উত্তর ইরাকের নিনেভে বসবাসকারী ইয়েজিদিরা সম্ভবত এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ধর্মীয়গোষ্ঠী।রহস্যময় এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি নির্ণয় খুব একটা সহজসাধ্য নয়।তবে এটা নিশ্চিত যে,এরা আদৌ ইসলামের কোন উপগোষ্ঠী বা শাখা নয়।শেখ আদি বিন মুসাফির নামক একজন সুফি সন্ত যিনি দ্বাদশ শতকে ইয়েজিদি ধর্মমতের সংস্কার করেছিলেন,তাঁকে কেন্দ্র করে ইয়েজিদিদের অতীত ঐতিহ্যকে বারবার বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে।ইসলামী চিন্তাবিদরা ইয়েজিদিদের প্রাচীনত্বকে নস্যাৎ করে দিলেও,তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।ইয়েজিদিদের ধর্মবিশ্বাস কেবল ইসলাম নয় খ্রিস্টীয় এমনকি পার্সি ধর্মমতের তুলনায় অনেক প্রাচীন।আসলে পশ্চিম এশিয়ার এই প্রাচীন ধর্মমতটি যুগ যুগ ধরে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিশ্বাসকে নিজের মধ্যে আত্তীকরণ করে নিয়েছে।ফলে এদের উৎস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এত জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।একদা ইসলামীয় আক্রমণের হাত থেকে লালিশের মন্দিরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়েই ইয়েজিদিরা মন্দিরের দেওয়ালে কোরানের কিছু বক্তব্য খোদাই করে দেয়।যদিও তাতে রেহাই মেলেনি বরং বারবার আক্রমন নেমে এসেছে।বর্তমানে লালিশে ইয়েজিদিদের যে মন্দিরটি রয়েছে তা আনুমানিক একশো বছর আগে নির্মিত।ইয়েজিদিরা বিশ্বাস করে যে,বহুকাল পূর্বে তাওসি মেলেকের সম্মানে লালিশের মন্দির নির্মিত হয়েছিল।লালিশের মন্দিরের প্রাচীনত্ব নির্ণয়ের জন্য জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিকরা ইরাক সরকারের কাছে বারবার আবেদন করলেও,তাতে সরকার কোন কর্ণপাত করেনি।অন্যদিকে ইয়েজিদিদের বেশ কিছু ধর্মীয় নেতা,যারা পশ্চিমী ডলারে পরিপুষ্ট তারাও বরাবর এর বিরোধিতায় সরব,কারন এর ফলে নাকি লালিশের পবিত্রতা বিনষ্ট হবে।
প্রাচীনত্ব নির্ণয়ের সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত রীতি হল রেডিও কার্বন পদ্ধতি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লালিশের মন্দিরের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ হয়নি।তাই মূলত সাহিত্যসূত্রের ওপর নির্ভর করেই যুক্তিসম্মতভাবে ইয়েজিদিদের উৎস সন্ধান করতে হবে।এই প্রেক্ষিতে সবচেয়ে কার্যকরী হল জেন্দ আবেস্তা।জেন্দ আবেস্তায় আসলে জরাথুস্ত্রের মতাদর্শ বিবৃত রয়েছে।ইরানের প্রাচীন নাম ছিল পারস্য।তাই এই পারস্যের নামানুসারে জরাথুস্ত্র প্রবর্তিত ধর্মমত পার্সি নামে পরিচিতি লাভ করে।উল্লেখযোগ্য বিষয় হল যে,জরাথুস্ত্রের পূর্বেও ইরানে এক প্রাচীন ধর্মমতের অস্তিত্ব ছিল,যার প্রমান জেন্দ আবেস্তায় পাওয়া যায়।কারন জেন্দ আবেস্তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে,জরাথুস্ত্রের আবির্ভাবের পূর্বে ইরানে প্রচলিত ধর্মমত ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত।যীশুর জন্মের আনুমানিক আটশো বছর পূর্বে জরাথুস্ত্রের আগমন ঘটেছিল।যদিও আধুনিক গবেষকরা ৬২৮-৫৫১ খৃস্টপূর্বের মধ্যবর্তীকালে জরাথুস্ত্রের জীবনীকাল নির্ধারণ করেছেন।তিনি মূলত পারস্যের সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের সমসায়িক ছিলেন। জরাথুস্ত্রের পিতার নাম ছিল পৌরুশসপ ও মাতার নাম ছিল দুঘধোবা দেবী।যদিও আজ পর্যন্ত জরাথুস্ত্রের জন্ম ইরানের কোথায় হয়েছিল তা নির্ণয় করা যায় নি।তিরিশ বৎসর বয়সে তিনি পিতার গৃহ ত্যাগ করে জ্ঞানান্বষণে দেশপর্যটন এবং তারপর তপস্যায় মনোনিবেশ করেন।অতঃপর কঠোর সাধনার ফলে সাবাতন নামক পর্বতে তিনি আহুর মজদার কৃপা ও দিব্যজ্ঞান লাভ করেন।
জেন্দ আবেস্তায় জরাথুস্ত্র ঈশ্বরকে ‘আহুর মজদা’ রূপে উল্লেখ করেছেন।আদতে এই আহুর মজদা হলেন বৈদিক দেবতা বরুন।কিন্তু বরুনের সাথে ইন্দ্রের ঘনিষ্ঠতা থাকায় আবেস্তা থেকে বরুন নামটি বাদ দেয়া হয়।কারন আবেস্তা ইন্দ্রের তীব্র বিরোধী।আসলে জেন্দ আবেস্তা বরাবরই বেদের উল্টো সুর গাইতে অভ্যস্ত।তাই বেদে যেখানে ‘দেব’ শব্দটি শুভসত্ত্বার বাহক সেখানে আবেস্তায় ‘দেব’ নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের পরিচয়বাহী।আহুর ও অসুর এই দুটি শব্দ প্রায় সমজাতীয়।অসুর বৈদিক সাহিত্যে নিন্দিত হলেও আবেস্তায় তাঁর স্থান সর্বোচ্চে।আসলে বেদ ও আবেস্তার রচিয়তার একই গোষ্ঠীভুক্ত ছিল,তাই এই প্রকার সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।যদিও পরবর্তীতে কোন এক বিষয়ে মতভেদ হওয়ায় এই গোষ্ঠী ভেঙে যায় এবং ধর্মবিশ্বাসেও পার্থক্য দেখা দেয়।বর্তমানে যে জেন্দ আবেস্তা প্রচলিত রয়েছে তা অপেক্ষাকৃত নবীন, যা সাসানীয় সাম্রাজ্যের সময়কালে(২২৪-৬৫১)সংকলিত।যদিও জেন্দ আবেস্তায় এমন বেশ কিছু বিষয়বস্তু আছে যা প্রাচীন ইরানীয় ধর্মের সময়কালীন অর্থাৎ জরাথুস্ত্রেরও পূর্বকালীন।আবেস্তায় বেদের নানা বিষয় থাকলেও ইয়েজিদিদের বিষয়ে প্রতক্ষ্যভাবে কিচ্ছু বলা নেই কিন্তু পরোক্ষভাবে কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়।জেন্দ আবেস্তায় বিবৃত হয়েছে যে,আহুর মজদা শুভ শক্তি বা ‘স্পেন্তা মন্যু’ সৃষ্টি করেছিলেন।অন্যদিকে এর বিপরীত শক্তি ছিল অাহ্রিমন এবং এই দুই শক্তির সংঘর্ষের মাধ্যমে সভ্যতা এগিয়ে চলবে।সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল আবেস্তায় বলা হয়েছে যে, এই অাহ্রিমন ময়ূর সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই ময়ূর হল অত্যন্ত অলস ও কুৎসিত।সর্বোপরি এই ময়ূর কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না।এবার একটু ইয়েজিদিদের সৃষ্টিতত্ত্ব দেখা যাক।এই তত্ত্ব অনুসারে তাওসি মেলেক সিঞ্জার পর্বতে অপূর্ব সুন্দর ময়ূর রূপে অবতীর্ণ হন এবং এই ময়ূর নিজের রঙের রূপান্তর ঘটিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উদ্ভব ঘটান।এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে,পার্সিরা কার্যত ইয়েজিদিদের সৃষ্টিতত্ত্বকেই নস্যাৎ করে দিচ্ছে।আসলে বিরোধী মতাদর্শকে তখনই গুরুত্ব প্রদান করা হবে,যদি জনমানসে তাঁর জনপ্রিয়তা থাকে।ইয়েজিদি ক্যালেন্ডার যীশুর উদ্ভবকালের চেয়ে প্রায় চার হাজার বছরের প্রাচীন।এর থেকে একটা অনুমান করেই নেওয়া যায় যে,পশ্চিম এশিয়ার ধর্মীয় পরিমণ্ডলে ইয়েজিদিরাই প্রাচীনতম এবং এদের ধর্মমত একসময় অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল বলেই জেন্দ আবেস্তা তাঁদের সৃষ্টিতত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিয়েছে।কেবলমাত্র ক্যালেন্ডার ই নয়,সাম্প্রতিক সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কারও পরোক্ষভাবে ইয়েজিদিদের প্রাচীনত্বের স্বপক্ষে কথা বলে।জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লস স্মিথ তুরস্কের গোবেকেলি টেপে থেকে প্রায় আট হাজার খৃস্টপূর্বাব্দের সমকালীন মন্দির আবিস্কার করেছেন।এই মন্দিরটি আবার তুরস্কের সানলিউরফা অঞ্চলের নিকটেই অবস্থিত এবং এই অঞ্চলে একদা ইয়েজিদিদের সংখ্যাধিক্য ছিল।এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম মন্দিরের নিদর্শন।এই মন্দিরের দেওয়ালে এক পক্ষী মানবের চিত্র খোদিত আছে,যার সাথে ময়ূরের পেখমের ব্যাপক মিল আছে।সর্বোপরি এই মন্দিরে সাপেরও প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে এবং লালিশস্থিত ইয়েজিদি মন্দিরের প্রবেশদ্বারেও সাপের চিত্র উৎকীর্ণ রয়েছে।বিস্ময়কর দিকটি হল এই যে,সাপ পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার আর অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
এবার দক্ষিন ভারতীয় দেবতা মুরুগানের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করা যাক।তামিলনাড়ুতে বোধহয় এমন কোন গ্রাম নেই,যেখানে মুরুগানের মন্দির নেই।তামিল সংস্কৃতির সাথে মুরুগান ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।এখন মুরুগান কতটা প্রাচীন তা আজও রহস্যাবৃত।একদা ফাদার হেরাস হরপ্পার একটি সীলে’মুরুগান আদু’ নামে শব্দদ্বয়ের উল্লেখ রয়েছে বলে দাবী করেছিলেন।দুর্ভাগ্যের বিষয় যে আজ পর্যন্ত হরপ্পীয় ভাষার কোন সর্বজনগ্রাহ্য উদ্ধার সম্ভব হয়নি।ফলে হেরাসের এই বক্তব্য অনেকেই মানেননি।সর্বোপরি হরপ্পার নিকটস্থ বেলুচিস্তানে তামিলের উপভাষা ব্রাহুই কি ভাবে প্রচলিত হল তার উত্তরও অজানা।যদিও এর ভিত্তিতে হরপ্পার অনার্য প্রেক্ষিতের বিষয়টি বেশ জোরদার হয়ে ওঠে।মুরুগান যে বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত স্কন্দ কার্তিকের সমজাতীয় তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।মুশকিল হল যে কার্তিক না মুরুগান কে প্রাচীন?ঋগ্বেদে কোথাও কার্তিকের উল্লেখ পাওয়া যায় না।কেবলমাত্র ঋগ্বেদের একটি সুক্তে ‘মেজমেষ’ নামক একজনের তথ্য পাওয়া যায়,যিনি শিশুদের ক্ষতিসাধন করতেন।অন্যদিকে বৈদিক দেবতা কার্তিক আবার শিশুদের ক্ষতিসাধনকারী মাতৃকাদের সাথে সম্পৃক্ত।এর ভিত্তিতে অনেকেই মেজমেষ ও কার্তিককে সমজাতীয় রূপে অভিহিত করেছেন।আসলে বৈদিক সাহিত্যের বরাবরেরই প্রবণতা রয়েছে যে,অনার্য সংস্কৃতিকে হেয় করে তার আত্তীকরণ ঘটানো।এই ধারাপাত বহু পরবর্তীকালে রচিত পুরাণগুলিতেও দেখা যায়।যেমন বাংলা অঞ্চলে রচিত পুরাণগুলিতে একদিকে গৌতম বুদ্ধকে নেতিবাচক সত্ত্বার সাথে যুক্ত করা হয়েছে,আবার তাঁকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবেও গন্য করা হয়েছে।সুতরাং বৈদিক কার্তিক যে আসলে অনার্য দেবতা তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই।তাই কার্তিকের চরিত্রের প্রতি কালিমালেপনেও বৈদিক সাহিত্য কুণ্ঠাবোধ করেনি।কার্তিক সম্পর্কে দাবী করা হয়েছে যে,নারী সম্ভোগে ব্যাপক আসক্তি থাকায় মাতা পার্বতীর সাথে তাঁর মনোমালিন্য হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি মহাযোগীতে রূপান্তরিত হন।
সর্বপ্রথম অথর্ববেদের ‘স্কন্দযাগ’ নামক অধ্যায়ে কার্তিক সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায়।যদিও অথর্ব বেদকে আবার চতুর্বেদের অংশ হিসেবে গণ্য করতে বেশ অসুবিধাই হয়।কারণ এই বেদের বিষয়বস্তুর চরিত্র অন্য তিন বেদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।ইন্দ্রজাল,জাদুবিদ্যা ইত্যাদি হল অথর্ব বেদের মুখ্য বিষয়।পরবর্তীকালে রচিত ব্রাহ্মণ গুলিতে ব্রাহ্মণ্যসম্প্রদায়ের সাথে ঋগ্বেদ,সামবেদ ও যজুর্বেদকে সম্পর্কিত বলা হলেও কোথাও অথর্ববেদের উল্লেখ নেই।তাই অনেকেই অথর্ববেদকে অনার্য সংস্কৃতির ধারক হিসেবে মনে করেন।অথর্ববেদের রচনা বেশ পরবর্তীকালেরই এবং তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বৈদিক কার্তিকের ধারনা আসলে অনার্য মুরুগানের থেকেই এসেছিল।যদি ঋগ্বেদর মেজমেষই আবার কার্তিক হন তাহলে সেক্ষেত্রে বেশ সমস্যা রয়েছে।কারন যে সকল তামিল সাহিত্যে মুরুগানের উল্লেখ পাওয়া যায়,তা ঋগ্বেদের তুলনায় নবীন।মূলত তিনশো খৃস্টপূর্বাব্দে বিরচিত তামিল সঙ্গম সাহিত্যে মুরুগানের কথা পাওয়া যায়।কিন্তু এখানেও এক রহস্য আছে।সঙ্গম সাহিত্যে এক দেবতার কথা পাওয়া যায়,যার গাত্রবর্ণ ছিল রক্তাভ এবং তিনি নীল ময়ূরের ওপরে উপবিষ্ট থাকতেন।এই দেবতা মুরুগানের থেকেও প্রাচীন এবং এরই বিবর্তিত রূপ হল মুরুগান।অন্যদিকে মুরুগানের অনেকগুলি নামের মধ্যে অন্যতম একটি নাম হল-‘গুহন’,যা থেকে বোঝা যায় যে তিনি গুহাবাসীদের দেবতা ছিলেন।অতএব সঙ্গম সাহিত্যে বর্ণিত মুরুগানের উৎপত্তি যে আরও প্রাচীনকালে হয়েছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে যে,সমগ্র দক্ষিন ভারতীয় অঞ্চলে একদা তামিল ভাষার আদি রুপের প্রচলন ছিল এবং এর আনুমানিক সময়কাল ছিল প্রায় তিন হাজার খৃস্টপূর্বাব্দ।
অনার্য মুরুগান ও ইয়েজিদি তাওসি মেলেকের মধ্যে বাহ্যিক প্রেক্ষিতে ব্যাপক মিল আছে।আবার উভয়েরই প্রত্নকথায় ময়ূরের গভীর তাৎপর্য রয়েছে।শুধু তাই নয় সঙ্গম সাহিত্যে ‘মইল ইয়ঝ'(Mayil Yazh)নামক এক বাদ্যযন্ত্রের বিবরণ পাওয়া যায়,যার আকৃতি ময়ূরের মত।সর্বোপরি তামিল ভাষায় ময়ূরের আরেক নাম হল মইল।তাহলে কি এই’মইল’ থেকে ‘মেলেক’ শব্দটি এসেছে?এই বিষয়ে এখনই কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।আরেকটি দিক হল যে,ইয়েজিদিরা কুর্দ জাতিভুক্ত এবং কুর্দ শব্দের অর্থ হল রক্তাভ বা লাল।আসলে কুর্দদের মুখমণ্ডলের রঙ অনেকটাই রক্তাভ।সঙ্গম সাহিত্যে আবার বিস্ময়কর ভাবে লাল বর্ণের দেবতার কথা পাওয়া যায়।আবার প্রাচীন তামিল শব্দভাণ্ডারে ‘কুরুধি’নামক একটি শব্দ পাওয়া যায়,যার অর্থ লাল।একই ভাবে কুরুধি থেকে কুর্দ শব্দটি আসতে পারে।তাহলে কি তামিলরা ইয়েজিদিদের থেকে প্রাচীন?একথার স্বপক্ষে প্রত্যক্ষ কোন প্রমান নেই,তবে পরোক্ষভাবে বেশ কিছু সূত্র পাওয়া যায়।একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হত যে,দক্ষিন ভারতীয় সভ্যতা অপেক্ষাকৃত অনেক পরবর্তীকালীন।সব হিসেব নিকেশ গুলিয়ে দিল যখন তামিলনাড়ু থেকে হরপ্পার ন্যায় একটি সীল পাওয়া গেল।তাহলে কি সুদূর দক্ষিন ভারতেও সমসাময়িক কালে হরপ্পার ন্যায় কোন সভ্যতা ছিল?এই দাবির স্বপক্ষে এখনও কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান না পাওয়া গেলেও বহু প্রাচীন তামিল প্রত্নকথা থেকে জানা যায় যে অধুনা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিপুল অংশজুড়ে এক সুপ্রাচীন উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল,যা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।এই সভ্যতকে’কুমারী কন্দম’নামে অভিহিত করা হয়েছে।বেশকিছু ভাষাতাত্ত্বিক মনে করেন যে,কুমারী শব্দটি আদতে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির বিশুদ্ধতাকে দ্যোতিত করে,যা পরে ইন্দো-আর্য ও সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে কলুষিত হয়েছিল।হরপ্পায় সোনা ব্যবহারের প্রমান পাওয়া গেছে এবং সোনার সম্ভাব্য উৎসক্ষেত্র হিসেবে দক্ষিনের রাজ্য কর্ণাটকের কোলার স্বর্ণখনিকে অভিহিত করা হয়েছে।এখন যদি সত্যি কোলার স্বর্ণখনি থেকেই হরপ্পায় সোনা যেত,তাহলে নিশ্চিত সেই সময় দক্ষিন ভারতেও কোন এক সভ্যতা ছিল,যা বহিরাঞ্চলের সাথে বানিজ্যে অভ্যস্ত ছিল।না হলে এমন তো কখনই সম্ভব নয় যে,দক্ষিন ভারতে তখন গহন বনাঞ্চল বিরাজমান অথবা দক্ষিন ভারতের মানুষগুলো উলঙ্গ হয়ে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় আর হরপ্পার লোকেরা এসে সোনা তুলে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়।
ইয়েজিদিদের উৎস কোথায় নিহিত আছে- প্রাচীন ভারতে না পশ্চিম এশিয়ায়?এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কখনই খুব একটা সহজ নয়।বৈদিক সাহিত্যে ময়ূর হল ইন্দ্রের সবচেয়ে প্রিয়তম পক্ষী।আর এই ইন্দ্র আবার জেন্দ আবেস্তায় নিন্দিত হয়েছেন।পাশাপাশি আবেস্তাতে ময়ূরকে অশুভ শক্তি অাহ্রিমনের থেকে সৃষ্টি বলে দাবী করা হয়েছে।এখানে বেশ এক সমজাতীয়তা লক্ষ্য করা যায়।বৈদিক সাহিত্য ও ইয়েজিদি শ্রুতিকথা দুটি ক্ষেত্রেই ময়ূর ইতিবাচক আর আবেস্তা যেমন একদিকে বেদ বিরোধী তেমনই অন্যদিকে সেখানে ময়ূরের নিন্দা করেছে তাঁর আলস্য ও সৃষ্টিবিমুখতার কারনে।তাহলে কি এই ইয়েজিদিরা আদতে আর্যদের পূর্বপুরুষ?বিশেষত ঋগ্বেদের যে বিষয়বস্তু তাতে সর্বপ্রানবাদ বা অ্যানিমিজমের যেমন ধারনা পাওয়া যায় তেমনই মনুষ্যদেহ সম্বলিত ঈশ্বর বা অ্যানথ্রোপোমরফিজমের ধারনাও পাওয়া যায়।তবে বিস্ময়কর ভাবে ‘টোটেম’ ধারনার প্রতিফলন তেমন ভাবে এই বেদে নেই।টোটেম হল কোন প্রাণী বা কোন পক্ষী অথবা কোন ফল যাকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করে ঈশ্বর রূপে তাঁর আরাধনা করা।ইয়েজিদি তাওসি মেলেক যে আদতে এক টোটেম তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই,কারণ ইয়েজিদিরা ময়ূররূপী টোটেমকে পবিত্র রূপে গণ্য করে তার উপাসনা করে।তাহলে কি এমন এক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল যেখানে ইয়েজিদিদের ধর্মীয় আদর্শ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে জেন্দ আবেস্তা পরোক্ষভাবে তাঁদের সৃষ্টিতত্ত্ব নস্যাৎ করে দিল এবং বেদে ময়ূরকে যুক্ত করে দেওয়া হল ইন্দ্রের সাথে,যিনি আবার আবেস্তাতে অত্যন্ত সমালোচিত চরিত্র।সর্বোপরি বেদও ইয়েজিদিদের সন্তর্পণে এড়িয়ে গেল কিন্তু ময়ূরকে যুক্ত করে দিল ইন্দ্রের সাথে অর্থাৎ সেই আত্তীকরণের নমুনা যা পাওয়া যায় কার্তিকের ক্ষেত্রে এবং বহু পরবর্তীকলে পৌরাণিক সাহিত্যে গৌতম বুদ্ধের ক্ষেত্রে।আসলে বেদ যে ময়ূরকে নিয়ে খুব একটা খুশি ছিল না তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।প্রাথমিক পর্বে ময়ূরকে কেন্দ্র করে বেদে কোন নেতিবাচক মানসিকতার প্রতিফলন পাওয়া না গেলেও প্রায় হাজার বছরের ব্যবধানে রচিত রামায়নে ময়ূরের প্রতি নিন্দাসূচক বক্তব্য পাওয়া যায়।রামায়নের কাহিনী অনুসারে ইন্দ্রের সাথে সাক্ষাতের পূর্বে ময়ূরকে দেখতে অত্যন্ত কুৎসিত ছিল এবং তার গলার স্বর ছিল অত্যন্ত কর্কশ।তাই ময়ূরের কোন গ্রহনযোগ্যতা ছিল না।একদা রাবন স্বর্গলোক আক্রমন করলে ইন্দ্র পলায়ন করেন এবং এইসময় তিনি ময়ূরের পেখমের পশ্চাতে লুকিয়ে রাবনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন।এরপর ময়ূর ইন্দ্রের নিকট বর প্রার্থনা করলে,ইন্দ্র ময়ূরকে এক অনিন্দ্য সুন্দর পক্ষীতে রূপান্তরিত করেন ও তাকে স্বর্গালোকে নিয়ে যান।অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে,বিরোধিতার সুরটা আগে থেকেই লুকিয়ে ছিল যা পরে বৈদিক সভ্যতার পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতিতে প্রকাশিত হয়।একটা বিষয় স্পষ্ট যে,বেদ ময়ূরের বিরোধিতায় বেশ ভয় পেয়েছিল।কারন পার্সি ধর্মের প্রবক্তা জরাথুস্ত্র শেষ পর্যন্ত ময়ূরের জন্মদাতা অাহ্রিমনের অনুগামীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন।সুতরাং ময়ূর পূজারীদের বাহুবলী কার্যকলাপের আরও প্রাচীন নিদর্শন নিশ্চয়ই ছিল,যেগুলি সম্পর্কে বেদের রচয়িতারা জ্ঞাত ছিলেন।পরিশেষে এটুকুই বলব যে,ইয়েজিদিদের প্রাচীনত্ব নিয়ে কোন সন্দেহই নেই কিন্তু তাঁদের উৎস কোন অঞ্চলে হয়েছিল তা নির্ণয় এখনই সম্ভব নয় ,যতদিন না ইয়েজিদিদের বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে সরাসরি কোন সূত্র পাওয়া যাচ্ছে।
সায়ন দেবনাথ, এম ফিল, প্রথম বর্ষ
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
@সায়ন, ভাল লেখা। কুমারি কান্ডম সমুদ্রে তলিয়ে যাবার সময় হয়ত অনেকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায়- যার একটা অংশ তামিল আর একটা অংশ ইয়াজিদি হতে পারে। মালেক তাউস কিন্তু সপ্তম এঞ্জেল বা দেবতা। এই সাত এঞ্জেল বিষয়টা আবার তামিলদের সপ্ত কন্যা বা দেবী টাইপের একটা ব্যাপারের সাথে মিল আছে। তামিলরা সপ্তপ্রদীপ জ্বালায় এদের উদ্দেশ্যে। আমার কাছে বিষয়টা ঝাপসা একটা ধারনা । এই দিকে একটু নজর দিতে পারেন।
ইয়াজিদি শব্দের মূল কিন্তু গ্রীক। যার অর্থ লাল সূর্য। মূল ইয়াজিদিদের চামড়া লাল শুধু মুখ নয়। কিন্তু এখন বহু মিশ্রণে এই বিশুদ্ধতা নেই।
বহুবছর আগে পড়া দীপঙ্কর লাহিড়ীর ‘বিলুপ্ত জনপদ প্রচলিত কাহিনি’ বইটার কয়েকটা বিষয় এখানে প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। যদ্দুর মনে হয় তিনি কয়েকটা বিষয়ে আলাপ করেছিলেন।
( ১) তামিলরা প্লেটোর হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিসের মানুষ বা আটলান্টিসবাসী। আটলান্টিসবাসীদের সাথে তামিলদের সংযোগ আছে।
(২) ইহুদিদের দশ গোষ্ঠীর গল্পে একটা গোষ্ঠীর হারিয়ে যাবার কাহিনি আছে। সেই হারিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীটা হতে পারে মিজোরামের লুসাই জাতি। কারণ লুসাই মানে যেমন দশের এক তেমনি; লুসাইদের উপকথা অনুযায়ীও তারা হচ্ছে দশটা গোষ্ঠীর একটা; যারা বাকি নয়টা গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের উপকথার বর্ণনার সাথে ইহুদিদের দশ গোষ্ঠীর উপকথার বর্ণনারো মিল আছে।
বইটা আমার আশেপাশে নেই। সম্ভব হলে বইটা দেখে নিতে পারেন।
@লিলেন, সেই মিডেল ইস্ট থেকে এতগুলো অঞ্চল পার হয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা পূর্ব ভারতেই তারা স্থায়ী হল!! হয়ত এটা সম্ভব হয়েছে সিল্ক রোডের কারনে।
কেমনে গেলো আর কেমনে আসলো সেই হিসাব তো আলাদা। ভারত থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া আর অস্ট্রেলিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত যাতাতেরও তো উদারহণ আছে। সেই ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে তো সড়ক যোগযোগই আছে। এটা বরং সহজই হবার কথা