ধরা যাক কোন এক ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে যে কয়জন প্রার্থী দাড়িয়েছে তারা কোন না কোন ভাবে মানুষকে ঠকিয়েছে। চুরি বা বাটপাড়ির দিকে তাদের কিছু না কিছু অবদান রয়েছে। এটা দেখে অল্প সময়ের ভিতরে কিছু লোক এক হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললো। যে ভাবেই হোক একজন ত্যাগী আর গুনী মানুষকে ক্ষমতায় আনতে হবে। যে কথা সেই কাজ। গুনী মানুষ একজন পাওয়া গেল কিন্তু তার কুরসীর খায়েশও নেই আবার ভোটে খরচ করার মত পয়সাও নেই। লোকজন দল বেধে ছুটলো গুনীর কাছে। অনেকটা জোর করে দাবী রেখে গুনীকে রাজী করালো নির্বাচন করতে। সবাই মিলে চাঁদা তুলে ভোটের খরচ যোগালো। অল্প-বয়স্করা সার বেধে তার নিরাপত্তার কাজে সেচ্ছাসেবী হলো। অবশেষে এই গুনীকেই সবাই ভোট দিয়ে বিপুল বিক্রমে জয়যুক্ত করলো। এটা নিছক কোন গল্প নয়। এমন ঘটনা এই উপমহাদেশের সবখানেই ঘটেছে আগে, এখনো ঘটছে। মহিশাসুর যখন চেপে বসে তখন জনার্ধনকে গোকুলে বাড়ার সুযোগটা আমাদের করে দিতেই হয়- এটাই আসল কথা। এটা যেমন ইউনিয়ন কাউন্সিলের বা পৌরসভার জন্য সত্য, গোটা দেশের জন্যও তা সমান ভাবে প্রযোজ্য।
যারা সেই নেপথ্যচারী, গুণী মানুষটাকে ধরে এনে সবার সর্দার বানালো, তারা কারা? যারা খেলার মাঠ থেকে দুরাচার দৈত্যদের তাড়িয়ে খেলার নির্ভরযোগ্য একটা পরিবেশ ফিরিয়ে আনলো, তারা কারা? তারা নবীনের পুজারী নতুন ঊষার গর্বিত বার্তাবাহক, আমাদের যুবসমাজ, স্বপ্নবাজ কিশোর কিশোরী। যে কোন বড় স্থাপনা বানাতে গেলে গায়ে গতরে শক্তি-সামর্থ্যে যারা কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে এগিয়ে আসে, তারা সবল মাংশপেশীর বলিষ্ঠ যুবক, বয়োবৃদ্ধরা নয়। যাদের আছে প্রযুক্তি-দক্ষতা-কৌশল, যারা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন সময়ের প্রবাহমানতাকে সঙ্গে নিয়ে, তারা নিঃসন্দেহে বয়োজ্যেষ্ঠ, প্রবীন। তাদের কাজ করার পরিবেশ, প্রতিবেশ সংরক্ষন করবে নবীনেরা। এই দায় কোনমতে অস্বীকার করা যায় না। কোন কাজই তাই একা কোন গোষ্ঠি বা দল সম্পন্ন করতে পারে না। প্রত্যেকের জন্যে নির্ধারিত হয়ে যায় ভিন্ন ভিন্ন কার্যবিভাগ। এটাই নেতৃত্ব-স্থাপনার অমোঘ শৃঙ্খলা, যে শৃঙ্খলার বাইরে পড়ে আছে আজকের বাংলাদেশ। প্রবীনের আছে অভিজ্ঞতা-কৌশল, নবীনের আছে স্বপ্ন- এই দুইয়ের সমন্বয়ে জন্ম নিবে আগামী দিনের নেতৃত্ব।
কিন্তু প্রবীন যদি না আসে? তারা যদি তাদের চোখ-কান ঢেকে রাখে ডানা দিয়ে- তাহলে কি হবে? তাহলে কিভাবে জ্বলবে আলো? আলো ছাড়া মানুষ আঁধারে পথ দেখবে কি করে? পথ আছে, উপায় আছে- উপায় একটা না একটা থাকে সব সময়। সময়ের কাছ থেকে নিতে হবে সেই শিক্ষা। সময় কারও জন্যে বসে থাকে না, স্বপ্নবাজরাও অপেক্ষায় থাকবে না কারও। দরকার হলে নিজেদের বুকের পাজর বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গে জ্বালিয়ে নিয়ে সেই আলোতে তারা পথ চলবে, অন্যকে দেখাবে দিশা। পথ চলতে চলতে তাদের ভিতরে এমনিতেই গড়ে উঠবে নেতৃত্বের দক্ষতা। প্রচলিত নেতৃত্বের পঙ্কিল নিস্রাব বহমান নেই তাদের হৃদয়ে, কারন তাদের নেতৃত্ব আছে, নেতা নেই। তারা সবাই নেতা। তারা সবাই রাজা। তাদের সবার সততা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর মানবিকতা জমা থাকে এক পাত্রে। সেখান থেকে কল্যানের বহমান ফল্গুধারা স্পর্শ করে প্রত্যেকের দেহ-মন-হৃদয়। একক আর সমষ্টি তাদের কাছে সমান মুল্যবান। তারা এক বিরল নেতৃত্বের উদ্ভাবক। তারা জেনে গেছে কিভাবে বজ্র দিয়ে আগুণ জ্বালতে হয়। তারা আর কেউ না, তারা স্বপ্নবাজ নবীন।
ইতিহাস সাক্ষি দেয়- যারা আজ প্রবীন, তারাও এক সময় নবীন ছিল। তারাও স্বপ্ন দেখতো, যেমন আজকে দেখে নতুনেরা। কিন্তু কী সেই অনুঘটক, যা তাদের স্বপ্ন দেখা ভুলিয়ে দিলো আলাদিনের প্রদীপের ঘসায়। অনেকে বলে- ভয়, লোভ, আলস্যের শক্তি অনেক, অপশক্তি- ইন্দ্রজালিক। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, স্বপ্ন দেখার মতন একটা নদীর প্রবাহকে বন্ধ করে দিতে পারে ইন্দ্রজাল, যাদু! মনে হয় তারা একক আর সমষ্টির ভেতরকার দুর্ভেদ্য বন্ধনটার আসল রহস্যের কথা যে কারনেই হোক ভুলে গেছে। তাই এই অধঃপতন। তাই তারা আলো জ্বালাবার সব ক্ষমতা হারিয়ে নামরদ হয়ে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। তাই হয়তো তারা ধরতে পারছে না কাঠকয়লা আর হাড়কয়লার (মানুষের মাংস আর হাড় দিয়ে তৈরী এক প্রকার কয়লা) পার্থক্যটা। এমন আরো অনেক জিনিসের পার্থক্য তারা ধরতে পারছে না। অনেকে আবার বলছে, এই ছড়ীঘুরানো প্রজাতিটা নাকি হাইব্রীড, মানে দোয়াচলা- মানুষ আর অন্য কোন জন্তুর শংকর। প্রমান ছাড়া এই তথ্যটাও বা কেমনে বিশ্বাস করি। এতসব হতাশার ভিতরেও একটুখানি আশার আলো দেখি মাঝে মাঝে- একদিন, হয়তো নিকট কোন ভবিষ্যতে এই জনপদের স্বপ্নদেখা নতুন মানুষেরা আলো জ্বালবে বজ্রের আগুন দিয়ে। এই জনপদে জন্ম দিবে আরো একটা একাত্তরের, যেখানে থাকবে না কোন শংকর মানব, অথবা চোখ-কান ঢাকা নামরদ।
শীতে কাতর কতিপয় বিপন্ন বাঁনর আগুন জ্বালাবার জন্যে মরিয়া হয়ে অনেকখানি শুকনো লতাপাতা-খড় জড় করে। মেঘলা সন্ধ্যায় তারা কয়েকটা জোনাকি পোকা ধরে লতাপাতার ভিতরে ফেলে সমানে ফু দিতে থাকে। আচানক খড়ের উপরে বাজ পড়ে তাতে আগুন লেগে যায়। দ্রুতগতি বিদ্যুতের বেগ আর শক্তির বিষয়ে বানরদের কোন ধারনা না থাকায় তারা ধরে নেয় জোনাকি পোকা দিয়ে আগুন জ্বলে। পরে যতবার আগুনের প্রয়োজন হয়েছে তারা চেষ্টা করেছে জোনাকি দিয়ে আগুন জ্বালতে, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থতার হতাশা তাদের ম্লান করেছে। যারা আকাশ থেকে বাজ নামাতে পারতো তারাই একাত্তরে বিদ্রোহ-বিপ্লবের আগুন জ্বেলেছিল। তারা মানুষ ছিল, তারা জানতো বিদ্যুত কি জিনিস। পরে বহুবার আরো একাত্তরের প্রয়োজন হলেও কেউ পারেনি আগুন জ্বালতে। কারন তারা হয়তো বানর হয়ে গেছে, আর মানুষ নেই। তাই জোনাকি পোকা দিয়ে বারবার চেষ্টা করে গেছে একাত্তরের পূনর্জন্মের। একাত্তরের প্রয়োজন কোন দিনই ফুরাবে না, ফুরায় না।
শংকর মানব নয়, আমার মনে হয় রক্ত-মাংসের মানুষই একদিন পরিবর্তন আনবে; হয়তো আগামী শতকেই…