নিষিদ্ধ রাজনীতি :পতেঙ্গায় শেখ মুজিব গণপাঠাগার
দেশে চলছে সামরিক শাসন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান-একাত্তুরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা-একটি সেক্টরের কমাণ্ডার-প্রধান সামরিক প্রশাসক। অথচ দেশে বিরাজ করছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী আবহ। একাত্তুরের স্বাধীনতা বিরোধীরা যেন হিংস্র শ্বাপদের মত গর্ত থেকে বের হয়ে আসছে একে একে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পুণর্বাসিত হচ্ছে। দেশটাকে তারা আবার পাকিস্তান বানানোর স্বপ্নে বিভোর।
পক্ষান্তরে শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ, ইত্যাদি শব্দাবলী দেশে যেন নিষিদ্ধ। রেডিও-টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনুপস্থিত। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে সরকারী মিডিয়াতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস প্রচার করা হয় না। এমনকি কারা ছিল হানাদার বাহিনী, কাদের বিরুদ্ধে বাঙালি যুদ্ধ করেছে তা কিছুই বলা হয় না।
এহেন বৈরী পরিস্থিতিতে সম-মনাদের সংগঠিত করার কৌশল হিসাবে আলম সম মনা যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে তুলে শেখ মুজিব গণপাঠাগার। মুসলিমাবাদের আইয়ুব আলী বাটলারের বাড়ীর পুকুর পাড়ে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে পাঠাগারের সাইনবোর্ড লাগানো হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জনাব শফিকুর রহমান উদ্যোক্তাদের কিছু টেবিল চেয়ার ও বইয়ের র্যাক কেনার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিছু বইও সংগ্রহ করল উদ্যোক্তারা। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে পতেঙ্গা এলাকার কিছু তরুণ প্রজন্ম আবারো সংগঠিত হতে লাগল।
আলমের সহমুক্তিযোদ্ধা মো: ফছিউল আলম ও আবুল কালাম, সহপাঠি মো: রফিকুল ইসলাম, তরুণ আওয়ামী লীগ কর্মী নুরুল হুদা, মো: ইছহাক, প্রতিবাদী ছাত্র আলী আজম প্রমুখ পাঠাগারের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আছে। পাঠাগারে সপ্তাহে একদিন বিকাল বেলা পাঠচক্রের উদ্যোগ নেওয়া হল। সে পাঠচক্রে রিসোর্স পারসন হিসাবে শহর থেকে এডভোকেট কাজী গোলাম সারোয়ার, এডভোকেট আনোয়ারুল কবির ও এডভোকেট আনোয়ারুল কবির চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকেন। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ, রাজনৈতিক অর্থনীতি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তার বাস্তবায়নের পথ, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও তৎপরবর্তী দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ইত্যাকার বিষয়ে আলোচনা করত শহর থেকে আগত আলোচকবৃন্দ।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীরা পাঠচক্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনার গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করতে শুরু করে। আলম প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে আলোচকদের আলোচনা শ্রবণ করে, বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচকদের প্রশ্ন করে। এ পাঠচক্রে অংশ গ্রহণ করে আলমের কাছে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা অনেকটা পরিস্কার হতে থাকে। বিশেষভাবে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলমের ধারণা ছিল অনকেটা ভাসা ভাসা। এ পাঠচক্রে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের প্রতি তার উৎসাহ ও আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু কেন সকল রাজনৈতিক দল অবলুপ্ত করে বাকশাল নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন-সেটা আলমের বোধগম্য ছিল না। এ পাঠচক্রে অংশ গ্রহণের পর সে এখন বঙ্গবন্ধুর একক জাতীয় দল গঠনের একটি ব্যাখ্যা খুঁজে পায়। সে জানতে পারে, বিশ্বে যে সকল দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে-সেখানে একটি একক বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বেই তা হয়েছে। গণতন্ত্রেরও একটি নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পায় আলম-জনগণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধু যাকে শোষিতের গণতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন-তার বাকশাল গঠনকালীন ভাষণে।
আলম আশা করেছিল, চরম এ রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে তাদের এ সাহসী উদ্যোগ অন্তত আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সমর্থন সহযোগিতা পাবে। কিন্তু আলম অবাক বিস্ময়ে দেখল, আওয়ামী লীগের নগর নেতাদের কেহ কেহ ভীষণ মনক্ষুণ্ণ হল। গহিরায় শেখ মুজিব গণপাঠাগার আছে বলে পতেঙ্গায় সে নামে পাঠাগার করা যাবে না মর্মে পত্রিকায় বিবৃতি আসল। জবাবে গ্রামে গ্রামে শেখমুজিব গণপাঠাগার গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি পাঠানো হল। আওয়ামী লীগের নগর নেতৃত্ব শেখ মুজিব গণপাঠাগার আয়োজিত রাজনৈতিক পাঠচক্রের তীব্র বিরোধীতা করে শহর থেকে আসা আলোচকদের না আসার জন্য প্রথমে বারণ এবং পরে রীতিমত হুমকী প্রদান করতে লাগল। প্রথমে বিষয়টি আলমের মোটেও বোধগম্য হয় না।
পরিশেষে আলম বুঝে, এ নাজুক অবস্থায় আওয়ামী নেতৃত্বের মধ্যে এ কেবল নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নয়-আদর্শের দ্বন্ধ। আলম এ প্রথম বুঝতে পারল, বঙ্গবন্ধু যে সকল নেতা-কর্মী নিয়ে সমাজতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন, সে সকল নেতা-কর্মীদের অনেকেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসও করত না। অনেকের আবার সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কোন ধারণাও ছিল না।
যারা সমাজতন্ত্র, তথা সমাজের প্রগতিশীল পরিবর্তনের পক্ষে ছিল না, তারা আওয়ামী লীগ, যুব লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ ছিল। আলম অবাক-বিস্ময়ে দেখল, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনগুলোর সভা-সমাবেশে রুশ-ভারতের দালালেরা হুশিয়ার, সাবধান ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-ধ্বংস হউক, নিপাত যাক” এ দুই পরস্পর বিরোধী শ্লোগান ধ্বনিত হতে লাগল। এ আদর্শিক দ্বন্ধের শিকার শেখ মুজিব গণপাঠাগার।
সামরিক সরকারী গোয়েন্দা বাহিনীর নজরে পড়ে শেখ মুজিব গণপাঠাগার। ঘন ঘন গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা শেখ মুজিব গণপাঠাগার পরিদর্শন করতে থাকেন এবং আলমসহ পাঠাগারের উদ্যোক্তাদের নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগল-পাঠাগারের আড়ালে কোন রাজনীতি করা হচ্ছে কিনা জানার জন্য বস্তুত তারা ছিল উদগ্রীব।
গোয়েন্দাদের তৎপরতা বুঝতে পেরে আলমেরা ও তাদের পাঠচক্রের কৌশল পাল্টাল। গোয়েন্দাদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য পাঠচক্রের স্থান কখনো কখনো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বেড়িবাঁধের পাদদেশে স্থানান্তর করা হল। অংশগ্রহণ কারীদের হাতে থাকত কবিতার বই। কোন আগুন্তুক আসলে শুরু হত কবিতা পাঠের আসর।
ইতোমধ্যে আলম ইস্টার্ন রিফাইনারী লি: নামক একটি জ্বালানী তেল শোধনাগারে চাকুরী পায় একজন ল্যাবরেটরী টেকনিশিয়ান হিসাবে । সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক,খ, অ, আ, পাঠ করে সে জানত পেরেছে-সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে মেহনতি শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা হয় অগ্রণী। তাই আলম ভাবতে লাগল-সমাজ বিপ্লবের কাজ করার জন্য সে যেন নতুন একটি ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। তার প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার মাধ্যমে সে দেশের শ্রমিক আন্দোলনে সংযুক্ত হতে পারবে।
১৯৭৮ ইং সালের জানুয়ারী মাস। ইস্টার্ন রিফাইনারী লি: এর শ্রমিক-কর্মচারীরা তাদের দাবীনামা আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করে। প্রতিষ্ঠানে একজন শ্রমিক হিসাবে অত্যন্ত নবীন হওয়া সত্ত্বেও আলম সে আন্দোলনে সক্রিয় কর্মীর ভূমিকা গ্রহণ করে। ফলত: শ্রমিকদের মধ্যে তার একটি পরিচিতি গড়ে ওঠে। তবে তখনো দেশে প্রচলিত শ্রম আইন সম্পর্কে তার কোন সম্যক ধারণা ছিল না। আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ধর্মঘটে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু আইনগত দিক থেকে এ ধর্মঘট ছিল বেআইনী। প্রথমত: দেশে তখন জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন-রাজনৈতিক তৎপরতার সাথে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ। তদুপরি ইস্টার্ন রিফাইনারী এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন(সিবিএ) সর্বশেষ কর্তৃপক্ষের সাথে যে চুক্তি করেছিল, তার মেয়াদ তখনো এক বছর বাকী। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল চুক্তি বলবত থাকাকালীন সময়ে নতুন কোন অর্থনৈতিক দাবী উত্থাপন করা যাবে না। তারপরও নবনির্বাচিত ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ ধর্মঘট আহ্বান করে।
ধর্মঘট যখন শুরু হয়, তখন শ্রমিক-কর্মচারীরা কারখানার বাইরে অবস্থান নেয়। কর্তৃপক্ষ নির্বিঘ্নে কর্মকর্তাদের সাহায্যে কারখানা টিম্ টিম করে চালিয়ে রাখে। সিবিএ নেতৃবৃন্দ রীতিমত আত্মগোপনে। ধর্মঘট ডেকে কারখানা চত্বর ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে শ্রমিকদের এক সভায় আলম বিরোধীতা করে বক্তব্য রাখলে তাকে সিবিএ নেতাদের তোপের মুখে পড়তে হয়।
পরিশেষে ধর্মঘটের ৪ দিনের মাথায় ধর্মঘট আর ধরে রাখা গেল না। মাথা নত করে শ্রমিক নেতারা কারখানায় প্রবেশ করল। পরাজিত বাহিনীর সামনে বীরদর্পে কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী ড. আজিজুর রহমান ধর্মঘটী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে তার বিজয়ী ভাষন দিলেন। শ্রমিক রাজনীতির শুরুতেই নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে প্রচণ্ড একটি ধাক্কা খেল আলম। যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন, পরিচালনা কিংবা নীতি নির্ধারণে ক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই তার ছিল না তথাপি পরাজয়ের গ্লানি তাকে ভীষণ বিমর্ষ করল। জাতীয় রাজনীতির পরিপূরক হিসাবে শ্রমিক আন্দোলনেও আত্মনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিল আলম।
খুবই সত্য কথা! আ’লীগে জামায়াতি/মৌলবাদি (মানসিকতার) লোকের অভাব নেই, এমনকি এই সময়েও!
যাই হোক, আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসকে খুবই বিশ্বস্ত ও স্বচ্ছ চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা রয়েছে সিরিজটিতে। এই ধরনের সিরিজগুলি তাই শুধু লেখা নয় আমার কাছে, এগুলো এক একটা মূল্যবান দলিলও বটে!
সিরিজ চলুক।
@গুবরে ফড়িং,
অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আপনার লেখার আয়তন ছোট হয়ে যাচ্ছে, আরেকটু বড় হওয়া উচিৎ। যেহেতু এটা ব্লগ তাই রাখঢাক না রেখেই লেখা উচিৎ। যেমন,আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা গন পাঠাগারের বিরোধিতা করত, কারা আগতদের হুমকী-ধমকি দিত তাদের নামসহ প্রকাশ হওয়া উচিৎ। সম্ভব হলে ওই সময়ের পত্রিকার ক্লিপও ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনার সিরিজটা আগ্রহ নিয়ে পড়ছি, তাই পরামর্শ ইতিবাচক ভাবেই নিবেন- এ আশা রাখি।
@বিপ্লব কর্মকার,
অশেষ ধন্যবাদ। তবে যাদের নাম জানতে চেয়েছন,তাদের অনেকে এখনো জীবিত। তাই নাম উল্লেখ থেকে বিরত থেকেছি। সমসাময়িক ইতিহাস চর্চার সমস্যা এখানেই।