অভিজিৎ রায়কে আমি বলতাম গুরু। এই লোকটা রাস্তা থেকে তুলে এনে আমাকে মুক্তমনায় জায়গা করে দিয়েছিলেন। আমার ছোট-জীবনে মানুষের যতটুকু ভালোবাসা-স্নেহ-সম্মান পেয়েছি তার প্রায় পুরোটাই এই মানুষটার কারণে, আমি এতটার যোগ্য নই। এবছর আমার প্রথম বই ‘ত্রিশ লক্ষ শহিদ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’র প্রকাশনা নিয়ে এই মানুষটার উচ্ছ্বাস আমি দেখেছি, আমার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়ে আমার ক্ষুদ্র জীবনকে ধন্য করে গেছেন মানুষটা।
জীবনের সবচেয়ে বড় আয়রনি সম্ভবত এটাই;
এখনো নির্লিপ্ত আমি মাথা নিচু করে চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছি…
তবুও চলতে হবে,
আলো হাতে চলিয়াছে যে আঁধারের যাত্রী তাঁর সম্মানেই নিবেদন করলাম…
এক.
১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর ফিলিপাইন। ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের এক রায় অনুসারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় জাপানি জেনারেল ‘তময়উকি ইয়ামাশিতা’-র ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয় এই দিনে । তার উপর আনিত মানবতা বিরোধী অপরাধ ছিলো ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবলিটি’ অথবা ‘কম্যান্ডার রেস্পন্সিবলিটি’। আজ আলোচনা করবো তার অপরাধের মাত্রা নিয়ে।
জি হ্যা, মুজাহিদের অপরাধের মাত্রা সম্পর্কে একটা পরিস্কার ধারনা দেয়ার জন্যই এই নিবন্ধের অবতারণা।
শিং মাছ যেমন ছাই দিয়ে চেপে ধরতে হয় বদর কম্যান্ডার মুজাহিদকেও তেমন ছাই চাপা দিয়ে ধরতে হবে আমাদের। আমার বন্ধু মহলে অনেককে বলতে শুনি ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে হতাশাপূর্ণ কথা, এসব কথা যারা বলেন তারা সবাই যে জামাতি-হেফাজতি এমন নয় বরং দেশের বিভিন্ন সমস্যা থেকে তৈরি হতাশা, সরকারের বিভিন্ন কাজকর্মে বিরক্তি সর্বোপরি এই সরকারের মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় সম্পদে পরিণত করার প্রবণতা নিয়ে অনেকের ভেতরেই একটা ক্ষোভ কাজ করে। সোজা বাংলায় এই ক্ষোভটা স্বাভাবিক ভাবেই আমার মধ্যেও কাজ করে প্রায়শ। সরকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লাইসেন্সধারণ করে ইচ্ছামত অনৈতিক কাজকর্ম করা এবং সেই কর্মকে চেতনার ফিল্টারে সাদা করে নেয়া তো পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারে চেতনাকে পদে পদে অপমান করার সামিল।
সেই ক্ষোভ কিংবা বিরক্তি থেকে অনেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে, ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক আজেবাজে মন্তব্য করে বসেন। তবে সমস্যাটা হচ্ছে এইসব মন্তব্যের/সমালোচনার পেছনে যুক্তি আর তথ্যের রসদ যোগায় বাঁশেরকেল্লা। ফলশ্রুতিতে প্রকারন্তে জামাত-শিবির বিরোধী মানুষই কিন্তু জানার অভাবে দিনের শেষে জামাতের পারপাস সার্ভ করে থাকেন। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই জামাত-শিবির প্রত্যেকটা রাজাকারের বিচারের পর রায়ের খণ্ড খণ্ড অংশ আউট অফ কনট্যাক্স তুলে নিয়ে এসে নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করতে চায়। আদালতে দেয়্যা সাক্ষিরা নাকি মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে এই কথা প্রচার করে নিজেদের সাক্ষীদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়।
আমরা যারা আইনের মানুষ নই তাদের পক্ষে আদালতের নিয়মকানুন তেমন একটা জানা সম্ভব হয় না। সাক্ষীদের সাক্ষ্য কেমন করে নেয়া হয়, কেমন করে সাক্ষির সাক্ষ্য সত্য নাকি মিথ্যা যাচাই করা হয়, সেটা স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের অজানা, এই না জানার সুযোগ নিয়েই ক্রমাগত মিথ্যাচার করে বেড়ায় এই ‘বাঁশেরকেল্লা’ চক্র।
এই পর্যন্ত তিনজন যুদ্ধাপরাধীর পরিচয় পরিবর্তন করে মামলা পরিচালনা করেছে তারা। কাদের মোল্লা, সাইদি এবং সাকা চৌধুরী এই তিনজনের ক্ষেত্রে একই নিয়মে মামলা পরিচলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘এই কাদের/সাইদি/সাকা নাকি যুদ্ধকালীন গনহত্যায় নেতৃত্ব দেয়া সেই কাদের/সাইদি/সাকা নয়’ অন্য কোন(একই নামের) মানুষের অপরাধের দায়ে তাদের মক্কেলদের ফাঁসানো হচ্ছে!!! (মজাটা হচ্ছে একই ঘটনা একজন না দুইজন না তিনজনের ক্ষেত্রে মেনে নেয়া একটু কষ্টকর বৈ কি)
একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় কাদের মোল্লা, সাইদি এবং সাকা চৌধুরী তিনজনই ১৯৭১ সালে তেমন পরিচিত কেউ ছিলো না কিন্তু অন্যদিকে মুজাহিদ, নিজামি, গোলাম আযম এরা যথাক্রমে থানা, জেলা, শহর, দেশ এমনকি আন্তর্জাতিক ভাবেও সুপরিচিত ছিলো ১৯৭১-এর আগে থেকেই, এরা সবাই একেবারে কেন্দ্রে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলো রাজাকার-আলবদর-আলশামস কিলিং স্কোয়াডদের। আর তাই তাদের পরিচয় গোপন করে অন্য কাউকে মুজাহিদ/নিজামি/গোলাম বানানোর নাটক জামাত করতে পারেনি জামাত। আর তাই তাদের ক্ষেত্রে একটা কমন যুক্তি হচ্ছে “পারলে আমাদের নেতারা কাকে খুন করেছে দেখান?”। সম্প্রতি প্রায় প্রতিটি শুক্রবার জুমার নামাজের পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ‘মুজাহিদ মুক্তি পরিষদ’-এর নামে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে যেখানে বড় বড় করে লেখা আছে-
“কাকে হত্যার দায়ে জনাব আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো??”
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ- ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রেসিডেন্ট, পদাধিকার বলে কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদরের কমান্ডার। তার নেতৃত্বে এই দেশের শত শত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই নরপশুকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেছে। পরবর্তীতে আপিল বিভাগও এই রায় বহাল রেখেছে।
বিচারের রায় বিশ্লেষন করে দেখা যায় এই লোকটার পক্ষে এত এত এত দালিলিক প্রমাণ আছে যে কোন সুস্থ মানুষ সুস্থ মস্তিস্কে তাঁকে ‘ভালো মানুষ’ বলতে পারবে না। সম্ভবত এই রায়ের কার্যকরের মধ্যে দিয়ে দেশে প্রথম আল-বদরের কোন কমান্ডারের ‘সুপিরিয়র রেস্পন্সিবলিটি’ অর্থাৎ ‘প্রধান হিসেবে অপরাধের দায়’ নিয়ে ফাঁসির দড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এবং সেই অপরাধের প্রমাণ যতটানা সাক্ষ্য ভিত্তিক তারচেয়ে অনেক বেশী তথ্য ভিত্তিক, কেউ এই রায় কে ‘ভাড়া করা সাক্ষী’ বলে উড়িয়ে দিতে পারবে না।
এই মামলার রায় পড়লে দেখা যায় ডিফেন্স এক কথায় এবারের এই মামলার বেলায় প্রায় সবকিছুই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে বা মেনে নিয়েছে। তারা মেনে নিয়েছে ১৯৭১ সালে মুজাহিদ পুরো পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রেসিডেন্ট ছিলো। তারা মেনে নিয়েছে যে ১৯৭১ সালে আলবদর নামের একটা সংগঠন বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলো। তারা মেনে নিয়েছে যে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলবদর হেড কোয়ার্টার ছিলো এবং সেখানে বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে অত্যাচার করা হতো, হত্যা করা হতো। তারা এটাও মেনে নিয়েছে যে মুজাহিদ মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে নিয়মিত যাতায়ত করতো।
কিন্তু তারা মানতে নারাজ যে আলবদর প্রধান মুজাহিদ একজন খুনি। এবং তাদের একটাই কথা যে আদালত রায়ে উল্লেখ করেনি মুজাহিদ আসলে কাকে হত্যা করেছে।
দুই.
সুপিরয়র রেস্পন্সিবলিটি কিংবা কম্যান্ডার রেস্পন্সিবলিটি নিয়ে এই লেখার শুরুতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি জেনারেল ‘তময়উকি ইয়ামাশিতা’ সম্পর্কে যেটা বলছিলাম সেই কথায় আবার ফিরে আসি। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ ম্যানিলার এক আদালতে জেনারেল তময়উকি ইয়ামাশিতার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো ম্যানিলা গনহত্যা সংগঠনে ভূমিকা, সিংগাপুর এবং ফিলিপাইনে নিরীহ মানুষদের হত্যার অভিযোগ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে জেনারেল ইয়ামাশিতার বিরুদ্ধে আনিত সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিলো যে জাপানি সেনাবাহিনীর একজন কম্যান্ডার হিসেবে সে তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি। জাপানি সৈন্যরা যখন গনহত্যা চালাচ্ছিলো তখন জেনারেল ইয়ামাশিতা নৈতিকতার জায়গা থেকে তাদের এরকম কর্মকাণ্ড করতে বাধা দেননি কিংবা দিতে পারেননি। জেনারেল ইয়ামাশিতার আইনজীবীরা জাপানি বাহিনীর হাতে গনহত্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে যুক্তি দেখায় যে যুদ্ধের ভেতর যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো এবং জাপানি সেনাদের ভেতর চেইন অফ কম্যান্ড পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আর তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও জেনারেল ইয়ামাশিতা তার সৈন্যদের হত্যা, ধর্ষণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারে নি।
সেই বিচারে কেবল মাত্র সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ব্যর্থতার কারণে জেনারেল ইয়ামাশিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত, সেই রায় সুপ্রিম কোর্ট এবং আপিল কোর্টের পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমা বঞ্চিত হয়ে ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয়।
ফাঁসিকাঠের তেরটি সিঁড়ি অতিক্রম করার পর যখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তার কোন শেষ বক্তব্য আছে কি না, তখন জেনারেল ইয়ামাশিতা যা বলেছিলেন তার চুম্বক অংশ পাঠকের উদ্দেশ্যে-
“আমি ম্যানিলা সুপ্রিম কোর্টে যেই কথা বলেছিলাম সেটাই বলবো যে আমি আমার সাধ্যমত কাজ করেছি তাই আমি ঈশ্বরের সামনে লজ্জিত হব না। কিন্তু তোমরা হয়তো বলতে পারো ‘আপনার জাপানি সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা ছিলো না’ আসলে আমার বলার কিছুই নেই, এটাই আমি। আমি সব সময়ই বিচার বাবস্থার প্রতি আস্থাশীল। যখন আমাকে ম্যানিলায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিলো তখন আমার ভালো চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো, আমার সাথে ভালো ব্যাবহার করা হয়েছিলো। তোমাদের ভালো এবং ভদ্র অফিসারেরা সব সময়ই আমার সাথে ভালো ব্যাবহার করেছে এবং আমাকে রক্ষা করেছে। আমার মৃত্যুর কারণে আমি তোমাদের দোষারোপ করবো না। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুণ।”
–
–
–
–
–
তিন.
কর্নেল পল ওয়ারফিল্ড টিবেটস জুনিয়র পৃথিবীময় বিখ্যাত শুধু একটা কারণে এবং এই একটা কারণ জনপ্রিয় হবার জন্য যথেষ্ট। তিনি পরিচিত জাপানের হিরোশিমায় পৃথিবীর প্রথম আনবিক বোমা নিক্ষেপকারী হিসেবে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট নিক্ষিপ্ত সেই বোমায় তাৎক্ষনিক এক লাখ বিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, এবং পরবর্তীতে মৃত্যু ঘটে আরও প্রায় দ্বিগুণ-তিনগুণেরও বেশী মানুষের। সেই আনবিক বোমা নিক্ষেপের ৯ দিনের মাথায় জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে।
আসুন ঐতিহাসিক এই আনবিক বোমা নিক্ষেপ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
সবাইকে উল্লেখিত নামগুলোর দিকে একটু লক্ষ রাখতে অনুরোধ করবো।
তর্কের খাতিরে ধরে নেই এই আনবিক বোমার বিস্ফোরণ একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ (!!)। এই আনবিক বোমা- লিটল বয় নির্মাণ করা হয় জেনারেল লেসলি গ্রোভের নেতৃত্বে ম্যানহাটান প্রকল্পে। এই প্রকল্পের সাথে আমাদের কর্নেল টিবেটস সংশ্লিষ্ট হন ১৯৪৪ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর। সেই প্রকল্পের প্রধান ছিলেন এয়ার ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল উজাল ইন্ট এছাড়া ছিলেন আরও তিন জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেখান থেকে কর্নেল টিবেটস কে ঐতিহাসিক ৫০৯ তম কম্পোজিট গ্রুপের দায়িত্ব দেয়া হয়। যেখানে ছিলো ১৮০০ জনবল এবং ১৫টি বি-২৯ বোমারু বিমান। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় আনবিক বোমা- ‘লিটেল বয়’ ও এরকম একটি বি-২৯ বিমান থেকেই নিক্ষেপ করা হয়েছিলো।
এবার একটু বিমানের দিকে তাকাই, আমাদের আলোচনার বি-২৯ বিমানটি কিন্তু ছোটখাটো কোন বিমান নয়। কারণ বাক্তিগত ভাবে আমি ছোটবেলা থেকেই কল্পনা করে এসেছি যে ছোট একটা প্লেনেই বুঝি সেই বোমাটাকে একজন নিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে আসে, এমনও শুনেছি যে বোমাটা মারার পর বৈমানিক নাকি নিচের অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে উঠেছিলো ‘এ আমি কি করলাম’। যদিও বাস্তবতা সেদিন অন্যরকম ছিলো, এই বিমানে সেদিন ৯ জন যাত্রী ছিলেন এবং সবাই তারপরের বাকি জীবন হেসে খেলে কাটিয়ে গেছেন। তাদের বোমার আঘাতে কোন প্রার্থনারত বৃদ্ধ কিংবা সদ্য জন্ম নেয়া শিশু মারা গেলো কি না সেটা তাদের ভাবনায় কখনোই আসে নাই। বরং তারা আজীবন বুক ফুলিয়ে খুশী মনে বড়াই করে বলে বেড়িয়েছে নিজের কাজের কথা।
তো সেই বিমানের আমাদের কর্নেল টিবেটস উপস্থিত থাকলেও তিনি কিন্তু প্লেনও চালান নাই আবার সুইচ টিপে দিয়ে বোমাটাও হিরোশিমার বুকে ফেলেন নাই। তিনি কেবল এই গ্রুপটার নেতৃত্ব দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন রবার্ট লুইস ছিলেন পাইলটের আসনে, ক্যাপ্টেন ভেন ক্রিক জায়গাটা নিশ্চিত করেছেন আর বোম্বার মেজর থমাস ফেরেবি বোমাটা ছুঁড়েছেন।
চার.
আশা করছি আমার পাঠকরা বুঝতে পারছেন ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবলিটি’ কিংবা ‘কম্যান্ডার রেস্পন্সিবলিটি’ কি ভয়ংকর ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। প্রথম ঘটনায় উল্লেখিত জেনারেল ইয়ামাশিতা কোন একজন মানুষকে হত্যা করেননি, কাউকে এমন কি হত্যা করতে হুকুম দেননি, সুপারিশ করেননি। কেবল তার নিচের অধিনস্ত সৈন্যদের অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারেননি। আর অন্য দিকে মুজাহিদ কিলিং ফোর্স আলবদরের কম্যান্ডার। তার নেতৃত্বে/নির্দেশে খুন হয়েছিলো এদেশের শত শত বুদ্ধিজীবী। মুজাহিদের ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবলিটি’ কিংবা ‘কম্যান্ডার রেস্পন্সিবলিটি’ বিচারের জন্য কেন আমাদের নির্দিষ্ট একজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার দায় প্রমাণ করতে হবে?
কেউ যদি ধারনা করে থাকেন ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবলিটি’ অথবা ‘কম্যান্ডার রেস্পন্সিবলিটি’তে সর্বোচ্চ সাস্তির বিধান কেবল সামরিক অফিসারদের জন্য- তাদের বলতে চাই জাতিসংঘের রুয়ান্ডা ট্রায়ালে করা স্কুল শিক্ষক জেন পল আকায়াশুর বিচারের কথা।
নিজের গ্রামের তুতসিদের যখন নির্মমভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা করে সঙ্খ্যাগুরু হুতুরা তখন আকায়াশু উসকানি মূলক বিভিন্ন কথাবার্তা, ঘৃণার বাণী ছড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয়দের ধর্ষণ ছাড়াও তুতসি জীবিত মানুষদের তালিকা তৈরি করে প্রচার করে হুতুদের কাছে। জাতিসংঘ পরিচালিত সেই আদালত জেন পল আকায়াশুকে তাদের আইনের সর্বোচ্চ শাস্তিতে দণ্ডিত করে। সে আজ পর্যন্ত তার যাবত জীবন কারাদন্ডের শাস্তি খেটে যাচ্ছে। উল্লেখ্য জাতিসংঘ পরিচালিত কোন আদালতেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই।
আশা করি সবার কাছে পরিস্কার হয়েছে কেন আল বদর কম্যান্ডার মুজাহিদের ফাঁসি কোন একক ব্যাক্তিকে হত্যার জন্য দেয়া হয়নি বরং দেয়া হয়েছে তার ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবলিটি’ কিংবা ‘কম্যান্ডার রেস্পন্সিবলিটি’র কারণে।
এখন আনবিক বোমা নিয়ে লেখা দ্বিতীয় ঘটনার শিকার একই ভাবে হিরোশিমার কোন পরিবার তার স্বজনের হত্যাকারীকে খুঁজতে যায় তাহলে দয়টা কার উপরে এসে পড়বে বলতে পারেন কি। আমাদের কমান্ডার কর্নেল টিবেটস সাহেব তো কোন একজন মানুষকে হত্যা করেননি। এখন যদি টিবেটস সাহেব জানতে চান “কাকে হত্যার দায়ে আমাকে সাব্যস্ত করা হচ্ছে?” তাহলে কি উত্তর দেবেন? কারণ টিবেটস সাহেব নিঃসন্দেহে গুলি করে কাউকে হত্যা করেননি,আনবিক বোমাটা হয়তো স্পর্শও করেননি, এমনকি বলেনওনি ‘kill them…’, শুধু অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
শুধু এটার জন্যই সেইদিনের তিন লক্ষ মৃত্যুর দায় কর্নেল পল ওয়ারফিল্ড টিবেটস জুনিয়রের, সমান ভাবে সেই দায় এয়ার ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল উজাল ইন্টের, এবং জেনারেল লেসলি গ্রোভের। এরা কেউই নিজ হাতে একজন মানুষকে হত্যা করেনি, কিন্তু এরা প্রত্যেকে এই শতাব্দীর সবচেয়ে জঘন্যতম খুনি।
এটাকে সুপিরয়র রেসপন্সিবলিটি বলে
একই ভাবে, আল বদর কম্যান্ডার আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আল বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামি, আল বদরের মাতৃ সংগঠন জামাতের আমির গোলাম আজম। এরা শতাব্দীর জঘন্যতম খুনি। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গনহত্যার মাস্টারমাইন্ড।
আলবদরের কথা বলতে গিয়ে মুনতাসির মামুন স্যার একবার লিখেছিলেনঃ আলবদরের নিষ্ঠুরতার কথা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয়, আলবদর হোক, রাজাকার হোক, মানুষ কি মানুষের ওপর এমন অত্যাচার করতে পার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হামিদা খানের বিবরণটার কথা বারবার মনে পড়ে ।
‘আর একটু এগিয়ে যেতেই সামনে বড় বড় দুটো মস্ত মানুষ, নাক কাটা, কান কাটা, মুখের কাছ থেকে কে যেন খামচিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে হাত-পা বাঁধা।…’
‘আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা । মুখ ও নাকের কোন আকৃতি নেই, কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। স্তনের একটি অংশ কাটা.. মেয়েটি সেলিনা পারভীন। শিলালিপির এডিটর।…
‘মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে। প্রতিটি ফলার পাশে পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যস্থ কঙ্কাল সাক্ষ্য দিচ্ছে কত লোক যে এই মাঠে হত্যা করা হয়েছে।’
হামিদা রহমান ডা. ফজলে রাব্বীর লাশ দেখে লিখেছিলেন-
‘ডা. রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা, জল্লাদ বাহিনী বুকের ভিতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানত যে, তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তাঁর হৃৎপি-টা ছিঁড়ে ফেলেছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় কাত হয়ে দেহটা পড়ে আছে। পাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। রাব্বী সাহেবের পা দুখানা তখনও জ্বলজ্বল করে তাজা মানুষের সাক্ষ্য দিচ্ছে। নাক, মুখ কিছুই অক্ষত ছিল না। দস্যু হায়েনার নখের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত।… সামনে চেয়ে দেখি, নিচু জলাভূমির ভিতর এক ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য। সেখানে এক নয়, দুই নয় একেবারে বারো/তেরোজন সুস্থ সবল মানুষ। একের পর এক শুয়ে আছে।’
মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বলেছিলেন-
‘হানাদার পাক বাহিনীর সহযোগী আলবদররা পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের পর যখন পালিয়ে যায় তখন তাদের হেড কোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা বোঝাই চোখ। এ দেশের মানুষের চোখ। আলবদরের খুনীরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে বস্তা বোঝাই করে রেখেছিল।’
-[দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯.১.১৯৭২]
ডা. আলীম চৌধুরীর চোখও আলবদররা উৎপাটন করেছিল। মওলানা তর্কবাগীশ আরও বলেছিলেন, ‘খুনীদের নামে এই বাহিনীর নাম দেয়া হলো আলবদর বাহিনী। এ কি কোন মনঃপূত নাম? যে বদর যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য, ইসলামের প্রথম লড়াই, সেই যুদ্ধের সঙ্গে কি কোন সংযোগ এই নৃশংসতার মধ্যে ছিল? হানাদারদের সহযোগী এই বদর বাহিনী শুধু ইসলামের শত্রু নয়। এরা হলো জালেম।’
সবশেষে কিছু পেপার কাটিং জুড়ে দিলাম,
তাদের জন্য যারা ‘আল বদর’ বাহিনীকে অস্বীকার করতে চায়…
মনোযোগ দিয়ে পড়েছি..। ভালো লেগেছে ভীষণ। ভাবনার খোরাক আছে অনেক এ লেখায়..। যারা দেশ, জাতি নিয়ে সারাক্ষণ ভাবেন, তাদের মগজে এর মর্মকথা সজীব থাকলে ভালো হবে…।
অসাধারণ লেখা,তথ্যবহুল লেখা।অজানা অনেক বিষয় জানার সুযোগ পেলাম।
ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে
বর্ণিত, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, প্রতিটি মানুষই দায়িত্বশীল,
সুতরাং প্রত্যেকেই অবশ্যই তার
অধীনস্থদের দায়িত্বশীলতা বিষয়ে
জিজ্ঞাসিত হবে।
[বুখারি৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪, ২৫৫৮, ২৭৫১,
৫১৮৮, ৫২০০, ৭১৩৮, মুসলিম ১৮২৯,
তিরমিযি ১৭০৫, আবু দাউদ ২৯২৮, আহমদ
৪৪৮১, ৫১৪৫, ৫৮৩৫, ৫৮৬৭, ৫৯৯০]
আরিফ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই বিশ্লেষণ ধর্মী, তথ্যপূর্ণ লেখাটার জন্য। এদের বিচার করতে আমাদের কতো কতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে, কতো ফ্রন্টে লড়াই চালাতে হচ্ছে, জীবন দিতে হচ্ছে অথচ এরা এক রাতেই পেছন থেকে গুলি করে আমাদের পুরা জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে স্তব্ধ করে দিতে পারে। লড়াইটা অসম, তাও আমরা যারা মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চাই, তাদের যৌক্তিক পথেই যেতে হবে। পথ চলতে গিয়ে আমরা পেছন থেকে জবাই খাবো কিন্তু তাও আমরা লিখেই যাবো- ‘রেফারেন্স’ দিয়ে।
নিয়মিত লিখতেই থাকুন 🙂
সুপিরিয়র রেস্পন্সিবিলিটি নিয়ে লেখা কোনো বাংলা বই কি আছে? বা অনুবাদ বই?
বিচারিক দূর্বলতার কারনেই কাদের মোল্ল্লার মত ঘৃণ্য অপরাধী ফাঁসির পুরস্কারটি উপেক্ষা করে ভি দেখাতে পেরেছিলো। শাহবাগ প্রতিবাদের জন্ম সেই কারণেই আর ফাঁসি আদায়ও সেভাবেই। রিভিউ নিয়ে কি কোন ভয় আছে?
তবুও
কেন? ঘৃণ্য আল বদর কমান্ডার মুজাহিদ কি ফাঁসি থেকে বেঁচে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন?
কারণ মুজাহিদের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রমাণের ঝামেলা নাই, সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে তার অপরাধ প্রমাণ করা যায়…
ফলে অন্য রায়ে যেগুলো নিয়ে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে সেগুলোও দূর করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
আর- না আশা করছি মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকবে
ভালো লিখেছেন
লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।