“শাণিত চাপাতি হয়ে কোপ দিলে যাপন দর্শনে
পথজুড়ে গড়াগড়ি গেল সাদা চিন্তার মগজ
তবু, সাধ্য কী ঠেকাবে আমার অজস্র ক্লোনজন্ম তুমি”
-মুজিব মেহদী
ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারীর পর থেকে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। পত্র-পত্রিকা, স্যোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ- সবখানেই অভিজিতদার হত্যাকান্ডের ছবি- একজন আহত মানুষ রাস্তায় পড়ে আছেন, তাঁর রক্তাক্ত স্ত্রী সাহায্য চাইছেন চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষদের কাছে, সেই নির্বিকার মানুষেরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে দেখছে, সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসছে না কেউ। চোখ বুঁজলেই এই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন ফিরে ফিরে আসে- কেউ এগিয়ে আসছে না- কেউ কেউ মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলতে ব্যস্ত! আমার জীবনে এমন ভয়াবহ কিছু কি আমি আগে দেখেছি? জীবনের বাকী দিনগুলোয় দেখার আশা করি? – না! মানুষের এই নির্লিপ্ততার থেকে ভয়াবহতম কিছু আর হতে পারে না। দেশের সাধারণ মানুষের এই অশ্রাব্য নির্বিকার আচরণ দেখে বিশ্বাস জন্মাতে থাকে- অভিদার মতন একজন মানুষকে কি এরা এবং এই দেশ সত্যিই ডিজার্ভ করে! এই যে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন এবং তার জন্যে নিজের জীবন দিয়ে দেয়া- এত বড় আত্মত্যাগ আমরা ডিজার্ভ করি না। এই খুনের বিচার চাই- যদিও যারা বিচার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন প্রতিটি হত্যাকান্ডের- তাদের ওপরে সঙ্গত কারণেই ভরসা করার সুযোগ নাই। তবু মনে মনে আশা থেকে যায়- হয়তো এই বিশেষ হত্যাকান্ডটির ভেতর দিয়ে সমস্ত হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার সংস্কৃতি চালু হবে এই দেশে।
অভিজিৎদার মতন মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মানুষেরা চিরকালই বন্ধুর পথের একাকী পথিক ছিলেন। তাঁদের সাথে সমাজ ছিলো না, রাষ্ট্র ছিলো না, এমনকি যে মানুষদের জন্যে আলো নিয়ে তাদের এই নিঃস্বার্থ যাত্রা সেই মানুষও এদের সঙ্গ দেয়নি কোনোকালে। ইতিহাস এমনই সাক্ষ্য দেয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলতে গেলেই বিশ্বাসীরা কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিতে ছুটে আসে হাতে করাত-কুড়াল নিয়ে। ধর্ম দুর্বল মানুষের অন্তর্গত অসহায়তার সবচেয়ে করুন দৃষ্টান্ত! আত্মবিশ্বাসহীন মানুষের কল্পিত একজন স্রষ্টার সর্বগ্রাসী শক্তির ওপর নিজের ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দিয়ে শান্তি খুঁজে পেতে হয়। ঈশ্বর দুর্বল মানুষের প্রান্তিক নির্ভরতার স্থল। ঈশ্বরকে চিনতে হয়তো দুটো জিনিসই সবথেকে বেশি সাহায্য করতে পারে- একঃ বিজ্ঞান এবং যুক্তি, দুইঃ ধর্মগ্রন্থগুলোর নিবিড় পাঠ। আভিজিতদা আমাকে দ্বিতীয় পথটির সন্ধান দিয়েছিলেন। তাঁর উৎসাহেই কোরান আর উপনিষদ( সমস্ত আমি সংগ্রহ এখনও করতে পারিনি- দুইটা এডিশান মাত্র পেয়েছি) পড়া শেষ করে নিজেকে Zarathustra’র সেই পংক্তিটি শুনিয়েছিলাম – “Could it be possible? this old saint in the forest has not yet heard the news, that GOD IS DEAD.”
আমার জীবনের চরম একটি চরম মানসিক বিক্ষুব্ধ সময়ে আমি গুগল করে ‘muktomona’ইয়াহু গ্রুপটি খুঁজে পেয়েছিলাম ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে। বিক্ষুব্ধ অবস্থাটির কথা একটু বলি- যথেষ্ট রকমের রক্ষণশীল একটি পরিবেশে জন্ম এবং বড় হবার পথে একটা সময় নিজেকে শংশয়বাদী হিসেবে আবিষ্কার করে ওই বয়সটাতে এসে তখন চারদিকের তথাকথিত কাছের এবং আপন মানুষগুলোর থেকে আমি মানসিকভাবে সম্পূর্ণরকমে বিচ্ছিন্ন। নিজের অবস্থানটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না, স্বস্তি পাচ্ছি না- একটা ভয়ানক মানসিক একাকীত্ব এবং বিষাদের মধ্যে আবর্তিত। আশেপাশের কারও সাথে অধিকাংশ দর্শনগত এবং আধ্যাত্মিক ইস্যুগুলোতে একমত হতে পারি না- আবার নিজের বিশ্বাসের কথা স্পষ্ট করে প্রকাশ করার সাহসও রাখি না। আমি জানি না কেউ এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন কিনা আমার মত করে- গেলে হয়তো বুঝতে পারবেন। এরকম এক সময়ে মুক্তমনা ইয়াহু গ্রুপের মেইলগুলো পড়তে গিয়ে আমি আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলাম, মানসিক দোলাচল থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম- এবং চিনতে পেরেছিলাম নিজেকে। তখন ওখানে ধর্ম নিয়েই বেশি তর্ক হত, সেই তর্ক তখন বিষয় ছাড়িয়ে ব্যক্তিকেও আক্রমণ করতো কখনও কখনও। শুধুমাত্র একজন মানুষ সবসময় এই ব্যক্তিগত তর্কের ওপরে রেখেছিলেন নিজেকে- তিনি অভিজিৎ রায়। প্রায়ই বলতেন- তর্ক হবে বিষয়বস্তু নিয়ে, ব্যক্তিকে তার বাইরে রেখে। তাঁর মতন যুক্তি দিয়ে কথা বলতে খুব কম মানুষকেই দেখেছি। সেই থেকে অভিজিৎ রায় আমার সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন এবং প্রিয় মানুষ। তিনি ‘অভিদা’ হয়েছেন তার আরও দশ বছর পরে- যখন তাঁকে প্রথম দেখি নিউইইয়র্ক এ, ২০১১ সালে।
মুক্তধারার বইমেলার সেই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় এবং শেষ দিন গান শেষে মঞ্চ থেকে নামার সময় একজন ডাকলেন- তোমার সাথে একজন দেখা করতে চায়। নিচে নামতেই অভিদা-
” আমি অভিজিৎ, কাছেই এসেছিলাম একটা কাজে, ওদের বাংলা পত্রিকায় দেখলাম ‘মনিকা রশিদ’ গান করবেন- ভাবলাম ‘আমাদের ‘মণিকা হলেও হতে পারে, চান্স নিলাম একটা!’ আমার তখন আনন্দ কোনো বাঁধা মানছিলো না, লোকজন ডেকে এনে সবার সাথে তাঁকে আলাপ করিয়ে দেয়া; মীজান ভাইকে বলা যায় চেয়ার থেকে তুলে এনে অভিদার সাথে আলাপ করিয়ে দেয়া- ছবি তুলেটুলে একাকার করেছিলাম। অভিজিতদার মুখে ওই ‘আমাদের মণিকা’- আমি কখনোই ভুলবো না। প্রথম দেখায় কাউকে এত আপন করে নেয়া যায়- আমি জানতামই না! এত মেধাবী একজন মানুষের মধ্যকার এই অসাধারণ বিনয় যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য- আর আমার বলতে তো দ্বিধা নেই- আমার এই যে আজকের আমি- তার পেছনে অভিজিৎ রায়ের একটা বড় ধরণের ভূমিকা রয়েছে। মানবিকতা আর যুক্তিনির্ভর দৈনন্দিন জীবনযাপন আমি অভিজিৎ রায় এবং মীজান রহমানের কাছে শিখেছিলাম- মানুষের প্রতি মানুষের সংবেদ শিখেছিলাম তাঁদের কাছে। মুক্ত মন নিয়ে যাবতীয় সমস্তকিছুকে গ্রহণ করা এবং প্রশ্ন করাও অভিজিতদার কাছে শেখা। অভিজিতদা সেকথা জানতেন বলেই বিশ্বাস করি। পরের বছর বইমেলায় আমাকে যথাসম্ভব বিব্রত করে আমার বইয়ে অটোগ্রাফ নিয়েছিলেন- দীর্ঘ সময় ব্যাপী আড্ডা! আমি এসব কী করে ভুলবো! কী করে মেনে নেয়া সম্ভব যে এরকম একজন মানুষকে আমরা চোখের সামনে খুন হতে দেখলাম- কিছুই করতে পারলাম না বা করলাম না! এসব ভাবলে নিজের এবং নিজেদের অক্ষমতার জায়গাটা টের পাই- নিজের ভেতর জন্ম নেয়া অক্ষম রাগ একরকম প্রতাপশালী বিষন্নতায় রূপ নেয়। অবশ্য সেই অক্ষমতার স্থলটা আর থাকে না যখন দেখি বন্যাদি এই প্রবল শোক নিয়েও উঠে দাঁড়িয়েছেন, লিখছেন- শক্তভাবে নিজের অবস্থানটির কথা জানাচ্ছেন, প্রতিবাদ করছেন স্পষ্ট ভাষায়। দিদি, আমরা সবাই আপনাকে ভালোবাসি- যতটুকু শক্তি আছে সব নিয়ে আছি আপনার পাশে। যে আলোর মশাল নিয়ে অভিজিতদা হেঁটেছিলেন- সেই আলোকবর্তিকা কখনো নিস্ফল হওয়া সম্ভব না। সেই আলোর পথে একদিন আমাদের সন্তানেরা হাঁটবে, আমাদের সন্ততিরা হাঁটবে।
রইলো তাহার বানী
রইলো ভরা সুরে ….
থামবে না আলোর পথের এই যাত্রা
অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হয়ে আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। একা হয়ে পড়েছিলাম পুরোপুরিই। মুক্তমনার সন্ধান পেয়ে আসি মুক্তমনায়। দিনরাত পড়তে থাকি, মগ্ন হয়ে থাকি। দেখতে পাই, আমি একা নই, অন্ধত্বমুক্ত আরো অজস্র আছেন। আমি আশ্রয় নিই এখানে এসে, আমার একটা প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেবার জায়গা হয়। সেই জায়টাটি তৈরি করে রেখেছিলেন অভিদা মানুষকে আলোর পথ দেখাতে, মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচাতে। মুক্তমনা তথা অভিদা কাছে মার কতটুকু ঋণ তা বলে শেষ করার নয়।
আপনার মত আমিও ওনার কাছে কৃতজ্ঞ। উনি অনন্যসাধারণ ছিলেন। হৃদয়ে থাকবেন অনন্তকাল।