১৮৫২ সালের এক দিন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের পার্বত্য শহর দেরাদুন। সেখানে একটি অফিসেসকালবেলা এক তরুণ প্রবেশ করেন এবং তাঁর সিনিয়রকে বলেন, “স্যার, আমি দুনিয়ার উচ্চতমপর্বতশৃঙ্গ আবিষ্কার করেছি!!”   তাঁর সিনিয়র ব্রিটিশ ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। একজন নেটিভ ভারতীয়,যিনি কিনা
 আবার বাঙ্গালী মাথায় এত বুদ্ধি রাখে?? তখন ব্রিটিশরা এদেশের মানুষদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যকরতো। সে কিনা এই আবিষ্কার করেছে?

 

মাউন্ট এভারেস্টের নাম কে না জানে? এটি হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে শীর্ষবিন্দুর উচ্চতাঁর হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে এর উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার (২৯,০২৯ ফুট) । এটি হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশ, নেপাল এবং চীনের সীমানার মধ্যে এর অবস্থান।

 

যুগ যুগ ধরেই এই শৃঙ্গ জয় করার ইচ্ছা অনেকেরই। অনেক অভিযাত্রী জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন এই শৃঙ্গ জয় করতে গিয়ে। তেনজিং নরগে এবং এডমুন্ড হিলারী ১৯৫৩ সালের ২৯ শে মে যৌথভাবে সর্বপ্রথম মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন।

 

কিন্তু পাঠক আপনাদের কি জানতে ইচ্ছা করে না কে সর্বপ্রথম পরিমাপ করে নির্ণয় করেন মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা? এরফলেই বের হয়ে আসে এই শৃঙ্গই বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ। চলে যাই শুরুর গল্পে। হ্যাঁ। এক অসাধারণ মেধাবী বাঙ্গালী গণিতবিদ কে সর্বপ্রথম পরিমাপ করে নির্ণয় করেন মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা। তাঁর নাম রাধানাথ শিকদার।

 

রাধানাথ শিকদারের জন্য ১৮১৩ সালে কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। তাঁর পিতার নাম তিতুরাম। শৈশবে রাধানাথ ‘ফিরিঙ্গি’ কমল বসুর বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন; এটির অবস্থান ছিল কলকাতায় ৪৮নম্বর চিৎপুর রোডে। পরে ১৮২৪সালে তিনি ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। এইখানেই তিনি ৭ বছর ১০ মাস পড়াশোনা করেছিলেন। হিন্দু কলেজেই রাধানাথ পেয়েছিলেন ইংরেজীর শিক্ষক হিসেবে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, গণিতের শিক্ষক হিসেবে ডাঃ জন টাইটলার প্রমুখ সব বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তিদের।

 

হিন্দু কলেজে পড়াকালীন সময়ে তাঁর মেধার প্রস্ফুলন ঘটে। বিশেষ করে গণিত বিষয়ে তাঁর এমন অসীম জ্ঞান সবাইকে মুগ্ধ করে। ১৬বছর বয়সে ছাত্র থাকাকালীনই তিনি নিজেই জ্যামিতির একটি সম্পাদ্য সমাধানের পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেন, যা ‘Gleanings in Science’ (১৮৩১) পত্রিকায় ‘‘To draw a Tangent to two Circles’’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।

 

১৮৩১ সালে ভারতে সার্ভেয়র জেনারেল ছিলেন জর্জ এভারেস্ট। তিনি একজন দক্ষ, তরুণ গণিতবিদকে খুঁজছিলেন। তাঁর বন্ধু ডাঃ জন টাইটলার তাঁর ছাত্র রাধানাথের নামটি সুপারিশ করে দিলেন এভারেস্টের কাছে। ঐ সময়ে আইজ্যাক নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’ সমগ্র ভারতে প্রথম চর্চা করেছিলেন রাধানাথ শিকদার এবং রাজনারায়ণ বসাক এবং সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁদের শিক্ষক ডাঃ টাইটলারের জন্যই। এভারেস্ট রাধানাথকে নিয়োগ দিলেন। রাধানাথ সার্ভেয়র জেনারেলের অফিসে যোগ দিলেন ১৮৩১সালের ২০শে ডিসেম্বর, বেতন মাসে ৩০টাকা।

জর্জ এভারেস্ট

রাধানাথ ১৮৩২ সালের ৭ই মে গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্ভেয়র হন এবং দেরাদুনের সিরোন্‌জ অঞ্চলে জরিপের কাজে যুক্ত হয়ে যান। এই জরিপের কাজের জন্য প্রতিভাশালী বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্ট বেশ কিছু নিজস্ব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন; উল্লেখযোগ্য, রাধানাথ এই রকম কিছু পদ্ধতির পরিমার্জন করে দিয়েছিলেন। এমনই একটির শিরোনাম ছিল, ‘A Set of Tables for Facilitating the Computation of Trigonometrical Survey and the Projection of Maps for India’।

জর্জ এভারেস্ট অবসর নিলেন ১৮৪৩ সালে। তাঁর আগে তিনি ‘The Great Arc of India’-র কাজটি সম্পূর্ণ করেন। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ভয়ঙ্কর সমস্যাসঙ্কুল জরিপের কাজ। তাঁর জায়গায় অভিষিক্ত হলেন অ্যান্ড্রু ওয়াহ।

অ্যান্ড্রু ওয়াহ।

১৮৪৫ সালের ৩১ মার্চ তারিখেই তিনি ভারতের ‘প্রধান কম্পিউটার’ (Chief Computer) পদোন্নতি পান। রাধানাথ শিকদার দেরাদুনের সার্ভে অফিস থেকে কলকাতাঁর সার্ভে অফিসে বদলি হয়ে এলেন ১৮৪৯ সালে।

১৮৪৭ সালে অ্যান্ড্রু ওয়াহ হিমালয় পর্বতমালার পূর্বপ্রান্তে একটি নতুন শৃঙ্গ আবিষ্কার করেন। তিনি ধারণা করেন এর উচ্চতা তখন পর্যন্ত জানা পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে বেশী হতে পারে। এর নাম রাখা হল ‘শৃঙ্গ-১৫’ (Peak-XV)। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে হিমালয় পর্বতের ৭৯টি শিখরের উচ্চতা নির্ণয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। এগুলির মধ্যে ৩১টির স্থানীয় নাম ছিল আর বাকিগুলিকে রোমান অক্ষরের সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা হতো। সেই মতো ভবিষ্যতের এভারেস্ট শৃঙ্গটিকে অভিহিত করা হতো ‘শৃঙ্গ-১৫’ (Peak-XV) নামে।

 

হিমালয় পর্বতের সব শৃঙ্গের উচ্চতাঁর মাপগুলি সমস্তই জমা পড়েছিল কলকাতাঁর গণনা বিভাগে। আর এতে নেতৃত্ব দিলেন রাধানাথ। ১৮৫২ সালের একদিন তিনি আবিষ্কার করে বসলেন ‘শৃঙ্গ-১৫’ (Peak-XV) পৃথিবীর সবথেকে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ। তাঁর হিসাবে এর উচ্চতা ২৯,০০২ ফুট। তিনি দেরাদুনে অ্যান্ড্রু ওয়াহকে বিষয়টা জানান। এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ওয়াহ সাহেব কাউকে না জানিয়ে দেরাদুনে ‘কম্পিউটার’ পদে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান হেনেসি সাহেব ও তাঁর সহযোগীদের দিয়ে বিষয়টা ক্রসচেক করান। অবশেষে ১৮৫৬ সালে রাধানাথের কৃতিত্ব স্বীকৃতি পায়।

 

সে বছর রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি ঘোষণা দেয় পিক ১৫ এই হল বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গ। জর্জ এভারেস্টের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। ওয়াহ্ কোনো প্রচলিত আঞ্চলিক নাম প্রস্তাব করতে পারেননি, কারণ সে সময় নেপাল ও তিব্বত বিদেশীদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল, যদিও তিব্বতীরা একে বহু শত বছর ধরে চোমোলুংমা বলে আসছিল। এর নাম প্রথমে মন্ট এভারেস্ট রাখলে চাইলেও পরে এর নাম রাখা হয় মাউন্ট এভারেস্ট।

 

দুঃখের বিষয় এটাই ১৮৫২ সালে এভারেস্টের উচ্চতা পরিমাপ করলেও রাধানাথের কৃতিত্ব গোপন করে ইংরেজরা।

 

১৮৫১ সালে সার্ভে বিভাগের এক ম্যানুয়াল প্রকাশিত হয়। এর নাম ‘A Manual of Surveying for India’। এর লেখক ছিলেন, আর স্মিথ এবং এইচ এল থুইলিয়ার। এই গ্রন্থে তারা রাধানাথের অবদান এর কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু ১৮৭৫ সালে তাঁরা রাধানাথের নাম মুছে দেন তৃতীয় সংস্করণে। ১৮৭৬ সালে ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া নামক সংবাদপত্র এই ঘটনাকে মৃতের উপর ডাকাতি বলে উল্লেখ করে।

 

 

রাধানাথের আবিষ্কারের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন ভারতের প্রাক্তন সার্ভেয়ার জেনারেল  কর্নেল সিডনি জেরাল্ড বুরার্ড ১৯০৪সালে বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার’-এর ১০ই নভেম্বর সংখ্যায় ‘‘Mount Everest : The Story of a Long Controversy’’ শিরোনামে এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করে। এর পরেই বিশ্ব জানতে পারে এই অসাধারণ গণিতবিদ সম্পর্কে।

 

তিনি ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। ১৮৫৪ সালে তাঁর বন্ধু প্যারী চাঁদ মিত্রের সাথে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে মাসিক পত্রিকা নামে পত্রিকা বের করেন।

 

১৮৬২ সালের ১৫ মার্চ তিনি অবসর গ্রহণ করেন এবং তৎকালীন জেনারেল এসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন ( বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ ) এ গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

 

১৮৬৪ সালে তিনি জার্মানির  “Natural History Society of Bavaria-র সম্মানজক সদস্যপদ পান।

 

১৮৭০ সালে ১৭ মে চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার গঙ্গার ধারে তাঁর নিজস্ব বাগানবাড়িতে এই মহান গণিতবিদের জীবনাবসান ঘটে। তিনি ছিলেন চিরকুমার।

 

এরপর বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল নেচার লিখল, “Baboo Radhanauth Sickdar for many years chief computer to the Trigonometrical Survey of India, at one time in charge of Calcutta Observatory, and a mathematician of some attainments, died in May last at Calcutta.”

 

 

রাধানাথ সবসময় ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে। সত্যের পক্ষে। একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। ১৮৪৩ সালের ১৫ই মে।

 

দেরাদুন শহর।

 

সে সময়ে সাধারণ মানুষকে উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসাররা জোর করে পয়সা না দিয়ে খা‍‌টি‍‌য়ে নিতো। আর ঐটিই রেওয়াজ ছিল। কিন্তু ঐ দিনের ঘটনায় এমন অমানবিক কাজে বাধ সেধেছিলেন অসীম সাহসী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ইনিই রাধানাথ শিকদার। রাধানাথ সেই সময় দেরাদুনেরই গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অফিসের কম্পিউটার পদে চাকুরিরত। রাধানাথের পরিচারককে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার এইচ ভ্যানসিটার্ট  সাহেব বিনা পয়সায় তাঁর নিজের মালপত্তর বহন করিয়ে নিচ্ছিলেন। এমন কাণ্ড দেখে রাধানাথ সেই মালপত্তর আটকে রাখেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটকে সশরীরে তাঁর কাছে আসতে বাধ্য করেন। তাঁরপরই উপরোক্ত উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়।

 

শেষে রাধানাথ মালপত্তর ফেরত দিলেন বটে, তবে তাঁর বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। মামলায় রাধানাথ হেরে যান এবং দুশো টাকা জরিমানা হয়ে যায়। সেই আমলে দুশো টাকা কিন্তু অনেক বেশী অর্থ। রাধানাথ কোনোরকম গ্রাহ্য না করে সে টাকা মিটিয়ে দেন। রাধানাথের এই প্রতিরোধের ফলে এই রকম বেগার খা‍টিয়ে নেওয়ার মতো অমানবিক কাজ অচিরেই বন্ধ হয়ে গেল।

 

এভারেস্ট তাঁর কর্মচারী সম্পর্কে বলেছেন,  “Hardy, energetic young man, ready to undergo any fatigue, and acquire a practical knowledge of all parts of his profession.”

 

তিনি রত্ন চিনতে ভুল করেন নাই। তাই আরও লিখেছেন, “There are a few of my instruments that he cannot manage; and none of my computations of which he is not thoroughly master. He can not only apply formulate but investigate them.”

 

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি একবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন মাউন্ট এভারেস্টের নাম রাধানাথের নামে নামকরণ করতে।

 

রাধানাথের আবিষ্কারের পর মাউন্ট এভারেস্ট আরও উঁচু হচ্ছে।

 

১৯৫৫ সালে আরও ২৬ ফুট উঁচু হয়ে ২৯,০২৮ ফুট (৮,৮৪৮ মিটার)  হয়ে যায়  যখন ভারত সরকার নতুন করে সার্ভে করে। ১৯৭৫ সালে চীন সরকারও একই ফলাফল পায়। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই এর তুষার শীর্ষকে গণনার ভিতর আনা হয়, পাথুরে মাথা বাদ দিয়ে।

 

১৯৯৯ সালে আরও ৭ ফুট উচ্চতা বেশি পাওয়া যায় যখন মার্কিন গবেষকরা নতুনভাবে উচ্চতা নির্ণয় করেন। ২০০৫ সালে চীনা গবেষক দল এর উচ্চতা পায় ৮,৮৪৪.৪৩ মিটার। এই উচ্চতা কোন তুষার শীর্ষকে বাদ দিয়ে। তুষারের টুপি এর উচ্চতা নিয়ে যায় ৮,৮৪৮ মিটারে। প্রতি বছর এর উচ্চতা ৪ মিলিমিটার করে বাড়ছে।

 

 

 

তথ্যসূত্রঃ

 

১। The man who ‘discovered’ Everest-Soutik Biswas; BBC News Online, Monday, 20 October, 2003.

 

২। মাউন্ট রাধানাথ দ্বিশততম জন্মবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি-শঙ্করকুমার নাথ; দৈনিক গণশক্তি, ৪ঠা, আগস্ট ২০১২

 

৩। Indian mathematician 1st to identify Everest as highest mountain peak; Times of India | Jun 2, 2008.

 

৪। উইকিপিডিয়া

 

৫। Mount Everest: The Story of a Long Controversy. Author: Burrard, S. G.. Publication: Nature, Volume 71, Issue 1828, pp. 42-46 (1904).

 

৬। Who discovered Mount Everest?-Parke A. Dickey; History of Geophysics: Volume 4, Eos, VoI.66, No. 41, October 8, 1985, PAGES 697-700.

 

৭। Radhanath Sikdar: Beyond the Peak- Ashis Lahiri.

 

৮। Patterns of Colonial Science in India, Indian Journal of History of Science, 15(1), May 1980 – Deepak Kumar.