লেখকঃ জাহানারা নুরী
সেকুলার মূলধারা, নাগরিক বুদ্ধিজীবিতা এবং ইসলামী মৌলবাদ
এক.
প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবি নিয়ে। অনেক পরের আলোচনা আগে শুরুর করেছি বলে উপলব্ধি করছি কিন্তু বিষয়টি একটি পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে সম্ভবতঃ ক্ষতি নেই । ফলে চলতি পর্বেও আমরা বুদ্ধিজীবি পর্বটি র আলোচনা চালু রাখছি তবে এবার আমরা বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবি সেকুলার মূলধারা ও ইসলামী মৌলবাদ এর পরিচয়ের ওপর আলোকপাত করবো। তবে সর্বাগ্রে সেকুলারিজম শব্দ কি বোঝায় তার চলতি দুনিয়ার ব্যাখ্যা গুলো উত্থাপন করে নিতে চাই।
সেকুলার শব্দটির অর্থ বুঝতে গেলে নানা অভিধানের ও গুণীজনের মতামতের স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে। আমরা অভিধান দিয়েই শুরু করতে পারি;
Oxford Dictionary-মতে:
“The doctrine that morality should be based solely in regard to well-being of mankind in the present life to the exclusion of all consideration drawn from belief in God.”
Webster’s Dictionary বলছে :
“The belief that religion and ecclesiastical affairs should not enter into the functions of the state.”
গুণীজন বিতরিত জ্ঞানের পৃষ্ঠা উল্টালে আমরা দেখতে পাবো সেকুলারিজম কে তিন ভাবে তারা ব্যাখ্যার প্রয়াস পেয়েছেন।
প্রথম দল একে ব্যাখ্যা করে এথিজম দিয়ে। কার্ল মার্কস, ফরাসী সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুর্খেম এবং জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক শ্যাক্স ওয়েবার বিশ্বাস করতেন কাজে কর্মে তুলনামূলক আলাদা বৈশিষ্ট্য খোঁজার মাধ্যমে. বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান এবং ডিমিস্টিফিকিশনের দ্বারা ধরণী সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস বা এ জাতীয় ধর্মের অবিশ্বাসের ভেতর দিয়ে এথিজমের দিকেই যাচ্ছে।
দ্বিতীয় দলের মতে সেকুলারিজম অর্থ ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা। তবে রবার্ট বেল্লাহ, চার্লস টেলর, ইয়র্গেন এবারমাস এবং হোসে কাসানোভা বিশ্বাস করতেন পাবলিক ডোমেইনে ও ধর্ম আসতে পারে তবে তার উপস্থিতি থাকতে হবে যুক্তিশাসিত, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং মোল্লা-পুরোহিত বা ফাদার দ্বারা নয়।
তৃতীয় দলের চোখে ধর্ম থাকতে পারে তবে তা রাষ্ট্র থেকে পৃথক থাকবে এমনকি মন্দির, চার্চ বা মসজিদ ও সরকার থেকে দূরের বিষয় থাকতে হবে। এই বিশ্বাস বলাই বাহুল্য এথিজম বা ধর্মহীনতার বিপরীতে অবস্থিত এবং ধর্ম পাবলিক লাইফের ডিসকোর্স হতে পারে বলে মত প্রকাশ করছে।
দুই.
সেকুলারিজমই বাংলার মূলধারা এ এক ঐতিহাসিক সত্য হওয়া স্বত্ত্বেও কোনটি মূলধারা মৌলবাদী ইসলাম না সেকুলার বাংলার বাঙ্গালীর আবহমান স্বজাত্য বোধ যা সে প্রকাশ করে তার নিত্য দিনের আচার, কৃষ্টিতে- সে বিষয়ে অহেতুক যুক্তিহীন বিতর্ক জিইয়ে রাখছে একটি গোষ্ঠী। ধীরে ধরে গোপনে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে যারা মৌলবাদী নয় তারাও এতে অংশগ্রহণ করছে ও নিজেদের সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক ও জনবৈশিষ্ট্য বিষয়ক ইতিহাস জানা স্বত্ত্বেও ক্রমান্বয়ে মৌলবাদী রেখার দিকে সরে যাচ্ছে বা এর ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেস্থান থেকে এক কদম দিলেই পুরো মৌলবাদীরূপে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
সন্দেহাতীতভাবে ‘মুস্লিম’ শব্দ দিয়ে যা বোঝান হয় তার চেয়ে অনেক বেশী বিস্তারিত, ব্যাপক ভাব প্রকাশ করে ‘বাঙ্গালী’ শব্দটি। সঙ্খ্যাতত্ত্বের দিক দিয়ে এটি বৈচিত্র্যময় একটি টার্ম। এর ভাব,বোধ, বর্ণ বিচিত্র। এই ভ্যারিয়েবিলিটি নিয়ে ‘বাঙ্গালী’ টার্ম হিসেবে যথেষ্ট ব্যাখ্যাত হয়েছে নানাভাবে, নানা জনের নানা দৃষ্টিতে । এই একটিমাত্র শব্দ থেকে যে সত্য উঠে আসে তা হল এই শব্দটি যে জনপদকে বোঝায় তা হোমোজিনিয়াস নয়। তা অনেককে নিয়ে। এককভাবে এ জাতিকে উপলব্ধি করা যায় না। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস ও তেমনই বহুত্বে বর্ণিল । ‘মুসলিম’ একক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী গোষ্ঠীকে বোঝায়। কিন্ত্ত বহু বিশ্বাসে বিশ্বাসী নানা গোষ্ঠী মিলেই জাতি। বাংলার সাধারণ মানুষের নিত্য জনজীবনের দিকে তাকালে আমাদের শৈশবে এটি বুঝতে কখনও আমাদের কষ্ট হয় নি। কাদের এটা বুঝতে কষ্ট ? অথরিটি নিয়ে যাদের সমস্যা আছে। কার শাসন থাকবে সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের না কি জাতি পরিচয়ের ? এমন না জাতির পরিচয়ের ভেতর যারা বাস করে তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস জাতির ভেতরে থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বরং জাতির ভেতর নিজ নিজ ইতিহাস পরিচয় নিয়ে ই মানুষ বেঁচেছে। বাঁচতে বাঁচতে সাধারণ মানুষ- যাদের এককালে ‘গণ’ বা গণতন্ত্রের জনতা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো তারা-বিবর্তনের পথ পরিক্রমায় হাজার হাজার বছর পার করে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই যে মাটি তাকে লালন করছে সে মাটির সহস্র বছরের রীতিনীতির ভেতর দিয়ে মানুষের বিশ্বাস টিকে থেকেছে। বর্ণাশ্রম পীড়িত লোক দেবতার উপাসক, হিন্দু, হীনযান বৌদ্ধ থেকে ইসলাম দীক্ষা নেয়া আজকের বাঙ্গালী মুসলিমের ভেতরে যে নানা সংস্কৃতির স্রোতের মহতী সম্মিলন ঘটেছে, তার ফলেই তার সংস্কৃতি পরিচয়, তার আচার কৃষ্টির ভেতর বিচিত্রের মহা মিলন। সেকুলারিজম বস্ত্তত বাঙ্গালীকে কেউ শেখায় নি। এটি তার অভ্যন্তরে নিয়ে সে জন্মেছে। সুতরাং সেকুলারিজমই মেইনস্ট্রিম এটা ব্যাখ্যা না করলেও চলে। তারপরও সেকুলার বাংলাদেশকে এক ধরণের চক্রান্তের মধ্যে ফেলার অপচেষ্টা চলেছে এবং চলছে। এবং এই চক্রান্ত দু’ভাবে চলছে এক একে সরাসরি আঘাত করে, দুই . একে ভুলে গিয়ে এর ওপর চলমান আঘাতে নিরব থেকে সমর্থন জুগিয়ে বা চলতি রাজণীতিকে সমর্থন জুগিয়ে।
তিন.
বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদের মধ্যে যা কিছু অগ্রসরমানতার উপাদান রয়েছে তার পশ্চাদপসরণের দু’টি কারণের একটি হচ্ছে বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিদের প্রগতিশীল অংশের দুর্বৃত্তপণা (চেতনা ও রাজনৈতিক উভয় অর্থে ) দ্বিতীয়টি শিক্ষার অধোগতি।
প্রগতিশীল অংশ বলতে এখানে আমি বোঝাতে চাই মৌলিক কমিউনিস্ট এবং তা থেকে উদ্ভুত অন্যান্য ঐতিহ্য যেমন সোশ্যালিস্ট ডেমোক্রেসিতে যারা বিশ্বাসী যারা এবং বিপরীতে যারা ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক এক ধরণের সোশ্যালিজমের কথা বলেন তাদের অবশ্যই এদের অন্তর্ভূক্ত করি না।
নিজেকে বামপন্থী হিসেবে প্রকাশ করতে ইচ্ছুক বুদ্ধিজীবি বাম ধারার কথা বার্তা বলেন লিখেন. কিন্তু তাদের সমাজের চলমান ইসলামী চরমপন্থীদের ধর্মভিত্তিক রক্তাক্ত চলতি জিহাদের পরিপ্রেক্ষিতে কোনও বক্তব্য নেই। ধ্রুপদী মার্কসবাদ নিয়ে তাদের যে বক্তব্য তার পরিপ্রেক্ষিতে মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে তাদের যে অবস্থান তা কি মানবতন্ত্র বিরোধিতারই নামান্তর।
রুশ বিপ্লবী প্লেখানভ বলেছিলেন,-‘সমস্ত ভাবধারাই উৎপন্ন হয় সমকালীন মনস্তত্ত্বের এক অভিন্ন উৎস থেকে।’ সুতরাং রিলিজিয়ন বা যে কোনও ভাবধারার উৎস মানুষের মন ও মনন। এ সব বুদ্ধিজীবি শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ও তার নিয়ম নীতির সুবিধাভোগী ফলে এর বিপরীতে তাকে দাঁড়াতে আমরা দেখবো না। ধর্মগ্রন্থ ও এর আদর্শ মনুষ্যত্ববিরোধী। এক কাল্পনিক আল্লাহর ততোধিক কাল্পনিক মীথ সমূহের একদিকে রয়েছে সর্বশক্তিমান এক সৃষ্টিকর্তার ভাবমূর্তি, অপরদিকে তাকে চ্যালেঞ্জ করা এক চরিত্র-শয়তান। এই দুইয়েরই ভয় মানুষের প্রতি মুহুর্তের ক্রীড়নক। তাকে সহনীয় করতে মানুষের মনস্ত্ত্বকে আমলে নিয়ে সাথে যুক্ত করা হয়েছে বেহেশতের প্রলোভন।
হাল আমলের ইসলামী জঙ্গীদের গোটা বিশ্বে জিহাদকে ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে যে চেতনা কাজ করছে তা একটি মীথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এক বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে পরিচালিত। মীথটির ভিত্তি হচ্ছে কুরআনকে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় রক্তপাত, হত্যা, ও বিনাশের এক লিখিত ম্যনিফেস্টোরূপে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এবং একটি গল্প। গল্পটি বলছে যে – দাজ্জাল নামক এক চরিত্রের আগমনের আগে একটি শিশু জন্মাবে যাকে দাজ্জাল হত্যা করবে।এবং প্রচার করা হচ্ছে ও এই শিশুটি জন্মেছে ২০০৮ এ এবং তাকে ইসলামের শায়খরা দেখে শুনে রাখছে। তাদের অনুমান ২০২৯ এর দিকে তার বয়স যখন ২০-২১ হবে তখনই নিশ্চয় তাকে হত্যা করা হবে। যেহেতু সে জন্মেছে তাহলে দাজ্জালও জন্মেছে এবং ইসলাম কথিত মতে ইমাম মাহাদী যে দাজ্জালকে পরাভূত ও নিহত করবে সেও তাহলে জন্মেছে ও বড় হচ্ছে। সুতরাং দাজ্জাল হত্যার পর ইমাম মেহেদীর নেতৃত্বে যে সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম হবে তা তো কুরানেই আছে।সে হিসেব মতে জিহাদীদের পৃথিবী জয় সন্নিকট। এ যুক্তি দেখিয়ে তারা রিক্রট করছে তরুণ ও মধ্য বয়ষ্ক মুসলমানদের।
বাংলাদেশে কোনও অগ্রজ বুদ্ধিজীবিকে এখন প্রকাশ্যে এসব গাল গল্প বিষয়ে নিজ মত প্রদর্শন করতে দেখা যায় না। এমনকি তারা দেশের জন্য ক্ষতিকর কোনও কর্মসূচী, পদক্ষেপ নিয়েও মত প্রদান করেন না। তারা তাদের বুদ্ধিকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সরকার তোয়াজে ও তোষণে নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ও একনায়কতান্ত্রিক কিম্বা অস্ত্রনির্ভর ক্ষমতার মানবিক মুখাবয়ব আশা করেন তারা অব্যাহতভাবে। তা কি সম্ভব? আমাদের মনে রাখতে হবে ইসলাম ধর্মরূপে আবির্ভূত হয় সপ্তম শতকে। ঐ শতকের আরবে কেন গোটা বিশ্বেই রাষ্ট্র ও সমাজ বলতে কোনও প্রতিষ্ঠান ছিল না, ছিল গোষ্ঠী বা ট্রাইব এবং পরিবার। মুহাম্মদের কথিত ধর্মেও সমাজ নেই রাষ্ট্র নেই আছে উম্মাহ। আছে ট্রাইবের ভেতরে পরস্পরকে সাহায্য করার ও ট্রাইবকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রবণতা। কিম্বা পরিবারভিত্তিক সহায়তার ধরণ। খেয়াল করুন বিবি খাদিজা যখন তার জনৈক দাসের কাছে তার সিরিয়ায় যেতে তৈরী বাণিজ্যদলে একজন সৎ মানুষ নিয়োগের প্রত্যাশা রাখেন, তখন দাস তারই পরিবারের তরুণ মুহাম্মদের দরিদ্র চাচার কাছ থেকে মুহাম্মদকে চেয়ে নিয়ে আসে। কারণ কুরাইশ গোত্রে মুহাম্মদের সততার ও সত্যবাদিতার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। বিবাহের পর খাদিজা তার বানিজ্য, ক্রমে উন্নতি করা ব্যবসা ও সব সম্পত্তি মুহাম্মদকে অর্পন করে যার ওপর দাঁড়ায় নতুন ধর্মে আগত প্রথম যুগের মুসলমানদের অর্থনৈতিক শক্তি। দেখা যাচ্ছে এখন আমরা রাষ্ট্র বলতে যা বুঝছি তখন তেমন ধরণের রাষ্ট্র বলতে কিছু ছিল না। সামাজিক শ্রমের বিভাজন, কাজ, কেন্দ্রীয় এক প্রশাসনের অধীনে সে কাজের আমলাতান্ত্রিকীকরণ এবং ক্ষমতা সংহতকরণ ও সব মানুষকে তার অধীন করে রাষ্ট্ররূপে যে ভৌগোলিক জনপদ দাঁড়ায়, তেমন কিছু আরবে তখনও প্রতিষ্ঠা পায় নি। ফলে মুসলমানদের জীবন পরিচালনায় যে নীতি মুহাম্মদ প্রদান করেন তাই ছিল সময়ের তুলনায় অগ্রসর ভাবনা। কুরআনে রাষ্ট্র ইত্যাদি যে সব ধারনার কথা বলা হয় তা ব্যাখ্যাকারদের ধারণা এবং তারা অনেকেই মুহাম্মদের জন্মের পরে এসেছেন। জিহাদীরা বিশেষ করে যে ইবনে তাইমিয়্যাহর যে ফিলোসফি অনুসরণ করে কুরান কে যুদ্ধের ও রক্তের মেনিফেস্টো বানিয়ে ফেলেছে তার কথিত সব হাদীসই কিন্তু স্মৃতিজাত। তিনি কোনও গ্রন্থ উদ্ধৃত করে নি। একইভাবে মুহাম্মদ কি বলেছেন সে হাদীসগুলো ও প্রথম সাহাবার স্মৃতি থেকে রচিত।
অগ্রজ বুদ্ধিজীবিদের একাংশ প্রত্যাশা করেন যে চরমপন্থীরা নিপীড়িতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে খুন খারাপী ও চরমপন্থা শুরু করেছে,তারা নিশ্চয় বিশ্বাস করেন না যে তাদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর স্বযংক্রিয়ভাবে চরমপন্থীরা সমানাধিকার ও সমতার পক্ষে কাজ করবে। কারণ তার রাষ্ট্র পরিচালনার মূল আইন যে গ্রন্থকে ভিীত্ত করে তাতো সমানাধিকার ও সমতা স্বীকৃত নয়। তাদের স্বপ্ন সম্ভব করতে হলে ধর্মকে ও ক্ষমতাকে অনেক মানবিক হতে হবে, এতখানি বদলাতে হবে যেন তার মৃত্যু হয় এবং তারপর বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিবাদী মানবিক বোধ হিশেবে তার পুনর্জন্ম ঘটে।
@ জাহানারা নুরী-
রাজনৈতিক দল, বিশেষ ভাবে ক্ষমতাসীন দল যদি সেকুলারিজমে বিশ্বাস না করে তাহলে কোন দু:খে তারা সংবিধানের সেকুলার বাণীকে আত্মীকৃত করে সমাজকে প্রাগ্রসর করবে-কথাটি বুঝলাম না।
আমার ধারণা সে কৌশল নির্ধারণ করাটাই এখন আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি কাজ। সে পথে যেতে হলে শুরুতেই মনে রাখতে হবে আমাদের সমাজ কিন্তু হাজার হাজার বছর বহিরাগত ধর্মের পীড়ন সহ্য করেছে । কিন্তু হার মানে নি। এটি অত্যন্ত প্রাণবন্ত একটি সমাজের উদাহরণ। আগত ধর্মগুলোকেও বাঙ্গালী সমাজ কিন্তু নিজের সংস্কৃতির ভেতর আত্মীকরণই করে নিয়েছে। এই লড়াকু সমাজটিকে এখন দরকার সেকুলার ইলেমেন্টগুলোকে আরো ছড়িয়ে দিতে একটু সাহায্য করা।
একটি উপায় হতে পারে আমাদের সংস্কৃতির সেকুলার ক্ষেত্রগুলোকে আরো বেশি মানুষের মাঝে পৌঁছে দেয়া যায় কিভাবে সে পথটি খুঁজে বের করতে হবে। সংস্কৃতি কিন্তু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বরং রাষ্ট্র বেশির ভাগ মানুষ যে সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ করে সে সংস্কৃতির পেছনে রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদ পুঁজি খাটানো শুরু করে। খেয়াল করুন একই সাথে হিজাব ও পহেলা বৈশাখ নিয়ে ব্যবসার উদাহরণগুলো।
সেকুলার পথে যাওয়ার আরেকটি অন্যতম শক্তি কিন্তু সচেতন ধর্মকে যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারে এমন নারীরা। সাধারণ সামাজিক কাজে যুক্ত নারীরাও যাতে ব্যাপক হারে পথে, কর্মস্থানে, ব্যাবসা বাণিজ্যে, থাকে, সামাজিক জীবনে ও কর্মক্ষেত্রে সাহসের সাথে এগিয়ে আসে সে পথটা উন্মুক্ত করতে হবে। সে পথ উন্মুক্ত রাখার একটি উপায় পথটিকে নারীর জন্য নিরাপদ করা। আর নিরাপদ করার কাজটিতে পুরুষদের সমিমলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
তৃতীয়তঃ যদি ধর্ম নয় মানবিকতাকে শিশুদের মধ্যে প্রচার করা যায় ও প্রচার করে এমন বিদ্যালয়কে আমাদের সমর্থন দিয়ে আরো সাহস যোগানো যায় তাতেও একটা দুয়ার খুলে যায়। এই যে ছোট ছোট পদক্ষেপ, এগুলো নেয়ার মানুষ যে একেবারে নেই তা নয়। তারা একা, তারা সাহস করতে পারছে না। প্রতিটি সাংস্কৃতিক দলের, সচেতন মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনে এই গোল (goal) কিভাবে অঙ্গীকৃত করা যায় তার উপায় বের করতে হবে। এসব একটু এনজিও টাইপ কথাবার্তা মনে হতে পারে। কিন্তু ভেবে দেখা যায়।
সংবিধানে সেকুলার যে বাণী আছে সেটুকুই আদায় করার জন্য সমাজের দাবীর চাপ সরকারের ওপর থাকা জরুরী। কারণ সংবিধানই মূল ডকুমেন্ট যা রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকার এর দিক নির্দেশনা দিয়েছে। সে নির্দেশনা নাগরিকের অধিকার আদায়ের দিক দিশাও নির্দেশ করে বৈ কি। আপনি আমি না চাইলে আমাদের অধিকার রাস্ট্র অটোমেটিক দেবে এটা ভাবাও যুক্তিসঙ্গত নয়। বিশেষ করে যদি রাষ্ট্র নিপীড়নমূলক নিয়ম দ্বারা চালিত রাষ্ট্র হয়। আপনাকে ধন্যবাদ।
আমাদের সংবিধানে যখন সেক্যুলারিজম-যাকে আমার বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতা বলেছি-অন্যতম মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হল, বস্তুত: তখন থেকেই আমরা, তথা আমাদের শাসক নেতারা তার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছে,এভাবে-ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যার যার ধর্ম তার তার এবং রাষ্ট্র কোন ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক অর্থ হওয়া উচিত-ইহজাগতিকতা-যার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের কোন যোগসূত্র থাকবে না। অর্থাৎ যারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা করেন, তাদের মধ্যেই ছিল দোদুল্যমানতা । এ দোদুল্যমানতা হয়ত জ্ঞানগত, নতুবা আপোষকামীতা-ধর্মের প্রতি তাদের বিশ্বাসজাত। তাই তাদের ধারণা ছিল ধর্ম থাকবে পরিবার তধা সামাজিক পর্যায়ে, আর রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সে ধারণা যে সোনার পাথর বাটির মত অকার্যকর, তাতো এতদিনে সুপ্রমাণিত হয়েছে। তবে হ্যাঁ, একটি অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ সমাজকে ধীরে ধীরে সেক্যুলার বিজ্ঞানমনস্ক সমাজে রূপান্তরের রণকৌশল হিসাবে ঐ পন্থা অনুসরণ করা যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে নেতৃত্বের মাথায় সে অঙ্গীকার পরিস্কার থাকতে হবে-অর্থ্যাৎ রণনীতিতে থাকতে হবে অবিচল। কিন্ত দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ্ ও তার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব-এমনকি বঙ্গববন্ধুও ব্যক্তিগতভাবে সেক্যুলার ছিল কিনা সে প্রশ্ন করা যায়। কারণ তার জীবদ্দশায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, ইসলামী সম্মেলনে যোগদান ইত্যাদি কার্যক্রম সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ক্রমে ইসলামী রাষ্ট্রের চেহারা দিতে থাকে- সে ইতিহাস আমাদের ভুললে চলবে না। আমাদের যে সকল বুদ্ধিজীবিদের চরিত্র নিয়ে উপরোক্ত নিবন্ধে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে-তার মূলও কিন্তু এখানে। ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে মানসিক অবস্থান নিলেও সাহস করে তারা ধর্মের অসারতা নিয়ে কথা বলতে নারাজ। কারণ সেক্ষেত্রে ইসলামের মূলগ্রন্ত্রের অনেক বাণীকে চ্যালেঞ্জ করতে হয় যে।
আমার মনে হয় আওয়ামী লীগ, বিম্পি, বা এরশাদের দল সেকুলার ছিল কি না সে প্রশ্ন না করে সংবিধানের সেকুলার বাণীকে কিভাবে আত্মীকৃত করে আমাদের সমাজকে আরও প্রাগ্রসর করা যায় সে দিকে নজর দেয়া বেশি জরুরী ও স্ট্রাটেজিক। জরুরী ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করা। রাষ্ট্র ধর্মকে প্রণোদনা দেবে না, দান দেবে না, এমন কি সরকারী কোনো কাজে কোনও ধর্মের পতিনিধিকেও নিয়োগ দেবে না। ধর্ম পাঠ কেবল পরিবারে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। তবে তা শিশু বয়সে অবশ্যই নয় পরিণত হয়ে উঠলে। মাদ্রাসাগুলো যেমন শিশুদের থাকা খাওয়ার ব্যবাস্থা করে তেমনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোকে দরিদ্র শিশুদের আশ্রয় ও বিদ্যালাভের স্থান করে গড়ে তুললে মাদ্রাসার প্রয়োজন কমে যাবে। মূলতঃ একটা বাস্তবভিত্তিক যুক্তিবাদী সমাজে পৌঁছুতে হলে এই পথে হবে এগুতে হবে আমাদের। একটি একটি করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাস্তব কারণে বানান ও এডিটিং এর ভুল থেকেই যাচ্ছে, ক্ষমাপ্রার্থী। যদি পাবলিশ হবার পর এডিটিং এর সুযোগ থাকতো তো মুক্তমনায় কোনগুলো ভুল আসছে দেখে এডিট করে দিতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আগামীতে আরো নির্ভুল করার চেষ্টা করবো। আপনাদের মন্তব্য, সমালোচনা ও প্রশ্ন জানতে চাই। এই সব ভুলটুল স্বত্ত্বেও যারা পড়ছেন তাদের এবং মুক্তমনাকে ধন্যবাদ। নুরী
দ্রুতপঠনে যেটুকু চোখে পড়েছে সে’সব ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। নতুন কিছু চোখে পড়লে জানাবেন, সহযোগিতার দরজা খোলা রইলো।