মানুষের সাথে আগুনের একটা মিল আছে। আগুন যেমন শুধুমাত্র কোনো বস্তু না, বা শক্তি না, বরং একটা চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া। মানুষও তাই। আজ থেকে কুড়ি বছর আগের আপনার শরীরের কোনো কোষ, কোনো নিউরনই এখন আর আপনার মধ্যে নেই। তবুও শৈশবের স্মৃতিগুলো আছে। এবং ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবলে সেগুলো অন্য কারো জীবন মনে হয় না। বরং মনে হয় নিজের জীবনই। মানুষও তাই একটা চলমান রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যার মাঝে খাবার হিসাবে দাহ্য বস্তু ঢুকছে, অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সেগুলো শক্তি দিচ্ছে। এবং এক সময় খরচ হয়ে যাওয়া জ্বালানি ফিরে যাচ্ছে পরিবেশে। একটা আগুন থেকে অন্য আরো অনেক আগুন ধরানো যায়। একজন মানুষের থেকেও অনেক মানুষের সৃষ্টি হতে পারে। আগুন আলো দেয় তাপ দেয়। মানব শরীরও তাপ উৎপন্ন করে। তবে মানুষের আলোটা ভিন্ন প্রকৃতির। মানুষের রাসায়নিক প্রক্রিয়াটা আরেকটু জটিল।

তবে আগুনের সাথে মূল পার্থক্যটা স্মৃতিতে। একটা মোমের আগুন যখন একটা বুনসেন বার্নার বা, গ্যাসের চুলায় ধরানো হয় সেটা তার অতীতের অবস্থা আর মনে রাখে না। আগুনের প্রকৃতিটা (যেমন রং, তাপমাত্রা, তড়িৎচৌম্বকীয় স্পেক্ট্রাম) স্রেফ সেটা ‘কাকে পোড়াচ্ছে’ তার উপর নির্ভর করে। মানুষের বেলায় অবশ্য তা না। সে তার খাদ্যাভ্যাস আমূল বদলে ফেললেও, তার শৈশব স্মৃতি, তার ভাবনার জগৎ সেসব বদলে যায় না। অবশ্য কিছু সাইকাডেলিক ড্রাগ আছে যা ভাবনাচিন্তায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কিন্তু সেগুলো আমাদেরকে ভিন্ন মানুষে পরিণত করে না। তাই মানব অস্তিত্বের জন্য মানুষের স্মৃতি গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাদের মস্তিষ্কে ধারণ করা স্মৃতিই হোক কিংবা হোক ডিএনএ তে ধারণ করা বংশগতীয় নকশা। তবে স্রেফ এই মস্তিষ্কের স্মৃতি আর ডিএনএর নকশাই মানুষকে মানুষ করে না। কারণ অমনতো যে কোনো প্রাণীরই আছে। মানুষ, বিশেষ করে আধুনিক মানুষ এখন আর শরীরের গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। তার অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে তাই আরো অনেক কিছুকেই বিবেচনা করতে হয়। যেমন কোনো মানুষের যদি একটা নোটখাতা থাকে, যেখানে সে তার ভাবনাগুলো, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রোজেক্টগুলো, ছোটোখাট পর্যবেক্ষণ, জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো টুকে রাখে। তাহলে এক সময় এই খাতাটাও তার অস্তিত্বের একটা অংশ হয়ে পড়বে। এর সব কিছু যেহেতু তার মাথায় থাকবে না। সেহেতু খাতাটা হঠাৎ হারিয়ে ফেললে, সে নিজের একটা অংশকেই হারিয়ে ফেলেছে বোধ করবে। কারণ ওই খাতাটা থাকলে সে যা কিছু করত, করতে পারত, তার অনেক কিছুই আর করা হবে না। স্রেফ বিস্মৃত হবার কারণেই। এযুগে আমাদের স্মার্টফোন, দৈনন্দিন ব্যবহারের কম্পিউটার, কিংবা প্রিয় গিটারখানা, এসবও তাই আমাদের অস্তিত্বেরই একটা অংশ। যার যে কোনোটা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলেই আমরা আগে যা ছিলাম তার চেয়ে ‘কম কিছু’ হয়ে পড়ি। অর্থাৎ আমাদের কিছু বস্তুগত নির্ভরশীলতা, যেগুলো আমাদের আইডিয়া ও স্মৃতিকে ধারণ ও প্রকাশ করতে অপরিহার্য্য সেগুলোও আমাদের একটা অংশই। তাই ‘আমি’ বলতে স্রেফ আমার শরীরের অস্থি-মাংস-কোষ-কলা ভাবলেই হবে না। আমির গণ্ডিতে এগুলোও এসে যাবে। কিন্তু এখানেই কি শেষ?

আমাকে যদি আমার এইসব জাগতিক এক্সটেনশন সহকারেই এটা নির্জন দ্বীপে, সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখা হয় তাহলেও কি আমি আমি থাকবো? আর এই প্রশ্নের উত্তরেই আগুনের সাথে মানুষের আরেকটা পার্থক্য পাওয়া যায়। তা হলো, আগুন নামক রাসায়নিক প্রক্রিয়াটা আর দশটা আগুনের উপর নির্ভরশীল নয়। যেখানে মানুষ নামক রাসায়নিক প্রক্রিয়াটার অন্য মানুষ ছাড়া অসম্পূর্ণ। অন্যান্য মানুষ যাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব, সখ্য, আত্মীয়তা, ভালোবাসা তাদেরকে ছাড়া আমি আর আমি থাকি কী করে? তিন বছর বয়স্ক আয়লান কুর্দি নামক যে শরনার্থী শিশুটি ভেসে উঠেছিলো তুরস্কের কোনো এক সৈকতে; তার বাবা তার সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যাওয়া শিশুটির মা ও ভাইকে কবর দিতে ফিরে গেল যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়ায়। তাকে যখন ইউরোপে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় তখন সে বলেছিলো, Now I don’t want anything, what was precious is gone. একজন মানুষের অস্তিত্বের জন্য তার সম্পর্কগুলো ঠিক এমনই অপরিহার্য্য। এমন প্রতিটি সম্পর্কের বিচ্ছেদেও আমরা আগের চেয়ে কম মানুষ হয়ে উঠি। এবং হয়তো এক সময় স্রেফ অর্থহীন রাসায়নিক প্রক্রিয়াতে পরিণত হই।

অভিজিৎ’দা কে নিয়ে লিখতে গিয়ে এসব কেন ভাবছি? কারণ সেই ফেব্রুয়ারীর কালো রাতটির পর থেকে আমার নিজের অস্তিত্বেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ খোয়া গেছে বলে মনে হচ্ছে। অভিজিৎ’দা কে হারানোর পর শুধু একজন স্নেহময় বড় ভাইকেই হারাইনি, হারিয়েছি একজন শিক্ষক, মেণ্টর, একজন সহযাত্রীকে। মনে পড়ে পরিচয় হবার আগে, অন্য একটা ব্লগে লেখালিখি করতাম আমরা। একদিন নিউমার্কেটে গিয়ে দেখি অভিজিৎ রায়ের লেখা বই। বই যারা লেখে তারা তখন আমার কাছে অন্য জগতের মানুষ। আমি ভাবছিলাম, এই গত রাতে যে আমার একটা লেখায় প্রসংশা করলো, সেই অভিজিৎ রায় এত চমৎকার একটা বই লিখেছেন! বইটার নাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রি’। সে সময় পকেটে টাকা থাকতো না বলে হল থেকে গিয়ে নিউমার্কেটের সুন্দর সুন্দর বইগুলোর উপর হাতবুলিয়ে আসতাম। হাত বুলিয়ে এলাম অভিজিৎ দার বইটির উপরেও। একই প্লাটফর্মে আমরা লেখালিখি করি, ভাবতেই গর্বে বুকের ছাতি ছয় ইঞ্চি ফুলে গিয়েছিলো। তারপর মুক্তমনায় লেখালিখি শুরু। স্টিফেন হকিং এর গ্র্যান্ড ডিজাইন বইটা অনুবাদ করতে গিয়ে পরিভাষা নিয়ে দিনরাত অভিজিৎ’দা কে জ্বালানো। কখনো নিজেরাই বানিয়ে ফেলতাম নতুন পরিভাষা। এইসব যোগাযোগের মধ্য দিয়েই যেন আমরা হয়ে গেলাম চিরকালের পরিচিত দু’জন মানুষ। বইটা প্রকাশের জন্যও অভিজিৎ’দা দেশবিদেশে প্রকাশকদের কাছে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। আমার বাংলাদেশী প্রকাশকের অপেশাদারিত্বে শেষ-মেস সেটা ভেস্তে যায়। সান্তনা ছিলো, বই টা তো আছে-ই মুক্তমনায়। আর অভিজিৎ’দার সঙ্গে এমন আরো কত শত প্রোজেক্ট করা যাবে! সেই অভিজিৎ’দা আর নেই।

এই যে সপ্তাখানেক আগে স্টিফেন হকিং ব্লাক হোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স নিয়ে নতুন তত্ত্ব দিলেন, আর দু’দিন আগেই আবিষ্কার হলো মনুষ্য প্রজাতির আরেক দলের ফসিল। অভিজিৎ’দা থাকলে কী চমৎকার সব প্রবন্ধ লিখে আমাদের সামনে তুলে ধরতেন এইসব আবিষ্কারের খুটিনাটি। কই এমন সমৃদ্ধ প্রবন্ধ কেউ তো লিখলো না এবার। এই শূন্যস্থান বুকে বাজছে খুব।

নিজের সাথে কীভাবে যে লড়াই করেছি গত ক’টা মাস। যে মানুষটা স্রেফ আলো ছড়িয়েই গেলেন, তাকে কি নৃশংস ভাবে হত্যা করলো কিছু অন্ধকারের কীট। শতশত মানুষ, পুলিশ, প্রশাসন সবার চোখের সামনেই। কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ চিৎকার করে বলেনি, ‘থামো’ ! বন্যা’পার সেই রক্তাক্ত ছবিগুলো দূর হচ্ছিলো না মন থেকে কিছুতেই। তবে নৃশংসতার চেয়েও বেশি প্রভাবিত হয়েছিলাম মানুষের উপর আস্থা টলে যাওয়ায়। সে সময় সাধারণ মানুষের যে উল্লাসধ্বনি বয়ে এনেছিলো ফেসবুক আর নানান রকম ওয়েব পোর্টাল সেসব দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। এরা কি দেখতে পায় না, কী ঘটেছে পাকিস্তানে, আফগানিস্তানে, ইরাক, সিরিয়ায়? জঙ্গিবাদ সে সব স্থান থেকে মুছে দিচ্ছে মানবতার শেষ চিহ্নটুকু। এরাও কি সেইসব দিনকেই চাইছে বাংলাদেশে? কলম/কীবোর্ড হাতে অভিজিৎ রায়ের চেয়ে, কালাশানিকভ হাতে কোনো জঙ্গিই কি এদের কাছে বেশি কাম্য? কে এদেরকে বোঝাবে? ইরান-ইরাক-আফগানিস্তানেও হয়তো প্রগতিশীল কিছু মানুষ একসময় ছিলো। তাদেরকে ধ্বংস করেই তো আজ মধ্যযুগীয় বর্বরতার চাষবাস সেখানে। আমাদেরও কি এভাবে হেরে যেতে হবে? হারিয়ে যেতে হবে? এইসব হতাশাই ঘিরে ধরছিলো চারিদিক থেকে।

তারপর এক সময় হতাশাটা দূর হয়ে গেল। হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে এখন ক্রিটিক্যালি ভাবতে শিখছে। ফেসবুক-ইউটিউব সহ নানাম প্লাটফর্মে গড়ে উঠছে বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনার গ্রুপ। নতুনরা বের করছে পত্রিকা, ইউটিউব চ্যানেল, আয়োজন করছে পাঠচক্র, লেখালিখির উৎসব, অনুবাদ প্রতিযোগিতাসহ হাজারো কর্মকাণ্ড। স্কুল কলেজে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা তাদের ভাবনার গভীরতা দিয়ে হর হামেশাই অবাক করে দিচ্ছে আমাদের। এটা সত্যি যে, ক্ষমতাধরদের পৃষ্টপোষকতায় ধর্মান্ধতার চাষবাসও বাড়ছে এদেশে। কিন্তু শেষমেষ সত্যেরই জয় হবে। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, অভিজিৎ রায়ের আগুন এখন জ্বলছে হাজারো কিশোরের-কিশোরীর মনে। মানুষ তার বইগুলো পড়ার জন্য খুঁজছে। শারীরিক অভিজিৎ রায় এর শেষ হলেও, যে অনুরণন তিনি তুলেছেন তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে হাজার মনে। হাজার মানুষের অস্তিত্বের একটা অংশ হয়ে পড়ছেন অভিজিৎ রায়। আমাদের অভিজিৎ’দা।