এক.

কি কারণে জানি না, একদিন এই নোংরা শহরটাতে কদম ফুলের চাহিদা খুব বেড়ে গেলো। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। সবার হাতে কদম ফুল দেখে শীর্ণ ছেলেটাও দু’টো কিনে ফেললো। শহীদ মিনারের নির্জন রাস্তাটায় আজ প্রচণ্ড ভিড়। রাজপুত্র আজ দেশে ফিরে এসেছেন, শেষবারের মত। শহর ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে আজ, ছেলেটা ক্রমাগত মেয়েটাকে এসএমএস পাঠিয়ে চলছে। কোন উত্তর আসছে না, গত তিন মাস ধরে নাম্বারটা থেকে কোন উত্তর আসে না, অথচ তিন মাস আগে নাম্বারটা থেকে অজস্র উত্তর আসতো, আসতো অজস্র প্রশ্ন।

ছেলেটা লিখছে;
“একটা কদম কিনলেই হতো;
দুটো কিনলাম…”

ছেলেটা নিশ্চিতভাবে জানে, যদি নূন্যতম সুযোগও থাকে; মেয়েটা আসবে। প্রচণ্ড বৃষ্টি ভালোবাসা একটা মেয়ের পক্ষে এদিন ঘরে বসে থাকা সম্ভব না। সামনের এই বিরাট ভিড়ের মাঝে ও নিশ্চয়ই আছে।

ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। লাইনটা এগিয়ে চলতে থাকে শবদেহের দিকে। নুহাশ খুব শক্ত করে তার বোনের হাতটা ধরে রেখেছে। পুত্র নিনিত খুব আকুল হয়ে সবাইকে দেখছে, ও সম্ভবত বুঝতে পারছে না সামনে এসব কি হচ্ছে। মৃতদেহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। এই মানুষটার মৃতমুখ আমি দেখতে চাই না, মাত্র বছর খানেক আগে এই শহীদ মিনারের একটু সামনেই পাবলিক লাইব্রেরীতে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। দেখতে তিনি খুব সুদর্শন ছিলেন না; তবে তিনি আমার নায়ক ছিলেন। আমি আমৃত্যু তাঁকে কল্পনা করার সময় সেই জীবন্ত হাস্যজ্জল মানুষটার ছবিই দেখতে চাই। স্রোড্রিঞ্জার নাকি বলেছিলেন ‘একটা জিনিস চোখে না দেখলে আসলে আমাদের জগতে তার কোন অস্তিত্ব নাই’। আইনেস্টাইন তাকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন ‘তাহলে বলতে হয়, জানালাটা বন্ধ করে দিলে আকাশের চাঁদটাও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। সেটা সম্ভবত যৌক্তিক শোনায় না’। যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক আমি আসলে এটা বিশ্বাস করতে অনিচ্ছুক হুমায়ূন আহমেদ মৃত। এমন কি দুই বছরবাদেও…

ভিড় ঠেলে বেরিয়ে দেখি কদম দুটো হাতেই রয়ে গেছে…

——

দুই.

“…শফিক চা শেষ করে পকেটে হাত নিয়ে দেখে মানিব্যাগ আনে নি। এরকম ভুল তার সচরাচর হয় না। তার আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। শফিক মনস্থির করতে পারছে না। সঙ্গে মানিব্যাগ নেই এই তথ্য দোকানিকে আগে দেবে, না চা-সিগারেট খেয়ে তারপর দেবে!

শফিকের হাতে বিভূতিভূষণের একটা উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ইছামতি। বইয়ের দ্বিতীয় পাতায় শফিক লিখেছে- ‘অবন্তিকে শুভ জন্মদিন’। অবন্তির বয়স ষোল। সে ভিকারুননিসা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। শফিক তাকে বাসায় অংক শেখায়…”

আমার হাতে একটা বই, বইটার নাম দেয়াল। লেখক হুমায়ূন আহমেদ, বইটার প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই লেখা উপরের অংশটুকুন, এই বইটা আমি উপহার পেয়েছি। আরও একবার আমার জন্য প্রমাণিত হয়েছে পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে যেটার ব্যাখ্যা খুঁজে পাবার চেষ্টা করা পাপ…

মেয়েটাকে আমি অংক করাই, তার বাসার সামনে একটা টং দোকান, দোকানে মাঝেমাঝে চা-টা খাই। আজ আমার হাতে একটা বই, বইয়ের নাম ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ লেখক হুমায়ূন আহমেদ। মেয়েটার আজ জন্মদিন। আমি একটু দ্বিধায় ভুগছি, বইটা কি তাকে দেব নাকি দেব না। বইটার দ্বিতীয় পাতায় শুভেচ্ছাক্তি।

হ্যা, সেদিন আমি বইটা দিয়েছিলাম এবং মনে করে করে আমার জন্মদিনেও মেয়েটা একটা বই উপহারদিয়েছিলো। ”দেয়াল”, দ্বিতীয় পাতায় গোটা গোটা হরফে লেখা’;

“আরিফ ভাইয়া কে…”

মেয়েটা কি আমাকে দেয়ার আগে বইটা পড়েছিলো কি না আমার জানা নাই। জানার চেষ্টাও করি নাই।
কিছু ঘটনা ব্যাখ্যা করতে নাই, কিছু ঘটনা ব্যাখ্যা করা পাপ…

না, এই মেয়েটাকে আমি ভালোবেসে ফেলতে পারিনি।
তার কারণ হয়ত, এই মেয়েটার সামনেই অন্য আরেকজন মানুষকে আমি লুকিয়ে-চুকিয়ে অজস্র এসএমএস পাঠাতাম। অন্যরকম একটা মোহ।

আহারে…
আমার সেই মোহ বুঝি কোনদিন কাটলো না…

তিন.

মুক্তিযুদ্ধ আমি নিজের চোখে দেখি নাই। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। তার শুরুটা একটা বই, ”জোছনা ও জননীর গল্প” এই গল্প পড়তে পড়তেই আমি হঠাৎ নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করলাম। এই বইটার প্রত্যেকটা পাতার ভাঁজে-ভাঁজে জমা আছে কত কষ্ট, কত কান্না, কত হাসি। বালিশের কভার ভিজে আসে। একটা একটা অনুচ্ছেদ পড়ি, আমার ভেতরে কে যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। কেন আমার জন্ম হলো না সেই সময়টাতে, আমি কত দুর্ভাগা।

মনে পড়ে চুন্নু ডোম শাখারি বাজার থেকে লাশগুলো ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলতে যেয়ে বর্ণনা করেছে-
মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাই নাই, যোনিপথ ক্ষত বিক্ষত এবং পেছনের মাংস কাটা দেখেছি। মেয়েদের দেখে মনে হয়েছে তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন সজোরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং নিতম্বের মাংস যেন ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতির মাথায় খোপা খোপা চুল দেখলাম। মিডফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবারে একশ লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।

বাদদেই অনেক অনেকবার বলেছি এই গল্প, বারবার বলেই এর আবেগকে বোঝাতে পারবো না,
শুধু হুমায়ুন আহমেদের শেষ দৃশ্যটার কথা বলি;

“নাইমুল কথা রাখেনি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মাঝে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায় আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনার রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে।

গভীর বেদনায় বলে আহারে… আহার…”

ভাবতে ভাবতে আমিও যেন চন্দ্রগ্রস্থ হয়ে পড়ি… শহীদ যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে থাকি… অপলক নয়নে…

হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা দামী বই যদি কিনতে না পারি চোখে পানি চলে আসে। আমার একমাত্র গর্ব… আমার নিরঙ্কুশ অহংকার… আমার চোখের সামনের শেলফটাতে সারি সারি মুক্তিযুদ্ধের বই। এই একটা, শুধু একটা ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাজ নাই…

চার.

নাইমুল কথা রাখেনি…
শাহেদও ফিরে আসেনি…
শুভ্র, হিমু মিসির আলীরা ফিরে আসবে না…
ফিরে আসবেন না ম্যাজিশিয়ানও…

কিন্তু আমরা… আমাদের কি হবে…

মধ্যবিত্ত স্বপ্নচারী তরুণ…
লিলুয়া বাতাসে হেঁটে চলা…
আমরা তো চিরটা জীবন নন্দিত নরকের চারকোণা ক্যানভাসেই আটকে থাকতে চাই…
অবন্তীদের বাসার সামনে ক্যাপেস্টেন ফুঁকতে ফুঁকতে জীবন কাটিয়ে দিতে চাই…
অনেক রাত করে রূপাদের বাসার সামনে নীল শাড়ি পড়া একটা অলিক মানবীর জন্য জীবন দিতে চাই…
সারারাত খালি পায়ে হেঁটে আঙুলে ফোস্কা ফেলে দেই…
জোছনা দেখে পাগল হয়ে যাই…
বৃষ্টির ঘ্রাণ পাই…
একটা এসএমএসের জন্য অপেক্ষা করতে চাই আরও অনেক অনেক দিন…

আপনি মানুষটা ভালো না;

“জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণ রসায়ন,
জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন…”