সাজিয়াদের এখানে ক্রিসমাসের সময় ‘আন্তর্জাতিক ক্রিসমাস’ মেলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের দেশীয় বিখ্যাত সব পণ্য নিয়ে পশরা সাজান। সাধারণত খুব ভীড় হয়। খাবার, কাপড়, গয়না, পটারি, শো’পিস কী নেই সেখানে! মেলা উপলক্ষ্যে মঞ্চে বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের পরিবেশনায় নাচ-গান হয়। আবার ভিডিও চলে প্রজেক্টরে; যাকে বলে উৎসব উৎসব আমেজ। সাজিয়াও প্রতিবার যায় অন্যান্য বান্ধবীদের সাথে মেলা দেখতে। জিনিসপত্রের বেশ দাম হয়, বেশির ভাগ পণ্যই হাতে তৈরি বলে দাবী করা হয়। চাইলেই মনের মতো সব কেনা যায় না। তারপরও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নানা রঙের আলোয় সাজানো ‘ক্রিসমাস মেলা’ একটা বিরাট আকর্ষণ। হরেক রকমের খাবার, স্ন্যাকস, গরম গরম তৈরি করে বিক্রি করা হয়। খাবারের দোকানে ভীড় তো লেগেই থাকে। শীতকালের বিষণ্ণতা আর অন্ধকার কাটিয়ে মানুষকে চাঙ্গা করে রাখে এই মেলাগুলো।
পোলিশ স্টলে দাঁড়িয়ে সাজিয়া তার অনেকদিনের শখের পোলিশ পটারির বিখ্যাত সেই নীল-লাল কম্বিনেশানের ডিশ, প্লেট, বাটি এগুলো বাছাই করছিলো কেনার জন্য তার বাজেট অনুযায়ী। প্রতিবারই কিছু না কিছু কেনে সে কিন্তু এবার অনেক কিছু কিনবে ভেবে আগে থেকেই তৈরি ছিলো। সাজিয়ার সাথে আরো কয়েকজন ছিলেন। কেউ কেউ টুকটাক কিছু কিনলেন কিন্তু একজন কিছুই কিনলেন না, সারা স্টল শুধু আঁতিপাতি করে দেখলেন আর কিছুক্ষণ সাজিয়ার কেনাকাটা দেখলেন। সাজিয়া একটু অবাক হলো কারণ তিনি কেনার বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন আগে। সাজিয়া চাকুরীজীবী, ছিমছাম চলাফেরা। তাকে দুশো-পাঁচশো ইউরো খরচ করার আগে একটু ভাবতে হয় অথচ ইনি বড় ব্যবসায়ীর গৃহিণী, আপাত দৃষ্টিতে উনার সেই সমস্যাও নেই।
কৌতূহলী হয়ে সাজিয়া জিজ্ঞেস করেই ফেললো,’ভাবী, কিছু কিনলেন না?’
-শুকনো গলায় জবাব,’নাহ, ভাবী।’
সাজিয়া বলবে না বলবে না ভাবলেও কখন যে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো,’আপনার তো ডিশগুলো অনেক পছন্দ, সবসময় বলতেন না আপনি?’
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাজিয়ার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে দুটো সার্ভিং ডিশ বের করে পেছনটা দেখালেন। ওখানে ‘সোয়ার্জকফ’ ব্র্যান্ডের মাথাটা আঁকা।
তারপর বললেন,”মানুষের মুখ, মাথা এগুলো দেয়া থাকলে বাড়িতে ফেরেশতা আসে না। এগুলো কেনা, ব্যবহার করা হারাম। আমি তো এসব বাছি, মেনে চলি। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, বংশের শিক্ষা, এগুলোতো বাদ দিতে পারি না। বিদেশে আসছি বলে কী হয়েছে, খানদান তো খানদানই আছে।”
শেষের কথাগুলো হয়তো তিনি সাজিয়াকে লক্ষ্য করেই বললেন। কারণ সাজিয়ার মধ্যে তো বাছাবাছির বালাই নেই। যা ভাল লাগে তাই করে, সমাজ, ধর্ম এসব নিয়ে ভাবনা কম। দুদিনে চোখে বিদেশ দেখে দেশের সব শিক্ষা দীক্ষা ভুলে বসে আছে।
ঘরে কুকুর ও প্রাণীর ছবি থাকা কেমন?
*************** *************** **
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
তাআলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ
করেছেন;-
“ঐ ঘরে রহমতের ফিরিশতা প্রবেশ করে না, যে ঘরের
ভিতর কুকুর থাকে বা জীবজন্তুর ছবি থাকে।”
-বোখারী ও মুসলিম শরীফ।
বন্ধুরা আপনাদের কারও ঘরে যেকোনো প্রাণীর
ছবি অথবা আপনাদের পরিবারের কারও
ছবি টাঙানো থাকলে তা আজই নামিয়ে ফেলুন। কেননা যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে ঐ
ঘরে নামাজ আদায় করলে, নামাজও পর্যন্ত
হবে না। নামাজগুলো পুনরায় পড়া ওয়াজিব। এমনও হতে পারে, আপনাদের রুমের
মধ্যে ক্যালেন্ডার অথবা পত্রপত্রিকা থাকতে পারে এবং এগুলোর মধ্যে জীবজন্তুর কিংবা নায়ক-নায়িকার ছবি থাকা অবস্থায় আপনি নামাজ আদায় করেছেন। ঐ নামাজও হবে না। আর কারও ঘরের শো-কেসের মধ্যে বাঘ, বাল্লুক, হরিণ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি রাখা হয় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। এগুলোও রাখা যাবে না। কেননা এ ধরনের
মূর্তিও ঘরের মধ্যে রাখা হারাম। ইসলাম
আসছে মূর্তি ভাঙার জন্য, মূর্তি গড়ার জন্য নই।
আল্লাহ-তাআলা আমাদেরকে বোঝার
তাওফিক দান করুক। আমিন।
সূত্রঃ কুরআন ও হাদিসের বানী – Voice of Quran & Hadith
সাজিয়া এমনি বেশ টক টক কথা বলতে পারে মুখ চালাতে খুব মন্দ নয় সে। এখন একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। মনে মনে হাসতে হাসতে ভাবতে লাগলো, যে-দেশে ভ্যান গগ, রেমব্র্যাঁ-র ছবির এতো বড় বড় মিউজিয়াম আর মাদাম তুসো’তে আছেই দিনরাত হাঁ-করে খোলা, সে-দেশে ফেরেশতার নির্বিঘ্নে চলাফেরা তো খুবই অসুবিধাজনক হওয়ার কথা। যেখানে সেখানে ফেরেশতা উষ্ঠা খেয়ে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। ঐটুকু সোয়ার্জকফের মাথা খুঁজে খুঁজে বাড়ি বাড়ি যেতে গেলে ওভারটাইম করতে হবে তাকে।
তারচে বড় কথা কাফেরদের দেশে ব্যবসা করে দুনিয়ার টাকা কর ফাঁকি দেওয়াতে দোষের কিছুই দেখে না ফেরেশতারা; যত দোষ ঐ আঁকা আঁকির মধ্যেই খুঁজে পায়! প্লেটে পশু, প্রাণীর ছবি থাকা হারাম কিন্তু দেয়ালে ছেলে মেয়েদের ছোটবেলার ছবি, তারবেলা? যে টাকা থেকে যথাযথ কর পরিশোধ করা হয়নি, তার কী হবে? ওহ, সৌদি, দুবাই, কুয়েত, বাহরাইনে তো কর নেই, মুসলমানদের জন্য তো কর ব্যাপারটি নেই। সেটা নাছাড়াদের ব্যাপার। আমরা তো যাকাত দেই, কোরবানী দেই, গরীবরা পেট ভরে বছরে দুদিন মাংস খায়, কাপড় পরে, আবার কী।
আঁকাআকিতে মুসলমানরা বিশ্বাস করে না তার প্রমান অনেক বার তারা রেখেছে। কার্টুন হোক আর সোয়ার্জকফের মাথা, আঁকা বন্ধ। সম্প্রতি ‘শার্লে এবদো’কে যে শিক্ষা তারা দিয়েছে তা অনেকদিন ফরাসিরা ভুলতে পারবে না আশা করি। ঠিক যেমন লেখালেখিতেও তাদের ভরসা নেই। তুমি কার্টুন এঁকেছো তার জবাবে অন্য কার্টুন আসতে পারে, তুমি প্রবন্ধ লিখেছো তার জবাবে প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। কিন্তু তা হবে না কখনোই। যেহেতু কোরানে ছবি আঁকা, গল্প লেখা এগুলো নিষেধ করা হয়েছে তাই তাদের বিশ্বাস হলো চাপাতিতে। এক কোপে লাল লাল ছোপ ছোপ গরম রক্ত গলগল করে বের হয়, কর্ম সাবাড়। কি উত্তেজনা আসে তা দেখলে। বই পড়ে বা ছবি এঁকে এই উত্তেজনা পাওয়া সম্ভব?
সাজিয়া অন্য আর একদলকে দেখেছে যারা নিজেদেরকে মডরেট বলে পরিচয় দেয়। এদের চেয়ে সুবিধাবাদী ভেজাল প্রজন্ম বোধহয় পৃথিবীতে নেই। মডরেট ভাই ও বোনেরা, তারা যেকোন ভাবেই এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের ফমূর্লায় ফেলে সবকিছুকেই। ইসলামে লেখালেখি, ছবি আঁকাআকি যে নিষিদ্ধ নয় সেটা প্রমাণ করে দিতে তারা বদ্ধ পরিকর। কোরানে অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান ইঙ্গিতে, ইশারায় বলা আছে যেগুলো আবার রাসূল হাদীসে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেসব বুঝতে হলে সবাইকে অনেক পাক দিলে ইসলামিক লাইনে পড়াশোনা করতে হবে, বিভিন্ন কিতাব পড়তে হবে। অশিক্ষিত হুজুরদের কিংবা কাফেরদের ভুল ব্যাখ্যায় পড়লে চলবে না। সে সব বলতে বলতে হয়রান হয়ে মুখে ফেনা তুলতে থাকেন।
সাইদ বিন আব আল হাসান বর্ণনা করেন যে তিনি যখন ইবনে আব্বাসের সাথে বসেছিলেন তখন এক লোক তার কাছে আসেন এবং বলেন,’হে আব্বাসের পিতা, আমি ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করি।’ইবনে আব্বাস বললেন,”আমি সেটাই বলব যা আমি আল্লাহর নবীর কাছ থেকে শুনেছি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যে লোক ছবি আঁকে তাকে আল্লাহ শাস্তি দেবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাতে জীবন দিতে পারে এবং সে সেটা করতে কখনওই সক্ষম হবে না।” এটা শুনে সেই লোকটার মুখ শুকিয়ে গেল। ইবনে আব্বাস তাকে বললেন,”কি দুঃখের কথা! যদি তুমি ছবি আঁকতেই চাও তাহলে আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে গাছপালার ছবি বা অন্য কোন জড় বস্তুর ছবি আঁকতে পারো।”
সুতরাং মানুষ কোন জীব বা জন্তুর জীবন দিতে পারে না। আল্লাহই একমাত্র সেই ক্ষমতার অধিকারী তাই মানুষকে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ জীব জন্তুর ছবি আঁকতে নিষেধ করেছেন। ঠিক একারণেই মোমিন মুসলমানেরা কখনওই তাদের ঘরে কারও ছবি রাখে না। -সহি বুখারি, ভলিউম- ৩, বই – ৩৪, হাদিস – ৪২৮।
এখন প্রশ্ন হলো- ছবি আঁকা ও তোলা কি এক জিনিস?
কারণ, ফেসবুক হিজাবধারী রমণীদের বিভিন্ন লাস্যময়ী ভঙ্গিমার প্রোফাইল পিকচারের ভারে নাজুক অবস্থায় আছে। হিজাবী সেলফি একটা মারাত্মক ডাইনামিক মাত্রা যোগ করেছে ফটোগ্রাফী শিল্পে।
সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে আসলে এক জিনিস। মানুষ হাত দিয়ে কোন লোকের হুবহু ছবি আঁকতে পারে আবার ক্যমেরা দিয়ে হুবহু ছবি তুলতে পারে। উভয় কাজের উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই তা হলো কোন লোকের হুবহু প্রতিকৃতি তৈরী। একটা হাত দিয়ে আর অন্যটা যন্ত্র দিয়ে। কিন্তু যেভাবেই হোক একজন লোকের প্রতিকৃতি তৈরী করলে সেটাতে কেউ জীবন দিতে পারবে না আর তাই উক্ত হাদিস মোতবেক তা নিষিদ্ধ।
এ বিষয়ে আরও একটা হাদিস দেয়া যেতে পারে;-
“জিব্রাইল মুহাম্মদকে বলছে, যে ঘরে কুকুর বা কোন ছবি থাকবে সেই ঘরে ফিরিশতারা প্রবেশ করে না।”
এখানে ছবি বলতে জীব জন্তু বা জড় বস্তু কোনো কিছুই বলা হয় নি। তবে জড় বস্তুকে যদি এর আওতার বাইরে রাখি তাহলে দেখা যাচ্ছে কোনো জীব জন্তুর ছবি আঁকা নিষেধ। আর তাই তাদের ছবি তোলাও নিষেধ। ভিডিও ছবি যেহেতু স্থির ছবিরই অপর রূপ অর্থাৎ হাজার হাজার স্থির ছবি তুলে যদি নির্দিষ্ট গতিতে চালনা করা হয় তখন সেটা গতিশীল দেখায় যা সেই ছবি তোলারই নামান্তর মাত্র। সুতরাং ভিডিও ছবিও তোলা যাবে না, আর তাই যাবে না সিনেমা বা টিভি দেখা।
এখন কেউ এসে যদি ফতোয়া দেয় যে নবীর আমলে তো ছবির দরকার ছিলো না, এখন তো মানুষের ছবি তোলা দরকার বহু দালিলিক কাজে যেমন- আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদিতে তাই এখন এটা বৈধ। সেটা হবে চূড়ান্ত রকম মুনাফিকি ফতোয়া কারণ হাদিসে পরিস্কার ভাবে বলা হয়েছে ছবি আঁকা যাবে না। যুগের পরিবর্তনে তো আর মহানবীর কথার নড়চড় হতে পারে না বা পারে না ইসলামের বিধি বিধানের পরিবর্তন। সুতরাং যারাই নিজেদের ছবি আঁকবে তা সে যতই দরকার হোক না কেন, অথবা যারাই সিনেমা টেলিভিশন দেখবে তারা মহা গুনাহগার বা মুনাফিক এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
এখন শুধু শোয়ার্জকফের ভাতের থালা, বাসায় পাখির ছবি, শাড়িতে প্রজাপতির ছবি এড়ালেই কি এই পৃথিবী বাসযোগ্য হবে? হলিউডের স্টুডিও, বলিউডের স্টুডিও, ল্যুভরের মোনালিসা সবই পৃথিবিতে ফেরেশতাদের চলাফেরায় বাঁধা দিচ্ছে। অবশ্য তার একটা বন্দোবস্ত শীঘ্রই করে ফেলতে অনেকেই সক্রিয় আছেন। বাংলাদেশ সমস্ত মূর্তি ভেঙে এ-ব্যাপারে পৃথিবীতে দৃষ্টান্তমূলক নজির স্থাপন করছে। অন্যদিকে না হোক, এ দিকে কেউ যেন বাংলাদেসীদের হারিয়ে প্রথম স্থান দখল করতে না পারে সেদিক তারা তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। সম্প্রতি ব্রাক্ষনবাড়িয়াতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর স্মৃতি বিজরিত যাদুঘরটি ধ্বংস করে এপথে আরও কয়েক কদম তারা অগ্রসর হয়েছে।
সাজিয়া, নিজেকেই নিজে বলে, মানুষই কি এমন না ধর্মই এমন!
এক কথায় দারুনভাবে ফুটে উঠেছে মানুষের বায়বীয় ধর্মীয় অন্ধত্ব।
আসলেই প্রশ্ন কে বড়, মানুষ না ধর্ম নামক বায়বীয় অনুভূতি???
ভাল থাকুন।
একমত।
ধন্যবাদ তানবীরা, আপনার লেখায় নতুন মাত্রা পেল। মনে হয়, ঢিলটা গভীর জলে পড়ে চোরা স্রোতে অনেক দূর টেনে নিয়ে গেছে, তাই ‘ম’ তে ভাঁটা পড়েছে। যখন বুদবুদ উটবে, তখন বুঝা যাবে প্রতিক্রিয়া। আরও লেখার জন্য আশায় আছি।