে চুনবালির পলস্তারা দিয়ে দাও । দেওয়ালের মাঝখানে হাওয়া থাকার দরুন ঘরের ভিতরটা আর গরম হতে পারবে না । তোমরা একজন কেউ প্রথমে করে দেখো , পরে অনেকেই করতে পারবে । ” কিন্তু সেই প্রথম একজন যখন আর কাউকেই পাওয়া যায় গেল না – অবশেষে কবিই হলেন সেই প্রথম একজন ।
সুরেন বাবু তো সে ইচ্ছের কথা শুনে প্রথমটায় বেশ আপত্তি করলেন ! তারপর রবীন্দ্রনাথ যখন খুব করে ধরে বললেন , ” বেশ তো সুরেন সাহেব , সব ঘর যদি না-ই করতে চাও তবে একটি ঘর অন্তত আমার মাটির হাঁড়ি সাজিয়ে করে দাও । আমি বলছি ভালো হবে । ” তখন , মাটির বাড়ির উত্তর – পশ্চিম কোণের একটি ঘর হল মাটির হাঁড়ি দিয়ে । হাঁড়ির ওপর হাঁড়ি সাজিয়ে তার উপর ওপর মোটা মাটি লেপে দেওয়ালের ওপর খাড়াখাড়ি হাঁড়ির মাথা গুলো নীচের দিক করে বসিয়ে সারগাছ ও কাশফুলের ডাঁটি গায়ে গায়ে বেঁধে ঘরগুলোর মাথার ফাঁকা অংশ ওপর ও ভিতর মাটির পলেস্তারায় বন্ধ করে ঘরের আকার দেওয়া হল । ছাদের উপরেও মাটির হাঁড়ি সারি সারি উপুড় করা হল ।
গাছতলায় বসে বসে নন্দলাল জাফরির নকশা কাটেন ; কখনো বা কলাভবনের দল নিয়ে মাটির দেওয়ালে মূর্তি গড়েন । বাড়ির সামনে তৈরি হল দক্ষিণমুখী অর্ধচন্দ্রাকার খোলা আঙিনা । পথ হতে মাটি উঁচু হতে হতে উঠে এসেছে আঙিনায় , আঙিনা গেছে ঘরের ভিতরে ঢুকে – ঠিক যেমনটা রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন , ” পথ আর ঘরের তফাতই বোঝা যাবে না – পথ যেন আপনি এসে ঘরে ঢোকে ” । বাড়িতে উঠতে সিঁড়ি ভাঙতে হয় না মোটে । ঘর হতে বেরিয়ে আঙিনা বেয়ে এসেই পথ , সেই পথই উত্তরায়ণের ফটক পেরিয়ে সোজা চলে গেছে আশ্রমে ।
এর মধ্যেই বসন্ত উৎসব এসে পড়ল (২০ মার্চ ,১৯৩৫ ) । এবারের উৎসবে বহু জনাগম হয় , উপস্থিত ছিলেন – বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত , তাঁর স্বামী শ্রীপন্ডিত ও শ্রীমতী কুমারস্বামী । প্রতিবারের মতোই প্রাতে আম্রকুঞ্জে উৎসব ; সেদিন রবীন্দ্রনাথ বসন্ত উৎসবের মর্মকথা নিয়ে অনেক কিছু বলেন এবং নিজেই ফাল্গুনী নাটকের কিছু অংশ পাঠ করেন । সকলকে অবাক করে এরপরও তিনি বসন্ত কবিতাটি আবৃতি করেন এবং সদ্য রচিত দুটো গান নিজেই গেয়ে সকলকে শোনান । ( ১৯৩৫ – এর বিশ্বভারতী নিউজে লিখছে ঃ The vasantotsava was celebrated on the 20th of March 1935 . In the evening the poet recited his poem , বসন্ত and sang two songs composed on that very day ) গান দুটি –
আমার বনে বনে ধরল মুকুল |
ওগো বধূ সুন্দরী , তুমি মধুমঞ্জরী ।
( প্রসঙ্গত , শান্তিদেব ঘোষ মহাশয়ের রবীন্দ্রসংগীত বইটিতে উল্লেখ আছে , ওগো বধূ সুন্দরী – এটি পূর্বে কবিতা ছিল । গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাত ভাই চম্পা ছবিকে অবলম্বন করে ১৩৩১ সালে কোনো বিবাহ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এটি লেখেন । পরবর্তীকালে তিনি কবিতাটির ভাষা কিছু পরিবর্তন করে তাতে সুর দিয়ে গানে রূপান্তরিত করেন । আবার সুধীরচন্দ্র কর বলছেন সালটা ১৩৪২ । সঠিক তারিখ হল ১৩৪১ এর চৈত্র মাস ।
বনে বনে ধরল মুকুল গানটার প্রসঙ্গে পার্থ বসু লেখা থেকে না উল্লেখ করলেই নয়, ‘ একটি গানের সন্ধান পাওয়া গেছে , বনে বনে ধরল মুকুল । রবীন্দ্রনাথ বেদীতে বসেই গান শুরু করেছেন ; দক্ষিণের হাওয়ায় তাঁর চুল , দাড়ি বসনপ্রান্ত উড়ছে , ডান হাতের তর্জনী ঘুরিয়ে চলেছেন সদ্যোজাত গানটি শোনাবার উত্তেজনায় । রবীন্দ্রনাথের সামনে কিছু দূরে বসে আছে শিশুবিভাগের ছেলে মেয়েরা ; তারা হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে । রবীন্দ্রনাথের পিছনে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে তনয়েন্দ্রনাথ ঘোষ , ক্ষিতীশ রায় প্রমুখ অধ্যাপকেরা ইশারা ইঙ্গিতে ছোটদের চুপ করতে বলছেন কিন্তু তাদের হাসি যেন বাঁধ মানছে না । তার একটিই কারণ , রবীন্দ্রনাথ কন্ঠে সুরটি সর্বদা যথাযথ আনতে পারছিলেন না । কিন্তু তাঁর তুমুল হাত নাড়ায় যে ঘটনাটি ছোটদের কাছে হাস্যকর লেগেছিল , আমাদের কাছে সেই ঘটনাই খানিকটা করুণ বিয়োগান্ত নাট্য মনে হয় । ‘ )
সময় গড়াতে থাকে , সুরেন্দ্রনাথ আর নন্দলালের কোন দিকে তাকানোর সময় নেই , দিন রাত এক করে মাটির বাড়ি নির্মানের কাজে নিজদের সঁপে দিয়েছে তারা ।কবিরও ভারী উৎসাহ – মনে আনন্দ নিয়ে লিখে ফেললেন –
আমার শেষ বেলাকার ঘরখানি
বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে
তার নাম দেব শ্যামলী ।
ও যখন পড়বে ভেঙে
সে হবে ঘুমিয়ে পড়ার মতো ,
মাটির কোলে মিশবে মাটি ;
ভাঙা থামে নালিশ উঁচু করে
বিরোধ করবে না ধরণীর সঙ্গে ;
ফাটি দেয়ালের পাঁজর বের করে
তার মধ্যে বাঁধতে দেবে না
মৃত দিনের প্রেতের বাসা ।
অবশেষে ২৫ – শে বৈশাখের তিন দিন আগে বাড়ির কাজ মোটামুটি ভাবে সম্পূর্ণ হয় – স্থির হয় কবির জন্মদিনেই গৃহপ্রবেশ হবে ।
কবির ৭৪ তম জন্মোৎসব যথারীতি পালন করা হল । এই দিন স্মরণে অমিয়চন্দ্রকে গদ্য কবিতায় একটি পত্র দেন – যেটা আমরা পাই শেষ সপ্তকের মধ্যে ( ৪৩ – সংখ্যক )- ” পঁচিশে বৈশাখ চলেছে / জন্মদিনের ধারাকে বহন করে / মৃত্যু দিনের দিকে । ” এই দীর্ঘ কবিতায় জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা , বেদনা ,ক্ষয় , আঘাত , আশা আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ পেয়েছে ।
উৎসবের শেষে গৃহ-প্রবেশ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল – কবি আনুষ্ঠানিক ভাবে নাম দিলেন শ্যামলী । প্রভাতকুমার যথার্থই বলেছেন , মাটির ঘর করার ফরমাশ কবির , স্থাপত্য – পরিকল্পনা সুরেন্দ্রনাথের , ভাস্কর্য নন্দলালের । কবি , স্থপতি ও ভাস্করের মিলিত প্রয়াস আছে এই গৃহ রচনায় । তবে আসলে এই কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার কৃতিত্ব সুরেন্দ্রনাথ করের । এই গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানের মধ্যে কবি সে কথা স্বীকার করে সুরেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে – ” ধরণী বিদায়বেলা আজ মোরে ডাক দিল পিছু- কহিল, /একটু থাম , ‘ তোরে আমি দিতে চাই কিছু ‘, ” কবিতাটি পাঠ করেন ।
সন্ধ্যা বেলায় শান্তিনিকেতনের কর্মীরা পরশুরামের বিরিঞ্চি বাবা অভিনয় করেন । রবীন্দ্রনাথ প্রহসনটির স্থানে স্থানে অদলবদল করে দেন পূর্বেই এবং অভিনয়ের সময়েও স্বয়ং উপস্থিত থাকেন । অনুষ্ঠান শেষ হলে তিনি ঘরে ফিরে এসে ইন্দিরা দেবীকে লিখছেন , ” শরীর ক্লান্তিতে অবসন্ন … ধুমধাম হয়ে গেল একচোট । জনসাধারণের মাঝে মাঝে খেলা করবার শখ মেটানোর জন্যে জ্যান্ত পুতুলের দরকার করে , এই শখের জোগান দিয়েছি আমি – কিন্তু বড় ক্লান্তিকর । ”
পরদিন ভোরেই কলকাতার উদ্দেশ্য রওনা দিলেন কবি । জোড়াসাঁকোতে বসে তিনি ইংল্যাণ্ডে প্রতীমা দেবী ও রথীন্দ্রনাথকে লিখলেন – ” মাটির বাড়িটা খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে । নন্দলালের দল দেয়ালে মূর্তি করবার জন্য কিছুকাল ধরে দিনরাত পরিশ্রম করেছে … । গ্রামের লোকদের ঔৎসুক্য সব চেয়ে বেশি । মাটির ছাদ হতে পারে এইটাতেই ওদের উৎসাহ । পাড়াগাঁড়ে খড়ের চাল উঠে গেলে সব দিক থেকেই ওদের সুবিধা । ”
শ্যামলী গৃহ নির্মানে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কখনই আর্টিস্টের বিলাসিতা আনতে দেননি , অনেক ক্ষেত্রে তিনি দুজনকে শাসনও করেছেন – তাঁর একমাত্র দৃষ্টি ছিল ব্যবহারিক সাফল্যের দিকে । প্রসঙ্গত আমারা যদি এই সময়টার রবীন্দ্র মনন বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাবো , তিনি শ্রেণীগত সাহিত্য , কলা , আনন্দ – সৃষ্টির বিরোধীতা করছেন ভীষণ ভাবে ।
গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান হয়ে গেলেও , শ্যামলীর টুকিটাকি কাজ আরও কিছু বাকি – সে গুলো সারা হলেই সম্পূর্ণরূপে বাসোপযোগী বাড়ি হয় , কিন্তু সে টুকিটাকি কাজ যেন আর ফুরাতেই চায় না । রবীন্দ্রনাথ অধৈর্য্য হয়ে বললেন , ” এখানে থাকলে কেবলই মনে হতে থাকবে কাজ আর এগচ্ছে না । তার চেয়ে গরমের সময় , বোট আছে ঘাটে বাঁধা , দু মাস স্বচ্ছন্দে কাটানো যাবে । ফিরে এসে নিশ্চিন্তে শ্যামলীতে থাকতে পারবো ! ”
চলে এলেন চন্দননগরে গঙ্গার ধারে লালবাড়িতে – সে বাড়ির গা ঘেঁষে তরতর করে বয়ে চলেছে গঙ্গা। সে দিন গুলোতে কবি দুপুরে প্রায় খানিকটা সময় কৌচে বসে নানা রকম বিলিতি কাগজ পড়েন – কদাচিৎ কয়েক মিনিটের জন্য চোখ বোজেন , তারপর আবার লেখার কাজে মগ্ন হন আর বাকি অধিকাংশ সময়ই বারান্দাতে বসে কাটান – সেখান থেকে অনেক দূর অবধি গঙ্গা দেখা যায় – একদিন সে দিকের দৃশ্যপটের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে বললেন – ” জল হচ্ছে নৃত্য , পারে গর্জন , আর আকাশে সংগীত । অবশ্য বলা যেতে পারে তীরে এই তিনই আছে । … ধরো-না কেন , এই জলে কী একটা বিরাট ব্যাপার চলছে , কত জীবজন্তু , কত হৈ – চৈ । এই ডাঙায় যা আছে তার চেয়ে কতগুণ বেশি প্রাণী আছে জলের ভিতরে – কিন্তু দেখ কে বলবে । উপরে যেন একটি পর্দা টেনে রেখেছে , মনে হয় কী শান্ত এর ধারা । বলিহারি যাই মানুষকে , লজ্জাশরম এর কিছুই রাখলে না গো , এই আবরণ ভেদ করে জলের নীচে গিয়ে সব দেখেশুনে ফোটো তুলে দিলে সব প্রকাশ করে… “। গরমের শেষে যখন শান্তিনিকেতনে ফিরলেন , শ্যামলীর কাজ তখন শেষ হয়েছে । শ্যামলীকে দেখে তাঁর আনন্দ যেন আর ধরে না , অবিরাম খালি চেয়েই থাকে সে দিকে । বসবার ঘরে যে বেদী তৈরি হয়েছিল , তার উপর পাতা হল খেজুর পাতার তালাই । বাঁশের মোড়া , সরকাঠির চেয়ার দিয়ে হল গৃহসজ্জা । কোনার্কের বারান্দায় রাখা বেলফুল গাছ-সমেত মাটির কলসী গুলোকে আনা হল শ্যামলীর সামনে । রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে গেল প্রিয় বাতাবিলেবু গাছটিকে – তৎক্ষণাৎ আদেশ , তাকেও আমার সঙ্গে চাই , আমার কাছাকাছি থাকবে সে । আদেশ মাত্রই আড়াই হাত মাটি খুঁড়ে অতি যত্নে কচি গাছটি তুলে এনে লাগানো হল শ্যামলীর পাশে । এই গাছ একদিন ঘন সবুজ মোটা পাতায় ভরা তার কয়েকটি ডালের ঝিরঝিরে ছায়া মাটিতে ফেলল । কত সকালে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির অমল উপহার তাঁর সেই বাতাবিলেবু গাছটার ঝিরঝিরে ছায়ায় চেয়ার টেবিল আনিয়ে খাতা খুলে খুশি মনে লিখতেন । একসময় ছোট্ট গাছটুকু ডিঙিয়ে নক্ষত্র-লোকের রবির কড়া আলো এসে পড়ত মাটির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া রবির কপালে , উনি গ্রাহ্যই করতেন না , বলতেন ” সকালের এই রোদের তাপটুকু বরং ভালো শরীরের পক্ষে । বড়ো বড়ো গাছের নীচে বসলে এ সুবিধেটুকু পাই নে । ” বাতাবিলেবু গাছটি রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিল ছোট্ট একটি মেয়ে , উঠে চলে গেলে পাছে যদি সে মনে ব্যথা পায় – তাই কত সহজে রোদের তাপ মেনে নিতেন মনে ।
বর্ষা এল , সাথে সাথে তরল সবুজ রঙের পতাকা উড়িয়ে মাথা উঁচু করে শ্যামলীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল কত কি গাছের চারা । মালী ত্রস্ত হাতে সে গুলো সরাতে যাবে , এমন সময় কবির ভিতর থেকে সেই যেন বলাই বলে উঠল – ” ওরা ঠিক জায়গা বেছেই উঠেছে , ওদের কেউ নাড়াবে না । ” এমন ছাড়াপত্রে মনের আনন্দে যে যার মতো উঠতে লাগল – একপাশে উঠল জাম , বেল , মাদার , কুরচি ;আর এক পাশে তেঁতুল , আতা , শিরিষ , ইউক্যালিপটাস । পিছনের আঙিনায় আম , কাঁঠাল, সামনের আঙিনায় রইল ফুলে ভরা গোলঞ্চের বাহার ।
আঙিনা গোবর মাটি দিয়ে নিকানো থাকে – রবীন্দ্রনাথ কখনো আমগাছের ছায়ায় বসে লেখেন , মাদার কুরচি-তলায় বসে চা খান, কখনো গোলঞ্চের তলায় ছড়িয়ে পড়া সাদা ফুলের মাঝে আসনখানি পেতে বই পড়েন । শ্যামলীর রবীন্দ্রনাথ সেই জোড়াসাঁকোর বালক রবীন্দ্রনাথ , মাঝের বয়সটুকু যেনে একেবারেই ভেসে গেছে খোয়াই-কোপাইতে । শ্যামলীকে ঘিরে ঘিরে জোড়াসাঁকোর ছোট ছেলেটার খেলা যেন আর ধরে না – আজ সকালে চনবনে রোদ মাথায় নিয়ে হয়ত এখানে বসে লিখেই চলেছেন , কাল হয়তো জামের ছায়ায় ছুট্টে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন , জাম গাছটাও বুঝি খেলার একজন সাথী পেত তাই তো অমনি করে কচি পাতা গুলো দিয়ে তাঁর মুখে গালে হাত বুলিয়ে দিত – আবার কখনো বা দুষ্টু আমগাছটা ইচ্ছে করেই আমের বোল ঝুরঝুর করে ফেলতো ওঁর মাথার উপর , জোড়াসাঁকোর ছেলেটি কিন্তু এতটুকুও রাগ করতো না বরং দুষ্টু আম গাছটার সাথে বেশি বেশি করে ভাব দিত – এমন সময় সে তল্লাটে কোথা হতে এসে মেলা জমাতো হাজার মৌমাছি , ওদের সাথে গান জুড়তো আমাদের জোড়াসাঁকোর বালক ।
খেলা কি শুধু বাইরে , ঘরের ভিতরেরও চলতো সমান তালে সে ছেলের খেলা । দুপুরে এই কোণায় আছে তো বিকালে ঐ কোণে – ছবি আঁকতে ইচ্ছে করলে আরেক কোণে – দিন ভর এমনই চলে । একটা সময় মেঘের গায়ে রাঙা আলপনা সাজিয়ে সন্ধ্যা নামে , সারাদিনের কত খেলায় ক্লান্ত জোড়াসাঁকোর বালক এসে বসে শ্যামলীর সামনে খোলা অঙ্গনে – পথ যেথা আপনি এসে মেশে । কত রাত অবধি একাকী বসে থাকেন স্তব্ধ হয়ে দুচোখ বুজে । তখন সে আর বালক নয় , বৃদ্ধও নয় – সমস্ত পার্থিব বন্ধন মুক্ত অমৃতলোকের পুরুষ – নক্ষত্রবিথী তলে বসে থাকা , শত শত মানুষের নিভৃত লোকের দেবতা ।
গেয়ে ওঠেন-
” এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে ।
তার হৃদয়বাঁশি আপনি কেড়ে বাজাও গভীরে ।।
নিশীথরাতে নিবিড় সুরে বাঁশিতে তান দাও হে পুরে,
যে তান দিয়ে অবাক্ কর গ্রহশশীরে ।।
যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে জীবন-মরণে
গানের টানে মিলুক এসে তোমার চরণে ।
বহুদিনের বাক্যরাশি এক নিমেষে যাবে ভাসি-
একলা বসে শুনব বাঁশি অকূল তিমিরে ।। ”
দেখতে দেখতে বারো মাস পূর্ণ হল শ্যামলীতে । সেবারে ভরা শ্রাবণ , তার কী ভীষণ রূপ । সারাদিনই উবুশ্রান্ত বৃষ্টি আর তার সাথে সজল দামাল হাওয়ার দাপট । বীরভূমের মাটি রুক্ষ , মায়া মমতা কম – একটু বৃষ্টি হলো কি টুপটাপ গাছ পড়ে । সেখানে অত বৃষ্টি । শ্যামলীর মাটির ছাদে ফাটল ধরেছিল আগেই , এবারে বর্ষার জল ভিতরে ঢুকে ঢুকে পুরো ছাদটাকেই দিল ভিজিয়ে । উপরে এদিকে বৃষ্টির ঘনঘটা । সকলেই উদ্বিগ্ন , এভাবে যদি আরো কিছুক্ষণ চলে , তবে যে ছাদ গলে ধসে পড়বে । রবীন্দ্রনাথের কোনো দিকেই খেয়াল নেই , তিনি একমনে লিখে চলেছেন । বিকালের দিকে আকাশ যখন আবার নতুন করে থরে থরে মেঘে ভরে গেল , সাথে শুরু হল বিদ্যুৎ আর বৃষ্টির দারুণ কোলাহল – তখন সকলেই বিশেষভাবে আতঙ্কিত হয়ে উঠল কবির জন্য । রথীন্দ্রনাথ , প্রতিমা দেবীরা একে একে আসেন , কবিকে কত করে বোঝায় – অন্তত আজকের রাতটা আপনি উদয়নে এসে থাকুন । রবীন্দ্রনাথ ওদের সব কথাই ধীরভাবে শোনেন , আর সেই ভিজে ছাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসেন – যেন তার সাথে শলাপরামর্শ আগের থেকেই কিছু হয়ে রয়েছে । অনেক চেষ্টা করেও সকলে ব্যর্থ হয়ে , সেখান থেকে চলে গেল । মাটির বাড়িতে শুধু পড়ে রইলেন একলা কবি ।
রানী চন্দ লিখছেন , ” সারারাত চমকে চমকে উঠি , বিদ্যুতের ঝলকে জানালা হতে বারে বারে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করি । ভয় প্রাণে , না জানি কি দেখব সকালে । সন্ধে হতে বসবার ঘরের ছাদ গলতে শুরু করেছিল দেখে এসেছি ।
ভোর হতে-না হতে ছুটে এলাম শ্যামলীতে । গুরুদেব সেই বসবার ঘরে সেই মারাত্মক ছাদের নীচে ঘরের ঠিক মাঝখানে বসে বসে হাসছেন । বললেন, জানিস , কাল রাতে ছাদচাপা পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ । এত বড়ো খবরটা কাগজে উঠতে উঠতে ফসকে গেল – কি দুঃখের কথা বল্ দেখি ! আচ্ছা , কাল যে এত ভয় পেয়েছিলি সবাই , ছাদ ভেঙে পড়বে মাথায় – এ হবে সে হবে , কি হল ? কিছুই নয় । বেশ আছি , আমার জায়গায় আমি , ছাদের জায়গায় ছাদ , মিছিমিছি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলি সব আমার জন্য । ”
এরপর আর কোনো অনুরোধ নয় , প্রতিমা দেবী জোর করে রবীন্দ্রনাথকে শ্যামলী থেকে উদয়নে নিয়ে এলেন । আর সেদিনই ছাদটা খসে পড়ল । বাকি যতটুকু অবশিষ্ট থাকল , সেটুকু যাতে বৃষ্টিতে গলে না যায় তাই তাড়াতাড়ি তিরপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল । এই ভাবে সেবারের বর্ষা পার হল । বর্ষা শেষে আবার ছাদ মেরামতের কাজ শুরু করে দিল নন্দলাল , সুধীন্দ্রনাথরা – এবারে কেবলমাত্র মাটি দিয়ে নয় , মাটির উপরে তিরপল দিয়ে তার উপরে আবার মাটি আলকাতরা লাগানো হল ।
ইতিমধ্যেই রবীন্দ্রনাথের মনে বাড়ি নিয়ে নানা খুঁতখুঁতানি দেখা দিয়েছে – শ্যামলীর গেটটা বেমানান বড় , দূরের পথের বাধা সৃষ্টি করে , সুতরাং তাঁর আদেশে গেটটা ভেঙে ফেলা হল – অকারণ বলে বাঁশের বেড়া তুলে ফেলা হল – মাটির কলসীতে বেলফুলের গাছ গুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হল । এইরকম অনেক খুঁটিনাটি পরিবর্তন করেও রবীন্দ্রনাথের বিরক্তি আর কমে না , বলেন – “চারদিকে জিনিসে পত্রে ঠাসা , এর মাঝে আমি যেন বন্দী হয়ে আছি । একটু হাত-পা ছড়াবার জায়গা নেই । আমি চাই খোলামেলা একটি ঘর ; তা নয় – যেখানেই যাব এগুলি সব আমায় চার দিক ঘিরে থাকবে । বনমালী বলে , এগুলোসবই যে আপনার দরকারে লাগে , সরাব কি করে ?
– কি মুশকিল , ছোটো ছোটো ঘরে বই টেবিল বোঝাই , তার মধ্যে থাকতে গিয়ে আমি যে হাঁপিয়ে উঠি । না , না , এ হয় না । আমার জন্য একটি ঘর করে দাও – এর পাশেই । একখানি মাত্র ঘর , চারদিকে খোলা বারান্দা । জিনিসপত্র কিছু যাবে না সে ঘরে , সব থাকবে এখানে । আমার বইয়ের দরকার পড়ে , বলব কাউকে , যাও তো আমার অমুক বইটা এনে দাও দেখি শ্যামলী থেকে । রঙের দরকার , নিয়ে আসবে রঙ ; আবার কাজের শেষে যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে দেবে । নতুন ঘরে থাকবে কেবল আমি আর আমার হাতের একটি খাতা কি বই । ”
সুতরাং , শ্যামলীর পুবে কয়েক হাত তফাতে আবার নতুন বাড়ির কাজ শুরু হয়ে গেল ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শ্রীরানী চন্দ , প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
শ্যামলীর প্রাঙ্গনে কবিগুরু যে গানটি গেয়েছিলেন (ডকুমেন্টারি তোলা হয়েছিল), গনটি কোন গান?
বৈচিত্রপিয়াসী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ লেখাটি ভালো লাগলো। নিয়মিত লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ 🙂
:rose:
অতীব চমৎকার! খুবই ভাল লেগেছে পড়তে। অনেকদিন পর এরকম একটা লেখা পড়লাম। ধন্যবাদ!!
অনেক ধন্যবাদ 🙂
চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
শ্যামলী বাড়িটিতে নন্দলালের পরিকল্পনায় দেওয়ালে যে রিলিফ ভাস্কর্যগুলি তৈরি হয়েছিল তার কয়েকটি রামকিঙ্করের করা । আর এই বাড়িতে গান্ধীজীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একান্ত বৈঠক হয়েছিল । এই বাড়ি সম্পর্কে গান্ধীজীর প্রতিক্রিয়া কি ছিল জানতে পারলে ভাল হত , অবিশ্যি যদি কোন তথ্য থেকে থাকে তবেই ।
বেশ আমি এই সম্পর্কে তথ্যের সন্ধান করার চেষ্টা করব । ধন্যবাদ
বেশ ক’দিন পরে মুক্তমনায় এই রকম একটা লেখা পড়লাম। একটু লম্বা হলেও একনাগাড়ে পড়ে ফেলা গেলো। চমৎকার একখানা লেখা উপহার দেবার জন্য লেখক সাত্যকি দত্ত’কে ধন্যবাদ।
আরো লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।