শাহনাজ রহমতুল্লাহ আমার অত্যন্ত প্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের একজন। তাঁর কতো গান শুনে যে আমি সাগরের ঢেউ হয়ে যাই, ফুলের রেণু হয়ে যাই, পাখির ডানা হয়ে যাই! আমি সিক্ত হই, অনেক সময় তপ্ত মনে ঝরঝর বৃষ্টি নামে। বেশ কিছুদিন ধরে ইউ টিউব থেকে চিরুনী অভিযান চালিয়ে খুঁজে খুঁজে তাঁর গানই শুধু শুনছিলাম। এমত অভিযান চলাকালীন অবস্থায় সেদিন চোখে পড়লো এক আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রমী ভিডিও। ভিডিওটার উপরে নাম লেখা আছে – শাহনাজ রহমতুল্লাহ। কিন্তু সেই মহিলা দেখতে আদৌ আমাদের শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর মত না। আমি ভেবেছিলাম, একই নামের অন্য কেউ নিশ্চয় এবং ফানী কিছু করেছে হয়ত। কৌতুহল বশতঃ ভিডিওটিতে ক্লিক করি। গোলাপী রঙের বাহারী রঙচঙে জরী ও চুমকিতে আবৃত এক অদ্ভুত কাপড়ে মহিলা তাঁর কান, মাথা, চুল, হাত ভালো ভাবে আচ্ছাদিত করে রেখেছেন। সামনে হারমোনিয়াম। হারমোনিয়ামে সুর তুলছেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর চেহারাটা আমাদের শাহনাজ রহমতুল্লাহর মতো মনে হতে লাগলো আমার। আরো কিছুক্ষণ পর আমি নিশ্চিত ভাবেই সনাক্ত করতে সক্ষম হলাম যে, ইনি অন্য আর কেউ নন, আমাদের শাহনাজ রহমতুল্লাহই। তবে ইনার এ শোচনীয় অবস্থা কেন? এই মুক্ত আলোর বিহঙ্গের গায়ে ঘোর কৃষ্ণপক্ষের আস্তরণ কে চাপিয়ে দিলো? তারপর মনে হলো, তিনি হয়ত কোনো ইসলামী গান গাইবেন। তাই এই রকম পোষাক পরেছেন গানের প্রয়োজনে। আমাকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে গান গাইতে শুরু করলেন প্রিয় শিল্পী – খোলা জানালায় চেয়ে দেখি তুমি আসছ জানাতে সুপ্রভাত……। তারপর একের পর এক।

মনটা বড় দুঃখ ভারাক্রান্ত হলো আমার। ছোটবেলা থেকে দেখেছি উনাকে, শুনেছি উনার মধুঝরা কণ্ঠের গান। দেখেছি উনার মেঘের মত চুলগুলি উন্মুক্ত। দেখেছি সেই উন্মুক্ত মেঘের মতো চুলের রাশি উন্মুক্ত বাতাসে উড়ছে আর উনি গলা ছেড়ে গাইছেন। আজ কেন এমন হলো? কেন নিজের আজন্ম মুক্ত চুলের রাশিকে তিনি বন্দি করে ফেললেন কয়েদীর মতো। চুলরাশির অপরাধ কী ছিল? তাঁর চুলেদের বন্দী দশা দেখে আমার যে বড় বেদনা হলো ওদের জন্য। চুলদের কেন এই শাস্তি তিনি দিলেন একজন উঁচুদরের শিল্পী হয়ে?

আরো কয়েক বছর আগে অভিনয় শিল্পী শাবানার এমন কৃষ্ণগহ্বরকবলিত অবস্থা আমরা দেখেছিলাম। তিনিও নিজের মুক্ত চুলরাশিকে কয়েদীর মতো বন্দি করে ফেলেছিলেন। আমাদের মনে তখনো বেদনা জমেছিল উনার চুলরাশির জন্য। আলো থেকে পালিয়ে উনার কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ দেখে আমরা মর্মাহত হয়েছিলাম, করেছিলাম আর্ত চিৎকার। বন্দি দশা থেকে মানুষ মুক্ত হতে চায়। আর এঁরা স্বাধীন মানুষ হয়ে কেন স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব বরণ করলেন?

কিছুদিন আগে এক জায়গায় একটা বই দেখেছিলাম। নবাব ফয়জুন্নেসাকে নিয়ে লেখা একটি নাটক। লিখেছেন অভিনয় শিল্পী ফাল্গুনী আহমেদ। কৌতুহল বশতঃ লেখক পরিচিতি উলটে দেখলাম। এক কালের অভিনয় শিল্পী ফাল্গুনী আহমেদের ছবি দেখে মনটা বেদনাতুর হয়ে গেল। কৃষ্ণগহ্বরকবলিত দশা। মাথার চুলগুলিকে বস্তায় বন্দি করে ফেলেছেন।

এঁদের কেউ কণ্ঠশিল্পী, কেউ অভিনয় শিল্পী। এঁরা এঁদের শিল্পের মাধ্যমে আমাদেরকে জীবনের কথা বলেন, ভালোবাসার কথা বলেন, সুন্দর করে বাঁচার কথা বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা বলেন, আমাদের অধিকারের কথা বলেন, অন্যায়ের সাথে আপোশ না করতে বলেন, সভ্যতার কথা বলেন। আমাদের পথ দেখান। পথ প্রদর্শক যদি ঘোর কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করেন স্বেচ্ছায় তবে আমরা কোথায় যাব? কী হবে আমাদের গতি?

এঁরা কি ভাবছেন, সারা জীবন শিল্পের সাধনা করে কবীরা গুনাহ করেছেন? এখন কি ইসলামী বর্বর অন্ধকারের বস্তায় মাথা ঢুকিয়ে তার তওবা করছেন? তবে তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, ইসলাম ধর্ম তথা আল্লার এইসকল বাণী কি তাঁরা আল্লা অথবা নবী মোহাম্মদের রচিত কোরান থেকে পড়েছেন?
১, পুরুষগণ নারীদের উপর অধিকর্তা। কারণ আল্লা নারীর উপরে পুরুষের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এবং পুরুষেরা নারীদের ব্যয়ভার বহন করে, ফলে বিদূষীরা পুরুষের অনুগত থাকে। আর যেসব নারীদের মধ্যে অবাধ্যতার আশংকা দেখো তাদের উপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ করো এবং পিটাও। – সুরা নিসা, আয়াত ৩৪। (৪;৩৪)

২, যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে। তবে নিজেদের স্ত্রী বা অধিকারের দাসীদের বেলায় স্বতন্ত্র কথা, এতে তারা নিন্দনীয় হবে না। – সুরা মুমিনুন, আয়াত ৫,৬ (২৩;৫,৬)

৩, ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী প্রত্যেককে একশত দোররা মারবে। আল্লার বিধান পালনে তাদের প্রতি যেন তোমাদের দয়া না জাগে, যদি তোমাদের আল্লা ও পরকালের উপর বিশ্বাস থাকে। এবং মুমিনদের একটি দল যেন শাস্তি দানকালীন উপস্থিত থাকে। – সুরা নূর, আয়াত ২ (২৪;২)

৩, হে নবী, তোমার জন্য হালাল করে দিয়েছি, তোমার মোহর প্রদত্ত বিবিগণকে, তোমার গণিমতরূপে আল্লার প্রদত্ত তোমার আয়ত্তাধীন দাসীগণকে, তোমার সাথে হিজরতকারী তোমার চাচাত ফুফাত, মামাত, ও খালাত বোনদেরকে এবং বিনা মোহরে তোমার পত্নীত্ব বরণকারী মুসলিম নারী যদি নবী তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছা করে, (এ সুবিধা শুধু তোমার জন্য নির্দিষ্ট, অপর মোসলমানদের জন্য নয়)। আমি জানি সাধারণ মুমিনদের বিবি ও দাসীগণের ব্যাপারে আমি যে সব ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছি, তা এজন্য যে, তোমার কোনোরূপ অসুবিধা না হয়। আল্লা ক্ষমাকারী, করুণাময়। – সুরা আহযাব, আয়াত ৫০ (৩৩;৫০)

৪, স্ত্রীদের যাকে খুশি পৃথক রাখতে পারো এবং যাকে চাও সঙ্গে রাখতে পারো। পৃথক যাকে রেখেছ চাইলে তাকেও ডাকতে পারো। এতে তোমার দোষ হবে না। এব্যবস্থা তাদের প্রশান্তির, আর দুঃখ না পাবার উপকরণ। আর তাদেরকে যা কিছু দেবে তাতেই তারা সন্তুষ্টি লাভ করবে। আর আল্লা তোমাদের মনের সব বিষয় জ্ঞাত। বস্তুত আল্লা জ্ঞানবান ও সহনশীল। – সুরা আহযাব, আয়াত ৫১ (৩৩;৫১)

এগুলি ছাড়া আরো রয়েছে এইরকম অজস্র আয়াত। তাঁদের কাছে আমার এই লেখা পৌঁছাবে কিনা জানি না। যদি পৌঁছায় তাঁরা কি উত্তর দেবেন এই আয়াতগুলির? তাঁদের কেউ কি এই আয়াতগুলি সমর্থন কিংবা পালন করেন? যদি না করেন তবে তাঁরা কেমন মোসলমান?