বহু রক্তনদী শেষে, আজ স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালীর দুহাজার বছরের ইতিহাসের সব থেকে গৌরবোজ্জল অধ্যায়। বাঙালী বন্দুক ধরতে পারে, ট্যাঙ্কের সামনে মাথা না নুইয়ে গেরিলা যুদ্ধে যেতে পারে, ব্রিজ ব্লাস্ট করতে পারে নিজেকে স্বাধীন করতে- এক জাতির দীর্ঘ কাপুরষতার ইতিহাসে সব থেকে বড় ব্যতিক্রম এই মুক্তিযুদ্ধ- তাদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য, একজন বাঙালী হিসাবে আমি গর্বিত-যদিও আমি বাংলাদেশী নই।
আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিঊ নিয়েছি। শুনেছি তাদের কাহিনী। কেউ কেউ নৌকায় কাটিয়েদিয়েছেন গোটা ছমাস। মাছ ধরার নৌকাতে করেই গেরিলা এনকাউন্টার করেছেন খান সেনাদের বিরুদ্ধে। কাউকে কাউকে আবার জলা ধানি জমিতে রাতের পর রাত কাটাতে হয়েছে।
মার্চ থেকে দীর্ঘ নভেম্বর -ভারত যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে, খান সেনাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা।
আফশোষ এই যে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি কোন মুসলিম দেশ। এমনকি অনেক মুসলিম দেশ পাকিস্থানকে বাংলাদেশ নিধনে মৌলিক সমর্থন ও জানিয়েছিল ইসলামিক উম্মাহর স্বার্থে ( ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া)। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের মুসলিমদের কাছে আস্তে আস্তে তাদের “মুসলমান” পরিচয়টাই বড় হয়ে ওঠে। অথচ তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধটা ছিল, মুসলিম পরিচয় থেকে বেরিয়ে বাঙালীর পরিচয়ের মুক্তি ঘটানো।
বাংলাদেশের এই মুসলিম পরিচয় এবং সেখান থেকে মৌলবাদি একটা দেশে রূপান্তরের পেছনে ভারতের ভূমিকা আছে। ভারত বাংলাদেশের দাবি দাওয়াগুলিকে কখনোই সহানুভূতির সাথে দেখেনি। বাংলাদেশের বিস্তীর্ন অঞ্চল আজ হয় খরা না হলে বন্যা কবলিত। বাংলাদেশকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে ভারত কিছুই করে নি। ফলে ভারত বিরোধি মনোভাব ক্রমশ ইসলামিক জাতিয়তাবাদের রূপ নিয়েছে। এখন তা মৌলবাদ ছাড়া কিছু না।
বাঙালী হিসাবে, আমার সব থেকে বড় দুঃখ এই যে ধর্মের নামে বাঙালী জাতিকে দ্বিখন্দডিত করা হয়েছে। অথচ, আমদের বাঙালীদের নিজস্ব ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা সবকিছুই ছিল-আউল বাউলের গানে , কবিতায়। কিন্ত আমরা ঐতিহাসিক ভাবে হয়ে গেলাম হয় হিন্দু বা মুসলিম-অথচ এর কোনটাই আমাদের অতীত না-কোনটাই বাংলার ধর্ম না। নিজেদের মধ্যে ভাতৃদ্বন্দে আমরা বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করেছি।
এর একটা বড় কারন এই যে , আমরা আমাদের আউল বাউল সহজিয়ার আধ্যাত্মিক ট্রাডিশনকে নিজেদের করে নিতে পারি নি । হাজার বছরের গোলামির ফলে প্রভুদের ধর্মের আলখাল্লায় নিজেকে চাপিয়ে, বাঙালী হিন্দু মুসলমান সাজতে চেয়েছে। একটু শিক্ষিত হবার পরে লেনিনকে এনেছে। আলটিমেট ফল একটা ব্যর্থ জাতি। পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা-অথচ যেহেতু অধিকাংশ লোক ভিখিরি, অর্থনীতি বলতে কিছু নেই-বাংলাভাষার অন্তর্জলি যাত্রা সময়ের অপেক্ষা।
বাঙালীকে তার অতীত অনুসন্ধান করে বুঝতে হবে- তার অতীত গৌরবের- তার ভিত্তি আউল বাউলের সহজিয়া গান-যা মাটি আর মানুষের সন্ধান করে-ভাতৃদাঙ্গায় ইন্ধন যোগায় না-শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে না- জাতিভেদ মানে না- সাম্যের গান গাই আর মধুর রসে সিঞ্চিত করে জীবন। সেই অতীত হিন্দু মুসলমানের না। সেই অতীত সহজিয়া সাধনার যার শ্রেষ্ঠ ধারক এবং বাহক রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং লালন ফকির।
একদিন এই কাঁটাতারের বেড়াকে ভাংতেই হবে-দুই বাংলা মিশে এক বৃহত্তর শক্তিশালী বাংলা তৈরী হৌক-এটাই আমি চাই। কিন্ত তার জন্যে বাঙালীকে হিন্দু মুসলমানের পরিচয় থেকে মুক্তি পেতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে, আমাদের বাঙালীর সহজিয়া ধর্ম বিদেশী ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের থেকে অনেক বেশী উন্নত-তাই চাই না আমাদের হিন্দু বা ইসলামিক ঐতিহ্য। বৈদিক এবং ইসলামের আগমন বাঙালীজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে। তার থেকে মুক্তি দরকার।
আমরা বাঙালীরা যতক্ষণ ব্লগ পড়ি ততক্ষণই হয়তো বলি যে আমরা এক ও অখণ্ড বাঙালী জাতীয়তায় বিশ্বাসী ; কিন্তু বাস্তবে আমরা বাঙালীরা এক হওয়ার জন্য কিছুই করছি না! আমিও বাঙালীর অখণ্ড জাতীয়তায় বিশ্বাস করি, আমিও চাই বাংলার বুকের কাঁটা-তার উপড়ে বঙ্গোপসাগরে জলাঞ্জলি দেওয়া হেক। কিন্তু আমরা যা এই বাঙালী জাতীয়তায় বিশ্বাসী তারা একজোট হবো কীভাবে?
বিজয়ের শুভেচ্ছা সবাইকে।
লেখককে ধন্যবাদ, আমার মনে হয় আপনি ঠিক দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন। বাংলাদেশের সুবিধার দিক হলো আমাদের জাকজমকের ঐতিহ্য নেই। যা আছে তা আদিম সরল জীবনের উত্তরাধিকার, খেটে খাওয়া মানুষের ইতিহাস। বাংলা সাহিত্য যেমন খুব বেশি রাজরাজড়া আর রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি, সাধারন মানুষের কোলেই পুষ্টি পেয়েছে তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও সেই আউল, বাউলের সহজ পন্থার দিকেই। একটা জাতি তাই এই কিছু নেই এর অবস্থান থেকেই নিজের অন্তর্গত শ্রমে, অধ্যাবসায়ে নিজেকে গড়ে তুলবে, শক্তি খুঁজবে নিজের ভেতরেই। কিন্তু তা না করে নেশা ধরানো ধর্মীয় অবস্তব, শেকড়হীন একটা অহমিকাকে আমাদের ঐতিহ্য বলে চালানোর অপচেষ্টাতেই আমরা জাতি হিসেবে দিকভ্রান্ত হচ্ছি।
আপনার লেখায় প্রধান সমস্যাটাই উঠে এসেছে। কিন্তু দাদা আমার একটা প্রশ্ন যেই ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেছিল স্বাধীনতার পর তাদের এরকম বৈরিতামূলক আচরণের কারণ কি? আপনি ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে একক বৃহত্তর বাঙালি জাতি গঠনের আশা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও তাই চাই। কিন্তু আপনার মনে হয় না এর মাধ্যমে সারা উপমহাদেশে একটা প্রবল ঝাঁকুনির সৃষ্টি হবে? কেন না এই উপমহাদেশ ভাগই হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। বাংলাও ভাগ হয়েছিল হিন্দু মুসলমান পরিচয়ের ভিত্তিতে, কারো মনে তখন ‘আমরা বাঙালি’ এই আবেগ কাজ করেনি। আমরা যদি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ হই তাহলে ভারত পাকিস্তানের জন্মের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে না? তখন ভারতীয় উপমহাদেশ আরও ভাগ হয়ে যাবে না কি, কারণ এই অঞ্চলে বহু জাতির বাস? এইখানে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।