“আমার ধর্মের নাম মানব ধর্ম। আমার বিধাতা কোনো গোষ্ঠীর বিধাতা নন- তিনি সর্বমানবের, সর্বজীবের বিধাতা। সেই বিধাতা কারো পাপপুন্যের হিসাব রাখেন না খাতায়।”

– মীজান রহমান

২০০১ সালের দিকে। জাপানে গিয়েছি পড়াশোনা শেষ করে, প্রথমদিকে হাতে অনেক সময়- লাইব্রেরী থেকে খুঁজে খুঁজে ইংরেজী বই এনে পড়ি দুই একটা, কিন্তু মন চায় বাংলায় কিছু পড়তে। আমার ম্যাক পিসিতে তখন বাংলায় একমাত্র জনকণ্ঠ পড়া যায়- একদিন আরও একটি পত্রিকা পেয়ে গেলেম- দেশে বিদেশে, ক্যানাডা থেকে প্রকাশিত। সেইখানেই মীজান রহমানের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। তাঁর লেখায় মানুষের জন্যে অসীম মমতা, বিশ্বাস এবং উচ্চাশা দেখে আমার মনে হতো- এমন তরুন লেখকের দরকার আমাদের এখন। পুরো সমাজটা অন্ধকারে তলিয়ে যাবার প্রাক্কালে এই মানুষগুলো আলো নিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন- তার মানে ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা আশংকা করছি- ততটা বিমর্ষ হবার কিছু নেই! তখনও জানিনা, আটাত্তর বছর বয়ষ্ক এই তরুনের সাথে আমার একদিন সামনাসামনি আলাপ হবে- তাঁকে জানার এবং জেনে বিস্মিত হবার সময় আসবে একদিন!

‘কীভাবে বেঁচে থাকবো, এত ছোট্ট একটা জীবন আমাদের- কীভাবে এর সমস্তটুকু সুধায়, আনন্দে এবং অর্থবহতায় কাটানো যাবে?’ জীবন নিয়ে এটি একটি সাধারণ প্রশ্ন আমাদের। আমি জীবন নিয়ে আসলে ভাবিনি কখনও তেমন। ঘটনার অনিবার্যতায় বিশ্বাস রেখেছি- এবং বলা ভালো, তেমন উদাহরণ তখনও সামনে ছিলো না কিছু! প্রথম খুব গভীরভাবে ভাবনার সুযোগ যিনি করে দিলেন- দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর জীবন- আর সেই সমস্তের সবটুকুই হাঁ বোধক, শুভ প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তিতে পরিপূর্ণ;- নিরহংকার, মানবিক, কর্তব্যপরায়ন এবং দার্শনিক এই মানুষটির নাম মীজান রহমান! একজন বৃক্ষের মতন মানুষ তাঁর দু-বাহু প্রসারিত ছায়াতল নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন পথের মধ্যিখানে- কাছে গেলেই ছায়া মিলবে, শান্তি মিলবে, স্নিগ্ধতা মিলবে- আমরা যারা মীজান ভাইয়ের গুণমুগ্ধ, কিছুটা দেখেছি তাঁকে কাছে থেকে- তাঁদের কাছে তিনি এরকম!

10952656_10152788504999263_181566468_n

মীজান ভাইয়ের জীবন এবং কীর্তি নিয়ে ইতিমধ্যে অভিজিৎদা লিখেছেন, সেদিকে বরং না যাই আমি। মানুষ মীজান ভাইকে নিয়ে কিছু বলি আজ- যদিও এই যে এত তাড়াতাড়ি তাঁকে নিয়ে আমায় লিখতে হবে তা কখনও কাম্য ছিলো না। বয়স কখনো তাঁর কাছে ভার ছিলো না- নিয়মিত ব্যায়াম করতেন, সাঁতার কাটতে সুইমিং পুলে যেতেন, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতেন, একটা চমৎকার রুটিন সবসময় মেনে চলতেন- সময়মতন ঘুম, খাওয়া- আর এই আশি বিরাশি বছর বয়সের নিজের অতবড় বাড়ি ঝকঝকে-তকতকে, গোছানো। তাঁর বাড়ি গিয়ে বইয়ের শেলফের দিকে লোভীর মতন তাকিয়ে থাকতাম। প্রায়শই প্রসাদ মিলত বটে। বই ধার চাইলে উদারহস্তে দিয়ে দিতে দেখেছি তাঁকে। নবোকভের বই খুব প্রিয় ছিলো- তাঁর। আমায় ‘ললিতা’ কিনে দিয়েছিলেন- আরো কত যে বই নিয়ে এসে পড়েছিলাম মীজান ভাইয়ের কাছে থেকে, তার হিসাব দেয়া এখন কষ্টকরই হবে।

নিজের লেখায় যেমন প্রবাসী বাঙালির, নিজের ব্যক্তিগত-সামাজিকতার গল্প বলেছেন- ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও নানা সময়ে উঠে এসেছে তাঁর জীবনবোধের চিত্রটি- সরলভাবে। উঠে এসেছে জীবনযাত্রায়। নিজের প্রফেশনাল কাজের পাশাপাশি সেবা করেছেন দীর্ঘদিনের অসুস্থ স্ত্রীর, বলা যায় একহাতে মানুষ করেছেন দুই ছেলেকে। এই যুদ্ধচিত্রটির কথা একবার বলেছিলেন দুই হাজার বারো সালের অক্টোবরে- অটোয়া মিউজিয়াম যাবার পথে- গাড়িতে। সকালবেলা উঠে দুই ছেলে রেডি করে ছুট, পথে হাসপাতলে থেমে অসুস্থ স্ত্রীকে খাইয়ে দিয়ে অফিস, ছাত্র, গবেষণা- অফিস শেষে ছেলেদের স্কুল থেকে তুলে নিয়ে আবার হাসপাতাল, ফিরে রান্না করা, বাচ্চাদের খাওয়ানো-স্নান-হোম ওয়ার্ক- ঘুমাবার আয়োজন। এক একটি দিন- দীর্ঘ অনেকগুলো বছরের রুটিন তাঁর! ছোট ছেলে পিয়ানিস্ট হবে ঠিক করেছে- বাবা তাকে নিয়ে দৌড়াচ্ছেন বড় বড় পিয়ানো শিক্ষকদের বাড়িতে- ছেলের শেখার প্রাক্কালে নিজে প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের। আমার বাড়িতে একবার সম্ভবত শঁপ্যার কোনো কম্পোজিশান বাজছিলো- পয়েন্ট ক্লেয়র লাইব্রেরি থেকে ধার করে আনা। মীজান ভাই একটার পর একটা কম্পোজিশানের নাম বলে যাচ্ছিলেন। আমি জানতে চাইলাম- এতো মনে থাকে কীভাবে। জবাব দিলেন- ‘ছেলে পিয়ানিস্ট হতে চায়- তার আগ্রহের বিষয়টার মধ্যে নিজে প্রবেশ না করতে পারলে তাকে উৎসাহ দেব কীভাবে? এভাবেই শুনে শুনে–‘ তারপরে হাসলেন। আমাদের মধ্যে প্রায়ই ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে কথা হতো- নির্দ্বিধায় বলতেন- ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত রসে অবগাহন করার তেমন সময় পাননি, কিন্তু এখন এবং তখন সবসময়েই তাঁর সকাল নন্দিত হয় কলিম শরাফীর কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে।

আমি গাইতে বসলেও তাঁর জন্যে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে শুরু করতাম! পূরবী বসু আর জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত দম্পতির আমন্ত্রণে নিউইয়র্ক গিয়েছি গান গাইতে- দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের আগে মঞ্চে যাবার পথে ডাকলেন-‘… আমার শরীরটা ভালো না, ঠান্ডা লেগেছে; তাও শুধুমাত্র তোমার গান শুনবো বলে অনেক দূর থেকে গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম!’ আমার গান নয়- আমি এমন কী গাই আর- এ হলো তাঁর ফল্গুধারার মতন অমিয় স্নেহের একটা ছোট্ট নমুনা- সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াবো বলেই হয়ত- যতদিন বেঁচে থাকি!

আমার সাথে মীজান রহমানের প্রথম দেখা মন্ট্রিয়লে- এক বিকেলবেলার অনুষ্ঠানে। এই পরিচয়পর্বে মুক্ত-মনার একটা ভূমিকা ছিলো আসলে।
প্রথম পরিচয়ে আমি বললাম-‘ আপনাকে চিনি তো! লেখা পড়েছি।’
হাসলেন, হেসে বললেন- ‘তাই? কোথায় পড়েছো?’
-‘মুক্তমনায়!
অবাক হলেন, ক্যানাডা-আমেরিকার বাঙালীমাত্র তাঁর লেখা পড়ে থাকবে এটা মনে হয় স্বাভাবিক ব্যাপার- কিন্তু কেউ যে মুক্তমনায় পড়েছে এটা মনে হয় আশা করেননি। আশা না করাটাই স্বাভাবিক। এখানে যে বাঙালী হালাল মাংস ছাড়া খায় না, বিদেশে এসে ‘বাংলাদেশ হিন্দু এসোসিয়েসন্স’ বা ‘নোয়াখালী সমতি’গঠন করে অথবা ‘ক্যানাডিয়ান আওয়ামিলীগ’ এর সভাপতি হিসেবে নিজস্ব কার্ড ছাপায়ে জনে জনে বিলি করে- সেখানে কেউ মুক্তমনার মতন নাস্তিক ব্লগ পড়ে বা সেখানে লেখে এটা সহজে ভাবা সামান্য কষ্টকর তো হবেই।
– ‘বাহ্‌, তাহলে তো তুমি আমার আপনজন!’ আবার হাসলেন। সেই প্রাণখোলা হাসি! সেই থেকে তিনি আমার পরম বান্ধব! আনন্দে, বেদনায় তাঁর কাছে যেতে কখনোই কোনো দ্বিধা হয়নি।

আমি যে পরিবেশে- যে দেশে বড় হয়েছি এবং যা কিছু পারিপার্শ্বের মধ্যে দেখেছি- নারী হিসেবে তার অনেককিছু নিয়ে আমার অভিযোগ আছে, অভিমান আছে, রাগও আছে। আমাদের সর্বমান্য পন্ডিত ব্যক্তিটিই হয়তো বাড়ি ফিরে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন কখন খাবার টেবিলে সার্ভড হবে,কখন পায়জামাটি ইস্তিরি করে দেবে বউ। মুখে নারী স্বাধীনতার কথা বলা শিক্ষিত মানুষটি আকার-ইঙ্গিতে বউকে জানিয়ে দেন- পরপুরুষের সাথে হেসে কথা বলা যাবে না- বা হাঁটুর ওপরে যেন স্কার্টটি না ওঠে; কন্যাকে বলেন- ‘আমি তোমাকে তো অনেক স্বাধীনতা দিয়েছি!’ স্বাধীনতা যে সকলেরই ব্যক্তিগত অধিকার- কেউ সেটা কাউকে দিতে পারে না, কারো অধিকার নেই অন্যের পছন্দ-রুচি এবং জীবন নিয়ন্ত্রণ করার- আমাদের চেনা অনেক তথাকথিত মুক্তমনের মানুষ সেই ব্যাপারটাতেই বিশ্বাস করেন না। তাদের এইসব কনফিউশান দেখে দেখে নিজের জন্যে, বোনের জন্যে কন্যার জন্যে বিষাদগ্রস্থ থাকি- এবং সেই সময় আমার জানার সুযোগ হয় মীজান রহমানকে। নারী স্বাধীনতার কথা যিনি মুখে মুখেই বলেননি শুধু। নারীর প্রতি তাঁর সম্মানবোধ তাঁর প্রতিটি কথায় আচরনে দেখেছি আমরা। নারীকে তিনি দেখেছেন এবং মূল্যায়ন করেছেন মানবিকতার সংবেদনশীল দৃষ্টিকোণ থেকে, বাঙালী হিসেবে খুব গভীরভাবে অনুভব করেছেন বাঙালী নারীর জীবনকে। লিখেছেনও তা নিয়ে অনেক। মানুষকে নিয়ে, বিশেষ করে নারীদের নিয়ে খুব স্পষ্টভাবে এবং সংবেদ দিয়ে বলার করার ক্ষমতা ছিলো মীজান ভাইয়ের মধ্যে। আর তাঁর সেই হাসি আর অফুরন্ত স্নেহমাখানো প্রশ্রয়– একটি মেয়ের মধ্যে তিনি ছটফটে- আকাশপ্রবণ একটি পাখি দেখতে পান- পাখিটিকে বলেন- এই খাঁচা তোমার একদম ভালো লাগেনা, তাই না? পাখিটিকে তিনিই প্রথম পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন- উড়ে যেতে চাইলে যাবে- শুধু দরকার জানা কি চাও; যেখানে আনন্দ নেই, সেখানে যেতে নেই। সেখানে আসলে কিছুই নেই।’

ঋষী যাজ্ঞবল্কের স্ত্রী মৈত্রেয়ী তাকে বলেছিলেন- প্রভু, যা দিয়ে আমি অমৃত পাবো না, তা দিয়ে আমি কী করবো?
একজন মীজান রহমান, আমার বন্ধু- আমাকে বলেছিলেন- ‘যেখানে আনন্দ নেই, সেখানে আসলে কিছু নেই!’