-বাবা, ও বাবা, বাবা
-মশকরা করতাছস? এদিকে কি কেউ আছে যে বাবা ,বাবা কইরা চিতকুর পারস?
-আরে ফাতেমা ছেড়ি তো তর কেরামতি ধইরা লাইসে
-কোন কেরামতি?
-জীনে যে দুধ খায়, ছেড়ি তো এই কেরামতি মাইনসেরে দেহায়া কয় যে তুই একটা ঠগ
-ক্যামনে ধরল?
-আজিব তো, আমি ক্যামনে কমু?
-ঘুমা ,এহন ঘুমা, সকালে দেখমু
ফাল্গুনের ৩ তারিখ। বৃক্ষের মন্থরে নতুন পল্লব গজানো শুর করেছে। অল্প অল্প করে খাদ্য ভীরু লুকুচুরি খেলা বাচ্চাটার মত সূর্যের আলো পরছে। নৈসর্গিক প্রকৃতির মাঝে হটাত কোথাও কোকিলের গান শোনা যায়। চন্দ্রাবতী নদীর পাশের হিজল গাছটার দক্ষিণের বড় ডালের উপরে একটা কোকিল বসে আছে। খানিক আগে সেখান থেকে কোকিল পাখিটার গান শোনা যাচ্ছিল । পুরুষ কোকিল । তার ধারনা ছিল গাছের আড়ালে একটা মেয়ে কোকিল বসে আছে। কিন্তু তার ধারনাটা ভুল প্রমানিত হয়েছে। সেখানে আসলে একটা চড়ুই ছিল। যার কারনে পুরুষ কোকিলের কণ্ঠে এখন আর গান নেই । কি বিচিত্র জিবনের ধারা তাই না?
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পীর মুহাম্মদ কেরামত আলির ঘুম ভাঙ্গে । তার চেহারায় এখন বিরক্তি ও রাগের ছাপ।শান্তির ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেল। কোন শালা পিচ্ছি যে টিনের চালে বল মারল? এই গ্রামের পিচ্ছি গুলো বিরাট বদমাইশ । ভক্তি শ্রদ্ধা কাকে বলে জানে না।
কেরামত আলি সাহেব তার চেলা মতিন কে ফাতেমার বাড়িতে পাঠিয়েছে । ফাতেমা আর ফাতেমার বাবাকে খানকা শরিফে নিয়ে আসার জন্য । মতিন এক সময় কেরামত আলির বন্ধু ছিল। সেই নয় বছর বয়সের থেকে। এখন কেরামত আলি হয়েছে পীর বাবা আর মতিন তার প্রধান শিশ্য । দুজনের ই বিয়ের সাধ আর সংসারের আকাঙ্খা মিশিয়ে গেছে। তবুও মনের ভেতরের গহিনের প্রেষণা কখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে । দুজনের কেউই সবসময় সংযমের প্রয়োজন বোধ করেন না। এত সংযম করেই বা কি হবে? মানুষ আর পশু তো একই। দুর্ভাগ্য বশত মানুষের বুদ্ধি বেশি। বেটারা দল বাধতে শিখেছে। জিবনের অন্যরকম একটা মানে খুজে পেয়েছে তারা। যেই সমস্ত মানবির সামনে বাবা আর বাবার শিষে এর সংযম ভেঙ্গে যায় শুধুমাত্র তারাই কেরামত আলির মত ভাবতে শেখে, মানুষ আর পশু জাতির মাঝে মেলবন্ধন খুঁজে পায়।
ফাতেমা মেয়েটা শাহ কেরামত আলিকে বিশ্বাস করেন না। ফাতেমার মনে হয় লোকটা একটা ঠগ । এরকমভাবে মানুষকে ঠকানো কি ঠিক?
শাহ কেরামত আলি অনেকক্ষন ধরে ফাতেমাকে বোঝালেন। ফাতেমা যা দেখিয়ে ছিল টা জাদু আর কেরামত আলির টা ছিল প্রকৃতির লীলা ।
-সব এক হয় না রে ,মা । তোর মাথাটা ঠিক কর। মাথায় গিঁটটু লাগছে। গিঁটটু টা ঠিক কর।নাইলে তো তুই পাগল হয়া যাবি রে মা। তর কথাবার্তায় তো দেহি আল্লাহ বিশ্বাস ই নাই।
পিরবাবার কথায় ফাতেমার বাবাও সায় দিলেন।মেয়েতার কি দরকার সব জিনিস নিয়ে উল্টাপাল্টা মাথা ঘামানোর । পিরবাবা ফাতেমাকে একটা কাগজ দিয়ে বললেন- উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথায় আসলে খালি ঘরে একা বইসা , এই কয়লার টুকরাখানা সুতায় পেঁচাইয়া কাগজে একটা যোগ চিহ্ন আঁকবি। এরপরে যোগ চিহ্নের কেন্দ্রের বরাবর উপরে কয়লা আঙ্গুলে ঝুলায়া একনজরে তাকায়া থাকবি আর দোয়ায় ইয়ুনুস পরবি।সব ঠিক হয়া যাইব, আল্লাহ মেহেরবান।
আজকে প্রবল বৃষ্টি পরছে। টিনের চালের উপরে বৃষ্টির আওয়াজ টা সত্যিই খুব সুন্দর। পিরবাবা শাহ কেরামত আলির কাছে আজকে তেমন কোন মুরিদান নাই। কেরামত আলি ভাবছেন ফাতেমা মেয়েটার বুদ্ধি একটু বেশিই। সে কি বুঝে না –এত বুদ্ধি ভাল না?
কেরামত আলির চেলা মতিন এসে জিজ্ঞাসা করল-
-কি ডোজ দিলি?
-কিছুই দেই নাই ,যোগ চিহ্নের উপর কয়লা ধইরা তাকায়া থাকতে কইছি
-এটাতে অর কিছুই হইব না ।
-অর হইব ,অর মত মানুষের মাথারে কয় ফ্লেমেতিক বা আত্মস্থ । বৈজ্ঞানিকগো মাথার গঠন এইরকম হয়। এটা দিয়াই কাজ হইব।
আজকে ফাতেমার মনটা ভাল নেই। মা বাবা তাকে অনেক বকেছে ।
-নিজেরে বেশি বুদ্ধিমান মনে করস? তর তেহে কেউ কম বুঝে না।আর কোনদিন যদি দেখছি উল্টাপাল্টা জিনিস নিয়া মাথা ঘামাইতে…………
ফাতেমার নিজের উপরই রাগ লাগে।সে কেন এত বেশি বুঝতে গেল? এত বেশি বুঝা কি তার জন্য ভাল? ওই শয়তান কেরামত আলির উপরেও জিদ লাগছে। লোকটা আসলে বিরাট বদ।
ফাতেমা মন ভাল করার মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। তার প্রচুর কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এত বড় মেয়ে কাঁদলে মানুষ কি বলবে? সে আসলেই খুব বড়। ?
ফাতেমার হটাত মনে হল লোকটা কয়লা ধরে যেই কাজটা করতে বলেছে একবার করে দেখি তো।
ফাতেমা যোগ চিহ্নের উপরে কয়লা ধরে কয়লার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।হটাত ফাতেমার মনে হল কয়লাটা নড়ছে। কয়লাটা যোগ চিহ্নের এই পাশে ওই পাশে যাচ্ছে । সে তো হাত নাড়াচ্ছে না । তবে কয়লাটা কেন নড়বে? হ্যাঁ কয়লাটা সত্যিই ঝুলে রয়ে নড়ছে, এই পাশে ওই পাশে যাচ্ছে, কিন্তু কেন? কেন এরকম হচ্ছে? সে তো হাত নাড়াচ্ছে না । ফাতেমা ভয় এ হাত থেকে সুতাটা ফেলে দিল।
সারারাত ফাতেমার ঘুম হল না। সে কি সত্যিই কেরামত আলি কে ভুল বুঝেছে? কয়লাটা কেন নরবে?তাহলে সত্যিই কি ফাতেমাই ভুল ছিল আর কেয়ামত আলিই ঠিক?
পরদিন রাতে ফাতেমা নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে আবার কাজটা করতে শুরু করল। হ্যাঁ, আজকেও তো কয়লাটা নরছে।এদিক ওদিক যাচ্ছে। কে নাড়াচ্ছে এটাকে? কে?
আচমকাই ফাতেমার মনে একটা আধিভৌতিক অনুভূতি ঘিরে ধরল। তার শরীরটা কেমন জেন ঝিন ঝিন করছে। ফাতেমার মনে হচ্ছে তার আশেপাশেই কেউ একজন আছে। কে সে ? কে?
তার মনে হচ্ছে , সেই কেউ একজন টা তার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে । তার এমন লাগছে কেন? ফাতেমার মনে হল সে যেন গহিন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকার। শুধুই অন্ধকার।
ফাতেমার মা বাবা চিৎকার শুনে ফাতেমার ঘরে দৌড়ে গেল। তারা খানিকটা ভয় পাচ্ছে – মেয়েটা খাটের উপর এরকম খোলা চুলে ঝিম ধরে বসে আছে কেন?কি হয়েছে ওর?
পরদিন সকালে ফাতেমার বাবা লক মারফত কেরামত আলিকে খবর পাঠালেন যে, ফাতেমাকে জীনে ধরেছে।কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না। তাকে এখন বেঁধে রাখা হয়েছে।
সন্ধ্যার সময় কেরামত আলি ফাতেমার বাড়িতে গেলেন। ফাতেমা কেরামত আলির কাছে আসতে চায় না। সাতজন মিলেও ফাতেমার সাথে কেউ পেরে উঠছে না। মেয়েটার গায়ে এত আশ্চর্য জোর কথা থেকে এল? তার গলাটাও পুরুষের মত শোনাচ্ছে ।
ফাতেমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হল । অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত তাকে কেরামত আলির কাছে আনা হয়।
-তর নাম কি?
-কমুনা
-কালফার কচি দিয়া বাড়ি মারলেই কবি।
কেরামত আলি কালফার কচি দিয়ে ফাতেমার গায়ে অনেকগুলো বাড়ি মারলেন।
-আমার নাম কফিল।জিন কফিল
-ওরে ধরছস ক্যান?
-মন চাইসে
-মন চাইসে? না । দাড়া।
এরপর কেরামত আলি ফাতেমাকে কালফার কচি দিয়ে বেধরক পেটালেন।
-ওরে ছাইড়া দে
-না ছাড়মুনা
কেরামত আলি তখন ফাতেমার বাবাকে ডেকে বললেন – এই সমুসসা, কঠিন সমুসসা।এই জিন শয়তান জিন। একটা বাটিতে কইরা মরিচের গুঁড়া আনেন।
কিছুক্ষন পরে কেরামত আলি জিন কফিলের অর্থাৎ ফাতেমার চোখে মরিচের গুঁড়া মারতে লাগলেন।
-যাবি না , মারলে ঠিকই যাবি।দেহি কতক্ষন মাইর খায়া থাকতে পারস?
কেরামত আলি জিন কফিলের মুখে শরীরে জোরে জোরে লাথি মারতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত জিন কফিল ফাতেমাকে ছেড়ে যাবে বলে কথা দিয়েছে।তবে শর্ত হল তাকে একটা খাসি দিতে হবে।সবাই সেই শর্ত বাধ্য হয়েই মেনে নিল।কিছু টাকার খরচ করে খাসি গেলে তো সমস্যা নাই। মেয়েটা তো বাঁচবে।
কেরামত আলি জিন কফিলকে বললেন – ওরে যে ছাইররা যাবি সেইরকম একটা প্রমান রাইখা যা।এই পানি ভরতি কলসি দাঁতে নিয়ে পাঁচ কলম যাবি।
জিন কফিল রাজি হল
ফাতেমা কলসি দাঁতে নিয়ে পাঁচ কদম গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পরল।
পরদিন সকাল নয়টায় ফাতেমার জ্ঞান ফেরে।তার এখন কোন সমস্যা নাই।ফাতেমা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তার মা বাবা ও খুব খুশি। কেরামত আলি বাবা সত্যিই মেহেরবান। তার ছোঁয়াতেই মেয়েটা এখন সুস্থ হয়ে গেল।ফাতেমার এখন কোন সমস্যা নাই
পাঁচ মাস পর
তখন শ্রাবন মাসের দিন। এক সন্ধাবেলায় আকাশে মেঘ করে এল। ফাতেমার বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফাতেমা আর নেই। কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ বেশিদুর এগোল না। তার আগেই রাশ ভারি বৃষ্টি নামল । বৃষ্টির ঝম ঝম আওয়াজ প্রকৃতিতে এক অপূর্ব সিম্ফনি তৈরি করছে। প্রকৃতি, কি অপূর্ব সৌন্দর্য ! কি অপূর্ব এই মহাবিশ্ব ! কি অপূর্ব মেঘের অপারের ওই অনন্ত নক্ষত্রবীথি !
ব্যাখ্যাঃ অন্ধকার গল্পটি আমাদের সমাজের অন্ধ সংস্কার বা কুসংস্কারের প্রেক্ষাপটে তৈরি। যেই অন্ধ সংস্কারের ধারা চলে আসছে শতাব্দী ধরে। সমাজের কিছু অকর্মণ্য , অলস ও চতুর বাক্তিরা তাদের বুদ্ধির বদৌলতে সাধারণ মানুষকে নিজের কেনা গোলাম বানিয়ে রাখে। আর এই পথে তারা আশ্রয় নেয় মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের । আর এভাবে এক পর্যায়ে ধর্মের প্লাটফর্মও খারাপ করে থাকে মানুষের কাছে ভণ্ড পীরেরা।
আবার ওই সমাজের ই কিছু বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী মানুষ যখন প্রকৃত সত্যকে সকলের সামনে তুলে ধরেন , তখন ওই সমস্ত ভণ্ড ও চতুর ধর্মগুরুরা নানান পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে যুক্তিবাদী মানুষকে দমিয়ে রাখে। সমাজের এই রুপচিত্র আমরা প্রাচীনকাল মধ্যযুগ ও বর্তমানে ও দেখে আসছি। গালিলিও, কোপারনিকাস, টাইকো ব্রাহের সত্য আবিষ্কারের পরও ধর্ম গুরুদের গোঁড়ামি আর শ্রেষ্ঠত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সাড়ে তিনশত বৎসর সূর্যকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে হয়েছে।
অন্ধকার গল্পটিতে পীর কেরামত আলির মত ভণ্ড লোক যখন গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে প্রতারণা করে, বিজ্ঞানের জাদুকে অলৌকিকত্ব বলে প্রকাশ করে তখন ফাতেমা নামের অবিশ্বাসী ও যুক্তিবাদী মেয়ে তার প্রতারণামূলক উপার্জনের পথে আঘাত করে । তখন গ্রামের অশিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধিমান বালিকা ফাতেমাকে মারার জটিল ফন্দি আঁটে । ফাতেমাকে কেরামত আলি যেই পদ্ধতিতে মনের বৈপরীত্য দূর করার কথা বলেন সেখানে যে কোন মানুষই একলা ঘরে deep concentration দিয়ে তাকিয়ে থাকলে , কয়লার নাড়াচাড়া দেখতা পাবেন । এর পেছনে কাজ করে মানুষের অচেতন মনের ক্রিয়াকলাপ। ফাতেমা অশিক্ষিত মেয়ে , এই কয়লার নাড়াচাড়া ও তার চারপাশের অবস্থা তার মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যা থেকে সে হিস্টিরিয়া নামক মানুষিক রোগে আক্রান্ত হয়। যাকে আমরা না বুঝে জীনে ধরা বলে থাকি। কেরামত আলি জানতেন যে এই পদ্ধতিতে ফাতেমার হিস্টিরিয়া হতে পারে, কিন্তু গ্রামের মানুষ তাকে জীনে ধরা বলে ভাববে এবং তখন কেরামত আলিকেই যেতে হবে সেই জিন ছাড়াবার জন্য। কেরামত আলি ভেবেই রেখেছেন সে যখন জিন ছাড়াতে যাবে তখন ফাতেমাকে এমন প্রহার করবে যেন তার মানুষিক সমস্যা টুকু ভাল হলেও কিছুদিন পরে সে মারা যায়। আর তেমনটাই হয়েছে। কেরামত আলির শত্রু ফাতেমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার পথের কাঁটা সরে গিয়েছে।
:rose:
:yes:
:good:
:yahoo: