প্রাচীন ভারতে সামাজিক প্রগতি ও সংস্কারের প্রথম বিস্ফোরণের নাম বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতম, যিনি গৌতম বুদ্ধ বা বুদ্ধ নামেই সমধিক পরিচিত। যদিও খৃষ্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতক থেকেই এক শ্রেণীর সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের দেখা মেলে, যাঁরা কেউ বেদ বা যজ্ঞে বিশ্বাস করতেন না। এই সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আধিক্য দেখা যায় অব্রাহ্মন সম্প্রদায়ের মধ্যে,যাঁরা দরিদ্র ব’লে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করাতে সমর্থ ছিলেন না, আবার অব্রাহ্মন ব’লে যজ্ঞের ও উপনয়ণের অধিকারীও ছিলেন না। একটা বেদবিরোধী ধর্মাচরণের বিকল্প পথ পেয়ে এই সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অতিদ্রুত বিস্তার ঘটে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে।
এ সময়ের কিছু পরে খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে আরও দু’টো বেদবিরোধী ধারার প্লাবনে ভেসে যায় ভারতবর্ষ; একটি জৈন আরেকটি বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব। কালের বিচারে জৈন ধর্মের আবির্ভাব বৌদ্ধ ধর্মের কিছু আগে। যদিও জৈন ধর্মের চতুর্বিংশতিতম তথা সর্বশেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের জন্ম খৃষ্টপূর্ব ৫৯৯ অব্দে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম খৃষ্টপূর্ব ৬২৪ অব্দে, বোধি বা সিদ্ধিলাভ খৃষ্টপূর্ব ৫৮৯ অব্দে এবং মহাপ্রয়াণ খৃষ্টপূর্ব ৫৪৪ অব্দে।
জৈন ধর্ম তৎকালীন ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বৈদিক ধর্মের বিপরীতে তিনটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে।
প্রথমটি, বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মহাবীর এই প্রথম জৈন ধর্মে দেবতাকে দ্বিতীয় স্থানে নামিয়ে দেন। জ্ঞানের মাধ্যমে যিনি সিদ্ধিলাভ করবেন তিনি হলেন জিন। আর জৈন ধর্ম মতে জিনের নীচে দেবতার স্থান নির্ধারিত হয়।
দ্বিতীয়টি, ব্রাহ্মনের একচ্ছত্র যজ্ঞের অধিকার থেকে মুক্তি। জৈন ধর্ম মতে যজ্ঞের কোন স্থানই নির্ধারিত নেই। ত্রিরত্ন যথা জ্ঞান, বিশ্বাস ও নীতিসঙ্গত কর্মের মাধ্যমে চিত্তের বন্ধনমুক্তিই জৈন ধর্মের সারকথা।
তৃতীয়টি, শিক্ষিত লোকের ভাষা সংস্কৃত থেকে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের বোধগম্য অধর্মাগধী ভাষায় জৈন শাস্ত্র ও সাহিত্যসম্ভার রচনা।
সে সময়ে জৈন ধর্ম উত্তর ভারতে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল। অল্পবিস্তর দক্ষিণের কর্ণাট, অন্ধ্র ও কলিংগেও জৈনদের দেখা মেলে। কিন্ত অহিংস-নীতির অত্যধিক কড়াকড়ি এবং শুধুমাত্র ব্যবসাবানিজ্যের উপর নির্ভরশীলতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে জৈন ধর্মের তেমন বিস্তার পরিলক্ষিত হয়নি।
সে তুলনায় বৌদ্ধ ধর্ম ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বিশ্বের আরও অনেক দেশে ছড়িয়ে যায়। যদিও ভারতবর্ষের তুলনায় অন্যান্য দেশেই এখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশী। কিন্ত প্রাচীন ভারতে একসময় বৌদ্ধ ধর্ম বৈদিক ব্রাহ্মন্যধারাকে আতঙ্কগ্রস্থ করে তুলেছিল।
ব্রাহ্মন্যবাদের অতিশয় কড়াকড়িতে বেদবিরোধী সন্ন্যাসী ভাবধারার সাধারণ মানুষকে নিজেদের গন্ডিতে ধরে রাখার জন্য নিজেদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন ও সংযোজন আনেন ব্রাহ্মনসম্প্রদায়। যেমন,ব্রহ্মচর্য ও গার্হস্থ্য আশ্রমের সাথে বাণপ্রস্থ ও যতি বা সন্ন্যাস নামে আরও দু’টো আশ্রমের সংযোজন এলো। এর ফলে যজ্ঞ করার অনিচ্ছা ও সন্ন্যাসী হয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা লাভের ফলে বেদবিরোধী সন্ন্যাসীদের মধ্যে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে ধর্মান্তরের সংখ্যাও কিছুটা কমে এলো।
জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে কর্মমার্গ বা যজ্ঞের বিপরীতে আত্ম বা জ্ঞানমার্গের প্রাধিকার দেখে ব্রাহ্মন্য বা বৈদিকধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে মৌলিক কিছু পরিবর্তন আসে। যজ্ঞের চেয়ে শাস্ত্র বা সাহিত্যসম্ভার রচনার দিকে বৈদিক ধর্ম বিশ্বাসীদের মনোনিবেশ করতে দেখা যায়। মহাভারত রচনা যদিও জৈন বা বৌদ্ধদের আগেই শুরু হয়েছিল; কিন্ত রামায়ণ রচনার শুরু ও শেষ কিন্ত অনেক পরে। মহাভারতের রচনার শেষ আরও পরে। তাই জ্ঞান শাস্ত্রের বিস্তারের সাথে সাথে করের বোঝা থেকে বাঁচতে চাষাবাদ বা পশুপালনের বিপরীতে ব্যবসাবানিজ্যে বৈশ্যদের অংশগ্রহন দেখা গেল।
একথায় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ও বিস্তারের সাথে সাথে ভারতবর্ষে এক আমূল পরিবর্তনের জোয়ার এলো। কেউ সে জোয়ারে ভেসে ধর্মান্তরিত হলো আর অন্যরা সীমিত আকারে হ’লেও পরিবর্তন নিয়ে এলো অনেক সামাজিক প্রথা ও প্রচলিত রীতিনীতিতে। তাই প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব অনন্য ঘটনাই বটে।
ভারতে মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ, চীনের কনফিউসিয়াস ও পারস্যের জরাথ্রুস্টের আবির্ভাব খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে সারা বিশ্বের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ন ঘটনা। যদিও একমাত্র গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধধর্ম ব্যতিত আর কোন ধর্মীয় মতাদর্শই এত দীর্ঘকালব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেনি সারাবিশ্বে।
নানারকম সামাজিক , সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈষম্য সত্বেও প্রাচীন ভারতে বৈদিক সভ্যতার অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আর সে সভ্যতার সোপান থেকে প্রাচীন ভারতের সমাজকে এগিয়ে নিতে বৌদ্ধ ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া প্রথম বৌদ্ধ শাসক সম্রাট অশোক থেকে শেষ বৌদ্ধ পাল-সাম্রাজ্যের সময়ে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক বিকাশের ইতিহাস স্বর্ন-উজ্জ্বল। এ প্রসংগে শুধু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করলেই যথেষ্ট।
বাঙালায় বৈশাখী পূর্ণিমাই বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসীদের বৌদ্ধ পূর্নিমা। এই বৌদ্ধ পূর্ণিমাতেই সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্ম, বোধি বা সিদ্ধিলাভ এবং মহাপ্রয়াণ। এই তিনের সম্বন্বয়ে বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে বৌদ্ধপূর্ণিমা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মদিনে একটি কবিতা লিখেছিলেন তাঁর জীবন-সায়াহ্রে।
“কাল প্রাতে মোর জন্মদিনে
এ শৈল-আতিথ্যবাসে
বুদ্ধের নেপালী ভক্ত এসেছিল মোর বার্তা শুনে ।
ভূতলে আসন পাতি
বুদ্ধের বন্দনামন্ত্র শুনাইল আমার কল্যাণে
গ্রহণ করিনু সেই বাণী ।
এ ধারায় জন্ম নিয়ে যে মহামানব
সব মানবের জন্ম সার্থক করেছে একদিন ,
মানুষের জন্মক্ষণ হতে
নারায়ণী এ ধরণী
যাঁর আবির্ভাব লাগি অপেক্ষা করেছে বহু যুগ ,
যাঁহাতে প্রত্যক্ষ হল ধরায় সৃষ্টির অভিপ্রায় ,
শুভক্ষণে পুণ্যমন্ত্রে
তাঁহারে স্মরণ করি জানিলাম মনে
প্রবেশি মানবলোকে আশি বর্ষ আগে
এই মহাপুরুষের পুণ্যভাগী হয়েছি আমিও ।” ( জন্মদিনে)
সময় ও কালের বিবেচনায় যে ” বুদ্ধের শান্তিমন্ত্র” ভারতবর্ষের জন্য আশীর্বাদের বাণী ব’য়ে নিয়ে এসেছিল; সে রকম “শান্তিমন্ত্র” এখনও বিশ্ব মানবতার জন্য আবশ্যিকই শুধু নয়, অপরিহার্যও বটে।
তথ্যসূত্রঃ প্রবন্ধ সংগ্রহ -১ঃ অধ্যাপক ডঃ সুকুমারী ভট্রাচার্য
হিন্দু ধর্ম- ক্ষিতিমোহন সেন
। বৌদ্ধ পূর্ণিমা, ১৪২৩।
:good:
লেখাটা যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দীপক, একই সাথে আশারও। মানবজাতির জন্যে মহাবীর ও গৌতমের অবদান তাদের কর্ম ও বাণীতে রয়ে গেছে, যা সবার জন্যে উন্মুক্ত। তবে এই পঠিতব্য নিবন্ধে জৈন ও বৌদ্ধ মত-পথ বিষয়ে আরেকটু ত্বাত্তিক ও ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ হলে পাঠক আরো জানতে পারতো আর কি। পরিশেষে ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
বৈদিক ধর্মেও আত্মজ্ঞান-এর মাধ্যমে মোক্ষ প্রাপ্তির কথা বলা আছে | সেখানে বলা আছে যে যজ্ঞের ফল চিরন্তন নয় কারণ যজ্ঞ নশ্বর সামগ্রী দিয়ে হয় | জ্ঞানের ফল অবিনশ্বর | এইসব কথা উপনিষদে লেখা আছে |
কন বাসনাহীন ভাবে যে যজ্ঞ করা যায় তা মানুষকে মুক্তি দেয় | সেইরকম যজ্ঞ হলো : অগ্নিহোত্র , দর্শ , চাতুর্মাস্য, ইত্যাদি | এইগুলি কেবল গ্রাম্য ঔষধি দিয়ে সম্পন্ন হয় | এসব কথা মহাভারতের শান্তি পর্বে ভীষ্ম যুধিস্থিরকে বলেছিলেন | এছাড়া আরেক রকম যজ্ঞ আছে : অন্তর্যাগ | শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অনুশাসন পর্বের অনুগীতা পর্বাধ্যায়ে বলেছেন যে এই যজ্ঞে শুধু ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলিকে আত্ম রূপ অগ্নিতে আহুতি দিতে হয় | এটাও মোক্ষ প্রাপক |
জ্ঞানের মাধ্যমে মোক্ষ প্রাপ্তির কথা ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আছে | যোগবাশিষ্ঠ রামায়ন, বিবেক চূড়ামণি ইত্যাদি মোক্ষ শাস্ত্রের গ্রন্থে তা পাওয়া যায় |
দুঃখজনক যে কোন ধর্মেই নারী সম্মানজনক স্থান নেই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মেও কুসংস্কার ঢোকে এবং কর্মের পরিবর্তে বুদ্ধ পুজা চালু হয়(মহাজান বৌদ্ধ ধর্ম)। ভাল করে বলতে গেলে কোনো ধর্ম ই ঠিক নয়। খোজ নিয়ে দেখবেন ভন্তে (বৌদ্ধ সন্ন্যাসী) দের চরিত্র কি রকম এখন, তবে হ্যাঁ বুদ্ধ মানুষের আদর্শ চিরকালের,
শুধু তাঁকে মেনে চলাই যায় , তার বানি গুলিঃ–
“কোনো পরম্পরা এই বলে মেনো না যে সবাই মানে
এই বলেও মেনো না যে তোমাকে মানতে বলে সবাই ,
এমন কি বুদ্ধ বলে বলেও মেনো না,
তোমার যুক্তি তে গ্রাহ্য হলে তবেই মেনো”