বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের “সন্ধানীতে” নিয়মিত রক্তদাতা হিসেবে এই অধমের নাম তালিকাভুক্ত ছিল। ১৯৯২-৯৩ সালের কথা, তখন চক্ষুদান বিষয়েও ব্যাপক সচেতনতা চলছে চারিদিকে। মরণোত্তর চক্ষুদান! বিষয়টি বেশ রোমান্টিক বলে মনে হত আমার। আমি তো তিন পায়ে খাড়া! চক্ষুদান করেই ফেলেছি আর কি; আমার মৃত্যুর পরে আমি এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পাব,যার চোখে আলো ছিলনা তার চোখে আলো হয়ে এই পৃথিবীতে আরো অনেক বছর বেঁচে থাকার আনন্দ-লোভ, আর এর পেছনে মহৎ হয়ে ওঠার বাসনা সেতো রোমাঞ্চিত হবার মতই বিষয় ! তো একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্প করতে আসা ‘সন্ধানী’র ভাইদের কাছে জানতে চাইলাম আমি মরণোত্তর চোখ দান করতে চাই, দয়া করে বলবেন আমাকে কী করতে হবে? ওরা আমার কথা শুনে তো মহাখুশি। আমাকে বলল, আমি যেন মেডিকেল কলেজে গিয়ে কথা বলি। সেখানে কি সব প্রশাসনিক ব্যাপার স্যাপার রয়েছে তা ওরা বিস্তারিত জানেনা। আমি ওদের কথামতো বেশ একদিন সত্যিই চলে গেলাম মেডিকেল কলেজে। গিয়ে যার সাথে দেখা করার কথা তার কাছে প্রকৃত অর্থে আমাকে একটি ইন্টারভিউ দিতে হল, এবং সেটা শেষ করে কার্যতঃ আমি শূন্য ফলাফল নিয়ে আশাহত হয়ে বিরস বদনেই ক্যাম্পাসে ফিরে এসেছিলাম। ইন্টারভিউটি ছিল এরকম,
প্রশ্নকর্তাঃ আপনার নাম?
আমিঃ জ্বী , সালমা ইয়াসমিন
প্রশ্নকর্তাঃ কী করা হয়?
আমিঃ ছাত্র
প্রশ্নকর্তাঃ কোথায় পড়া হয়?
আমিঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, মাস্টার্স পড়ছি সমাজবিজ্ঞানে;
প্রশ্নকর্তাঃ হুম! (এবার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, গলার স্বরে গম্ভিরতা এবং আগের তূলনায় মনোযোগের আধিক্য নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ), তারপরে আবার প্রশ্ন, কেন চোখ দান করতে চান?
আমিঃ (খুব সরল জবাব), এটা তো মানব কল্যাণ, আমি মরে গিয়ে যদি কোন মানুষের কাজে লাগি, সেটা মন্দ কী? ভাল কাজ নয় ? তাই……
প্রশ্নকর্তাঃ আপনার বাড়ি কোথায় ? মানে স্থায়ী ঠিকানা কি? আমি সবসময়ই খুব বিব্রত বোধ করি এই প্রশ্ন কেউ আমাকে করলে। মেয়েদের নিজের বাড়ি বলে, স্থায়ী ঠিকানা বলে কিছু থাকে কিনা তখনো আমার জানা ছিলনা; তবুও জন্মের ঋণ বলে কথা! পৈত্রিক সূত্রে যে ঠিকানা অর্জিত হয়েছে তাইতো বলতে হবে। বললাম সেটা ………বাগেরহাট জেলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে আমার আবাস স্থল। ওটাকেই আপাতত আপনি আমার স্থায়ী নিবাস বলতে পারেন।
প্রশ্নকর্তাঃ এবার একটু ভ্রু কুঁচকে … ওহ! এতো আপনার স্থায়ী ঠিকানা নয়, আপনি তো এক্ষণও অবিবাহিতা। আপনার স্থায়ী ঠিকানা তো পরিবর্তন হবে। আপনার স্বামীর বাড়িই আপনার স্থায়ী ঠিকানা হবে (মনে মনে একটু হাসি পেল এই নতুন তথ্যটি শুনে,মনে হল আগে শুনেছি কী), আরও একটু বিরক্তি নিয়ে ভদ্রলোক তখন বললেন আপনি বরং যান, আমার সময় নষ্ট করবেন না। এভাবে হবেনা, আপনি এর পরে কোথায় থাকবেন কীভাবে জানব আমরা? তাছাড়া আপনি তো এই শহরের বাসিন্দাও না, মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে আমরা তো জানতেও পারব না যে আপনার ঠিকানায় চলে যাব …।
উনি এক নিঃশ্বাসে আমায় এসব বলে একবার আমার আশাহত মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন, এবং আবার বললেন, দেখুন এগুলো অল্প বয়সের আবেগ; আপনি যদি সত্যিই চোখ দান করতে চান তবে আপনার এলাকায় বা পরবর্তীতে যেখানে থাকবেন সেখানে যোগাযোগ করবেন। আর হ্যাঁ আরেকটি ব্যাপার, আপনার সই সাবুদ নিতে হলে আমাদের ফর্মে আপনার অভিভাবকের স্বাক্ষর লাগবে; এখানে তো আপনার কোন অভিভাবকও নেই। সুতরাং পরে কখনও অভিভাবকের সই নিয়ে আসলে, স্থায়ী ঠিকানা দিলে আমরা হয়তো ভেবে দেখব।
সেই যে ১৯৮৫ সালে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলাম, ছুটব বলে, ছুটে ছুটে একটা জায়গায় পৌঁছুব আমি; না থাক আ্মার চারধারে কেউ উহু-আহা করার, পিছলে গেলে হাতটা বাড়িয়ে দেওয়ার; ঝড় ঝঞ্ঝা বৃষ্টিতে আকাশের ওপরে আরেক আকাশ হয়ে থাকার, আমি যেন তবু নিজের চলার মত একটা পথ খুঁজে নিতে পারি, আমার যাবতীয় সমস্যার সমাধান নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজেই খুঁজে নিতে পারি, কোন কারণেই যেন কাউকে বিব্রত না করি। কারো ওপর অকারণ নির্ভরশীল না হয়ে পড়ি; আর এই ব্রত নিয়ে এতোটা কাল ভালই তো চলছিল, কিন্তু আজ এ কোন ধাক্কা খেলাম?? নিজের কাছে বারে বারে নিজেই প্রশ্ন করলাম, আমি মেয়ে… আমার চক্ষুদান করার বাসনা তবে আবেগ, আমার ব্যাক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই, আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই…? খুব ছোট হয়ে যেতে লাগলাম নিজের ভেতরে, রাষ্ট্রযন্ত্র শিক্ষিতা সচেতন মেয়েকেও অর্ধ মানব বলে মনে করে? এ কোন দেশে, কোন সমাজে বসবাস করছি আমি? এসব এলোমেলো ভাবনায় বিষণ্ণ মন নিয়ে বিকেলে প্রিয়বন্ধুর সাথে দেখা; আমার মন খারাপ হলেই ওর প্রথম এবং প্রধান কাজ হল খুঁড়ে খুঁড়ে রক্ত বের করা, অতঃপর মলম লাগানো। আমিও বেশ উপভোগ করতাম ওর এই অতিয়ামত্রার কেয়ারিং…। অগত্যা ওকে বললাম খুলে সব… আর বললাম, আচ্ছা তুই কি আমার অভিভাবকের জায়গায় সই করবি? ও মৃদু হাসল কেবল, আর কিছুই বলল না, আমিও আর সে নিয়ে কথা বাড়াইনি।
সে যাত্রা আমার চক্ষুদান কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়িলেও আমার মনের খায়েশ কিন্তু মিটিল না; উহারা ফলে ফুলে সুশোভিত হইয়া দ্বিগুণ নয় কেবল; চারগুণে রূপান্তরিত হইল। ১৯৯৮ সাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমি তখন পেটের ক্ষুধা নিবৃত লাগি দিনাজপুরে নিরন্তর কারাবাসে। আবারো সেই ‘সন্ধানী’ মহৎ হইবার নেশা আমারে ঘিরিয়া ধরিল, নাহি ছাড়ে আর! আর তাই নিজেই খুঁজে বের করি ‘সন্ধানী’র সন্ধান, আর আমাকে পাওয়া যাবে এমন একটি ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে দেই ওদেরকে। অনেকবার ‘সন্ধানী’র মাধ্যমে অনেককেই সরাসরি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রক্ত দিয়েছি। একবার এক রিক্সা চালকের স্ত্রীকে প্রসবকালীন রক্ত দিয়েছিলাম। আজো মনে আছে তাঁর বিনয়ের ভাষা, আমার রক্ত না পেলে বাঁচাতে পারত না তাঁর স্ত্রীকে, আর স্ত্রী না বাঁচলে নবজাতককে কীভাবে বাঁচাত সে? তার সেই কৃতজ্ঞতা আমায় ভদ্র পোশাকের আড়ালে অনেক বেশি আহত করেছিল; মনে হয়েছিল, আমাদের কত কী শেখা হয়নি জীবনে। সে সবসময় সুযোগ খুঁজত কীভাবে আমাকে খুশি করা যায়, শহরে দেখা হলেই আমাকে তার রিক্সায় তুলবে, এবং যথারীতি ভাড়া নেবেনা। আমিও ভাড়া না দিয়ে তার সন্তানের জন্য ভাড়ার অতিরিক্ত আর দশ-বিশ টাকা বেশি দিয়ে দিতাম। সে প্রতিবারই আনন্দে কেঁদে ফেলত, আমার জন্য দুহাত তুলে দোয়া করত। যাক সে কথা, আজকের গল্পের বিষয় এটা না, আমি এবার প্রসঙ্গে ফিরি…
আমি আবারো দিনাজপুরে মেডিকেল কলেজে গেলাম। এবারের বিষয় চক্ষুদান নয়, মরণোত্তর শরীর দান, সময়ের সাথে সাথে সাহস আর আবেগের ডালপালা আরও একটু বেড়েছে। তাই সরাসরি রক্ত দিতে গিয়েই জানতে চাইলাম আমি যদি মরণোত্তর শরীর দান করতে চাই কী করতে হবে? আমি আপনাদের কলেজে এটা দিতে চাই। আমার শরীরের স্কেলিটন নিয়ে পড়াশুনা করবে ছাত্রছাত্রীরা; এটা অধিকতর মহত্বের ব্যাপার। সুতরাং মহৎ আমাকে হতেই হবে। কিন্তু এ যাত্রাও ভাগ্য আমাকে সেই সুযোগ হইতে বঞ্চিত করিল। এবারেও সেই একই সমস্যা! কে আমার অভিভাবক, আমি কি আমার অভিভাবকের অনুমতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিনা, তাদের বা তার সম্মতি আছে কিনা, যদি সম্মতি না ই থাকে তবে আমি কীভাবে আমার শরীর দান করি?
ঘড়ির কাঁটায় সময় বদলায়, বদলায় ক্যালেন্ডারের পাতায়, হাজার বছর ধরে সমাজ ঘড়িটার কাঁটা থেমে থাকে আমাদের চর্চিত চর্বণে রাষ্ট্রযন্ত্রের আইনের কবলে, বস্তা পচা দলিল দস্তাবেজে……।। নারী কখনও মানুষ হয়ে ওঠেনা আর! হয়না তার শরীর আর মনের মালিক; শৈশবে মায়ের, কৈশোরে বাপের, যৌবনে স্বামীর, বার্ধক্যে ছেলের! নারীর মালিকানা হাত বদলায় কেবল, সে কখনও নিজের হয়না, সমাজের চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা হতে দেয় না…।
নারী কবে নিজের মালিক হবে?????
@ তানবীরা, গল্পটি সত্য, তবে এখানে প্রতিকী, আমি নিশ্চয়ই সেটা করব বন্ধু, তোমার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ!
আমাদের দেশে নারীদের প্রতিবন্ধকতা একটু বেশি-ই,সেগুলোকে জয় করাই হোক আসল লক্ষ্য,হতাশা নয়……
তুমি কানাডাতেও মরনোত্তর দেহ দান করতে পারো কিন্তু
সব কিছুই প্রতিনিয়ত,প্রতিক্ষনে বদlলায় কিন্তু বাংলার মানুষের মানসজগতের মন আর যেন বদলাতে চায় না , শুধু পেছনের দিকে এক নিগূড় অন্ধকারের দিকে যেতে চায় ,অন্ধকারই যেন তাদের ভালবাসার বস্তু সেখানে নারীমুক্তি সহ সামগ্রিক জীবনের সংস্কারমুক্তি তো অনেক বহুকাল সুদূরপরাহত।
তবে মুক্তি তো একদিন আসতেই হবে এই বাংলায় ,এটাই জীবনের ও সময়ের রূঢ় বাস্তবতা।
কলমযুদ্ধের দ্বারা আমাদের জংধরা ভোতা মাথা চূর্ন-বিচূর্ন হয়ে যাক..…….।।
@ আমরা অপরাজিত, দুর্বলের ওপর সবলের প্রতিষ্ঠা, সমাজের সব আচার-প্রথা-নিয়ম সেই বোধ থেকেই তৈরি হয়েছে এবং বহু বছর ধরে চর্চা চলছে একে টিকিয়ে রাখার, তাই সময়ের সাথে সাথে এর স্রোতের অনুকূলে না হয়ে এর যাত্রা স্রোতের প্রতিকূলেই হচ্ছে। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আসলে কি জানেন আমাদের সমাজই নারীদের দাবিয়ে রেখে এক ধরনের আনন্দ উপভোগ করে | এই যে আপনাকে চক্ষু বা শরীর কিছুই দিতে দেয়া হলো না , এর কারণ হলো সমাজের পুরুষরা নারীদেরকে হিংসা তথা ঈর্ষা করে | নারী কোনো ভাবে তাদের ডিঙিয়ে চলে যাবে সেটা তারা মেনে নিতে পারে না | তার ওপর ধর্মীয় শিক্ষা তো আছেই | সব মিলিয়ে….. এখনো অনেক দেরী |
@ অতিথি লেখক, আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ!