লিখেছেনঃ শাহানূর ইসলাম সৈকত
যদিও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের আইনের দৃষ্টিতে সমান, সমঅধিকার ও আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার ঘোষণা করেছে তারপরও এদেশের সমকামি সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত নির্যাতন, অবহেলা ও প্রতিক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সমকামিতা একটি গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ, সমলিঙ্গীয় বিবাহ ও লিঙ্গ পরিবর্তন করা আইনতভাবে অবৈধ এবং পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে সমকামি ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোন আইনগত সুরক্ষা নেই।
সমগ্র বিশ্বের ৭২টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ একটি অন্যতম রাষ্ট্র যেখানে এই একাবিংশ শতাব্দিতেও সমকামিতাকে ফৌজদারী আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গন্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় কোন ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় কোন পুরুষ, নারী বা পশু প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সঙ্গম করে, তবে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে, অথবা বর্ণনা অনুযায়ী নির্দিষ্টকালের কারাদণ্ড প্রদান করা হবে যা দশ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে, এবং এর সাথে নির্দিষ্ট অঙ্কের আর্থিক জরিমানাও দিতে হবে।
বিশ্বের যে ৭৫ টি রাষ্ট্রে এখনো সমকামিতা ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে তার অধিকাংশ রাষ্ট্রই এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত। যাদের মধ্যে অর্ধেক এর বেশি আবার কমন ওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র। অন্যদিকে বিশ্বের যে নয়টি রাষ্ট্রে সমলিঙ্গীয় বিবাহ বৈধ এবং সমকামী ব্যক্তির অধিকার অনেক বেশী নিশ্চিত তার অধিকাংশ উত্তর ও দক্ষিন আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সমকামি অধিকারের বিরুদ্ধে যে ৫৯টি রাষ্ট্র অবস্থান গ্রহণ করেছিল বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্র। যদিও বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালের জানুয়ারী মাসে হিজরাদের নারী পুরুষের বাহিরে পৃথক লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে তাদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
দক্ষিন এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এপর্যন্ত শুধুমাত্র ভারতে সমকামি সম্প্রদায়ের ব্যক্তি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। ২০০১ সালে কিছু সমকামী সংগঠন দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে ( যা বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অনুরূপ) চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট যেকোন সাবালক ব্যক্তির গোপনেকৃত স্বেচ্ছায় অব্যনিজ্যিক যৌন সঙ্গমের বিরুদ্ধে বিদ্যমান সকল আইনগত বিধি-বিধান অবৈধ বলে ঘোষণা করে। এত কিছুর পরও কিন্তু ২০১৩ সালে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট দিল্লি হাইকোর্টের উল্লেখিত রায় বাতিল বলে ঘোষণা করে।
কিছু কিছু সমকামী অধিকারকর্মী ও সংগঠন লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের জন্য গোপনে এবং সময়ে সমেয়ে খুব অল্প পরিসরে ক্যাম্পেইন কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখনো পর্যন্ত কোন সংগঠন বা ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ তাদের আইনগত স্বীকৃতি নিশ্চিত করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়নি এবং আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার মত কোন উদ্যোগও দৃশ্যমান নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সমকামী ব্যক্তি ও সমকামি অধিকারকর্মীদের উপর ইসলামী মৌলবাদীদের আক্রমন এবং সরকারের নজরদারী ও আইনগত নিপীড়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় সমকামী ব্যক্তি ও সমকামি অধিকারকর্মীরা দিনে দিনে অদৃশ্য থেকে অদৃশ্যতর হয়ে যাচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশের এভাবে অদৃশ্যমান হয়ে যাওয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতাদর্শ, লিঙ্গীয় বৈচিত্র ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই সরকারের উচিত আদৃশ্যমান হতে যাওয়া সমকামী সম্প্রদায়ের অইনগত স্বীকৃতি প্রদান করে তাদের আইনগত সুরক্ষা প্রদান করা।
আসলে সমকামিতার ব্যাপারে মানুষের আরো বেশি জানাশোনা প্রয়োজন । সহজ কথায় প্রচার । এটা যে একটা সহজ-স্বাভাবিক বিষয় সেটা আসলে বেশিরভাগ মানুষের জানা নেই ।
শুধু একটিবার ভেবে দেখুন তো,
যদি আপনার বাবা তার জীবন সঙ্গী হিসেবে কোনো পুরুষকে, অথবা আপনার মা কোনো নারীকে বেছে নিতো।
তাহলে আপনার অনস্থান টা কোথায় থাকত?
সমাজের সব বিষমকামী পুরুষ বা মহিলা কি সন্তান জন্ম দানে সক্ষম? আপনিও একবার ভেবে দেখুন আপনার বাবা অথবা মা অথবা আপনার বাবা মা উভয়েই যদি কোন কারনে স্থায়ীভাবে সন্তান জন্ম প্রদানে অক্ষম হত তাহলে আপনার অবস্থানটা কোথায় থাকত?
শুনে দুঃখিত হলাম। সমকামিতা কোন রোগ বা বিকৃত অভ্যাস নয়। নীতি-নির্ধারকদের উপর ধর্মের প্রভাব আর জৈব-প্রবৃত্তি সম্পর্কে অজ্ঞানতাই এমন অবস্থানের জন্য দায়ী।
শুধু যে সমাজের অশিক্ষিত স্তরের জনগনই সমকামিতার বিষয়টি ভুল্ভাবে জানে তা নয়, সমাজের শিক্ষিত স্তরের অধিকাংশ জনগণও সমকামিতার বিষয় সম্পর্কে সঠিকভাবে জ্ঞাত নয়!
বাংলাদেশের এলজিবিটি সমাজের দিগভ্রান্তির একটা মেজর কারণ সম্ভবত, বাংলাদেশে সমকামী, রূপন্তরকামী এবং হিজড়ারা এক আমব্রেলার নিচে আসতে পারছে না। যেটা ভারতে পেরেছে। গোটা এলজিবিটি কমিউনিটি একসাথে হয়ে, ধাপে ধাপে আইনের দ্বারস্থ হয়েছে। ওরা শুধু আদালতেই যায় নি, সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলেছে।
কিন্তু এখানে স্রোতের মূলধারার বাইরে মানেই ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন গ্রুপ। যতদিন বিচ্ছিন্ন থাকবে, ততদিন উল্লেখযোগ্য কিছু আশা করা যায় না, কারো থেকেই
আমাদের দেশে সমকামীতার বিষয়টি এত বেশী ঘৃণা, ধর্মবিরোধী আর অপরাধ হিসাবে দেখা হচ্ছে যে চাইলেও সকল এলজিবিটি সম্প্রদায় এক হতে পারছে না।