শুভ নববর্ষ। শুভ হোক ২০১৬ সবার জন্য। শেষ হোক ২০১৫ এর বিশ্বব্যাপী বিভীষিকা। সবাইকে ধন্যবাদ যারা পাশে থেকেছেন, বিপদের ঝুঁকি নিয়েও সঙ্গে হেঁটেছেন। আমার খুব কাছের মানুষদের জন্য রইল হৃদয়-নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা যারা যে কোনো মূল্যে, যে কোনো পরিস্থিতিতে পাশে থেকে নিরন্তর শক্তি জুগিয়েছেন, আগলে রেখেছেন, গহীন কোনো অজানায় ডুবে যাওয়ার আগেই টেনে তুলেছেন।
এই বছরটা শেষ হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার জন্য, আমাদের মেয়ের জন্য। যদিও বারবার আঁকড়ে ধরেছি স্মৃতিগুলো। একদিকে যেমন মনে হয়েছে বছরটা শেষ হলে প্রতীকীভাবে হলেও কষ্টের বোঝাটা হয়তো একটু কমবে, নতুনভাবে শুরু করার উদ্দীপনা নিয়ে আবার জীবনের গন্তব্য ঠিক করে নেওয়া যাবে, আবার অন্যদিকে বারবার মনে হয়েছে অভিকে তো বিদায় দেওয়া হয়নি ঠিকমতো কখনও। ওকে বিদায় না দিয়েই বছরটা বিদায় করে দিই কী করে?
অভিকে আমি জীবনের অপর পারে দেখিনি। আক্রমণের সময়টা মনে নেই, হাসপাতালে বারবার জ্ঞান হারানো এবং জ্ঞান ফেরার মাঝামাঝি সেই বিভ্রান্তিকর অবস্থাটায় ওকে যখন শেষবারের মতো দেখেছিলাম, তখনও ও বেঁচে ছিল, মুখে শব্দ করছিল। তখন ওর চিকিৎসার কথাই মনে হয়েছে শুধু, বিদায় নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি। তারপরের কয়েক ঘণ্টায় কী হয়েছিল তা ডাক্তার থেকে শুরু করে আমার মা পর্যন্ত সবাই অত্যন্ত যতনে লুকিয়ে রেখেছে আমার কাছ থেকে। আমার রক্তক্ষরণের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, অভি নেই সেটা আমাকে বলাটা না কি সমীচীন মনে করেননি তারা।
তবে বারবার স্টিচ আর কনকাশনের ধাক্কা কাটিয়ে জেগে উঠেই আমি সবাইকে বলেছি অভি আর আছে কি না সেটা যেন আমাকে জানায়। নেই জানলেও আমি সেটা নিতে পারব। না জানাটা আমি সইতে পারি না সেই ছোটবেলা থেকেই। জেনে কষ্ট পেতেও আমি রাজি আছি, কিন্তু না জেনে ভালো থাকতে আমার ভালো লাগে না।
কে শোনে কার কথা! সবার ভাবনাটা এমন যেন আমি না জানলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। পরের দিন যখন অভিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন আমি ওর মৃতদেহ দেখতে চাইনি। মনে হয়েছিল অভি বেঁচেই থাক আমার মনে, ওকে বিদায় দেব না কখনও। অভি এখন আমার জন্য যতখানি বর্তমান ততখানিই অতীত। ওকে নিয়ে বর্তমান আর অতীতের এই লুকোচুরি কোনো দিনও শেষ হবে কি না জানি না, সময়ই বলে দেবে হয়তো একদিন।
বিশ্বজগতের সব কিছুই তো আদ্যোপান্ত বিরোধিতায় পরিপূর্ণ, নিয়ত দ্বন্দ্ব-বিজড়িত। ক্ষুদ্র আমিত্ব বনাম বিশাল বিশ্বপ্রকৃতি, একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদ এবং বিশ্বনাগরিক হওয়ার প্রচেষ্টা, অর্থহীনতার মাঝে অর্থ, ধর্মের নামে নিরন্তর ধর্মহীনতা, মানবতার লেবাসে আচ্ছন্ন হিংস্র উপনিবেশিকতা আর সাম্র্যাজ্যবাদের হিংস্র থাবা থেকে শুরু করে অপার বিক্ষিপ্ততার মাঝে নিয়মের শক্ত গণ্ডি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের র্যানডম উদ্ভবের মাঝে প্রাকৃতিক নিয়মের বাঁধন, নিয়ম মেনে চলা প্রাকৃতিক নির্বাচনের অন্যতম চালিকাশক্তি র্যানডম মিউটেশন– কীসে নেই এই বিরোধ?
আমরা প্রতিনিয়ত জীবনের অর্থ বানাই, বেঁচে থাকার অর্থ বানাই, মরে যাওয়ারও। আর এটা করতে গিয়ে আমরা শত নিয়মের বেড়ি পরাই, দেশের পর দেশ আক্রমণ করি, মহাদেশ ধরে সভ্যতা লোপাট করে দিয়ে মানবতার গান শোনাই। আমরা শুরু খুঁজি, গন্তব্য খুঁজি, খুঁজি সমাপ্তির সান্ত্বনা। এই নিরন্তর অর্থ খোঁজার আকাঙ্ক্ষাই হয়তো আমাদের প্রজাতির টিকে থাকার, সাতশ কোটি সদস্যের শক্তিশালী দল গড়ে তোলার বিবর্তনীয় অস্ত্র। এই অর্থটা ছাড়া আমাদের প্রজাতির অস্তিত্বটাই মিছে হয়ে যেত হয়তো।
এই নিয়ত অর্থ খোঁজার চরম বিপরীতে আবার অর্থহীন, উদাসীন, র্যানডম এক মহাবিশ্ব আমাদের লেপ্টে থাকে। এই দুই মহা-বিপরীতের সহাবস্থান, চির-অমিমাংসীত দ্বন্দ্ব, তাদের চিরন্তন লুকোচুরি খেলার মধ্যেই সদা অনুরণিত হতে থাকে আমাদের নিমিখের অস্তিত্ব। তাই নিয়েই কত আয়োজন, কত স্বপ্ন দেখা, কত মারামারি, কাটাকাটি, হিংস্রতা ও ভয়াবহতা।
শুধু এই অর্থহীনতার বোধ থেকে আবার সার্ত্রের অস্তিত্ববাদের (একজিস্টেনশিয়ালিজম) ব্যক্তিত্ববাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং অর্থহীনতার বেড়াজালে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আজকের সমাজে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ব্যক্তিবাদ উপেক্ষা করার উপায় নেই আর, তবে সেটা সমষ্টিগত দায়িত্ব বা বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় ‘সমষ্টি’র পারস্পরিক সম্পর্ক, আদান-প্রদান, বিরোধ, উদ্দেশ্য, মিথস্ক্রিয়া উপেক্ষা করে নয়। বর্তমানকে সরলরৈখিকভাবে দেখলে ক্ষণিকের জন্য হয়তো সুনামি তৈরি করা যায়, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী পদধ্বনি তোলা যায় না।
পাশ্চাত্যের মানবতাবাদকে প্রায় এই দোষে দুষ্ট হতে দেখা যায়। ইউরোপ আজকে প্রায় এক হাজার বছরের কাছাকাছি সময় ধরে একদিকে অকল্পনীয় শিক্ষা-সভ্যতা, বিজ্ঞান, দর্শন এবং মানবতার কেন্দ্রভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছে। আবার সমান্তরালভাবেই এর অমানবিক হিংস্রতা, গণহত্যা, মহাদেশ ধরে উজাড় করে দেওয়ার কাহিনিরও তুলনা নেই। তাই এর শুধু একটা দিক নিয়ে মাতাল হয়ে উঠলে যেমন বস্তুনিষ্ঠতা হারায়, তেমনি বড্ড ভুল হয়ে যায় এর অন্য দিকটাতে শুধু ফোকাস করলে।
উদাহরণ হিসেবে আসুন সিরিয়া আর ইরাকের দিকে তাকাই, একে বেছে নিচ্ছি একান্ত সাম্প্রতিক ঘটনা বলেই। এক সময়ের শিক্ষা-সভ্যতার তুঙ্গে বিরাজ করা এই অঞ্চল আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। একদিকে ফাটছে রাশিয়া-আসাদ-ইরানের বোমা, আরেক দিকে আমেরিকা-ইউরোপ-ওয়াহাবি ধ্বজাধারীদের সম্মিলিত আকাশ-যুদ্ধ; ওদিকে আবার বিশাল জায়গা জুড়ে আইসিলের তৈরি ইসলামি খিলাফতের অন্ধকার প্রলয়নৃত্য। আর এর সব কিছুর মাঝে কোনোমতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়ার স্বৈরাচারবিরোধী জাতীয়তাবাদী ছোট্ট গেরিলা গোষ্ঠী। আর এর ফলাফল? মাতৃভূমি থেকে বিচ্যুত, সব-হারিয়ে পৃথিবীর দ্বারে আশ্রয় ভিক্ষাকারী লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকুল। এর দায়িত্ব কে নেবে?
এক দল বলছে একমাত্র সাম্রাজ্যবাদই দায়ী এর জন্য; আরেক দল শুধুই ইসলামি মৌলবাদের ভয়াবহতা এর জন্য দায়ী তাই বলছেন। কেউ আবার এক কাঠি এগিয়ে বলছেন, খোদ ইসলাম ধর্মই দায়ী এর জন্য। দেশি বহু বাম এবং পাশ্চাত্যের লিবারেলদের ভাবখানা এই যেন ইসলামে মৌলবাদের সমস্যার কথা তুললেই জাতিগত বৈষম্যের কাঁচের ঘরটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। ওদিকে আবার অন্ধ ধর্মবিরোধীরা দৃঢ় প্রত্যয়ে বিশ্বাস করেন যে, ইসলাম ধর্ম রাতারাতি আমুলভাবে পালটে গেলে বা উধাও হয়ে গেলেই পৃথিবীর সব সমস্যার যেন সমাধান হয়ে যাবে।
ওবামা-ফরিদ জাকারিয়াকুল এর সমাধান হিসেবে বলেছেন যে, পৃথিবীব্যাপী মুসলমান জনগোষ্ঠী এগিয়ে এলেই না কি এই ইসলামি মৌলবাদের উত্থান রোধ সম্ভব হবে। এরা সবাই বা অনেকেই হয়তো ঠিক, তবে আমি মনে করি এই একতরফা বিশেলষণগুলো আংশিকতার দোষে দুষ্ট।
এরা সবাই তাদের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, বুঝে বা না বুঝে শুধু তাদের সুবিধামতো সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে চান। কারণ সার্বিক বিশ্লেষণে গেলেই তো ঝক্কির শেষ নেই। দায়িত্ব এড়ানো বড্ড কঠিন হয়ে যায়। আজকের এই জটিল পরিস্থিতিকে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মের আলোকে চতুর্মাত্রিকভাবে বিশ্লেষণ না করতে পারলে এর মূলে ঢোকা সম্ভব নয় এবং ইতিহাসে কখনও সেটা হয়নি। তাই বুশ-ট্রাম্পরা অবাক হয়ে যখন প্রশ্ন করেন বাকি পৃথিবী কেন তাদের এত ঘৃণা করে বা মুসলমানেরা যখন বলে ইসলাম শান্তির ধর্ম তখন মনে হয় চিৎকার করে বলি, ইতিহাসের পাতাগুলো একবার পড়ে দেখো দয়া করে।
সিরিয়ার স্বৈরশাসক আসাদ যখন দেশপ্রেমী গেরিলাদের হত্যা করে বা রাশিয়া যখন বলে যে তারা শুধু আইসিল জঙ্গি মারছে, তখন বড্ড অসহায় লাগে নিজেকে। ইজরাইল যখন তার অস্তিত্ব নিয়ে নাকি কান্না কাঁদে বা ইরানের প্রেসিডেন্ট যখন হলোকস্ট মিথ্যা বলে দাবি করে, তখন বড্ড মায়া হয় আমাদের তথাকথিত মানব ‘সভ্যতার’ জন্য। আইসিল যখন বলে তারা মূল কোরানের বাণী অনুসরণ করছে, তখন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে সেই অধিকার কে দিল।
আর এদের পাশবিক খেলার ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা লাখ লাখ আফগান এবং সিরিয়ান শরাণার্থীর সর্বকুলহারানো মুখগুলো দেখলে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
বিংশ শতাব্দীতে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, উপনিবেশগুলোর পতন, মধ্যপ্রাচ্যে তেল আবিষ্কার, কোল্ড ওয়ার, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আমেরিকা-রাশিয়ার উত্থানের প্রেক্ষিতে যদি আধুনিক রাষ্ট্রগুলো তৈরির নাটককে খতিয়ে দেখা হয়, তাহলেই দেখা যাবে যে, মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে সে সময়ে কী রকম সাম্রাজ্যবাদী মরণ-খেলা চালানো হয়েছিল। আজকের ওয়াহাবি আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী নারকীয়তা নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলো এত অস্থির হয়ে উঠছে, অথচ তাদের তো হাতে ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে, পেলে পুষে বড় করেছেন তাদেরই সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো। একের পর এক বাম বা অগ্রসর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোকে ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। যেখানে স্বার্থে মেলেনি সেখানেই নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়ে বসানো হয়েছে পাশ্চাত্যের মনোনীত পুতুল সরকার, রাজা-বাদশাহ, স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী এমনকি ধর্মীয় মৌলবাদী শাসকদের।
চোখের সামনে দেখলাম ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা মিলে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে উৎখাত করে ইজরাইল নামের একটি পুরো রাষ্ট্র ঢুকিয়ে দিল পৃথিবীর ম্যাপে। এতে করে ইউরোপের বহুশতকের ইহুদি নিধনের পাপস্খলন হল বটে, তবে দেশহারা ফিলিস্তিনিদের কী হল তাতে কিন্তু কারও কিছু গেল-এল না।
উপরে বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের ঘটনাগুলো ফাস্ট-ফরওয়ার্ড করে, অসংখ্য রক্তের নদী পেরিয়ে (ফ্রেঞ্চ-ইন্দোচায়না যুদ্ধ, আরব-ইজরাইলি যুদ্ধ, কোরিয়ার যুদ্ধ, ফ্রেঞ্চ-আলজেরিয়ার যুদ্ধ, প্রথম সুদানি গৃহযুদ্ধ, সুয়েজ সঙ্কট, কিউবার বিপ্লব, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৬ দিনের যুদ্ধ, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ– ইউরোপ-আমেরিকার নারীদের যৌন অধিকার আন্দোলন, আমেরিকার কালোদের সমাধিকার আন্দোলন, আমেরিকার পোষা শাহ সরকারের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামি মৌলবাদী বিপ্লবসহ অসংখ্য যুদ্ধ, বিগ্রহ, আন্দোলন– এই লিস্টের তো শেষ নেই) আমরা যদি ইরান ইরাক যুদ্ধে এসে প্লে করি, তাহলে দেখতে পাই যে, তখন ইরাকের স্বৈরাচারি একনায়ক সাদ্দামের সঙ্গে আমেরিকার মহা-দোস্তিকালে চলছে। এই যুদ্ধের সময় সাদ্দামকে শুধু সাহায্যই করেনি অমেরিকা, সংখ্যালঘু কুর্দীদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের সব উপাদানও সরবরাহ করেছিল। তবে অমোঘ নিয়মেই সে দোস্তিও টেকেনি বেশিকাল। ইরাক কুয়েত আক্রমণ করার পরই সেই জোট ভেঙ্গে যায়।
তারপরের দুই দশকের কাহিনি তো আমাদের সবারই জানা। ২০০১ সালে আল কায়দার (এটাও তো সবারই জানা যে আমেরিকাই আল কায়দাকেও অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করেছিল তাদেরকে আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করানোর জন্য। আমার মতে, পৃথিবীতে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তৈরির প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা উচিত এখন থেকে) ৯/১১ আক্রমণের পর ম্যাস-ডিস্ট্রাকশানের অস্ত্রের ধোঁয়া তুলে সম্পূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক কারণে ইরাক আক্রমণ করে আমেরিকা।
তাহলে যারা বলছেন সাম্রাজ্যবাদই দায়ী আজকের অবস্থার জন্য তারা একদম ভুল বলেছেন না, তবে সম্ভবত আংশিক গল্প বলেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন এই যা। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের স্থানীয় রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সেখানে যে ব্যাপ্তিতে ইসলাম ধর্মের উপস্থিতি এবং অন্তঃবিরোধ বিদ্যমান– সেগুলোর উল্লেখ ছাড়া এই আলোচনা শুধু অসম্পূর্ণই নয়, তাতে চরম ত্রুটি এবং অসততা থেকে যায়।
এখন দেখুন , ‘আমরা সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের সব দোষ’– এই বলে মাতম করতে পারি, কিন্তু তাতে এই বাস্তবতাগুলো মিথ্যে হয়ে যায় না যে, ওয়াহাবি মতবাদ তৈরি করতে কোনো সাম্রাজ্যবাদ লাগেনি। খোদ আরবের ‘উর্বর’ ভূমিতে এক ‘উর্বর মস্তিষ্ক’ আরব মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের মাথা থেকেই এর যাত্রা শুরু ১৮ শ দশকে। তার শহরের শাসকেরা তাকে বহিষ্কার করলে তিনি পাশের শহরের শাসক সৌদ গোত্রের মোহাম্মদ ইবনে সাউদের কাছে আশ্রয় নেন। চুক্তি হয় যে, সৌদ ওয়াহাবের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবেন আর ওয়াহাব তার বিনিময়ে সৌদের ক্ষমতা এবং গরিমার গুণগান করে তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করবেন।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আবার সেই রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের বিবাহ। যাই বলেন না বলেন, ইতিহাসজুড়ে এদের ভালোবাসা কিন্তু রোমিও জুলিয়েট বা লাইলি মজনুর প্রেমকাহিনিও হার মানায়। তাদের শত্রু শুধু অমুসলিমরাই ছিল না বরং সুফি, শিয়া, অটোমান এমনকি ওয়াহাবি নিয়ম না-মানা সুন্নি মুসলমানদের বিরুদ্ধেও তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে।
জানি না কজন মুসলমান এটা জানেন যে, এই ওয়াহাবিপন্থীদের হাতে সেই ১৮০১-১৮০২ সালের কারবালা-তাইফের যুদ্ধ থেকে শুরু করে এখনকার আইসিলের যুদ্ধ পর্যন্ত অমুসলিমদের চেয়ে হাজারো গুণ বেশি মুসলিম জনগোষ্ঠী কচুকাটা হয়েছেন যাদের বেশিরভাগই আবার সুন্নি মুসলমান। ওদের বর্বরতায় দেশ বাড়ি সব হারিয়ে শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে লাখ লাখ মুসলমান জনগোষ্ঠী।
সেই গত আড়াইশ বছর ধরেই বিভিন্ন চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ওয়াহাবি এবং সৌদদের মেলবন্ধন কিন্তু এখনও অটুট। রাজনীতি এবং ধর্মের প্রেম-বন্ধন বলে না কথা! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অটোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটলে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আরব উপদ্বীপের সব গোত্র একীভূত করে সৌদ রাজবংশ সৌদি আরব প্রতিষ্ঠা করে। সামান্য কৃষিকাজ এবং হজ্বের আয়েই চলত এই গরিব দেশটি।
তারপর, ১৯৩৮ সালে তেল আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভালোবাসা, বিশ্ব রাজনীতি, ওয়াহাবি মতবাদের প্রভাব এবং বিস্তার থেকে শুরু করে সব খেলার চেহারাই বদলে গেল রাতারাতি। এতদিন শুধু মধ্যযুগীয় ওয়াহাবি-শরিয়া আইনে ডুবে থাকলেও এবার কালো সোনায় ডুবে গেল তারা, আর সেই সঙ্গে মুসলমান দেশগুলোতে পূর্ণোদ্যমে শুরু হল ওয়াহাবি মাদ্রাসা, মতবাদ এবং মূল্যবোধের প্রসার।
ওদিকে আবার মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে শিয়া এবং সুন্নি, ওয়াহাবি এবং অন্যান্য ইসলামি মতবাদের (তার মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়দের বলি হওয়া তো আছেই) মধ্যে ঘেন্না, কাইজ্জা, মারামারি, খুনাখুনিও গভীরতর হল। ওদিকে আবার পুঁজিবাদ/সাম্রাজ্যবাদের হর্তাকর্তারা কমিউনিজম নামক জুজুর ভয়ে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো দমন করে তাদের পছন্দমতো স্বৈরশাসকদের বসাতে শুরু করল। সে ইতিহাসে এখন আর ঢুকছি না এখানে, এ নিয়ে লিখতে গেলে একটা পুরো বই লিখে ফেলা যায়।
মৌলবাদী, রাজা-বাদশাহ, স্বৈরশাসক কিছুতেই আপত্তি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর স্বার্থের নৌকায় ঝড় তোলে। মিডিয়ার অনবরত প্রচারে আমাদের হয়তো মনে হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের বুকে রাতারাতি গজিয়ে গেছে আইসিলের খেলাফত। কিন্তু সাম্প্রতিককালেই আইসিলের জন্মের ইতিহাস একটু গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যায় ঘটনাগুলো কত ভয়াবহভাবে জটপাকানো (তারপরও মাকড়সার জালের মতোই একটা জটিল স্কিম আছে এর মধ্যে যা একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়), কত রকমের পরস্পরবিরোধী স্বার্থ কাজ করেছে এখানে এবং একে অপরের সঙ্গে তারা কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করার পর তাদের ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত মালেকি সরকার ইরাকে শিয়া-সুন্নি বিভেদ নতুন করে চাঙ্গা করে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যে এই জাতিশত্রুতা নতুন কিছু নয়। দুদিন আগেই মুসলমানদের পবিত্রভূমি সৌদি আরবে যে ৪৭ জনের গণ-শিরচ্ছেদ করা হয়েছে, তার মধ্যে একজন প্রভাবশালী শিয়া মওলানাও ছিলেন। আজ আবার খবরে দেখলাম. এ কারণে তেহরানে সৌদি দূতাবাস ভাঙচুরের পাশাপাশি ইরানের প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি সৌদিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে, সুন্নি মুসলমানদের রাজত্বের উপর অচিরেই এক ‘স্বর্গীয় প্রতিশোধ’ নেওয়া হবে।
ইরাক শিয়াদের পবিত্রভূমি, তবে তারা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও প্রায় হাজার বছরে প্রথমবারের মতো তারা ক্ষমতায় আসে মালিকি সরকারের আমলে। ২০০৬ সালে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাতে শিয়াদের সঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠ সুন্নি মুসলমান, খ্রিস্টান এবং কুর্দীদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে। সাদ্দাম হোসেন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে যে সুন্নি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারা শিয়া এবং কুর্দী উভয় সম্প্রদায়ের উপরেই পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরপরই মালিকি সরকারও সুন্নিদের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। মালিকি ঐতিহাসিক কারণেই আরব সুন্নিদের সন্দেহের চোখে দেখতেন। সাধারণ সুন্নি থেকে শুরু করে তাদের রাজনৈতিক নেতাদের উপর দমন নিপীড়ন চলতে থাকে; সুন্নি প্রতিবাদ প্রতিরোধে ঢালাওভাবে গ্রেফতার শুরু হয়; এমনকি সুন্নি ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক আল হাসেমিকেও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০০৭-২০০৮ সালে সুন্নি গোত্রের সদস্যরা একসঙ্গে হয়ে আনবার প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় আল কায়দাকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মালিকি সরকার এই বিশাল সুন্নি বাহিনিকে পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে চাকরি না দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয়। এদের অনেকেই পরবর্তীতে আইসিলে যোগ দেয়। এসব কারণেই সুন্নিদের অনেকেই আইসিলের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে শুরু করে, আর আইসিলও ইরাকের এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ কাজে লাগিয়ে ক্রমশ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে।
আইসিলের প্রাথমিক ফান্ডিংএর বেশিরভাগ নাকি এসেছিল সৌদি কোটিপতিদের কাছ থেকে। যদিও তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো দখল করার পরে আইসিল নিজেই শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠে। আর সে তেল অবাধে বিক্রি হতে থাকে তুরস্ক এবং সিরিয়ার ব্ল্যাক মার্কেটে।তুরস্কের সরকার তাদের অগ্রযাত্রায় কোনো রকম বাধা তো দেয়নি বরং আইসিল অবাধে তুরস্কের সীমান্ত পারাপার করতে থাকে। তুরস্ক আইসিলকে তাদের দেশের ভিতরের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার লক্ষ্যেই এটা করেছিল বলে ধারণা করা হয়।
ওদিকে সৌদি আরবসহ অন্যান্য সুন্নি আরব দেশগুলো, ইসরায়েল এবং আমেরিকার কাছেও আইসিল একটা বড় সুযোগ বলে পরিগণিত হয়। তারা আইসিলকে ব্যবহার করে সিরিয়া ও ইরানের শিয়া সরকার এবং হিজবুল্লাহ বাহিনীকে কোনঠাসা করতে পারবে বলে আশা করতে থাকে । এ কারণেই তারাও ওদের অবাধে বেড়ে উঠতে দেয়। এমনকি সিরিয়ার খোদ আসাদও এই সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করার চেয়ে তার সরকারবিরোধী বিদ্রোহী দলগুলোকে দমন করতেই বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। সত্যি কথা বলতে কী, আইসিলের অস্তিত্ব আসাদের জন্য প্রথমে একটা আশীর্বাদ হিসেবেই দেখা দিয়েছিল। পাশ্চাত্যের আসাদবিরোধী সরকারগুলোকে সে এর মাধ্যমেই দেখাতে পারবে যে সে ক্ষমতায় না থাকলে সিরিয়া আইসিলের মতো ইসলামি মৌলবাদীদের খপ্পরে পড়ে যাবে। তাই তাদের উচিত আসাদ সরকারকেই ক্ষমতায় রাখা।
আইসিল পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের জন্য একটু বেশি মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ালে আমেরিকা তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে নামকাওয়াস্তে তাদের বিরুদ্ধে আকাশ যুদ্ধ শুরু করে। যে আমেরিকা কয়েক দিনের মধ্যেই ইরাক বা লিবিয়ার মতো দেশ দখল করে নিতে পারে, তারাই এক বছর ধরে যুদ্ধ করে আইসিলের মতো এক ওয়াহাবি হাতুড়ে সন্ত্রাসী বাহিনীকে দমন করতে ব্যর্থ হয়।
এই বিশ্বনাটকে রাশিয়ার মতো আরেক পরাশক্তির কোনো ভূমিকা থাকবে না তা তো আর হতে পারে না। শত্রুর শত্রু যেহেতু আমার বন্ধু, তাই হিসাবমতো ইরানের মৌলবাদী সরকার এবং সিরিয়ার স্বৈরশাসকেরাও রাশিয়ার পরম বন্ধু হিসেবেই পরিচিত। কয়েক মাস আগে রাশিয়া আসাদ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে যুদ্ধেও যোগদান করে। স্ট্র্যাটিজিক কারণেই রাশিয়ার প্রতি অনুগত এই দুই সরকারকে ক্ষমতায় রাখা খুবই দরকার তাদের। দুর্মূখেরা বলে থাকে যে, রুশ বোমারু বিমান এবং অস্ত্রশস্ত্র না কি আইসিলের সন্ত্রাসীদের মারার চেয়ে আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদেরই হত্যা করে চলছে অনেক বেশি হারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এক আইসিলের জন্মকেও এক কথায় শুধু সাম্রাজ্যবাদ বা শুধু ধর্মের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ওয়াহাবিজমের কাল্টের অস্তিত্ব আরবের মাটিতেই যে গাঁথা ছিল সেটা তো আগেই দেখেছি। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই, ইসলাম ধর্ম এবং কুরানের বিভিন্ন ধরনের আক্ষরিক ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করেই আল-কায়দা, বোকা হারাম বা আইসিলের উদ্ভব।
এখন কথা হচ্ছে, হাজারো ধর্মীয় কাল্টই তো জন্মায় প্রতিনিয়ত কত জায়গায়, তাদের ক’টা টিকে থাকে? তাদের উদ্ভব, বিস্তার এবং টিকে থাকাটা নির্ভর করে আভ্যন্তরীনভাবে ওই সমাজে ওই মতবাদের অস্তিত্বের (এভেইলিবিলিটি) উপর, সেই সমাজের জনগণের গঠন, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি ফ্যক্টরের উপর। আর সেই সঙ্গে থাকে বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মিথষ্ক্রিয়া (আগেই যেমন দেখেছি)। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম বিশ্বের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
প্রশ্ন করতেই হয়, এত কাল্ট ধ্বংস হয়ে গেল ওয়াহাবিজম ধ্বংস হল না কেন? ফরিদ জাকারিয়ারা যখন বলে যে, মুসলমানদের ভিতর থেকেই পরিবর্তন আনতে হবে, সেটাও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। খ্রিস্টান ধর্মের নামেও হাজারো যুদ্ধ হয়েছে, তাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ও একজন আরেকজনকে মেরেছে, এক সময় এই ধর্মের নামেই উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকায় লাখ লাখ স্থানীয় অধিবাসীদের হত্যা করা হয়েছে, জোর করে লাখ লাখ স্থানীয়দের ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।
মধ্যযুগীয় ডাইনি পুড়ানো, জ্ঞান-বিজ্ঞানবিরোধী পোপের অন্ধ শাসনে জর্জরিত খ্রিস্টধর্মের পরিবর্তনও এসেছিল খ্রিস্টানদের ভিতর থেকে। এবং সেখানেও সে সময়ের ইউরোপের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও এর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
তাই আমাদের দেশে ইসলামি জঙ্গীরা নাস্তিক মারায় বিরতি দিয়ে যখন শিয়াদের মসজিদে আক্রমণ করে, তখন মুসলমানদেরই এগিয়ে এসে বলতে হবে যে, তারা ইসলামের এই ভার্সনে বিশ্বাস করে না। নাস্তিকদের কতল করার দাবিতে বা নবীর ছবি বা কার্টুন আঁকার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে যেভাবে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মুসলমান রাস্তায় নেমে আসে, তেমনিভাবেই অগ্রসর ইসলামি গবেষক, মওলানা এবং সাধারণ মুসলমানদেরও এর প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে।
আইসিল যখন একাধারে শিয়া সুন্নি থেকে শুরু করে অমুসলিমদের উপর মধ্যযুগীয় সন্ত্রাস চালায় তখন কেন পৃথিবীব্যাপী লাখ লাখ মুসলমান বেরিয়ে এসে সেটার প্রতিবাদ জানান না? আজ আমাদের আমেরিকার ইরাক আক্রমণের বিরুদ্ধে যেমন সোচ্চার হওয়া উচিত, নারী এবং সমকামীদের সমানাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত, বিশ্বব্যাপী নারী-শিশু পাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা উচিত, গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা বা ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সমর্থন জানানো উচিত– ঠিক একইভাবে উচিত সোচ্চার হওয়া বোকা হারাম, আল কায়দা, আইসিল, আনসারুল্লাহদের ঘৃণ্য বর্বরতার বিরুদ্ধে।
অতীত এবং বর্তমানের ঘটনাগুলোর পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায় যে, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম বা আইসিল ইসলাম নয়’ বলে দায়িত্ব এড়িয়ে হিন্দি সিনেমা দেখতে বসে গেলে আইসিলের চাপাতি বা একে ৪৭ আপনাদের ঘাড়েই তাক করা হবে। ইয়াজিদি মেয়েদের মতো আপনাদের বৌ-মেয়ে-বোনদের যৌনদাসী বানানো হবে বা নাইজেরিয়ার চিবক গ্রামের মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অপরাধে খোলা বাজারে বিক্রি করা হবে।
যারা ধর্মকে একটু হলেও সুস্থভাবে টিকিয়ে রাখতে চান এবং যারা একেই একমাত্র অনর্থের মূল বলে মনে করেন, তাদের দুইপক্ষেরই কি আজ বোঝা দরকার নয় যে, সব ধর্ম সৃষ্টির পিছনেই একটা জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক কারণসহ বহু ঐতিহাসিক কারণ কাজ করেছে। যুগে যুগে মানুষ ধর্ম সৃষ্টি করেছে, তাকে বদলেছে, ভেঙেছে, বর্জন করেছে তাদেরই প্রয়োজনে। ধর্ম সৃষ্টি এবং ধর্ম থেকে মুক্তি দুটোই দীর্ঘ পথযাত্রার ফসল। ধর্ম যেমন মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে বহুবার বহুভাবে, তেমনি আবার টিকে থাকার প্রয়োজনে তার নিজেরই সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছে বারবার।
আমাদের এই মানব সভ্যতার কোথায় কোন অংশে ভয়াবহ হিংস্রতা বিদ্বেষের ছড়াছড়ি ছিল না? একটু ভালো করে সভ্যতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, সব সভ্যতা সব কালেই ভয়াবহ উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ধর্ম এবং শোষণের রাজনীতির ঘৃণ্য আঁতাত তে নতুন ঘটনা নয়। মানুষের ইতিহাসে অবিচার, অনাচার, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, খুন জখম, মারামারি কখন ছিল না? সেটা সমাজ বা ধর্মের নামেই হোক আর বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দাসপ্রথা, সামন্তপ্রথা, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের নামেই হোক। পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী তো কখনও মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়নি, নারীদের সমানাধিকারের কথা লিখিত ইতিহাসের কোন পাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে সেটা পর্যন্ত জানি না আমরা।
প্রথা বদলেছে, ধর্ম বদলেছে, শোষণ রাজনীতি অর্থনীতির প্রেক্ষাপট এবং ধরন বদলেছে। কিন্তু অন্যায় অবিচারের ইতিহাস তো বদলায়নি। আর যেটা বদলায়নি সেটা হচ্ছে মানুষের বিরামহীন সংগ্রামের ইতিহাস।
সভ্যতা সব সময় দুপা এগিয়েছি তো এক পা পিছিয়েছি। তাহলে এখনকার পৃথিবীর ইতিহাসই বা অন্য কিছু হবে কেন? সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নিপীড়ন, অন্ধ ধর্মীয় প্রলয়নাচন, বেকারত্ব, আইডিন্টিটি ক্রাইসিস, নারী-যৌন-ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ আজকের পৃথিবীর সব অবিচারের বিরুদ্ধে কি মুসলমান জনগোষ্ঠির হাতে একটাই সমাধান খোলা আছে? টিনএজ মুসলমান ছেলেমেয়েদের আইসিলের বর্বরদের হাতে সঁপে দেওয়া? আরেক অন্ধকারাচ্ছন্ন, মানবিক গুণাবলীর ছিটেফোটা বিবর্জিত মধ্যযুগীয় এক বর্বরতায় ডুবে গিয়ে আত্মহুতি দেওয়া? ইতিহাসের কোন পর্বে মানব সভ্যতা এক লাফে এতটা পিছিয়েছে?
যুগে যুগে সব ধরনের অন্ধকারের বিরুদ্ধ্বে প্রবল বিক্রমে এগিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো কি আমাদের হৃদয়বৃত্তিতে নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে? একবিংশ শতাব্দীর অগ্রসর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নারী পুরুষের সম্মিলিত অধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম কি আর আমাদের চেতনায় সাড়া দেয় না?
ইতিহাস কিন্তু বলে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। মানুষের ইতিহাস একটা জট-পাকানো গোলকধাঁধা। শেক্সপিয়ার কোথায় যেন বলেছিলেন সত্যিকারের চেতনাগুলো মেলাতে আসুন আমরা যেন কোনো বাধাই গ্রাহ্য না করি। সত্যিকারের মানবিক চেতনাগুলো মেলাতে হলে আজকের সমাজের জটিল ডায়নামিক্সগুলো বোঝা, মানুষের মুক্তির চিন্তাগুলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং সেই অনুযায়ী সক্রিয় ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আর কী-ই-বা উপায় খোলা আছে আমাদের হাতে?
এক অভিজিৎ গেছেন তো কি হয়েছে? শতশত অভিজিৎ এগিয়ে আসবে, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
—————————- ইঙ্কলাব জিন্দাবাদ।
অসাধারণ লেখা এটি। কষ্টকে ছাপিয়ে মুক্তচিন্তার দ্বীপ জ্বালানোর সাহস যোগাবে লেখাটি। বন্যা আপার কলমের এই স্পুরণ যেন কখনো না থামে।
ধর্ম মানুষকে অসংরক্ষিত করে। ধর্ম মানুষকে সুরক্ষা দেয় না। দিতে পারে না। ধর্মীয় পরিচয় মানুষকে অসহায় করে তোলে। এর প্রমাণ আজ ধর্মের নামে বিশ্ব জুড়ে অস্বস্তি। একমত —-
লেখাটি খুব ভালো লেগেছে।
লেখাটি bdnews24.com এ আগেই পড়েছি। প্রথম কয়েকটি প্যারা ঝাপসা চোখে পড়েছি। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পা্রিনি। পরের প্যারাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে যাদের পড়ে বুঝা উচিত তারা কি পড়বে? ব্যাখ্যাগুলো কি মানবে! তারা তো “রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের “ বিয়ে দিতেই কৌশলী হচ্ছে।
বন্যা আহমেদ, আপনার মানসিক শক্তিকে আমি স্যালুট জানাই। অভিজিৎ রায়ের জন্য আমার যা লাগে তা থেকে সহজেই অনুভব করতে পারি আপনার কেমন লাগে।
যাহোক, আপনার লেখা অব্যাহত থাকুক।
@ বন্যা আহমেদ ,
এত স্বল্প পরিসরে এত বড় বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য লেখিকাকে ধন্যবাদ । তথাকথিত উদার গণতন্ত্রের মধ্যে যে ভণ্ডামি আপনি তুলে ধরেছেন সেটা ভাল লাগল । আজকের মৌলবাদীদের বাড় বাড়ন্তের জন্য পুঁজিবাদের অস্বাস্থ্যকর বুনো প্রতিযোগিতাও অনেকটা দায়ী । বিশ্ব পুঁজিবাদ যদি আরও একটু মানবিক হতে পারত তা হলে মানুষ অনেকটা তার উপর ভরসা করতে পারত । যে সব মৌলবাদীরা সাধারণ মানুষকে কল্পিত ধর্ম নির্ভর সভ্যতার স্বপ্ন দেখাচ্ছে তারাও এটা সহজে করতে পারত না যদি পুঁজিবাদ যে সংস্কৃতি ও সভ্যতা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে সেটা মানবিক হত । ইউরোপ এর কথা জানি না কিন্তু এই ভারতীয় উপমহাদেশে যে ভাবে অপসংস্কৃতি গ্রাস করতে পেরেছে তার জন্য ভোগবাদী বাজার সংস্কৃতি অনেকটা দায়ী । আর এই দিকটা যখন ধর্মের গুরুরা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে কল্পিত ধর্ম আশ্রিত সভ্যতার স্বপ্ন দেখায় তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষ সে দিকে আকৃষ্ট হয়
আপনার বিশ্লেষণধর্মী লেখাটা খুবই ভাল লাগলো। খন্ডচিত্র না দেখে পূর্ণচিত্র দেখার এই প্রয়াসে জটিল সমস্যাটিকে বোঝা সহজ হয়েছে। সংগ্রহে রাখার মত এবং চিন্তায় সহায়তা করার মত একটি মূল্যবান লেখা। অনেক সাধুবাদ।
সংকট ও বিয়োগের মাঝে আপনার দৃঢ়তা আমাকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করে। সত্যকে আবিষ্কারের তৃপ্তি হারাণোর ব্যাথাকে সহনীয় করুক, এই কামনা থাকলো।
একেই বলে মুক্তমনের আলোয় লেখা নির্মোহ বিশ্লেষণ। কষ্টগুলোকে ছাপিয়ে নতুন বছরের এমনি অনবদ্য উপহারের জন্য ধন্যবাদ বন্যা।
বেশ অনেকদিন পর আবার পড়তে পেলাম ঠাসবুননের দারুন একটা লেখা। তথ্যপূর্ণ আর গভীর পর্য্যবেক্ষণ-নির্ভর এবং ভাবনার অনেক অনেক জানালা খুলে দেবার মত রচনা। এই লেখাটি সংগ্রহে রাখবার মত।
চতুর আর সুবিধাবাদীরা সব সময়েই অন্যদের ঠকিয়ে নিজেদের জিতিয়েছে। অন্যদিকে বুদ্ধিমান উদার ভালমানুষেরা অন্যদের আলো দেখাতে আর বাঁচাতে গিয়ে মরেছে চতুরের চক্রান্তে। অথচ মরে গিয়েও বেঁচে থেকেছে বাতিঘরের মত। আলো জ্বেলে পথ দেখিয়ে চলেছে আজো। এরাই মুক্তমনের নির্মোহ মানুষ। এরা নিজে না নিয়ে দ্রুত অন্যদেরকে যদ্দুর পারে দিয়ে দেয়। পাঁড় জাতীয়তাবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, ছদ্মবেশী ধর্মবাদী অথবা সুবাধাবাদী যে বাদীই হোক না কেন, ওদেরকে সব সময়েই হারিয়ে নিরীহ ভালোমানুষের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে মুক্তমনের মানুষ, অভি অনন্তের মত আরো অনেক ভালো মানুষ। এদের ক্ষয় নেই। নতুন বছরে শুধু একটাই চাওয়া, মুক্ত মনের মানুষ যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলে, তারা যেন নিরাপদ থাকে, ভালো থাকে।
সর্ব প্রথম যে মুক্তমনার লেখা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয় তা ছিল বন্যা আহমেদ আপনার লেখা। আমি জানতামনা বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির মানুষরা লেখালেখি করে, মুক্তমনা ব্লগও যে আছে এটাও আমার জানা ছিলনা কিন্তু “বিবর্তনের পথ ধরে” সেই পথটা আপনারই দেখানো। তারপর অভিজিৎরায় সহ অনেকের লেখার সাথেই পরিচিত হলাম। ২০১৫ র রক্তস্নাত বছরটা পিছে ফেলে মনে হয়না কোন শুভ নববর্ষের আর দেখা পাব। কিন্তু শুভ-অশুভ এইসব ধারনা ছাড়াও কিছু দায় থেকেই যায়। সমমনা মানুষদের রক্তের দায়, তাদের আত্মত্যাগের দায়, যে জনগোষ্ঠীতে বড় হয়েছি সেই জনগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি দায়। আর এইসব দায়ই স্থবির হয়ে বসে থাকতে দেয়না। আপনার লেখা এখনও উৎসাহিত করে, নিরুদ্যম হয়ে পড়তে দেয়না, এই লেখাটা পড়তে পড়তে সারাবিশ্বের অন্ধকার চিত্রটা দেখতে দেখতেও মনে হয় সব শেষ হয়ে যায়নি, শেষ হয়ে যায়না, যুদ্ধটা চলতেই থাকে। নিজের কম্পমান কেরোসিনের কুপি বাতিটা নিয়ে এই অন্ধকারে পথ চলার সাহসটা যে পাই, তা আপনাকে দেখেই। আরো লিখতে থাকুন, ভালো থাকুন।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা, দিদি। আপনার কলম যেন না থামে। আপনাকে এখন দ্বিগুণ লিখতে হবে। পাশে আছি। সব সময় থাকবো।
বন্যাদিকে তার অসাধারণ লেখাটির জন্য ধন্যবাদ দেবার ধৃষ্টতা আমার নেই। শুধু বলতে চাই যেভাবে তিনি বর্তমান পৃথিবীতে চলমান ধংসলীলার সবগুলোদিক ছুঁয়ে গেলেন তা এককথায় অনবদ্য।
উনার মত করে সমস্ত মুক্তমনা, প্রগতিশীল ব্যক্তি যদি এভাবে ভাবতে পারেন তাহলে আমার ধারণা বর্তমানে প্রগতিশীল, মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনস্ক বিভিন্ন মানুষ ও সংগঠনের মধ্যে যে এক বিভেদ বা ভুল বোঝার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তা অনেকাংশেই দূর হবে।
অথবা-
কারা ইসলামকে সব সমস্যার মূল বা একমাত্র অনর্থের কারণ মনে করেন, আর তাদের সংখ্যাই বা কতো হবে জানিনা। তবে এইটুকু জানি ধর্মবাদী সমাজে ঘরের পারিবারিক অশান্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সমস্যাবলিতে প্রায় সর্বত্রই ধর্মের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
বলা হয়, পশ্চিমা রাজনীতির মোড়লেরা তথা সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিশ্বজুড়ে ইসলামী জঙ্গীবাদী সৃষ্টির মূল হোতা। তারা যদি সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিত তাহলে জঙ্গীরা এতো অস্ত্র পায় কোথায়? কথাটা সত্য, এরা অস্ত্র বিক্রী করে তাদের আর্থিক স্বার্থে। তবে প্রশ্ন থাকে সেই মরণাস্ত্রের খরিদদার বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিশেষ একটি ধর্মাবলম্বী হবে কেন? ওরা অস্ত্র খরিদ করে কোন স্বার্থে, যে অস্ত্র দিয়ে নিরপরাধ নিরীহ সাধারন মানুষকে মারে নিজেরাও মরে? আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই অস্ত্রটারও তো কোন হদিস মেলেনা, রামদা,চাপাতি নিশ্চয়ই পশ্চিম থেকে সরবরাহ করা হয় না।
অভিজিতের লেখা থেকে কিছু উদৃতি তোলে দিচ্ছি-
বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে ইসলাম বা কোরান যদিও সকল অনর্থের মূল উৎস নয় তবে অবশ্যই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের মূল উৎস।
:good:
আপনাকেও নববর্ষের শুভেচ্ছা।
প্রথম দুটি প্যারা যখন পড়ছিলাম মনের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসলো। কন্ট্রোল করতে পারলাম না।
ভাল থাকুন সবসময়। শুভকামনা রইলো।
শুভ নবর্বষ বন্যাপা। দুঃস্বপ্নের ঘোরে শুরু করা ২০১৫ সালটার দিকে শুরু থেকেই তাকিয়ে ছিলাম না, প্রিয় মানুষ হারিয়ে শুরু করা প্রথম বছর ছিলো আমার ২০১৫। সেই দুঃস্বপ্নের ঘোরেই যে প্রিয় অভিদাকে হারিয়ে বছরের সূচনা হবে তা ভাবি নাই, কখনও ভাবি নাই, অভিদা, আপনি রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকবেন আমাদের বাংলাদেশে। অসম্ভব সম্ভব করেছে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে। ২০১৫ পার করে ২০১৬ তে এসে আজ অভিদা নাই, অনন্ত দা নেই, নেই বাবু, নীল, নেই জাগৃতি প্রকাশনির বাইরে পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে থাকা দীপন ভাই। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, তাও ভালো আপনাকে হারাতেও হলো না, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলাম এই মর্মান্তিক একটা বাক্যে ‘ভালো’ বিশেষণ কিছুতেই যায় না…
ডাকা মেডিক্যাল মর্গের কেচিগেট থেকে উঁকি দিয়ে অভিদাকে দেখেছিলাম শেষবার, আমার বিশ্বাস হয় নি ঐটা আমাদের অভিদা। আমাদের প্রিয় অভিদা। জসীমুদ্দিন রাহমানির মতো মানুষ নামের কলংক অভিজিৎ দার কোনো লেখা কোনো কালেও পড়েছে বলে মনে হয় নি, কিন্তু হত্যার হুকুম দিতে তার গলা কাঁপেনি একটুও, হাত কাঁপেনি খুনের দলের এই মানুষটাকে পেছন থেকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করতে। মনে হয়, মানুষ আসলেই ভালো, মানুষের মধ্যে ভালোত্ব আছে বিবর্তীয় কারণেই কিন্তু ধর্মের পক্ষেই সম্ভব ভালো মানুষটাকে দিয়ে বর্বরতম কাজ করিয়ে নেওয়া, না জেনে, না বুঝে শুধু ঘৃণার বশে মানুষ হত্যা করা। আর সেই ধর্মের পক্ষেই আজ বিশ্বজুড়ে মাতামাতি, ধর্ম না থাকলে আমরা নাকি শ্যাষ!
আপনার সাথে একমত কিন্তু ইসলামে মৌলবাদের সমস্যা ঠিক এভাবে আমি বলতে দ্বিধা হয়। কারণ ইসলাম একটি সেট অফ আইডিয়া, জীবন বিধান, ইসলাম কথা বলে নারী স্বাধীনতা নিয়ে, সমকামীতা নাস্তিকদের নিয়ে, রাজনীতি, সমাজ নিয়ে, ইহকাল থেকে পরকালের অসংখ্য বিষয় নিয়ে। ইসলামের মূল যদি শুধু কোরানও ধরি, প্রত্যকের মুসলামনই বিশ্বাস করে কোরআন পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, কোরাআনে হয়তো সব বিষয় নিয়ে কথা বলা নেই, কিন্তু জিহাদ, বিধর্মী কতল, ঘৃণা, বর্তমানের সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না এমন আইডিয়াগুলোকে আছে সেগুলো আলাদা করে তো কোরআনে বিশ্বাস করার উপায় নেই। কেউ নিজেকে মুসলমান মনে করলে তাকে অবধারিত ভাবেই এই বিষয়গুলোকে মেনে নিতে হয়, ইসলামের মূল কোরআনের এটা গ্রহণ করবো, ঐটা গ্রহণ করবো এটা তো সম্ভব না। এই মূলে বিশ্বাসী মৌলবাদী মানুষের সংখ্যা তো সীমাহীন।
তবে ব্যাপার হলো, একটা বই থাকা স্বত্তেও বেশিরভাগই কখনও নিজ ভাষায় অর্থ সহ কোরান পড়ে দেখে নাই, সবাই যারা যার মতো করে বাক্য, আয়াত ব্যবহার করে নিজের সার্থ হাসিল করে। আইএস কোরআন থেকে আয়াত খুজে মানুষো হত্যা করে, আত্মঘাতি হামলা করে, প্যারিসের রাস্তায় মানুষ হত্যা করে, আল-কায়েদা আমাদের অভিদা-অনন্তকে জবাই করে, আবার ‘তথাকথিত’ মডারেট মুসলিমরা ‘শান্তির বাণী’ খুজে বের করে, তারা সহিহ শান্তিপ্রিয় মুসলিম দাবী করে নিজেদের আর আইএসকে বলে দেয় ইসরাঈলি এজেন্ট।
অথচ হওয়া দরকার ছিলো, ইসলামের এই আইডিয়াগুলোর স্পষ্ট বিরোধীতা করা। স্পষ্ট করে বলা যে, এগুলো আমাদের ধর্মে আছে, এইগুলো ১৪০০ বছর আগের জন্য প্রযোজ্য, সমাজ বাস্তবতা এখন অনেক বদলেছে এখন এই আইডিয়াগুলো বর্বর, আমরা এই আইডিয়াগুলোর বিরোধীতা করছি। মুসলিম বিশ্ব থেকেই এই জাগরণের দরকার। কিন্তু কই না, উলট আমরা দেখছি- আপনি যেমন বললেন-
ঠিক তাই, শার্লির এবদোর হামলার পরে আমরা ইসলামী বিশ্ব থেকে শুনি, আমাদের নবীকে নিয়ে কেনো কটাক্ষ করেছে এই রব, শুনি না একথা আমাদের নবীও একজন মানুষ, তাকে কটাক্ষ করায় তার কিছুই যায় আসে না, তার পথে কাটা বিছিয়ে রাখলেও তার কিছু যায় আসতো না। ঠিক তেমনি ভাবে, অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর শুনি, উনি নাকি নবীকে অপমান করেছিলেন, মুসলিম বিশ্ব থেকে শুনি না, অপমান করেছে তো কি হয়েছে, তার জন্য মেরে ফেলতে হবে নাকি? শুনি না একথা যে- আমাদের ধর্মের এমন করলে মানুষ হত্যার কথা আছে, আমরা এর বিরোধীতা করছি। আমরা এমন নিয়ম মানি না’।
ঠিক তেমনি ভাবে যখন প্যারিসে আক্রমণ হয়, তখনও দেখি ইসলামিস্টরা স্লোগান দেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম শান্তির ধর্ম, আইএসএস সহি ইসলাম নয়, আইএস ইসরাইলি ষড়যন্ত্র, এর সাথে সহি ইসলামের কোনো সম্পর্কে নেই। সম্পর্ক অবশ্যই আছে, সম্পর্ক আছে বলেই জিহাদিরা হুর আর বেহেশতের লোভে নিরপরাধ মানুষ হত্যায় লিপ্ত, ইস্রাইলের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে না। অবশ্যই আইএস সৃষ্টির পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর অবদান রয়েছে, কিন্তু যে মানুষগুলো আইএস এর হয়ে যুদ্ধ করছে, আনসার বাংলা হয়ে লেখক প্রকাশক হত্যা করছে তারা কি পশ্চিমাদের মদদে এমন করছে? মোটেও না, তারা কোরআন হাদীস নিয়ে মদদ দিয়েই এমন করছে।
ইসলামী বিশ্বকে তাই ডিনায়ালের উর্দ্ধে উঠে, ইসলাম শান্তির ধর্ম শুধু মুখে না বলে কাজের মাধ্যমে দেখাতে হবে, দেখাতে হবে প্রতিবাদের মাধ্যমে। নবীর কার্টূন আকার পরে যদি মুসলমানরা রাস্তায় প্রতিবাদে নামতে পারে তাহলে আইএস এর হামলার প্রতিবাদে কেনো নামবে না? কি তাদের আটকে রেখেছে? তাদের ধর্ম? অবশ্যই তাই। সেই ধর্মকে সেই আইডিয়াগুলোকেও আমাদের সমালোচনা করতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করার মধ্যেই ৮০ ভাগ সমাধান নিহিত, আমাদের মুসলিম বিশ্বর উচিত দোষ চাপানোর খেলা বন্ধ করে ইসলাম ধর্ম সংস্কারে মন দেওয়া।
[… দ্বিতীয় অংশে শেষ]
[…]
আমাদের বেশি কিছু করার নেই, আবার আছেও। মুক্তচিন্তার কথা বলে, আরও মানুষের কাছে সেগুলো পৌঁছানোর মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষ যেনো স্বাধীন, ইরফরমড চিন্তা করতে পারে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য অবদান রাখাই এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, একই সাথে প্রাণনাশীও। আজ না হোক, এমন করে শত বছর পরেও হলেও পরিবর্তন আসবে, পরিবর্তন এসেছেও। ইতিহাস তাই বলে। আর একারণেই হয়তো যারা মুক্তচিন্তার কথা বলে, বাক-স্বাধীনতার কথা বলে, ধর্মহীনতার কথা বলে তাদের উপর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর এতো রাগ ক্ষোভ। তাদের মিথ্যা জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায় বলেই হয়তো।
ইসলাম ধর্মের আক্ষরিক অনুসরণকারীদের কথা বাদ দিলাম, যাদেরকে মডারেট বলে ধরা হয় সেই তাদের পক্ষেও কি কোনোদিন এই ধর্মের সংস্কার চাওয়া সম্ভব? এমনকি যারা নামকাওয়াস্তে বা নামেমাত্র ধর্ম পালন করেন তাদের পক্ষে?
কারণ ‘মহাগ্রন্থ’ কোরান ত সকল যুগের সকল মানুষের জন্য সত্য এবং অপরিবর্তনশীল। আর ধর্মের অন্য কিছু মানুক বা না মানুক এই মডারেট গোষ্ঠী বা নামেমাত্র মানেওয়ালারাও এই কথাটি ভীষণভাবে মানেন বা বিশ্বাস করেন। ক্ষেত্রবিশেষে বিজ্ঞানকেও নিজেদের পক্ষে টেনে আনেন।
তাই এধরণের কোন আলোচনা শুরু হলেই তারা ত্যানা প্যাচানো শুরু করে দেন অথবা অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিক বিষয়ের অবতারণা করেন। এতেও কাজ না হলে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ঘৃণা পোষণ শুরু করে দেন।
তাই আমার মনে হয় ধর্মের ভিত্তি যতদিন দূর্বল না হচ্ছে বা এর প্রয়োজনীয়তা ফুরোচ্ছে ততদিন at least ইসলাম ধর্মের সংস্কার আশা করা ঠিক নয়। তবে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সংগ্রাম বা লেখনীর মাধ্যমে সেই সময়কে আমরা অবশ্যই আরো কাছে নিয়ে আসতে পারি।