ঢাকার ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া দরকার?
বিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরশন (ডিসিসি) এলাকার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ ডিসিসিতে নির্বাচনের হাওয়া বইছে। ঢাকার মেয়র বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ঢাকা সময়ের সাথে সাথে যত বড় হয়েছে মেয়রের গুরুত্ব ততই বেড়েছে। সম্ভবত একই সাথে রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষেও সেটা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের একটা সম্ভাবনা হিসাবে দেখা দিয়েছে। নানা সময়ে নীতিগত ভাবে স্বিকার করলেও বাস্তবে স্থানীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার বিষয়ে সরকারগুলোকে তেমন আগ্রহী মনে হয়নি। ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে কখনোই তেমন আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের জন্য খুব জরুরি। ঢাকার বেলাতে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন আলাদা গুরুত্ব বহন করে। বাসযোগ্যতার বিচারে ঢাকার ক্রমাগত পতনের মুখে নগর পরিকল্পনাবিদরা নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হন। অনেকেই জানতে চান, কী করলে ঢাকার এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব? এক কথায় অনেকেই নানা সময়ে বলেছেন ঢাকার জন্য নির্বাচিত আঞ্চলিক নগর সরকার (Metropolitan Regional Government) প্রয়োজন। এমন উত্তর দেবার কারণটি বোঝা খুব কঠিন নয়। ঢাকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যিনি থাকবেন তাকে আরো বেশি ক্ষমতা দিতে হবে এবং একই সাথে জবাবদিহিতার অধীনে আনতে হবে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই জবাবদিহিতা যতটা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তার চাইতে বেশি হবে শহরের অধিবাসিদের কাছে। গবেষণায় দেখা গেছে [১] ঢাকার ব্যবস্থাপনার সাথে ১৯ টি মন্ত্রনালয় এবং ৫১ টি জাতীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত। যে কেউ এই সংখ্যাটির কথা ভাবলেই আঁতকে উঠবেন, এতগুলো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় তাহলে কীভাবে ঘটে? কার্যত এই শুন্যস্থানই পুরণ করার কথা ছিল একজন নগর সরকার বা গভর্নরের অথবা উপযুক্ত ক্ষমতায়নের পর মেয়রের। ফলে এই সমন্বয়ের জন্য দরকারি ক্ষমতাও তাঁকে পেতে হবে। মেয়র বলতে আমরা যে দায়িত্ব এবং ক্ষমতা এতদিন বুঝে এসেছি সেটা এতটাই সীমিত যে, বাসযোগ্যতার প্রশ্নে ঢাকার যেই দুর্গতি তাতে তিনি তেমন পরিবর্তন আনতে পারবেন না। কাজেই মেয়রের স্থলে নগর সরকার এনে তার কার্যপরিধি বিস্তৃত করাকে অনেকেই সমাধান বলে ভেবেছেন।
নগরবাসির ভূমিকা কোথায়?
শহরের অধিবাসিদের কাছে মেয়রের জবাবদিহির বিষয়টিতে একটি প্রসঙ্গ সবার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের চাপে আমরা ভুলেই যেতে বসেছি যে ঢাকা শহর কেবল মাত্র কল-কারখানার বাসস্থান নয়, এখানে মানুষও থাকে। তাদের বিশুদ্ধ পানি, খোলা স্থান, খেলার মাঠ, দৃষ্টিনন্দন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, নিরাপদ নগর জীবন যাপন, স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা এসবের প্রয়োজন হয়। এই সুযোগ সুবিধা কেবল মাত্র বর্তমানের সুযোগ সুবিধা নয়, শহরের প্রতিটি নাগরিকের ভবিষ্যত কেমন হবে সেটাও ঠিক করে দেয় এই নগরের পরিবেশ ও পরিসেবার মান। সমাজে ন্যয়বিচারের ধারনা কতটা পরিনত নাগরিক সুবিধা সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে ন্যায্যতার সাথে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু চারপাশে উন্নয়ন বলতে যে ধারনার বাস্তবায়ন আমরা দেখি সেখানে ঢাকার উন্নয়ন বলতে আমরা কয়েকটি গৎবাধা প্রবনতা দেখি, যেমন: নিচু জমি আর জলাশয় ভরাট করে নতুন দালান, কল-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি, জানযটের “সমাধানে” একের পর এক ফ্লাই ওভার তৈরি, শহরের রাস্তা ব্যবহারর জন্য বেসরকারি খাতকে ফি (টোল) দেয়া, পরিবহণ ব্যবস্থায় অতিবানিজ্যিকিকরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারের অপরিনামদর্শি ব্যবহার (যেমন সি.এন.জির ক্ষেত্রে), শহরের পরিবহন ব্যবস্থাপনার কারিগরি দায়িত্ব পুলিশের হাতে অর্পণ। উলটোপথে হাঁটার এমন আরো উদাহরণ দেয়া যায়। প্রশ্ন করা প্রয়োজন এই সিদ্ধান্তগুলো যখন নেয়া হচ্ছে সেখানে নগরবাসিদের সাথে আলোচনা বা তাদের চিন্তাভাবনা জানার কোন চেষ্টা কি করা হয়? আমরা দেখি এক্ষেত্রে নগরবাসিকে মূলত দর্শক হয়েই থাকতে হয়েছে। যেন কোন এক অদৃশ্য শক্তি ক্রমাগত ঢাকার “উন্নয়ন” করে চলেছে। নগরবাসি জানতে পারে নি, তাদের সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব কাদের। একটু ভেবেচিন্তে দেখলেই, বাজার অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের প্রভাবের জায়গাটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই ক্ষেত্রে প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল ডিসিসির উত্তরে যাদের প্রার্থী হিসাবে প্রাথমিক ভাবে পছন্দ করছিল তাদের পেশাগত পরিচয়ের দিকে তাকালেই কিছুটা ধারনা পাওয়া সম্ভব। রাজনীতির সাথে ব্যবস্যার এই ধরনের সংশ্রব বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে যেমন একটি ভাবনার বিষয়, নগর জীবন এবং পরিবেশের উপরও এই ধারাটির নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নগরবাসিকে নগরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পক্রিয়ার সাথে অংশ নেবার সুযোগ তৈরি করে দেবার মাধ্যমে এসব নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
ডিসিসির বিভাজন
সরকারের পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক কাঠামোতে কোন পরিবর্তন আনা হলে সে সিদ্ধান্ত জনস্বার্থের জন্য কতটা অনুকূল তা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। ডিসিসি দু’ভাগ হবার সিদ্ধান্তটিতে জনস্বার্থের দিকগুলো নিয়ে তেমন কোন আলোচনার খবর আমরা জানতে পারি না। ডিসিসির বিভাজন বিষয়ক বিল সংসদের চৌকাঠ পেরোতে সব মিলিয়ে সময় লেগেছিল দশ মিনিট। ডিসিস ভাগ করা কেন যৌক্তিক এই বিষয় নিয়েও নীতিনির্ধারকরা আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টাও তেমন করেন নি। যারা যুক্তি দিচ্ছেন তারা তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসাবে দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের চোখে ডিসিসির বিভাজন একটা হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা ছিল। তবে এই হতাশার মধ্যেও আশার কথা ছিল — নগরবাসি নিজের ভালোটা বুঝতে পারছিল এবং এই বোধটা নাগরিকের নগর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত। কাজেই বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের অবস্থানও ছিল বিভাজনের বিপক্ষে। বিষয়টি কয়েক বছর পুরানো হলেও অপ্রাসংগিক হয়ে যায় নি। তাই ডিসিসি নির্বাচনকে সামনে রেখে ডিসিসির বিভাজন নিয়ে আলোচনাটি পুনরায় তুলে ধরছি।
নগরের ভৌত এবং কার্যকাঠামোর সাপেক্ষে মূল্যায়ন
মানুষের বাসস্থান, রাস্তাঘাট, বাজার, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছু গড়ে ওঠে পরস্পর সম্পর্কুযুক্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ফলে নগরের কাঠামো অনেক দিন ধরে একটু একটু করে গড়ে ওঠে। কাজেই ভৌত এবং কার্যগত (functional) কাঠামো যেকোন নগরকে বোঝার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নগর পরিচালনা বা বা নগরবাসিদের সেবা প্রদানের কাঠামো এই ভৌত এবং কার্যগত কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়। ডিসিসি ভাগের পক্ষে যুক্তি দেয়া হয়েছিল, ঢাকা শহর অনেক বড় হয়ে গেছে। এর বিস্তার আগের ক্ষুদ্র পরিসর থেকে বেড়ে অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছে। কোন সন্দেহ নেই তাতে। আর বড় একটি নগরের ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাবার মত একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, এই সমস্যার সমাধানের জন্য ডিসিসিকে দু’ভাগ তখনই করা যেত যদি আমারা দেখতাম ঢাকা শহর ভাগ হয়ে দু’টি শহর হয়ে গেছে। কিন্তু আদতে হয়েছে উল্টোটা; ঢাকার বিভিন্ন অংশের মধ্যে যতটা ফাংশনাল দূরত্ব আগে ছিল সেটা সময়ের সাথে কমে এসেছে। অন্তত ক্রমবর্ধমান জানযট থেকে আমরা যেটা বুঝি শহরের ভেতরের নানা অংশের মধ্যে ক্রমাগত যোগাযোগ এবং লেনদেন বেড়েই চলেছে। এর আগে সবাই চাকরি করতে যেত শহরের একটি বানিজ্যিক কেন্দ্রে এখন শহরের একাধিক বানিজ্যিক কেন্দ্র — মিতিঝিল, কাওরান বাজার, ধানমন্ডি, গুলশান এমনকি উত্তরা সব যায়গাতেই মানুষের কর্মক্ষেত্র আবার আবাসক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। মানুষ নগরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাচ্ছে জীবিকা, শিক্ষা, চিকিৎসা নানা প্রয়োজনে। ফলে নগরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ কমে না গিয়ে বরং অনেকাংশেই সেটা বেড়ে গেছে। কাজেই সময়ের সাপেক্ষে নগর হয়ে উঠেছে আগের তুলনায় অনেকটাই অবিভাজ্য। ফলে ডিসিসি ভাগের মত বিষয়টি একজন সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ গবেষক যে কারো চোখে একটা খেয়ালি সিদ্ধান্ত হিসাবে ধরা দিয়েছিল।
কেন্দ্রীয় সমন্বয় প্রসঙ্গে
শহরের কার্যপ্রনালীকে মানবদেহের সাথে তুলনা করা যায়। একটা দেহে অনেক অঙ্গ-প্রত্যংগ থাকে সেগুলোর মধ্যে যোগাযোগের সমন্বয় ঘটে আমাদের মস্তিষ্কে। প্রতিটি অঙ্গ নিজ নিজ কাজ করলেও সমন্বয়ের ব্যপারটা ওখানেই ঘটে। একটি মাথা নিয়েই এই জগতের বেশির ভাগ প্রানীর জীবন ধারন — এটা কোন দৈব দুর্ঘটনা নয় — এই বিন্যাসের একটা ব্যবস্থাপনাগত সুবিধা রয়েছে। জীবজগতে আমরা প্রাণীর দেখের কার্যাবলির এরকম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ই দেখি। যেকোন নগরী ব্যবস্থাপনা এবং সেবাপ্রদানের ব্যপারটিও একটা কেন্দ্রীয় কর্তার হাতে থাকা দরকার — যেমন একটা শরীরের জন্য দরকার একটা মাথা। রাবন বা মেডুসার যায়গা কেবল রূপকথায় — নগর পরিচালনার ব্যপারটি সেই তুলনায় নিতান্তই পার্থিব সমস্যা। নির্বাহের নানা বিষয় বিকেন্দ্রিকরন করা চলে কিন্তু একটা শহরের সমন্বয়ক একাধিক হতে পারে না কারন সেটা একটা শরিরের মত। যখন শহর বড় হয়ে যাবার প্রশ্ন আসছে তখন কার্যের নির্বাহগত সমস্যাই প্রকট হবে তখন একজন সমন্বয়কের অধীনে নগরের বিভিন্ন অংশকে এনে প্রতিটা অংশের নিয়মিত কার্যক্রম হতে পারে কেন্দ্রীয় পরিচালনার নির্দেশনায়। কিন্তু সমন্বয়ের ব্যপারটিকে ভাগ করা চলে না।
আটপৌরে নাগরিক অভিজ্ঞতা ও পরিসেবা সমন্বয়
আমরা দেখে আসছি এরমধ্যেই রাজঊক, সিটি কর্পোরেশান, ওয়াসা, ডেসা-ডেসকো ইত্যাদি নানারকমের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার সমন্বয়ের অভাবে নগরবাসিকে নানারকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ঢাকার জীবনে বৃষ্টির মৌসুম মানে কাদামাখা, আর শুকনো মৌসুম মানে ধুলিধূসর। স্বভাবতই এই সব দুর্ভোগের অবসানের দাবিটা নগরবাসি বা নগর সংক্রান্ত নানাবিধ ফোরামের পক্ষে থেকে অনেক দিন ধরেই উঠে আসছে এবং বরাবরের মতই দাবিগুলো হচ্ছে উপেক্ষিত। এর প্রধান কারণ কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারি এবং কার্যকর এখতিয়ার সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের অভাব। ফলে পুনর্গঠন বলতে যদি কিছু করতে হয় তাহলে সেটা সমন্বয় ব্যবস্থাকে আরো মজবুত করবে এমনটাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ডিসিসি ভাগের মধ্য দিয়ে ঠিক তার উল্টোটাই করা হল। ঢাকা যে বাসযোগ্যতার বিচারে অসহনীয় একটি স্থানে পরিনত হয়েছে এ নিয়ে নীতিনির্ধারকরা তেমন কিছু করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না।
নগর দারিদ্র ব্যবস্থাপনার চেহেরা কি হবে?
নগর কোন দিকে যাবে আর তার কি পরিনতি হবে সেক্ষেত্রে কিছু বলার সুযোগ নেই নগর দরিদ্র বা ভাসমান মানুষদের। ডিসিসি ভেঙ্গে দুই ভাগ হবার ফলে এদের জীবনে অনিশ্চয়তা বাড়ার সম্ভাবনা। আধুনিক শহরগুলোর ব্যবস্থাপনা সবসময়ে এই মানুষগুলিকে নগরে অনাকাঙ্খিত হিসাবে দেখে আসছে। নানা অজুহাতে শহরের কর্তারা এদের তাদের বাসস্থান থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছেন। ডিসিসি ভাগের মধ্য দিয়ে এমন একটি পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে বা হবে যাতে ডিসিসি দক্ষিণ এদেরকে পাঠাতে চাইবে উত্তরে, আর উত্তর পাঠাতে চাইবে দক্ষিণে। এটা কেবল দরিদ্র নগরবাসির বাসির বেলাতে নয়, যে কোন সমস্যাই নগরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পাঠিয়ে দিতে আর ভালগুলো নিজের অংশের দিকে টেনে নিতে প্রতিযোগীতা শুরু হবে। নগরের একাংশের উন্নয়নের শিকার হবে অন্য অংশ। দুই ডিসিসির বাস্তবতা নগর ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব (Conflict of Interest)। ঢাকা শহর নগর ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের কাছে একটা ব্যার্থতার উদাহরণ হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। এর মধ্যেই আমরা দেখেছি, উত্তর আর দক্ষিণে বৈষম্যের প্রসঙ্গ নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে [২]। যদিও এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা স্থানীয় সরকার পর্যায়ে হলেই ভাল হত।
দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতার বাড়বে না কমবে?
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শহর হিসাবে গুরুত্বের বিবেচনায় ঢাকা শহর অন্য যেকোন শহর থেকে আলাদা। এই গুরুত্বের কারণেই সারাদেশ থেকে শহরের মুখে মানুষের ঢল। একটা সামান্য শহর সময়ের সাথে পরিনত হয়েছে কর্মচঞ্চল শহরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হলেও মানুষ নানা কাজে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে যাচ্ছে, জীবন আর জীবিকার তাগিদে। অদূর ভবিষ্যতে এই ঢাকামুখীতা বাড়বে বৈ কমবে না। আর পাশাপাশি ঢাকা শহরের ওপর উঠে আসবে নানামুখি চাপ। এই চাপ সামলাতে ঢাকা শহ যেকোন নগর বা স্থানীয় সরকারের নিজস্ব নির্বাহি ক্ষমতা বাড়াতে হবে — যাতে যেকোন চাপের মুখে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া যায়। উদাহরণ হিসাবে আসতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব যখন উপকূলে পড়তে শুরু করবে, বাসস্থান এবং জীবিকা হারিয়ে মানুষ শহরে আসবে। এমন অবস্থায় ঢাকা শহরকে কাচের মত ভেঙ্গে পড়লে চলবে না বরং লোহার মত ঘাতসহ হতে হবে। সেই জন্যেই নগর ব্যবস্থার ফ্লেক্সিবিলিটি এখন নগরকেন্দ্রিক গবেষনার একটা কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিনত হয়েছে। এখন ডিসিসি দুই ভাগ হবার দরুন যেটা হতে যাচ্ছে তাতে করে ঢাকা পরিচালনগত ফ্লেস্কিবিলিটি কমে যাবে বলেই আশঙ্কা জাগে। কেননা এখন নগর ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়ায় স্বার্থের দ্বন্দ্ব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, কালক্ষেপণ এবং কেন্দ্রের উপর নির্ভরতা বাড়বে। কাজেই যেকোন দুর্যোগের মুখে মুখ থুবরে পড়তে পারে ঢাকা। দুর্যোগ মোকাবেলায় বর্তমান ঢাকার সক্ষমতা যেটুকু রয়েছে সেটুকু কমে যাবে বহুলাংশে।
বাংলাদেশের নগরায়নের বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশের নগরায়নের যেই প্রকৃতি তাতে বড় শহর হিসাবে ঢাকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ছোট বা মাঝারি শহর গুলোর বিপরীতে যখন বড় শহরগুলো অনেক বেশি জনসংখ্যাকে টানে এই পরিস্থিতিটা উন্নয়নের বিবেচনায় ভাল চোখে দেখা হয় না। নগর ব্যবস্থাপনার পরিভাষায় এই অবস্থাকে বলে প্রাইমেসি। সেই পরিভাষা ঢাকা একটি প্রাইমেট শহর (primate city)। দেখা গেছে অনুন্নত দেশে যেখানে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভাবনা সীমিত সেখানেই একটি প্রধান শহরকে কেন্দ্র করে দেশের নগর ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক নগর ব্যবস্থা একই রকম প্রাইমেসির সমস্যায় আক্রান্ত — এর অন্যতম প্রধান কারণ দুর্বল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। সারা বাংলাদেশের নগর পর্যায়ের স্থানীয় সরকারগুলোর হাতে ক্ষমতা কম থাকায় স্থানীয় অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন অথবা যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় তারা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে না। সিদ্ধান্ত আর অর্থায়নের জন্য তাদের সরকারের উচ্চতম মহলের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। তাছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর সাংসদদের নিয়ন্ত্রণের ছড়িও স্থানীয় সরকারগুলোর দুর্বল হয়ে থাকার পেছনে বাড়তি ইন্ধন যোগায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকার বেশি ক্ষমতা নিজের হাত রাখতে চায় বলে স্থানীয় সরকারগুলোকে বেশি ক্ষমতা তারা দেয় না বা দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এখন ডিসিসি ভাগ হবার ফলে মেয়রের ক্ষমতা কমে যাবার দরুন ঢাকা আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।
কিন্তু এই পরিনতি যে অবধারিত এমন তো নয়। বিভক্ত ডিসিসিতে নির্বাচনের মুহূর্তে নগর সরকার এবং স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গটি আলোচনা করে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়ত অর্জন করা যাবে না। কিন্তু ঢাকা মহানগরের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের কী ধরনের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চাই, সেটা নিয়ে আলোচনা চলমান থাকা খুব দরকার। এমনকি যারা নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন তাদের সামনেও প্রসঙ্গটিকে উত্থাপন করা দরকার। তারা কী মনে করেন একজন সীমিত ক্ষমতার মেয়র হয়েও তাঁরা ঢাকার কাঙ্খিত উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হবেন? প্রশ্নটি আমাদের অস্তিত্বের, ভবিষ্যতের। তাই আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক আমাদেরই করতে হবে।
তথ্যসূত্র:
[১] Mohit, M A (1992) ‘Institutional Arrangement for the Development of Dhaka Metropolitan Area: Problems and Issues’, Urban Land Management in Bangladesh, Nazrul Islam & Aminul Islam Chowdhury (eds)
[২] দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার উন্নয়নে বৈষম্য নিয়ে ক্ষোভ, দৈনিক যুগান্তর, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪ [লিঙ্ক]
ঢাকা শহর পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর একটি। বাসযোগ্যতার যে বৈশ্বিক তুলনা দেয়া হয় সে প্রসঙ্গ না তুলেও বলা যায় আমাদের শহরগুলোতে বাস্তবসম্মত কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয়না। নইলে এত বড় একটা শহর – অথচ কার্যকরী গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই! ভালো লাগলো আপনার লেখা। কলম চলুক।
ধন্যবাদ প্রদীপ দেব। বাস্তবসম্মত উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রসঙ্গ যেহেতু তুলেছেন, বলে রাখা ভাল পরিকল্পনা সম্ভবত পরিচিত পেশাগুলোর মধ্যে সবচাইতে বেশি রাজনৈতিক। বাংলাদেশে এই পেশাটির বাস্তবতা সেই বিচারে বেশ কঠিন। নগরের ভবিষ্যত কোন দিকে ধাবিত হবে সেটা নির্ধারণ করার ভার দৃশ্যত নগর পরিকল্পনাবিদদের হাতে থাকলেও মূল নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন ব্যবসায়িরা, বিশেষ করে আবাসন ব্যবসায়িরা। একটু একটু করে এই নিয়ন্ত্রনটি তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন এই পেশাটির উপর। ফলে উন্নয়ন পরিকল্পনা মুনাফা তৈরীর ইন্সট্রুমেণ্টে পরিনত হয়েছে। কার্যত এই সংকটগুলো আমাদের দেশের বা সমাজের বৃহত্তম সংকট হলেও দেখা যায় জনমানসের দৃষ্টিতে বা আলোচনায় বিষয়গুলো গুরুত্ব তেমন পায় না। গণপরিবহন নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে। উৎসাহ দেবার জন্য ধন্যবাদ।