১৯৮৬ সালের যে দিন আমার কাছে ক্রিকেটের মৃত্যু ঘটেছিল
মূল লেখাঃ রাহুল পণ্ডিতা
ফোনে তাকে উত্তেজিত শোনাল। “চলে এসো” সে বলল, “আমি তোমাকে একজনের সাথে দেখা করিয়ে দিতে চাই”। ততক্ষণে গভীর রাত হয়ে গিয়েছে; কিন্তু মানুষটি ছিলো খুবই প্রিয় একজন বন্ধু – একজন উদ্যোক্তা এবং বাইক রেসিং চ্যাম্পিয়ন। খান মার্কেটে মিলিত হতে আমাদের এক ঘণ্টা লেগে গেলো। কয়েক মিনিটের মাঝেই আমাদের সামনে একটি গাড়ি এসে থামল এবং মহেন্দ্র সিং ধোনী নেমে আসলেন। তিনি সাথে করে একজন বন্ধু নিয়ে এসেছিলেন, যার ফোলানো চুল দেখে মনে হয় তিনি হয়ত কখনো প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ছিলেন। ধোনীকে শান্ত দেখাচ্ছিল। আমরা করমর্দন করে একটি ক্যাফেতে প্রবেশ করলাম। তিনি একটি ‘লাইট কফি’ অর্ডার দিলেন এবং আমরা আলোচনায় প্রবেশ করলাম।
আলোচনা ক্রিকেটের দিকে মোড় নিল। আমার দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধোনী বললেন “আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি খুব একটা ক্রিকেট উৎসাহী নন”। “১৯৮৬ সালের এপ্রিলেই ক্রিকেট আমার জন্য মারা গেছে” আমি উত্তর দিলাম। “আপনি কি ম্যাচটির কথা স্মরণ করতে পারেন”? “আমার বয়স তখন মাত্র পাঁচ” তিনি হেসে উত্তর দিলেন। এমন সময় এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা উঠে এসে তার ছেলের জন্য একটি অটোগ্রাফ চাইলেন। একজন ভদ্রলোক এসে একত্রে একটি ছবি তুলবার অনুরোধ করলেন। ধোনী মেনে নিলেন। বিদায়ের সময় দ্রুত ঘনিয়ে এলো। আমরা উঠে দাঁড়ালাম এবং আমি ও ধোনী আগের চেয়েও দৃঢ়ভাবে করমর্দন করলাম। ধোনীর সাথে দেখা করার পর রবির অবস্থা কেমন হত এই চিন্তা আমার মনে খেলা করতে থাকল। আমি ১৮ এপ্রিল ১৯৮৬ এবং ১৩ অক্টোবর ১৯৮৩’র কথা স্মরণ করলাম।
রবি ছিলো আমার কাজিন, মামাতো ভাই। শ্রীনগরে আমাদের বাড়ির পাশের বাড়িতেই তারা থাকত। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এই ভাইটি ছিল আমার কাছে একজন রোল মডেল। তার মত করে আমি ওল্ড স্পাইস আফটার শেভ ব্যবহার করতে চাইতাম, চাইতাম আমার কাপবোর্ডের ওপর শ্রীকান্থ এর পোস্টার লাগাতে। ১৯৮৩ এর জুনে ভারত ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়লাভ করল। সেই দিনটি আমার স্মৃতিতে খুবই ঝাপসা, শুধু মনে আছে আনন্দ উৎসবের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। আমার বয়স তখন মাত্র সাত এবং খেলাটি সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সীমিত। কিন্তু সেই বছরের অক্টোবরেই সব কিছু পাল্টে গেলো। এই সময়েই ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ শ্রীনগরে রাজ্যের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে।
যতটুকু মনে পড়ে উভয় দলই খেলার একদিন আগে এসে পৌঁছে এবং তাদেরকে শের-ই-কাশ্মীর স্টেডিয়ামের নিকটবর্তী একটি হোটেলে এনে তোলা হয়। তাদেরকে প্রথাগতভাবেই বরণ করে নেয়া হয়। খেলার দিন আমি এবং রবি ঘ্রাণ শনাক্তকারী কুকুরগুলোকে পার হয়ে আগেভাগেই স্টেডিয়াম পৌঁছে গেলাম । ওয়েস্ট ইন্ডিজ টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিল। গাভাস্কার এবং শ্রীকান্থ ভারতের ইনিংস শুরু করতে মাঠে প্রবেশ করলেন।
এরপর এটা শুরু হল। স্টেডিয়ামের সর্বত্র পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান। পাকিস্তান আর জামাত ই ইসলামীর পতাকা দিয়ে পুরো স্টেডিয়াম ছয়লাপ। কাশ্মীরি মুসলিমদের হাতে পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের ছবিওয়ালা পোস্টার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের খেলোয়াড়রা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারা কি ভারতে খেলতে এসেছে নাকি পাকিস্তানে খেলতে এসেছে?
গাভাস্কার ১৬ তম বলে ক্যাচ আউট হয়ে ফিরে গেলেন। ১১ রানে। ভারতীয় দল ৪১ ওভারেই ১৭৬ রানে গুঁটিয়ে গেল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে নামল। দর্শকসারি থেকে আধা খাওয়া আপেল ভেংসরকারের পিঠে এসে পড়লো।
ভারত হেরে গেল। অনেক বছর পর গাভাস্কার রাহুল দ্রাবিড়কে বলেছিলেন সেইদিন ম্যালকম মার্শালকে দেখেছিলেন অনেক দ্রুত বল করতে, সম্ভবত তার জীবনে কাউকে এত দ্রুত বল করতে দেখেন নাই। কৃতি আজাদ পরে বলেছিলেন তারা সেদিন যেন পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে গিয়েছিলেন।
ভারতের পরাজয় এবং জনতার উল্লাসের পর আমি আর রবি বাসায় ফেরার পথে একটা কথাও বললাম না। রবি আমাকে কোমল পানীয় খাইয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।
১৯৮৬ সালে আমার রাজনৈতিক শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়। আমি তখন বুঝতে শিখেছি ভারত পাকিস্তান খেলা কি জিনিস। অবশ্য দুই বছর আগেই আমি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে ভিন্দ্রানওয়ালের সশস্ত্র খালিস্তানি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের জবাবে শ্রীনগরের মুসলিমরা আমিরা কাদালের হনুমান মন্দিরে হামলা চালায়। ঝিলম নদীতে হনুমানের বিগ্রহ নিক্ষেপ করা হয়, পুরোহিতরা প্রহৃত হন। এখন ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন সেখানে হরতাল পালিত হয়।
১৯৮৬ সালের ১৮ এপ্রিল শারজাতে অস্ট্রো-এশিয়া কাপের ফাইনালের দিন আমি আমার ঠাকুরদাদাকে বললাম শ্রীনগর শহরের কেন্দ্র মহারাজবাজার থেকে বাজি কিনে দিতে। শারজাতে আরব শেখরা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের প্রতিটি চার ছক্কা টাকা ছিটিয়ে উৎযাপন করছিল। কিন্তু ভারত সকল প্রতিরোধের মুখেও টিকে ছিল।
শেষ ওভারে আমার হৃদয় বুকের খাঁচা ভেদ করে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল। শেষ বলে পাকিস্তানের দরকার ছিল চার রান। জাভেদ মিয়াদাদ ছিলেন স্ট্রাইকে। চেতন শর্মার হাতে বল ছিল। আমার হাতে ছিল দেয়াশলাই এর বাক্স। শর্মার নিচু হয়ে আসা ফুলটস বলে মিয়াদাদ ছয় মারলেন। পুরো স্টেডিয়াম ফেটে পড়লো। মিয়াদাদ এবং ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান তাউসিফ আহমেদ প্যাভিলিয়নে ছুটে গেলেন। দেয়াশলাই এর বাক্স আমার হাতের ঘামে ভিজে গেল। শারজার মাঠে যেকোনো দাহ্য বস্তুতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল।
কিছু মুহূর্ত পরেই উপত্যকায় যেন দীপাবলি উৎসব শুরু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নেমে এল রাস্তায় পাকিস্তানের বিজয় উৎযাপন করতে। এই এপ্রিলে গ্যালনের পর গ্যালন লিমকা খেয়ে তারা উৎযাপন করতে লাগল। আমি মুখ কালো করে ঘরের এক কোণে বসে রইলাম হিন্দি ছবির সেই ধনী বাবার মত যার মেয়ে ড্রাইভারের সাথে পালিয়েছে। চার বছরের কম সময়ের ভিতর আমাদের নিজের বাড়ি ত্যাগ করতে হয়। ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রতি ব্যঙ্গ শেষমেশ আজাদির আহ্বানে পরিণত হয়েছে। রবি কাশ্মীর ত্যাগ করতে চায় নাই। ১৯৯৭ সালে এক বাস থামিয়ে তাকে এবং তার দুইজন হিন্দু সহকর্মীকে বের করে গুলি করে হত্যা করে কাশ্মীরি জিহাদিরা।
শারজার ২৫ বছর পর ভারত আবার একটি ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। আমি তারপরও দূরে থাকি। ক্রিকেটে জয় পরাজয় আমার কাছে এখন কিছুই লাগে না। আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন ওমর আব্দুল্লাহ সুরেশ রায়নাকে কাশ্মীর উপত্যকায় জায়গা জমি বরাদ্দ দেন, যার পরিবার একসময় কাশ্মীরে বাস করত। আমার বাবার অশ্রু দেখলাম ভারতের জয়ে পরে। তিনি আমার দিকে তাকালেন। ১৯৮৬ সাল থেকে আমার মনোভাব ক্রিকেটের প্রতি আমি তাকে বলতে পারি নাই ।
মোর ডাই অফ হার্টব্রেক গ্রন্থে সাউল বেলো এই অনুভূতিকে অবিহিত করেন প্রথম হৃদয় বা ফার্স্ট হার্ট হিসেবে। আমার প্রথম হৃদয় রয়ে যায় চেতন শর্মার ব্যর্থ ইয়র্কারের কাছে।
(মূল লেখাটি www.openthemagazine.com এ ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল প্রকাশিত হয়।)
পুনশ্চঃ সম্প্রতি রাহুল পণ্ডিতার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর নাম আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস। স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিত জনগোষ্ঠীর কষ্টের ইতিহাস নিয়ে এই বই।
এই নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার নিবন্ধ তুলে দিচ্ছিঃ
কাশ্মীরে পণ্ডিতরা ১৯৪১ সালের আদমসুমারিতে ছিলেন শ্রীনগর উপত্যকার জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। ১৯৮১-তে সংখ্যাটি নেমে দাঁড়ায় ৫ শতাংশে। তখনও অনন্তনাগে ১৯৮৬-র পণ্ডিত-বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়নি। পণ্ডিতদের পেটানো, তাঁদের মহিলাদের ধর্ষণ করা এবং ঘরবাড়ি ও মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু হয়নি। শুরু হয়নি উপত্যকা জুড়ে ১৯৯০-এর তীব্র, ব্যাপক পণ্ডিত-বিরোধী, ভারত-বিরোধী স্লোগান, মারধর, নির্যাতন। তবু বিদ্বেষের লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। অমৃতসর স্বর্ণমন্দিরে ভিন্দ্রানওয়ালের সশস্ত্র খলিস্তানি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানের ‘জবাবে’ শ্রীনগরের মুসলিমরা আমিরা কাদালের হনুমান মন্দিরে হামলা চালায়। ঝিলম নদীতে হনুমানের বিগ্রহ নিক্ষেপ করা হয়, পুরোহিতরা প্রহৃত হন। ইন্দিরা গাঁধী শিখ দেহরক্ষীদের গুলিতে নিহত হলে শ্রীনগরের রাস্তায়, বাজারে-হাটে, স্কুলে-কলেজে উত্সব পালিত হয়। তার ঠিক আগের বছরেই ইকবাল পার্কের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার বক্তৃতার সময় একদম সামনের সারির দর্শকরা নিজেদের যৌনাঙ্গ উন্মুক্ত করে বসে থাকে। ১৯৮৩-র ১৩ অক্টোবর শের-ই-কাশ্মীর স্টেডিয়ামে দর্শকরা সারাক্ষণ ভারতীয় ক্রিকেট দলকে হতোদ্যম করতে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে যায় (খেলা হচ্ছিল যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে), বেঙ্গসরকরকে আধ-খাওয়া আপেল ছুঁড়ে মারে, গ্যালারিতে পাক পতাকা ওড়ায়। ’৮৬-র শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে চেতন শর্মার শেষ বলে জাভেদ মিয়াঁদাদের ছক্কা হাঁকানোর সঙ্গে-সঙ্গে গোটা শ্রীনগর উপত্যকা উত্সবে মেতে ওঠে। সেই থেকে প্রতি বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসে শ্রীনগর ‘নিষ্প্রদীপ’ থাকে। বিশ্বের কোথাও কোনও খেলায় পাকিস্তান ভারতের কাছে হারলেই হিন্দু পণ্ডিতদের জানালার শার্সি খানখান করে আধলা ইট এসে ঘরের ভিতর আছড়ে পড়ে।
এগুলো কোনও বানানো গল্প নয়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অঙ্গরাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগর উপত্যকায় একদা বসবাসকারী, তবে অধুনা উদ্বাস্তু কাশ্মীরি পণ্ডিতদের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তাঁদের ভিটে-ছাড়া করতে ভয়-দেখানো শুরু হয় ১৯৮৯ থেকে। হুমকি যে অসার নয়, তা প্রমাণ করতে একে-একে হত্যাকাণ্ড শুরু হয় টিক্কালাল টাপ্লু, ভূষণলাল রায়না, মোহন লাল, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নীলকান্ত গঞ্জু…। প্রথমে রাতভর, তারপর দিনভর মিছিল-জমায়েত থেকে
‘নারায়ে তকদির
আল্লা হো আকবর’
ধ্বনি উঠতে থাকে। পণ্ডিত মহল্লায় হামলার সময় নিকটবর্তী মসজিদের মাইকে আজানের ধ্বনি বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে আর্তনাদ বাইরে শোনা না যায়। ‘হাম ক্যা চাহতে: আজাদি’ কিংবা ‘অ্যায় জালিমো, অ্যায় কাফিরোঁ, কাশ্মীর হমারা ছোড় দো’ স্লোগান ১৯৯০-এর মধ্যেই সাড়ে তিন লক্ষ পণ্ডিতকে কাশ্মীর উপত্যকার ভদ্রাসন ছেড়ে শরণার্থী হতে বাধ্য করে। দিল্লি থেকে জগমোহনকে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়। কিন্তু তত দিনে শুরু হয়ে গেছে দু’হাজার বছরেরও বেশি কালের স্বদেশ থেকে পণ্ডিতদের নির্বাসন। তারপর তা চলতেই থাকে। ১৯৯৭-এর মার্চ মাসে সংগ্রামপুরা গ্রামে ৭ জন পণ্ডিতকে বাড়ি থেকে বার করে হত্যা করা হল। ’৯৮-এর জানুয়ারিতে ওয়ান্ধামা গ্রামে শিশু ও নারী সহ ২৩ জন কাশ্মীরি পণ্ডিতকে বিনা প্ররোচনায় ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়। ২০০৩-এর মার্চে নদীমার্গ গ্রামে আবার ২৪ জন পণ্ডিতের নৃশংস গণহত্যা।
কাশ্মীর উপত্যকা এ ভাবেই পণ্ডিতমুক্ত হতে থাকে। পণ্ডিত পরিবারগুলি উদ্বাস্তু হয়ে জম্মুর শিবিরে তাঁবুতে আশ্রয় নেয়। জম্মুর তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করতে-করতে ওই তাঁবুতে কিংবা এক কামরার অপরিচ্ছন্ন বস্তিতে কোনও মতে সংসার, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, বয়স্কদের চিকিত্সা ও সকলের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা, সরকারের কাছ থেকে রেশনে চাল-গমের ডোল নিয়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি। যাঁদের উঠোনে ফলবতী আপেলের বাগান ছিল, ঘরে ছিল দেওদার কাঠের বহুমূল্য আসবাব, জম্মুতে তাঁদেরই চরম অসম্মানের গ্লানি নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। সমধর্মী হিন্দুরাও শরণার্থীদের ‘উটকো আপদ’ বলেই গণ্য করে, তাদের মেয়েদের মনে করে সহজলভ্য, সস্তা পণ্য। দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে এবং উপত্যকায় তাদের ফেরার সম্ভাবনা কমে আসায় উত্ফুল্ল মুসলিমরা শ্রীনগরের অভিজাত এলাকায় তাদের বসতবাড়ি, বাগান জলের দরে কিনে নিতে জম্মুতে দালাল পাঠাতে থাকে। যে মধ্যবয়স্ক দালালরা জম্মুতে টোপ নিয়ে হাজির হয়, দেখা যায়, তাদের ছেলেরাই উপত্যকায় হিজবুল মুজাহিদিনের এরিয়া-কমান্ডার। কাশ্মীরিদের তথাকথিত স্বাধীনতা-সংগ্রাম কি তা হলে ভূস্বর্গ থেকে আদি বাসিন্দাদের বিতাড়িত করে বহিরাগতদের দখল নেওয়ার অভিযান?
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের স্বদেশ হারানোরই উপাখ্যান— আওয়ার মুন হ্যাজ ব্লাড ক্লটস। আমাদের সকলের চোখের সামনে গত দু-তিন দশক ধরে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু আমরা (যারা অবশিষ্ট ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের ও রাষ্ট্রের বঞ্চনা ও নিপীড়ন নিয়ে এত মুখর, তারাই, কী আশ্চর্য) কাশ্মীর উপত্যকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু পণ্ডিত পরিবারগুলির উপর সেখানকার ধর্মীয় সংখ্যাগুরুদের চালানো হত্যা-ধর্ষণ-ধর্মান্তর অভিযান বিষয়ে অদ্ভুত মৌনী। যেন আমরা দেখতেই পাচ্ছি না যে, ঘটনাটা ঘটে চলেছে। আর আমরা, অর্থাত্ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানুষরা যেটা দেখতে পাচ্ছি না, সেটা তো নিশ্চয় ঘটছেও না। বরং কট্টরপন্থী হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি যখন নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে উদ্বাস্তু-করে-দেওয়া পণ্ডিতদের উপত্যকায় ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, তখন দিব্যি তাঁর সেই আশ্বাসে ভরসা রাখছি, তাকে প্রতারণামূলক মনে করছি না। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের শিখিয়েছে সংখ্যালঘুর ধর্মান্ধতা ও জেহাদি মতাদর্শের মধ্যেও সমন্বয় ও সংশ্লেষের সুর খুঁজে পেতে। তাই পণ্ডিত পরিবারগুলি যখন বিএসএফ-এর ক্যাম্প না-থাকলে দিনের বেলাতেও ঘরের বাইরে বেরতে চাইছেন না, আমরা তখন ‘কেন ওই ক্যাম্প এখনও তুলে নেওয়া হচ্ছে না’, তাই নিয়ে জনস্বার্থ মামলা করছি, পণ্ডিত-তাড়ানো জেহাদিদের মানবাধিকার রক্ষায় মড়াকান্নাও কেঁদে মরছি। রাহুল পণ্ডিতা নিজে সপরিবার উপত্যকা থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। তাঁর ভাই-দাদা, নিকটাত্মীয়েরা নিহত, ধর্ষিত হয়েছেন, পূর্বপুরুষরা ধর্মান্তরিতও। প্রথম কৈশোরে জম্মুর উদ্বাস্তু শিবির, পরে দিল্লিতে এখন তিনি সাংবাদিকের পেশায় কৃতবিদ্য। উপত্যকায় নিজের ফেলে-আসা ভিটে দেখতে গেলেও তিনি জানেন, ওখানে কখনওই আর ফেরা হবে না। পণ্ডিত পরিবারগুলির বর্তমান প্রজন্মের কাছে কাশ্মীর দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে-বাঁধানো সিপিয়া রঙের ছবির মতো, মৃত পূর্বপুরুষদের শুকনো মালা-পরা ছবির পাশেই যা সাজানো থাকে। কিন্তু উপত্যকার সেই আনন্দবেদনাময় স্মৃতি, সেই মিলন ও বিচ্ছেদের, বিভাজন ও বিদ্বেষের, নির্যাতন ও বঞ্চনার আখ্যান তো ভুলে গেলে চলবে না। বরং সেই ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়েই রাষ্ট্রীয় ও যূথবদ্ধ বিস্মরণের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালাতে হবে। রাহুলের এই স্মরণগ্রন্থ সেই রক্তচিহ্নলাঞ্ছিত চান্দ্র উপত্যকার ম্লান-হতে-থাকা জ্যোত্স্নালোকিত অবয়ব। এ বই না পড়লে আজকের কাশ্মীর অজানা থেকে যাবে, বোঝা যাবে না সেই অমর পঙক্তিমালার সম্যক তাত্পর্যও— যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াব, আমি বিষ পান করে মরে যাব…।
জটিল লেখা, মূল বক্তব্য পরিষ্কার হল না।
জাভেদ মিয়াদাদের সেই ছক্কা এখনো মনে পড়ে। রাতে টিভির খবরে দেখেছিলাম। এই ম্যাচের নাটকীয় জয় পাক ক্রিকেটের এক অঘোষিত ল্যান্ডমার্ক। ঘটন অঘটন পটিয়সী বলে পাক দল পরিচিতি লাভ করতে থাকে।