লেখকঃ কে এইচ রুধির
‘হাত বাড়িয়ে দাও’ ওরিয়ানা ফাল্লাচির অসাধারণ রচনাগুলোর একটি। মাত্র ৫৫ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি পড়ার সময় অসাধারণ এক মুগ্ধতায় বুঁদ হয়েছিলাম। এক বসায় পড়ে ফেলার মত একটি উপন্যাস।
প্রচ্ছদঃ হাত বাড়িয়ে দাও- ওরিয়ানা ফাল্লাচি। অনুবাদঃ আনু মুহাম্মদ।
এক মা আর এক ভ্রুণের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে। বিশেষত এক মেয়ের গল্প যার পেটে ভালবাসার মানুষটির বীজ যে ভালবাসার মানুষটি বীজ বুনেই ছুট দিয়েছে। মাতৃত্বের বার্তা যতটা না তাকে সুখী করে তুলছে তার চেয়ে বরং দুশ্চিন্তায় ভুগছে সে তার জরায়ুতে বড় হতে থাকা মানবভ্রুণকে নিয়ে। উনি চিন্তা করছেন তার শিশুটিকে এই জরাগ্রস্ত, নির্মম, হানাহানিপূর্ণ, বিশ্বাসঘাতকে ঠাসা পৃথিবীতে আনা উচিত কিনা সেটা নিয়ে। উপন্যাসের শুরুটাই হয়েছে এই শঙ্কা নিয়ে-
“গত রাতেই প্রথম টের পেলাম তুমি আছ-অসীম এক শূন্যতা থেকে আসা একটি ছোট জীবনবিন্দুর মতো। তোমার অস্তিত্বের এই আকস্মিক ঘোষণা আমাকে অভিভূত করল, বিস্মিত করল এবং বিদ্ধ করল একটি বুলেটের মতো।এক অজানা ভীতি আমার সারা শরীরে, সমগ্র সত্তায়। অন্যদের জন্যে এই ভয় নয়-আমি কাউকে পাত্তা দেই না। ঈশ্বরের ভয়ও নয়। ঈশ্বরে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। ব্যথার জন্যে আমার কোনো ভয় নেই।
ভয় তোমার জন্যে। যেখানে এবং যেভাবে আসছ তার জন্যে তোমাকে স্বাগত জানানোর আগ্রহ আমার কোনোকালেই ছিল না। কিন্তু জানতাম যে একদিন-না-একদিন তুমি আসবেই। আমার ভয়, যদি কোনোদিন তুমি চিৎকার করে প্রশ্ন করো- কেন তুমি আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এলে? কেন? কে বলেছিল তোমাকে? ”
একজন মা কীভাবে ঠেলে দিতে পারে তার সন্তানকে এই নষ্ট আর ভ্রষ্টদের রাজ্যে? তাই তিনি চাইছেন না তার সন্তান আসুক এই রাহুগ্রস্ত পৃথিবীতে। আবার সাথেসাথেই এক অপরাধবোধে ভুগছে। ভাবছে এই পৃথিবীতে অন্ততপক্ষে হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি করার অধিকার তো এই সদ্য পরিপূর্ণ হতে থাকা ভ্রুণটিরও আছে তাহলে কেন তাকে ভেতরে ভেতরেই শেষ করে দিবে! এই দু’টানায় পড়ে গেছে তার মন।
প্রতিদিন একটু একটু করে পরিপূর্ণ হতে থাকা ভ্রুণটির সাথে কথা বলে সমাজ-সংসার এবং সেখানে রাজত্ব করা আর শোষিত হওয়া মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তিনি ‘চিন্তার সঙ্গী’ বানিয়েছেন সেই ভ্রুণটাকে এবং জিজ্ঞেস করছেন তার ‘চিন্তার সঙ্গী’ কে – ‘তুমি কি হবে- ছেলে নাকি মেয়ে?’
তারপর একটু একটু করে ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে মেয়ে হলে কী কী শোষণ, বঞ্চনা, নির্মমতা আর অবহেলার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু উনি এইটাও চাচ্ছেন যাতে সে মেয়ে হোক আর তার মত করে সবকিছুর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হোক যা কিছুর মধ্য দিয়ে উনি গিয়েছেন। অপরদিকে উনি বলছেন নারী মহীয়সী, নারীর জীবন অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ।
“আর একই কারণে নারীর জীবন এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার, যেখানে সাহসের প্রয়োজন আছে এবং যাতে কখনোই একঘেয়েমি আসে না। ”
তিনি পুরুষ এবং নারীর মধ্যেকার বৈষম্যকে কটাক্ষ করে বলছেন-
“পৌরাণিক উপাখ্যান বলে – জীবন ব্যাখ্যা করার জন্যে প্রথম পুরুষই সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথম মানব হচ্ছে একজন পুরুষ- অ্যাডাম। ইভ এসেছে পরে- তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে এবং সমস্যা সৃষ্টির জন্যে। গির্জায় যে চিত্র ঝুলানো থাকে সেখানেও ঈশ্বর একজন শাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ-কখনোই শ্বেতশুভ্র চুলশোভিত বৃদ্ধা নয়। এবং উপাখ্যানের সব নায়কই হচ্ছে পুরুষ- আগুনের আবিষ্কারক প্রমিথিউস থেকে শুরু করে যাকে আমরা ঈশ্বরের পুত্র বলি সেই যিশু পর্যন্ত। ”
উনি আবার বলছেন –
“যদি তুমি ছেলে হয়ে জন্মাও তবুও আমার কোন দুঃখ থাকবে না। তবে তোমার ঝামেলা তাতে অনেক কম হবে। অন্ধকার রাস্তায় ধর্ষিতা হবার ভয় থাকবে না। প্রয়োজন হবে না বুদ্ধিবৃত্তি ঢেকে মসৃণ শরীর বানানোর। নিজের পছন্দমতো কারো সাথে শুলে কোনো বাজে কথা শুনতে হবে না তোমার। মানুষ কখনোই বলবে না, যেদিন তুমি একটি নিষিদ্ধ ফল তুলে নিয়েছ সেদিন থেকেই তোমার মধ্যে পাপ ঢুকেছে। জীবন সংগ্রাম হয়তো অনেক সহজতর হবে। তুমি তখন প্রয়োজনীয় অবাধ্যতার জন্য অপমানের শিকার হবে না, ভালোবাসার ‘দায়’ হিসেবে গর্ভধারণের ভয় থাকবে না। ”
কিন্তু ছেলে হয়ে জন্মালেই যে সব অনাচার, অবিচার আর দায়িত্বকে বুড়ো আঙুল দেখানো যাবে এমনটা নয় বরং ছেলে হয়ে জন্মালেই দায়িত্বের বোঝাটা বড্ড ভারী হয়। কিছু অতিরিক্ত দায়িত্বও তখন যোগ হয়। তিনি ‘পুরুষ’ শব্দটাকে ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে–
“একজন পুরুষ মানে সম্মুখভাগে লেজবিশিষ্ট একটি মানুষ নয়-একজন পুরুষ মানে একজন ব্যক্তি। ”
ব্যক্তি শব্দটিকে তিনি এই কারণেই ব্যবহার করেছেন কারণ ব্যক্তি শব্দটিতে কোন পুরুষ বা নারীর ভেদাভেদ নেই। সুতরাং পুরুষ মানে একটা সত্তাকেই প্রাধান্য দিতে চাচ্ছেন। কোন লিঙ্গান্তরের মারপ্যাঁচে ফেলতে চাচ্ছেন না। ভীতি নামক ঘৃণ্য বিশেষণকে ঝেড়ে ফেলে দিতে বলছেন কারণ “এই ভীতি মানুষকে মানুষ হতে দেয় না, কুরে কুরে খায়”।
তার ভালবাসার মানুষটি অল্প অল্প করে বেড়ে ওঠা ভ্রুণটিকে নষ্ট করে ফেলতে বলে কিন্তু উনি করেননি। তারচেয়ে বরং বয়ে নিয়ে গেছেন। বসের চোখ, বন্ধুর খটখটানি আর সামাজিক মানুষের কানাঘোষা সবকিছুকে পরোয়া না করে স্বপ্ন দেখে পৃথিবীর মুখ দেখানোর। শুরু হয় তার সমাজ-সংকার, রীতি-নীতি আর বাস্তবতার বিরুদ্ধে নিঃশব্দ যুদ্ধের। ভালবাসার মানুষটির এমন কদর্য রূপ দেখার পর ‘ভালবাসা’ জিনিসটা যে কি সেটা নিয়েই উনি বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন। ভালবাসার কোন সংজ্ঞায়ন করতে পারছেন না।
“আমি এখনও বুঝি না ভালোবাসা কী? এখন মনে হয় এটি একটি বড় ধরণের তামাশা, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে, অশান্ত পৃথিবীতে তাকে শান্ত রাখার জন্যে উদ্ভাবিত হয়েছে। সর্বত্র শুনি ভালোবাসার কথা-ধর্ম, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য, রাজনীতি কোথাও বাদ নেই। প্রত্যেকেই সব দুঃখের সর্বরোগের ওষুধ হিসেবে ভালোবাসাকে দাঁড় করিয়ে মানুষের দেহ এবং আত্মা উভয়ের সঙ্গেই প্রতারণা করছে। আমি এই শব্দকেই এখন ঘৃণা করি। ”
ডাক্তার যখন বলছেন- “কংগ্রাচুলেশনস ম্যাডাম” তখন তিনি প্রত্যুত্তরে বলছেন- “না, মিস”। মানে উনি বিবাহিত নন। সাথে সাথেই ডাক্তারের হাস্যোজ্বল মুখটা চুপসে যায় আর শেষপর্যন্ত সকল আনুষ্ঠানিকতা বাক্সবন্দী করে ফেলে। এমনকি ‘গুডবাই’ বলার প্রয়োজনটা পর্যন্ত বোধ করে না যেন আপদটা গেলেই বাঁচে।
তারপর তিনি একে একে তিনটি গল্প শুনান যার সাথে তার অবহেলিত ও বঞ্চিত জীবন প্রবলভাবে সম্পর্কিত। যার ফলে উনি ভাবতে শুরু করেছিলেন যে, ফুল ছিঁড়লেই মানুষ মারা যায়। আর চকোলেটের প্রতি তার বিতৃষ্ণা জন্মে আমৃত্যু এবং বুঝতে শুরু করে যে তার প্রত্যাশিত আগামীকাল শুধুই স্বপ্ন। তাই তিনি প্রশ্ন করছেন-
“তুমি কি ফুলগাছের মাথায় মৃত নারীদেহ দেখতে রাজি আছ? যাদের প্রয়োজন নেই তাদের উপর চকোলেটের ঢল দেখতে রাজি আছ? অন্যের নোংরা আন্ডারওয়্যার ধুতে রাজি আছ? এবং প্রতিবার উপলব্ধি করতে রাজি আছ যে, তোমার প্রত্যাশিত আগামীকাল শুধুই স্বপ্ন? ”
সেই ভ্রুণটি কি আদৌ মুখ দেখেছিল ভোরের সূর্য আর ঘুটঘুটে অন্ধকারের? সে কি কোন পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল কোনদিন? সে কি কখনো জ্যোৎস্না ধারায় মাতাল হয়েছিল? সে কি কখনো উন্মাদ নৃত্য করেছিল বর্ষার বারি ধারায়? সে না হয় পাঠক নিজ দায়িত্বে জেনে নেবেন।
ওরিয়ানা ফাল্লাচি একজন ইতালিয়ান লেখক, প্রধানত সাংবাদিক। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় Lettera a un bambino mai nato উপন্যাসটি। ১৯৭৬ সালে John Shepley উপন্যাসটিকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন Letter to a Child Never Born নামে। আনু মুহাম্মদ এই ইংরেজি অনুবাদটির বাংলা তর্জমা করেন হাত বাড়িয়ে দাও নামে।
প্রচ্ছদঃ Lettera a un bambino mai nato
বইটি যে কী ভালো লেগেছিল আমার! সেই সময়ে একজন অবিবাহিত মেয়ের গর্ভবতী ও মা হওয়া যে কত ধিক্কারের ব্যাপার ছিল সমাজের সর্বস্তরে তা এই বইটি পড়লে অনেকটা অনুমান করা যায়। আপনাকে ধন্যবাদ এখানে শেয়ার করার জন্য।