10649577_1557532594480891_3221638920301066927_n

জীবন ট্রেনে কোলকাতা থেকে চেন্নাই যাচ্ছিলাম করোমন্ডল এক্সপ্রেসে। ভিসাখাপত্তনম বন্দরের সুবিশাল স্টেশনে ট্রেন থামতেই ১-কেজির কাজু বাদামের প্যাকেট নিয়ে হাজির হলো ছোট ছেলে আর গ্রামীণ নারীরা। বাংলাদেশের বাজারে ৮০০/৯০০ টাকা কেজি দরের কাজুর দাম চাইলো মাত্র ১০০ টাকা। কিছুটা তাজ্জ্বব বনে গেলাম এতো কম দাম দেখে। ১০০ টাকায় এক প্যাকেট কিনে খুব খুশি হলাম সস্তা দেখে। ট্রেন ছাড়ার পর দরজার পাশেই দেখি পোড়খাওয়া শরীরের নারী আর তার শিশু বিক্রি করছে ৮০ রুপিতে প্রতি কেজি কাজু। ২০ টাকা ঠকাতে আফসোস করি মনে মনে। ভাব জমাই ‘পুডিকা’ নামের সাউথের এ নারীর সাথে। ৪ দিন পর চেন্নাই থেকে ফেরার পথে ১০-কেজি কাজু নেব এমন কথা দিলে মোবাইল নম্বর দিয়ে পুডিকা বলে, যেন ট্রেন ‘মুলুপাকা” স্টেশনে এলেই কল দেই তাকে। তখন কাজু নিয়ে ভিসাখাপত্তনম বন্দরে হাজির হবে সে।

আলাপে জানতে পারি, কাচা এ কাজু সরাসরি “কিষাণ” থেকে সংগ্র্রহ করে পুডিকা আর ১১ বছরের বালকপুত্র, তাদের গা থেকে ১০/১২ কিমি দুরে চাষ হয় এ কাজুর। তারা তা রোদে সামান্য শুকিয়ে ১ কেজির প্যাকেট করে, তাতে কেজি প্রতি ১০ রুপি থাকে তাদের। কাজুর সিজন না থাকলে অন্য জিনিস ট্রেনে বিক্রি করে মা বেটা। গিছগিছে কালো চামড়া আর সাদা দাতের ছেলেটা হিন্দি জানেনা বলে নামটা বলাতেও ভুলে গেছি আমি। কোলকাতা ফেরার পথে পুডিকা আর তার ছেলে থেকে ১০-কেজি কাজু নিয়ে শুকিয়ে ঘরে রাখবো বা স্বজনদের গিফট দেব এমন চিন্তন নিয়ে চেন্নাই পৌঁছি। চেন্নাই মানে মাদ্রাজ সমুদ্র সৈকতে অভিনব এক নৌকা দেখে মন ভরে গেলো। ফাঁক ফাঁক কাঠ দিয়ে বানানো নৌকাতে পানি ভরা থাকে। ঢেউ এলে পানি এফোড় ওফোড় করে চলে যায়, কখনো ডোবেনা, পানি ফেলতে হয়না জেলেদের। এমন নৌকো বাঙলাদেশে না থাকাতে জেলে দ্বীপাঞ্চলের জন্মসূত্রে স্বজন মানুষ হিসেবে নিজেকে আর পুরো জেলেদের অপরাধি মনে হয় আমার।

এক সময় ফিরতি বিশাল স্বর্পিল ট্রেনে যাত্রা করি কোলকাতার পথে ২৬/২৭ ঘন্টার জার্নি। রাত দুটোর দিকে ‘মুলুপাকা” স্টেশনে ট্রেন এলে বুক পকেট থেকে সেল বের করি ‘পুডিকা’কে ফোন দিতে। ৩-টার দিকে ভিসাখাপত্তনম স্টেশনে পৌঁছবে এ ট্রেন। হঠাৎ কি এক চিন্তনে আমাকে কল দিতে বাঁধা দেয় পুডিকাকে। সে হয়তো ঘুমুচ্ছে এখন তার ১১ বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে। মাত্র ১০ কেজি কাজু কিনতে এতো রাতে ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসবো এ স্টেশনে তাকে? তার চেয়ে ঘুমাক পুডিকা আর তার ছেলে এ বিশাল তারার ক্ষীয়মান আলোর পৃথিবীতে। শান্তির ঘুম ঘুমাক এ সংগ্রামী নারী!

ভিসাখাপত্তনম ট্রেন থামলে জানালা দিয়ে বিশাল প্রাটফর্ম দেখতে থাকি আমি। গরুর দুধের গরম চা কিনে খাই ১০ রুপিতে, হ্যা ঘুমুচ্ছে পুডিকারা কোথাও নেই সে। এক সময় হৃদকাঁপানো হুইসেল দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করে। আকস্মিক জানালা দিয়ে ষ্পষ্ট দেখতে পাই আমি দূরে, ‘পুডিকা’ আর তার ঘিচঘিচে কালো ছেলে অনেকগুলো কাজুর প্যাকেট নিয়ে দৌঁড়ুচ্ছে চলমান ট্রেনটি ধরার জন্যে! কিন্তু ধাবমান ইলেকট্রিক ট্রেনের গতি তখন মাঝবয়সি নারী পুডিকার ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, পুডিকা কি ধরতে পারবে এ ট্রেন? সে কি ঘুমায় না এ শান্তির পৃথিবীতে? সারারাত জেগে থাকে বাঙলাদেশ ভারতের পুডিকা নারীরা?

আমার ইচ্ছে করে পুডিকাকে ফোন না দিয়ে যে অপরাধ করেছি তার জন্য নিজেকে ক্ষমা যেন না করি কখনো। নিজের চিন্তন আর বোধকে ধিক্কার দেই আমি। ১০ কেজি কাজু কেন কিনলাম না পুডিকা নামীয় রাতজাগা এ মেয়েটি থেকে? সে কি জানতো এ ট্রেনে আমি আছি? ১০০ রুপি লাভ হতো তার এ কাজু আমাকে দিতে পারলে। হঠাৎ পকেটা রাখা ১০ রুপির ১০টি নোট পুডিকাকে দিতে প্রচন্ড ইচ্ছে হয় আমার, নিজের পকেট থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসবো বলে রাখা ঝকঝকে ১০ রুপির ১০টি নোট বাতাসে উড়িয়ে দেই আমি, যেন তা পুডিকার হাতে গিয়ে পরে। পরবে কি তা কখনো তার হাতে? যদিও তাকে দেখতে পাচ্ছি আমি ঝাপসা প্লাটফরমে দৌঁড়ুচ্ছে সে তার ছেলেকে নিয়ে দ্রুতি ট্রেনটি ধরতে।

নীলাভ রাতের নীল জ্যোৎস্নার আলোতে জানালায় মুখ দেই আমি। আমার প্রতিটা শিরা-উপশিরার রক্তে হঠাৎ পুডিকা নামের এ কুরূপা পৌঢ়া নারী ভেসে ওঠে। যে সারারাত দৌঁড়ুতে থাকে নানা স্টেশনে স্টেশনে জীবন যুদ্ধের মহড়ায়। চলমান ট্রেনের ঘুমন্ত রাতের জ্যোৎস্না গায়ে মাখতে পারিনা আমি। চাঁদনি এসে চুপিচুপি কানেকানে আমায় বলে বলে, এ ভাদর জ্যোৎস্না আর আসবে না তোর জীবনে, তার চেয়ে নেমে যা এখানে ‘ডাউরি’ স্টেশনে, যা পুডিকার কাছে, কাজু বিক্রেতা হ তুই ।

হঠাৎ আমি জয় গোস্বামীর “পাগলী, তোমার সঙ্গে” কবিতার পাগলির সাথে পুডিকার এক চমকপ্রদ মিল খুঁজে পাই নীল জ্যোৎস্নার আলো আঁধারে। এক ঘোরের মাঝে নিশুতি রাতে জয় গোস্বামী আমায় শোনাতে থাকে তাঁর—-

পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।
মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান
লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।
এক হাতে উপায় করব, দুহাতে উড়িয়ে দেবে তুমি
রেস খেলব জুয়া ধরব ধারে কাটাব সহস্র রকম
লটারি, তোমার সঙ্গে ধনলক্ষ্মী জীবন কাটাব
লটারি, তোমার সঙ্গে মেঘধন কাটাব জীবন।
দেখতে দেখতে পুজো আসবে, দুনিয়া চিত্‍কার করবে সেল
দোকানে দোকানে খুঁজব রূপসাগরে অরূপরতন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজোসংখ্যা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে রিডাকশনে কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে কাঁচা প্রুফ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ফুলপেজ কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে আউট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লে হালুয়া কাটাব জীবন।
কবিত্ব ফুড়ুত্‍ করবে, পিছু পিছু ছুটব না হা করে
বাড়ি ফিরে লিখে ফেলব বড়ো গল্প উপন্যাসোপম
পাগলী, তোমার সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।
নতুন মেয়ের সঙ্গে দেখা করব লুকিয়ে চুরিয়ে
ধরা পড়ব তোমার হাতে, বাড়ি ফিরে হেনস্তা চরম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে হেস্তনেস্ত কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে পুজা বেদি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মধুমালা কাটাব জীবন।
দোঁহে মিলে টিভি দেখব, হাত দেখাতে যাব জ্যোতিষীকে
একুশটা উপোস থাকবে, ছাব্বিশটা ব্রত উদযাপন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভাড়া বাড়ি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিজ ফ্ল্যাট কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যাওড়াফুলি জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে শ্যামনগর কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে রেল রোকো জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে লেট স্লিপ কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণা জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষান কাটাব জীবন।
সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে রামরাজ্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে প্রজাতন্ত্রী কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ছাল চামড়া জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দাঁতে দাঁত কাটাব জীবন।
এর গায়ে কনুই মারব রাস্তা করব ওকে ধাক্কা দিয়ে
এটা ভাঙলে ওটা গড়ব, ঢেউ খেলব দু দশ কদম
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোঝড় জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘ভোর ভয়োঁ’ কাটাব জীবন।