(অনেকদিন ধরেই এ বিষয়ে কিছু লিখব ভেবেও সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। কারন আমার জ্ঞান আসলে যথেষ্ট না। তবুও ফেসবুকের একটা গ্রুপে আমাদেরই সহ ব্লগার পৃথ্বীর একটা পোস্টে কমেন্ট করতে গিয়ে দেখলাম যে আর কেউই কিছু লিখছে না। তাই মনে হল নিজের মত করেই লিখি। শুরু করলাম! দেখা যাক কোথায় গিয়ে শেষ হয়!)
“জাতীয় সংসদ ভবন। স্থপতি: লুই আই কান। আমাদের দেশের স্থাপত্যের কথা বলতে যে ভবনের কথা সবার আগে সব ধরনের মানুষের মাথায় আসে।”
স্থাপত্য কি, স্থাপত্য কেন, স্থপতিদের কাজ কি এসব নিয়ে বিশদ কথাবার্তায় যাবার আগে সাধারন মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয় চিন্তা করা যাক। আমজনতা থেকে শুরু করে মোটামুটি উচ্চশিক্ষিত জণগনের বেশ বড় একটা অংশের ধারনা হচ্ছে স্থপতিদের কাজ ‘সুন্দর’ ভবন নকশা করা। এখন ‘সুন্দর’ বলতে আসলে কি বোঝায় সেটা নিয়েও নানাবিধ তর্ক হতে পারে! কিন্তু সর্বসাধারণের কাছে সুন্দর বলতে আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে দেখতে দৃষ্টিনন্দন কিছু বোঝায়। সেই দৃষ্টিনান্দনিকতাও আবার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী,অঞ্চল,পেশার মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে। তাই সেসব নিয়ে আরো বিস্তারিত কথা হবার আগে জানা যাক যে ডিজাইনার হিসাবে একজন স্থপতিকে কি কি বিষয়ে কাজ করতে হয়।
এ পৃথিবীতে হাজারো পেশার মানুষ বিদ্যমান। প্রতিটা পেশারই ভিন্ন ভিন্ন পেশাগত স্থান আর পরিবেশের চাহিদা আছে। তার সাথে পেশার বাইরের জীবন-যাপনেরও প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরে একটা কাঠামো বা এক একটা ভবনের এর। সেক্ষেত্রে স্থপতিদের কি পরিমান ভিন্ন ভিন্ন রকমের মানুষ, পেশা এবং চাহিদা পূরণের জন্য কাজ করতে হয় সেটার তালিকা করতেই হয়ত একটা বই লিখে ফেলা সম্ভব! অত ঝামেলায় না গিয়ে আসুন আমরা একটা ছোটখাট শ্রেণীবিন্যাস করে সবধরনের কাঠামোগুলোকে ঐ কয়েকটা শ্রেণীতে ফেলি।
১ – আবাসিক/residential (সংখ্যার দিক থেকে এই ক্যাটাগরির বিল্ডিং দুনিয়াজোড়া সবচে বেশি। তবে পার্থক্যগত বিভাজনে এর অবস্থান নিচের দিকে)
২ – বানিজ্যিক/commercial
৩ – বিনোদনমূলক/recreational
৪ – স্বাস্থ্যসংক্রান্ত/health
৫ – অবসর যাপন সংক্রান্ত/leisure
৬ – স্মৃতিস্মারক বা প্রতীকি/ monumental
৭ – পেশাগত/office building
৮ – খেলাধুলা সংক্রান্ত
৯ – মিউজিয়াম/আর্টগ্যালারী ইত্যাদি
১০ – জেলখানা।
এসব ক্যাটাগরীর বাইরেও ক্যাটাগরী আসতে পারে অথবা এ থেকে এক দুটো অন্য ক্যাটাগরীর মধ্যে চলেও যেতে পারে। এগুলো সরাসরি স্থপতিদের আওতার মধ্যে পরে। এর বাইরেও যেসব ব্যপার প্রায়ই স্থপতিদের ডিজাইনের আওতায় চলে আসে তা হচ্ছে।
# – ইন্টেরিয়র ডিজাইন। ( যদিও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার বলে আলাদা একটা ব্যাপার আছে কিন্তু সেখানেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থপতিরাই ইন্টেরিয়র বা বিল্ডিঙ্গের ভিতরের সব কিছু ডিজাইন করে দেন।)
# – ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন। (বাইরের দেশে ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনার আলাদা থাকে। আবার থাকেও না। থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ল্যান্ডস্কেপের বেসিক আউটলাইনটা স্থপতিরাই ঠিক করে দেয়)
# – আরবান ডিজাইন। (এটা বেশ বড়সড় একটা ক্ষেত্র। শহর, নগর থেকে শুরু করে রাস্তা, রাস্তার মোড়, ফুটপাথসহ আরো ছোটবড় নানা ইস্যু চলে আসে। এটাতেও আরবান ডিজাইনার বলে একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু এখানেও অল্পবিস্তর স্থপতিদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।)
এ তো গেল শুধু ডিজাইনের বাইরের শ্রেণীবিভাগ। ডিজাইনের ভেতরের শ্রেণীবিভাগ সে আরেক লিস্ট! যেহেতু মানুষ প্রতিদিনকার কাজে সরাসরি এসব বিল্ডিং বা কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত তাই বলা যায় বিল্ডিঙের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষের ব্যবহার্য দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান সব কিছুই স্থপতির ডিজাইনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন একটা সাধারন আবাসিক এ্যপার্টমেন্টের একটা ফ্ল্যাটের কথা যদি ধরি তাইলে যেসব ব্যাপার প্রথম দফায় মাথায় আসে তা হচ্ছে ফ্ল্যাটের রুম এ্যারেঞ্জমেন্ট। এটা স্থপতির প্রধান কাজ, তাই এটা বিশদভাবে বলবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু রুম এরেঞ্জমেন্টই শেষ না, ওটা কেবল শুরু। প্রতিটা রুমের ফার্নিচার এরেঞ্জমেন্ট কি হবে, বাথরুমের ফিক্সচার গুলো কোথায় বসবে, রান্নাঘরের ফিক্সচারের কি হবে, ঘরে কিভাবে বাতাস আসা যাওয়া করবে, ঘরে সূর্যের আলো ঢোকার কি বন্দোবস্ত হবে, ঘরের ইলেক্ট্রিকাল লাইন গুলো কোথা দিয়ে যাবে, পানির লাইনের কি হবে, স্যুয়ারেজ লাইনের ডাক্ট কোথা দিয়ে যাবে এসব সহ প্রতিটা জানালা দরজার ডিটেল পর্যন্ত স্থপতির করতে হয়। তাও আসলে শেষ হয় না। কোন রুমের রঙ কি হবে, বাইরের রঙ কি হবে, কোথায় সিমেন্টের প্লাস্টার হবে, কোথায় ইট দেখা যাবে, কোথায় টাইলস হবে, কোথায় মার্বেল হবে এসব থেকে শুরু করে আরো খুচরো কাজও স্থপতিদের করতে হয়। এবং সবগুলোই করতে হয় একজন সাধারন মানুষকে (ব্যবহারকারী) মাথায় রেখে। এর বাইরেও কোন কোন ক্ষেত্রে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি ও প্রায়শই আর্কিটেক্টরা ডিজাইন করে থাকেন।
আচ্ছা, এবার আসা যাক একজন স্থপতিকে ভবন নির্মানে কত ধরনের পেশার কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হয় এবং কত ধরনের পেশার পেশাজীবীদের সাথে কাজ করতে হয়।
১ – ভূতত্ত্ববিদ (মাটির গুণাগুন ও দৃঢ়তা পরীক্ষার জন্য।)
২ – স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
৩ – ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
৪ – মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার।
৫ – প্লাম্বিং ইঞ্জিনিয়ার।
৬ – কনট্রাকটর।
৭ – রাজমিস্ত্রী
৮ – কাঠমিস্ত্রী
৯ – রংমিস্ত্রী
এর বাইরেও আরো অনেকে। এবং সবগুলো কাজের মূল সিদ্ধান্তটা স্থপতির কাছ থেকেই আসে। মূল সিদ্ধান্তের পরবর্তী ধাপে সেটাকে বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব পরে বাকি শ্রেণীর পেশাজীবীদের উপর। এবং সেখানেও স্থপতির সার্বক্ষনিক তত্বাবধায়নের প্রয়োজন হয়।
এবার ভবনের নকশা করার ব্যপারে বলা যাক। ভবনের নকশা করার ক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে জমির অবস্থান। যেই জমিতে স্থপতিকে নকশা করতে দেয়া হয়েছে সেটার প্রাকৃতিক পরিবেশ,সামাজিক পরিবেশ,সামাজিক অবস্থান, ঐ স্থানের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ব্যবহারকারীদের সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিষয় সামনে চলে আসে। যেমন ধরা যাক বাংলাদেশের ঢাকা শহরের উত্তরার আবাসিক এলাকায় একটা এ্যপার্টমেন্ট ডিজাইন করতে হবে। প্রকৃতিগত দিক থেকে বাংলাদেশ উষ্ণ-আর্দ্রতা সম্পন্ন (hot humid) দেশ। তাই এখানকার বাসাবাড়ি নকশা করার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে বাধাহীন প্রাকৃতিক বাতাস প্রবাহের ব্যাবস্থা থাকতে হবে নাহলে বাসিন্দাদের চরম অস্বস্তিতে দিনযাপন করতে হবে। আবার আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় দেখে বেশি খোলামেলা করতে গিয়ে বৃষ্টি যেন সমস্যার সৃষ্টি না করে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। সামাজিক পরিবেশের দিক থেকে জায়গাটা রাজধানী শহরের অন্তর্ভূক্ত যেখানে কিনা প্রতি ইঞ্চি জমির দামও হাজার টাকা। ঐ আবাসিক এলাকার এ্যাপার্টমেন্টের ব্যবহারকারীরা সাধারণত মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত। তাই ফ্ল্যাটের আকৃতি, রুমের সাইজ এবং রুমের সংখ্যা নির্ধারিত হবে একটা সাধারন মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের চাহিদা এবং সামর্থ হিসাব করে। আর ফ্ল্যাটের রুমের বিন্যাস হবে আমাদের সাংস্কৃতিগত অভ্যস্ততার উপর নির্ভর করে। যেমন ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতার কারনে আগেরকার দিনে আমাদের ঘরবাড়ির বহির্মহল আর অন্দরমহল পুরোপুরিই আলাদা থাকত যাতে করে বহিরাগত কোন মানুষ বা মেহমান অন্দরমহলে অবস্থিত মানুষ এবং বিশেষত ঘরের মহিলাদের যাতে দেখতে না পায়। অর্থাৎ যাতে অভ্যন্তরের প্রাইভেসি অটুট থাকে। শহুরে ছোট ফ্ল্যাটগুলোতেও স্থানস্বল্পতা সত্ত্বেও এই নীতি মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। ঘরে ঢুকতেই মেহমানদের বসার জায়গা বা ড্রয়িং/লিভিং রুম এমন ভাবে বিন্যস্ত করা হয় যেন ওই বসবার জায়গা থেকে ঘরের অন্দরমহল পৃথক থাকে। অন্তত সরাসরি পৃথক না থাকলেও অন্তত পর্দা দিয়ে আলাদা করে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। এরকম খুটিনাটি আরো অনেক সিদ্ধান্ত স্থপতিদের নিতে হয়।
এগুলো সবই গেল বৈষয়িক ব্যাপার স্যাপার। আপনি ভালো স্থপতিই হোন আর খারাপ, নবীন কি প্রবীন এসব সবগুলো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং তত্বাবধান করার ক্ষমতা আপনার থাকতে হবে। এবার আসুন আবার সেই অবৈষয়িক ব্যাপারে ফিরে যাওয়া যাক। নান্দনিকতা বা সৌন্দর্যের দিক থেকেও স্থাপত্যকর্ম কে বেশ কিছু শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলা যায়। সেগুলো হচ্ছে বাহ্যিক সৌন্দর্য, স্থাপত্যের আইডেনটিটি, ভেতরের সৌন্দর্য, ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ স্বস্তি নিশ্চিত করা ইত্যাদি। আবার ভেতরের স্থানসংক্রান্ত সৌন্দর্য শুধু দর্শনগত না। সেখানে অনুভবের ব্যাপারও থাকে। মানুষের সব ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করতে পারাও মাঝে মধ্যে স্থাপত্যের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন একটা সাধারন থাকার জায়গা আর একটা প্রার্থনার চার্চ বা মসজিদের স্থাপত্যের বিস্তর ফারাক। মসজিদ, মন্দির, গির্জার স্থাপত্য ইচ্ছাকৃত ভাবেই এমন ভাবে করা হয়ে থাকে যে যাতে প্রথম দফায় সামনে গিয়ে চোখের দেখাতেই শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়তে হয়। তারপর ভেতরের স্পেসকে এমনভাবে তৈরি করতে হয় যেন ভেতরে গিয়ে আরেকদফা নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে।
“দিল্লিতে অবস্থিত বাহাই ধর্মের অনুসারীদের লোটাস টেম্পল।”
তারপর আসে ভেতরের শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপার। প্রার্থণার স্থানের শব্দ নিয়ন্ত্রন এমন হতে হয় যেন সবচে পিছে বসে থাকা মানুষটাও সামনের ফাদার বা ইমামের প্রার্থনা শুনতে পায় এবং এমন ভাবে শব্দ নিয়ন্ত্রনের ব্যাপারে চিন্তা করতে হয় যেন এধরনের প্রার্থনাস্থলে মূল প্রার্থনাকারীর স্তুতিবাক্য ভরাট শব্দে গম গম করতে থাকে(যদিও এখন শব্দ যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কিন্তু তাতে এই ফলাফল পাওয়া যায় না)। তাতে করে মানুষের মন আরো অবনত হয়ে পরে। শব্দের পর আসে আলো। কোন স্থাপত্যে কিভাবে আলো ঢুকছে, কতখানি ঢুকছে সেগুলোও ব্যাবহারকারীদের নানা ভাবে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ মানুষের প্রায় সকল ইন্দ্রিয়ই কোননা কোন ভাবে স্থাপত্য দিয়ে প্রভাবিত হয়। আবার শুধু ভেতরের সৌন্দর্যই যে স্থাপত্যের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় তা না। আমি একটা স্থাপত্যের ভেতরে বসে আমার বাইরের পরিবেশকে কিভাবে উপলব্ধি করছি সেটাও প্রায়শই স্থাপত্যের বড় অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এসব অনেক কথা। কয়ে ফুরোবে না। কিন্তু ঝামেলাটা হচ্ছে ভেতরের সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে বা অনূভুতির সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে মানুষ শুধু ফলাফলটাকেই তারিফ করে, ফলাফলের কারনটাকে নয়। যেমন চার্চে বসে আমি চার্চের ভেতরের শব্দ বা বাইরে থেকে রঙিন কাচের ভেতর দিয়ে আসা বহুবর্নী আলোকেই এ্যপ্রিশিয়েট করছি কিন্তু সেই আলোর বা শব্দের কারন যে চার্চটাই সেটা খেয়াল করছি না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি প্রকৃতি অনুভব করছি। কিন্তু জানালার কারনে যে আমার অনুভবে পার্থক্য হচ্ছে সেটা আমার চিন্তায় আসছে না। এ্যাপ্রিসিয়েশনের বেলায় বেশিরভাগ মানুষ (সাধারন মানুষ এবং অনেক ক্ষেত্রে এসব সম্পর্কে জানাশোনা মানুষও) বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই এ্যাপ্রিশিয়েট করে অভ্যস্ত।
Leave A Comment