প্রথম পর্ব এখানে।
২. উৎপথে গমন
ইসলামের অনুসারী থেকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ হওয়ার এই যাত্রা অবশ্য আয়ান হারসির জন্য সংক্ষিপ্ত কিছু নয়। এ এক দীর্ঘ যাত্রার ফল। আয়ান তাঁর আরেক বিখ্যাত গ্রন্থ ইনফিডেল এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
ধর্মানুরাগী মুসলমান হিসাবেই ছোট বেলায় গড়ে তোলা হয়েছিলো তাঁকে। ছোট বেলায় মেয়েদের খৎনা করার যে নিয়মটা প্রচলিত আছে আফ্রিকার কিছু মুসলিম দেশে, সেটা তাঁর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়েছিলো। এই ভয়ংকর কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবার পরেও তিনি তাঁর জীবনের দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত ধর্মানুরাগী মুসলমান হিসাবেই থেকে গেছেন। ছোট বেলায় মাদ্রাসায় গিয়েছেন তিনি, কোরান মুখস্ত করেছেন। সেই সময় তাঁরা মক্কায় ছিলেন অল্প কিছুদিন। তখন তিনি কাবা শরীফে যেতেন নিয়মিতই। টিনএজ বয়সে মুসলিম ব্রাদারহুডেও যোগ দেন তিনি। ধর্মানুরাগী মুসলমান হিসাবে জীবনের অর্ধেকটাই কাটিয়ে দেন তিনি।
আয়ানের জন্ম ১৯৬৯ সালে সোমালিয়াতে। তাঁর বাবা ছিলেন সোমালিয়ার বিরোধী দলের একজন নেতা। সেই সময়ে সোমালিয়াতে সিয়াদ বারের স্বৈরশাসন চলছিলো। আয়ানের মা ছিলেন তাঁর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। মা-বাবা দুজনেই মুসলমান ছিলেন, তবে তুলনামূলকভাবে তাঁর বাবা ছিলেন অনেক বেশি উদারপন্থী, সেখানে মা ছিলেন একজন গোঁড়া মুসলমান। আয়ানের দুই বছর বয়সের সময় পুলিশ এসে তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দেয়। পরবর্তী বছরগুলো বাবাকে ছাড়াই কাটাতে হয় তাঁদের।
আয়ানের কোরান শিক্ষা শুরু হয় তাঁর নানির কাছ থেকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর। একটু বড় হলে মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু করেন তিনি। এর মধ্যে এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় তাঁরা বাবা জেল থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। সোমালিয়া তাঁর জন্য অনিরাপদ বলে পালিয়ে ইথিওপিয়া চলে যান। ইথিওপিয়া খ্রিস্টানপ্রধান দেশ বলে তাঁর মা সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। তাঁর কাছে ইথিওপিয়া হচ্ছে কাফের দিয়ে পরিপুর্ণ এক নোংরা দেশ। ইথিওপিয়া যাবার বদলে তিনি ইসলামের পূন্যভূমি সৌদি আরব যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এর জন্য ভূয়া পাসপোর্ট তৈরি করেন তিনি এবং সেই পাসপোর্ট দিয়ে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। আয়ান তখন আট বছরের বালিকা।
সৌদি আরবে গিয়ে মক্কাতে বসবাস করা শুরু করেন তাঁরা। তিনি এবং তাঁর বোন হাওয়া ভর্তি হন মেয়েদের কোরান শিক্ষার স্কুলে। ভাই মাহাদ ভর্তি হয় ছেলেদের মাদ্রাসাতে। এখানে এসে প্রথম তাঁর উপলব্ধি ঘটে যে ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক পূর্বসংস্কারের উর্ধ্বে উঠতে পারে নি। সৌদি মেয়েদের গায়ের রঙ ফর্সা। এর জন্য তাদের অহংকারের সীমা পরিসীমা নেই। আয়ান এবং তার বোনের গায়ের রঙ গাঢ় বর্ণের বলে তারা তাঁদেরকে আবিদ বা কৃতদাস বলে ডাকতো।
এখানেই আয়ান প্রথম শারিয়া আইনের কঠিন প্রয়োগ দেখেন। প্রতি শুক্রবার প্রকাশ্য স্থানে জুম্মার নামাজের পর কাউকে শিরোচ্ছেদ করা হতো, কাউকে দোররা মারা হতো, কোনো নারীকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হতো, কখনো বা কোনো ছিঁচকে চোরের হাত কেটে নেওয়া হতো কব্জির কাছ থেকে। মেয়ে হবার কারণে তিনি এগুলো চাক্ষুস দেখার সুযোগ পান নি অবশ্। কিন্তু তাঁর ভাই এগুলো দেখতে পেতো। তাঁর কাছ থেকেই তিনি এইসব ভয়াবহ ঘটনাগুলোর বর্ণনা শুনতেন।
এর মধ্যে তাঁর বাবা ইথিওপিয়া থেকে মক্কায় এসে পরিবারের সাথে যোগ দেন। এ সময়ই আয়ান প্রথম তাঁর বাবা এবং মায়ের ইসলাম ধর্ম বিষয়ে ধারণাটার পার্থক্যটুকু বুঝতে পারেন। ঘরের মধ্যেও ছেলেরা এবং মেয়েরা আলাদা রুমে নামাজ পড়ার রেওয়াজ রয়েছে সৌদি আরবে। তাঁর বাবা এই প্রথাকে ভাঙার চেষ্টা করেন। তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে নামাজ পড়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। অন্যেরা যেখানে বিশেষ করে তাঁর মা সবসময় জাহান্নামের আগুনের ভয় দেখাতেন, সেখানে তাঁর বাবা এর পুরো ব্যতিক্রমী কাজ করতেন। সপ্তাহে একদিন তিনি ছেলেমেয়েদের কোরান পড়াতেন। আরবী আয়াত অনুবাদ করে শোনাতেন তাদের। সেখানেও তিনি তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যাই বেশি দিতেন। তিনি ছেলেমেয়েদের বলতেন যে, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছে শাস্তি দেবার জন্য নয়। দুনিয়াতে তিনি মানুষ পাঠিয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর এবাদত বন্দেগীর করার জন্য। আয়ানের মায়ের অবশ্য এই বিষয়ে মতানৈক্য ছিলো না। আয়ান কোনো কারণে মায়ের অবাধ্য হলে তিনি চিৎকার করে জানান দিতেন যে, এই অপরাধের জন্য দোজখের আগুনে নিক্ষেপিত হবে এবং সেখানেই অনন্তকাল পুড়ে কাবাব হবে।
বছর খানেক পরে, আয়ানের বয়স যখন নয় বছর, তাঁদেরকে সৌদি আরব ছেড়ে চলে আসতে হয়। তাঁর বাবাকে সৌদি সরকার বহিষ্কার করে। এবার তাঁরা ফিরে আসেন ইথিওপিয়ায়। কিন্তু, এখানেও থাকা হয় না। তাঁর মায়ের ইথিওপিয়ার প্রতি ঘৃণার কারণে দেড় বছর পরে তাঁরা চলে আসেন কেনিয়াতে।
নাইরোবিতে স্কুলে যাওয়া শুরু করেন আয়ান আর হাওয়া। এখানেই তাঁরা ইংরেজি শেখা শুরু করেন। তাঁর মা একই রকমের গোঁড়া থেকে যান। স্কুলে তাঁরা যা কিছু শিখতেন, যেমন মানুষের চাঁদে নামা, কিংবা বিবর্তন, এগুলো যে সত্য হতে পারে, তা মেনে নিতে পারতেন না। বিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিলো যে, কেনিয়ানরা এপ থেকে বিবর্তিত হতে পারে, তাঁরা কিছুতেই নয়। চৌদ্দ বছর হতে না হতেই আয়ানকে তাঁর মা ভর্তি করে দেন মুসলিম গার্লস স্কুলে।
ষোল বছর বয়সে আয়ান শিক্ষক হিসাবে পান সিস্টার আজিজাকে। সিস্টার আজিজার সান্নিধ্যে এসে নিজেকে আরো উন্নত মুসলমান বানানোর উপায় খুঁজে পান তিনি। সিস্টার আজিজা শুরুতে ছিলেন সুন্নি মুসলমান। কিন্তু বিয়ের পরে শিয়া মুসলমানে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। পুরো হিসাবি ছিলেন তিনি। এমনকি হাত ঢাকার জন্য গ্লাভস এবং পা ঢাকার জন্য মোজা পরতেন তিনি। সিস্টার আজিজা ধর্ম পড়ানোর চেয়ে প্রচারই বেশি করতেন। আর সেটাও ছিলো অনেক বেশি মাদকতাময়। লাঠির ভয় নয়, অদম্য এক টানে তিনি আটকে ফেলতেন তাঁর শিক্ষানবীশদের। তাঁর বক্তব্য ছিলো যে, “আমি কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। বরং আল্লাহর বক্তব্য, তা৬র ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষাকে শুধু সহভাগিতা করছি। আমরা যদি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করার পথ বেছে নেই, তাহলে অবশ্যই আমরা নরকের আগুনে পুড়বো। কিন্তু, আমরা যদি তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারি, তবে, অবশ্যই আমরা বেহেশতে যাবো।“
কিছুটা সময় লাগলেও শেষ পর্যন্ত আয়ান সিস্টার আজিজার পথই বেছে নেন। সেই বেছে নেওয়াটাও ছিলো একান্তমনে, একাগ্রে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করেন তিনি। দর্জির কাছে গিয়ে পা থেকে গলা পর্যন্ত মোড়ানো পোশাক তৈর করে নেন। মাথায় বাঁধতে থাকেন কালো স্কার্ফ। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাটাই তখন তাঁর কাছে ধ্যান এবং জ্ঞান।
শুধু সিস্টার আজিজা নয়, এসময় তাঁকে প্রভাবিত করে আরেকজন ধর্মপ্রচারকও। তাঁর নাম বোকোল সম। বকোল সম দ্বারে দ্বারে গিয়ে ইসলামের ডাক দিতেন। সিস্টার আজিজা যেখানে হিজাবি ছিলেন, বোকোল সম তেমনি পরতে সৌদি পোশাক। নাইরোবির সোমালিয়ান তরুণরা তখন বখে যাওয়া শুরু করেছে, পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে দলে দলে গিয়ে রাস্তায় আড্ডা পেটায়, মেয়েদের উত্যক্ত করে, কখনো না সুযোগ বুঝে ধর্ষণও করে। বোকোল সম, এদের সবাইকেই মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দিতে আহবান জানানো শুরু করেন। শুরুতে তিনি মাত্র একাই এই কাজটা করতেন। এরপরেই তাঁকে সাহায্যের জন্য রাস্তায় হিড়িক পড়ে গেলো। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মসজিদও তৈরি হয়ে গেলো একটা এবং বোকোল সমকে সেখানকার ইমাম বানিয়ে দেওয়া হলো। দ্বারে দ্বারে ঘুরে দীন ইসলাম কায়েম করা লোক বোকোল সম রাতারাতি একটা আন্দোলনের নেতা বনে গেলেন।
মুসলিম ব্রাদারহুড কাজে নেমে পড়লো। সমাজে যে বিশৃঙ্খলা ছিলো, সেটাকে দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলো তারা। রাস্তা থেকে বখাটে ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলো। তাদেরকে নতুন কাপড়-চোপড় দিলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো শিখালো। সহজ ভাষায় বললে, তাদের জীবনকেই পালটে দিলো মুসলিম ব্রাদারহুড। এই ছেলেপেলেগুলোর কোনো দিকনির্দেশনা ছিলো না, ছিলো না কোনো ভবিষ্যত ভাবনা। তাদের পরিবার এটা দিতে ব্যর্থ হয়েছিলো। কিন্তু, সেই তারাই মুসলিম ব্রাদারহুডের কল্যাণে একটা সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা পেয়ে গেলো। সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার এই অসাধারণ কাজটা করার জন্যই বহু লোকে তাৎক্ষণিকভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ হয়ে গেলো।
বোকোল সমের মুল বক্তব্য ছিলো যে, পার্থিব জগৎ ক্ষণস্থায়ী। মহানবির নির্দেশিত পথের বাইরে কেউ যদি চলে, তবে সে তার আসল জীবনের, যেটা শুরু হবে পরকালে, তার পুরোটা সময় ধরেই দোজখের আগুনে পুড়বে। কিন্তু, কেউ যদি সঠিকভাবে চলে, তবে আল্লাহ পুরস্কার হিসাবে তাকে বেহেশতে বসবাস করতে দেবে। আর কেউ যদি আল্লাহ সৈনিক হয়, তবে সে আল্লাহর কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করবে।
সিস্টার আজিজা এবং বোকোল সম ছিলেন রণলিপ্সু ইসলামের অগ্রদূত। এই রনলিপ্সু ইসলামের জন্ম মুহাম্মদের মদিনা জীবনের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে। না বুঝেই আরো অসংখ্য মানুষের মতো আয়ানও এর খপ্পড়ে পড়ে যান। ফলে, আয়াতুল্লাহ খোমেনি যখন সালমান রুশদির কল্লা চাইলো স্যাটানিক ভার্সেস লেখার অভিযোগে, তখন এটা উচিত কি অনুচিত সেই বিবেচনায় আয়ান গেলেন না। বরং আয়াতুল্লাহ খোমেনির সাথে সহমত পোষণ করলেন। শুধু তিনি একা নন, তাঁর সম্প্রদায়ের সব মানুষেরই এক কথা ছিলো যে, সালমান রুশদিকে মরতে হবে। সে নবিকে অপমান করেছে। কাজেই, শাস্তি তার প্রাপ্য। এর বাইরে অন্য কোনো কিছু চিন্তার কোনো অবকাশ নেই।
ঘন মেঘের প্রান্ত ছুঁয়ে যেমন আলোর ঝিলিক খেলা করে, সেরকম এই গোঁড়ামির অন্তরালেই বয়ে চলেছিলো মৃদুবেগে কোনো অন্তঃসলিলা। ছোটবেলা থেকেই প্রবল কৌতুহলী ছিলেন আয়ান, সেই সাথে ছিলো সবকিছু জেনে নেবার জন্য অনর্গল প্রশ্ন করার বাতিক। এই সব প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত ছিলো দীর্ঘ এক পথে যাত্রা করার অনিশ্চিত এবং টালমাটাল ছোট ছোট পদক্ষেপ। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ আসে এর পরেই।
বিরানব্বই সালে আয়ানের বিয়ে হয়। এটি ছিলো পরিবারের ঠিক করে দেওয়া বিয়ে। তাঁর স্বামী ওসমান মুসা ছিলেন সোমালিয়ান বংশোদ্ভূত ক্যানাডিয়ান নাগরিক। একজন প্রথাগত সোমালিয়ান মেয়েকে বিয়ে করাই ছিলো তাঁর মূল উদ্দেশ্য। সোমালিয়াতে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। কাজেই, কেনিয়ায় বসবাসরত সোমালিয়ান মেয়ে খুঁজে নেওয়া হয় এই উদ্দেশ্যে। প্রথম সাক্ষাতেই তাঁর হবু স্বামী জানিয়ে দেন যে, তিনি ছয়টি ছেলে সন্তান নিতে ইচ্ছুক। আয়ান এই বিয়েতে অমত করে। কিন্তু তাঁর মতামতের কোনো মুল্য দেওয়া হয় না। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে আয়ান হস্তান্তরিত হয়ে যান তাঁর স্বা্মীর পরিবারের কাছে। দুই পরিবারের মিলন ঘটে। এবং এটাই ছিলো মূখ্য জিনিস। আয়ান এই সিস্টেমের ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র।
স্বামীর সাথে মিলিত হবার জন্য যাত্রা শুরু করেন আয়ান। জার্মানিতে ছিলো স্টপওভার। এখানেই সবকিছু খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে থাকেন তিনি। আর সেই ভাবনার ফল হিসাবে ক্যানাডাগামী প্লেনে নয়, বন থেকে এমস্টার্ডামগামী ট্রেনে চেপে বসেন তিনি। সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে পালিয়ে আসা একজন ব্যক্তি হিসাবে হল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন তিনি। এটি মঞ্জুরও হয়ে যায়। সমাজকল্যান ভাতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা শুরু করেন তিনি। ডাচ ভাষা শেখেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেন, লেখালেখি শুরু করেন, সেই সাথে নানা বিতর্কেও অংশ নেন। সবশেষে ডাচ পার্লামেন্টেও নির্বাচিত হন। এর কোনোটাই ইসলাম ত্যাগ নয়, কিন্তু এগুলোই ছিলো ক্রমে ক্রমে তাঁর ইসলাম থেকে বের হয়ে আসার কার্যক্রম।
বিরানব্বই থেকে দুই হাজার এক সাল পর্যন্ত ধর্মকর্ম পালনকারী একজন মুসলমান হিসাবেই তাঁর কেটেছে। যদিও ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশীলনগুলো কমে আসা শুরু হয়। নামাজ, রোজা বন্ধ হয়ে যায়, হিজাবও হয়ে পড়ে অবাঞ্চিত। তবে, মনের ভিতরেও তখনও তিনি রয়ে যান মুসলমান। এই সময় পাঁচ বছর তিনি তাঁর এক প্রেমিকের সাথে বসবাস করেন। এই প্রেমিক ছিলেন নাস্তিক। এর ঔরসে সন্তান নেবারও পরিকল্পনা করেন তিনি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে তিনি একটা দ্বৈত জীবন যাপন শুরু করেন।
এই দ্বৈত জীবন থেকে মুক্তি আসে নাইন-ইলেভেনের পর থেকে। এই সময় এই দ্বৈত জীবন যাপনের ভারসাম্য বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাঁর জন্য। এই সন্ত্রাসীদের মূল অনুপ্রেরণা যে নবি মোহাম্মদ, এটাকে বুঝতে তাঁর খুব একটা অসুবিধা হয় নি। তিনি প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। কিন্তু, যখন ডাচ রেডিও বা টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে যখন তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করা হচ্ছিলো যে, তিনি একজন মুসলমান কিনা, তখন তিনি টের পেলেন যে, তাঁর স্বর নরম হয়ে গিয়েছে। এর উত্তর দেবার জন্য শব্দ হাতাতে হচ্ছে তাঁকে।
এই অবস্থা থেকে মুক্তি আসে দ্রুতই। যদিও সেই মুক্তি ছিলো ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক। তাঁর মনের মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলো ছিলো সেগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে এগিয়ে যান তিনি। কোরান আল্লাহ লেখে নি, মোহাম্মদ নৈতিকতার পথপ্রদর্শক না, মৃত্যুর পরে কোনো জীবন নেই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে নি, এই ধারণাগুলো মনের মধ্যে মুক্ত হয়ে আসে। ধর্মবিরোধী এই অবস্থান নিয়ে ইসলামে থাকা সম্ভব নয়। এটা ইসলামের মুল স্তম্ভকেই চ্যালেঞ্জ করা। এই চ্যালেঞ্জের মাধ্যমেই দীর্ঘ এক যাত্রার শেষে উৎপথে গমন শুরু হয় তাঁর।
তারপরেও তাঁর এই উৎপথে গমনকে, ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার যাত্রাকে, শুধুমাত্র নাইন-ইলেভেনের অবদান বললে ভুল হবে। যদিও এটিই ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করেছে। নাইন ইলেভেনের পরেই তিনি মুসলমান হিসাবে তাঁর বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছেন। যদিও এর পিছনে মূল কারণ হিসাবে রয়ে গিয়েছে, তারও আগে পশ্চিমা চিন্তা-ধারার সাথে তার চেনা পরিচয় এবং সংশ্রব। এই পশ্চিমা চিন্তা-ধারা যৌক্তিক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়, মুল্যায়ন করে এবং একে ডালপালা গজিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়।
মুসলমানরা ইসলাম ধর্ম কে নিয়ে খুব বরাই করে এটা নাকি শান্তির ধর্ম ………
splendid!!! অসাধারণ জীবনকাহিনী।।।।
কিন্তু আমি গভির ভাবে ঈস্বরে বিশ্বাসী । আমি বিশ্বাস করি তিনি আছেন , আমার -তোমার, ধূলা কনা থেকে মানুষ সকলের মধ্যেই সূক্ষ্ম রুপে । তাই দুই-এক কথায় তাঁর অস্তিত্ত সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল ।
ফরিদ ভাই,জানছি আরো জানতে উদগ্রীব হয়ে আছি।
লেখাটি পড়ে ভাল লাগল। লেখককে খনেক ধ্যবাদ এধরনের একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।
@Woashim Farooque আপনি একদম ঠিক লিখেছেন। আমিও আপনার সাথে একমত।
আসলে ধর্ম নিয়ে কেই গভীর কোন চিন্তাভাবনা করে না সবাই গতানুগতিক ভাবেই ধর্ম কে অনুসরণ করে । ঠিক ভাবে ভাবনাচিন্তা করলে সবার জীবনই আয়ান হিরসি আলির মতই হবে । বাস্তবতা হলো ধর্মের কিছু রীতি আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপনের মধ্যে এমন ভাবে অনুপ্রবেশ করেছে যে অনেকের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এই গেরোকল থেকে বেরহতে পারচ্ছেনা । কোন ধর্মই মানেনা এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এমনই চলতে থাকবে ।
লিখাটি ভাল লেগেছে , লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
“রনে বনে জলে জংগলে যেখানে ই বিপদে পড়বে সেখানেই আমাকে স্বরন করবে, আমি ই উদ্ধার করব।”-লোকনাথ ব্রহ্মচারী
তো হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসীদের মতে যে স্হানেই কোন না কোন ভাবে বিপদগ্রস্হ হবে তখই লোকনাথ ব্রহ্মচারী স্বরন করিবে ঐ বিপদ থেকেই লোকনাথ ব্রহ্মচারী তাকে উদ্ধার করবে । একজন মেয়ে যখন ই ধর্ষনের স্বীকার হন তার চেয়ে বিপদের সময় আর কিছু হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করিনা তাই যখন একজন ধর্মে বিশ্বাসী মেয়ে ধর্ষনের স্বীকার হন তখন তিনি নিরুপায় হয়ে অবশ্যই তার বিশ্বাসের সৃষ্টি কর্তার কাছে সাহায্যের স্বরনাপন্ন হন তখন বেচরা নিজের শক্তি বা সামর্থের কথা ভুলে শুধু তার সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ খোদা ঈশ্বর ভগবান বা তথা কথিত কোন মহাপুরুষের সাহায্য কামনা করেন কিন্তু তখন সেই সৃষ্টি কর্তা বা মহাপুরুষ কাপুরুষের মত বোধ হ্য় ব্লু ফ্লিমের মত ঐ ধর্ষনকে উপোভোগ করেন । তাই
ট্রেন , বাস, মাইক্রোবাসে ট্রাক ট্রালারে ধর্ষনের শিকার হইবে তখন ও লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে স্বরন করিবে ধর্ষক আরো বেশি কাম উত্তেজনায় ধর্ষন করিয়া আনন্দিত হইবে ।-জয় বাবা লোকনাথ জয় হোক তোমার সৃষ্টি কর্তার ।
@Woashim Farooque
ঠিক বলেছেন
Comment…ধর্ম,তুমি কি যাবে নাকি অন্তর অবিজ্ঞানের ধবল ধোলাই দিয়ে তোমাক বিদায় করতে হবে?যাওয়ার আগে কিছু অভিযোগের কলংক নিয়ে যাও-১।নিজেকে যদি এতই শ্রেষ্ঠ মনে কর তবে তোমার মধ্যে এত বিভাজন কেন,কেন-হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান এত নানান জাত আবার তাদের ভিন্ন ভিন্ন মত?
২।তোমাকে নয় ধর্ম তোমাদের যে সৃষ্টি করল সে কোথা থেকে সৃষ্টি হল?
৩।তোমার দাবীর মত তুমি নিঁখুত হলেনা কেন?
৪। নরকের খাতায় নাম লেখানোর পরে কেন আমায় পৃথিবীতে পাঠালে, জন্মের আগে আমার কী দোষ ছিল?
৪।তোমার ইশারাতেই সব কিছু ঘটবে তাহলে আমাদের বিপথগমনেও তোমার ইশারা নেই কি?
হায়রে ধর্ম!তুমি যে কিছু অদূরদর্শী,অনঅভিজ্ঞ স্বার্থপর লোকের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সৃৃষ্টি হয়েছো এই বিজ্ঞনের যুগে তা বুঝতে কারো বাকি থাকবেনা তা তুমি জেনে রাখ।
“৪। নরকের খাতায় নাম লেখানোর পরে কেন আমায় পৃথিবীতে পাঠালে, জন্মের আগে আমার কী দোষ ছিল?
৪।তোমার ইশারাতেই সব কিছু ঘটবে তাহলে আমাদের বিপথগমনেও তোমার ইশারা নেই কি?”
@শাহিন শাহ,
আসলেই কি এর কোনও উত্তর আছে?
খুবিই সুন্দর লেখা
হ্যাঁ, শিক্ষানবিস ভাইয়ের বক্তব্যকে আমি যৌক্তিক মনে করছি। তবে ফরিদ ভাই,, তাঁর নারী জীবনের কিছু উপাখ্যান সম্ভবতঃ তাঁকে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে আরোও গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো বলে কোথায় যেনো পড়েছিলাম ক’দিন আগে। তবে তাঁর জীবনের শুরুর যে ঘটনাক্রম, তা এতো বিস্তারিত জানতাম না। সেটা জেনে এখন ঠিক একটা উপলব্ধীতে পৌঁছেছি যে তাঁর এ ধর্ম বিচ্যূতি হঠাৎ নয়, এক পরিবর্তনশীল আত্মোপলব্ধীর ধারাবাহিকতা।
এতটা ক্ষ্যাপা মনোভাবে না লিখে যুক্তিতর্কের বিশালতার সম্প্রাসরন জরুরি নয় কি। তাছাড়া আয়ান হিরসি একমাত্রিক আমেজ ফুটিয়ে যৌক্তিক ব্যাংখ্যা করেন যা কিছুটা হলেও দৃষ্টিকটু।
আমি সাধারণভাবে আয়ান হিরসি আলি’র দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করি না, এবং তার কথাবার্তা আগে যা শুনেছি তা বেশ একমাত্রিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেশ বাজে লেগেছে।
তবে আপনার এই লেখাতে তার জীবনীটা পড়ে উপকৃত হলাম। এতকিছু জানতাম না। হয়ত ধর্মের বিরুদ্ধে এরকম সংগ্রাম করতে হয়েছে বলেই এতটা ক্ষেপেছেন।
জটিল অসাধারণ এক জীবন যাত্রা। এরকম আরও আয়ান হিরসি আলির আগমনই ধর্মের অচলায়তন ভাংগার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
হা রিয়েলি জটিল অসাধারণ এক জীবন যাত্রা। বিয়িয়ন বিলিয়ন মানুষ কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাস করে আজো
নাস্তিকেরা বলে থাকে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস একটি অন্ধবিশ্বাস। তারা বলে, যেহেতু আল্লাহকে দেখা যায়না, ধরা যায় না, শুনা যায় না, লজিক দিয়ে প্রমাণ করে যায় না – কাজেই আল্লাহ্ বলে কিছু নেই। কিন্তু, বাস্তব হলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস এবং সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করা মানুষের জন্মগত স্বভাব। আর যদিও নাস্তিকেরা নিজেদেরকে যুক্তিবাদী বলে দাবী করে, কিন্তু সত্য হলো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব যুক্তি বা লজিক দিয়ে প্রাচীণ কাল থেকেই প্রমাণিত হয়ে এসেছে।
বর্তমানে আমরা যে লজিক বা যুক্তিবিদ্যা পড়ি, তার আবিষ্কারক হলো প্রাচীণ গ্রীকের পন্ডিতগণ। গ্রীকের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত লজিশিয়ান বা যুক্তিবিজ্ঞানী ছিলেন প্লেটো এবং তার ছাত্র এরিস্টোটল, যারা লজিককে formal discipline হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। আপনি জানেন কি এরা দুজনেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব (তাদের ভাষায় ‘unmoved mover’) বিশ্বাস করতেন? এরা দু’জনেই যুক্তি দিয়েই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে গেছেন। এর মাধ্যমে এটুকু বোঝা গেল, যুক্তিবাদী(?) নাস্তিকেরা যুক্তিবিদ্যার পিতা / পিতাতুল্যদেরকে নিজেরাই বিশ্বাস করে না।
এবার আসুন দেখি প্লেটোর যুক্তি কি ছিল। প্লেটো যে যুক্তিটি ব্যবহার করেছিলেন সেটা হলো, Design Indicates Designer, অর্থাৎ – প্রতিটি নকশারই নকশাকারী আছে। মহাগ্রন্থ কোরআনে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এই একই যুক্তি দিয়ে বার বার অবিশ্বাসীদের নিকট স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন (যেমনঃ সূরা আন’আম ৬:৯৯, সূরা রুম ৩০:২০-২৭)। উদাহরন দিয়ে বুঝানো যাক। আপনি যদি সমুদ্র পারে একটা বালির ঘর দেখেন, আপনি কি চিন্তা করবেন – বাহ কি সুন্দর একটা ঢেউ এসেছিল যেটা একটা বালির ঘর তৈরি করে চলে গেছে? নাকি এটি চিন্তা করবেন, নিশ্চয়ই এখানে কোন মানুষ এসে এটা বানিয়েছিল? কাকে আপনার যুক্তিবাদী মনে হয়? এটা সম্পূর্ণই অযৌক্তিক হবে যদি কেউ বলে, যে ঐ বালির ঘর ভাগ্যক্রমে বা হাজার হাজার ঢেঊ এর মিশ্রনে হয়েছে। বরং সাধারণ বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন যেকোন মানুষই বলবে যে ঐ বালির ঘরটি নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তৈরী করেছে। কারন, প্রতিটা সৃষ্টির পেছনেই স্রষ্টা থাকে। ঠিক একইভাবে, এই মহাবিশ্ব এবং এর ভিতরের সবকিছুর অবশ্যই একজন স্রষ্টা আছে।
আয়ান হিরসি আলির আগমনই ধর্মের অচলায়তন ভাংগার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এ কথা যুগ যুগ ধরে মিথ্যা প্রমানিত। তার মত ২ / ৪ জন মিস্টার ইবলিসের পথ বেছে নিলেও প্রতিদিন অনেক মানুস ধর্মের দিকে আরও বেসি আগ্রসর হছচেন। পৃথিবির বুকে এখনো দ্রুত প্রসারিত ধর্মের নাম ইসলাম।
@ A.Hamid,
না হয় মেনে নিলাম সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু / কেউ আছে। কিন্তু সেটা কি বা কেউ না জেনেই আপনি কি করে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা আল্লাহ। সেটা তো গড, কৃষ্ণ , বুদ্ধ বা আরো কেউ তো হতে পারে। বিজ্ঞানের অসুবিধা হলো না জেনে বা না বুঝে সে বলতে পারে না যে সৃষ্টিকর্তা আছে। আপনার সুবিধা হলো আপনি না জেনেও বলে দিতে পারেন যে তিনি আছেন এবং নিশ্চিত ভবে তিনি আল্লাহ।