শেষমেস যেতেই হলো দেশে। এগার বছরের মাথায় এটা আমার দ্বিতীয় স্বদেশ ভ্রমন। এবার একা যাচ্ছি বিশেষ কাজে। অনেকে প্রতিবছর দেশে যায়, যেতে পারে। নাড়ীর টানে যেভাবে পারে দেশের মাটিতে পা রাখে, মাথা ঠেকায়। তারা দেশ প্রেমিক। আমি তা আজো হয়ে উঠতে পারিনি। মনে হয় প্রতিষ্ঠা, পেশা এইসব মাথার ভেতরে খুব ভাল করে জেকে বসেছে, তাই সময়ের দৌড়ের গতিবেগটা ঠাহর করতে পারি না। তৃতীয় ঋপুর হাতে বন্দী মানুষের যা হয়। সে যাই হোক অনেক সময়, অর্থ ব্যায় করে অবশেষে দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। কম করে একটা মাস সেখানে কাটাতে হবে- এমনই আদেশ। এটা অনেক পাওয়া- কোনকিছু দিয়ে তাকে পরিমাপ করা যাবে না।

পিয়ার্সানে আমিরাতের বেল্টে লোট-বহর তুলে দিয়ে, ইমিগ্রেশনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা পরীক্ষায় পাশ করে যখন নিজের নশ্বর দেহটাকে নিয়ে উড়োজাহাজের পাদানিতে পা রাখলাম, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। হাওয়াই জাহাজে উঠেই মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো দেশের স্বপ্ন-গন্ধ-রসে। জানালার পাশে বসে সেই খোয়াবের ওমে চোখ বন্ধ করে বুঁদ হয়ে থাকলাম। জাহাজ ভিড়লো দুবাইয়ের ঘাটে। এখানে কাটাতে হবে সাতটা ঘন্টা। তাও কেটে গেল একসময়। এখন আবার প্লেনে উঠার পালা। এখান থেকে যারা উঠলো তাদের সিংহভাগ বাঙালী, কর্মজীবি মানুষ। একই পোষাক পরা, একই চলা-বলা, একই চুলের নক্সা কাটা জনা বিশেক লোক অপেক্ষা করছে বিমানে উঠার। তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনারা কারা? উত্তরে বললো- আমারা সেনাবাহিনীর লোক। নন-কমিশন অফিসার। বাগদাদে গিয়েছিলাম তাদের সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করতে। সেখান থেকেই দেশে ফিরছি।
মনেমনে বললাম- তথাস্ত। এভাবেই পৃথিবী চলবে, থাকবে শান্তিতে। আসনে বসতে গিয়ে দেখি আমার আসনটা বেদখল হয়ে গেছে। সেখানে চারদিক আলো করে বসে আছে সেই সেনা সদস্য, যাকে আমি লাউঞ্জে বসে প্রশ্ন করেছিলাম। জানালার পাশের সিটটা আমার বুক করা সেই গোড়া থেকে, বড়ই কাঙ্খিত জায়গা। মনটা সামান্য দমে গেল। ভদ্রলোক মুখে এমন একটা অধিকারের ভাব আর বন্ধু বাতসল্য নিয়ে বসে আছে, যে আমি আর না করতে পারলাম না। আমাকে দেখেই অতি পরিচিত মানুষের মতন কথা বলা শুরু করে দিল। ধৈর্য্য ধরে থাকলাম। প্লেন ছেড়ে দিল। আধাঘন্টা যেতে না যেতে খাবার এলো- শুধুই আমার সহযাত্রী সৈনিক প্রবরের জন্যে। খাবার দেখেই বুঝলাম, আমি জিতেছি। আরো বুঝলাম, দিন শেষে সবুরে মেওয়াই ফলে। আমি পুরান ডাইবেটিক রোগী। আসার সময় বউই আমার জন্যে ডাইবেটিক খাবারের ফরময়েশটা যোগ করে দিয়েছিল, যাতে সারাটা রাস্তা আমি নিরাপদে তৃণভোজী প্রাণীর মতন ফাইবার ওয়ালা খাবার চিবাতে চিবাতে যেতে পারি। এই বিস্বাদ খাবারের জ্বালাতন থেকে রেহাই পেয়ে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। আমার সিটে বসা সহযাত্রীকে উদ্দেশ্য করে মনেমনে বললাম- থাকো, জানালার ধারে বসে প্রকৃতি দেখ, আর ফাইবার চিবাও। দেশে তোমরা থাকো প্রিন্সের মতন। সময় অসময়, মধ্যরাতে ঘুমন্ত দেশবাসীকে চমকে দিয়ে, ভুলভাল ইংরেজী বলে দেশের রাজা হয়ে যাও। এখন না হয় সামান্য একটু কষ্টই করলে। সহযাত্রী আমার দিকে একবার তাকালো। তাকে বললাম- হয়তো বিশেষ যাত্রী হওয়াতে তাকে সবার আগে খাবার দিয়েছে। খেতে বসে সে কি অভিযোগ তার। এত খারাপ খাবার সে নাকি জীবনে দেখে নাই। নানান জাতের পানসে লেবু জাতীয় ফল-ফুলোরীতে ভরা তার প্লেট। গ্রেপ ফ্রুটের (আঙ্গুর ফল নয়) চাইটা খেয়ে হাচ্চি দেয়া শুরু করলো আমার সহযাত্রী। বিড়বিড় করে বললো- ক্যপ্টেন সাহেবকে বলতে হবে, আমিরাতের সার্ভিস ভালো না। আমি সব শুনে চুপ মেরে যাই, আর মনে মনে বলি- এইবার বোঝ জানলার কাছে অন্যের সিটে বসার মজা। আরো ঘন্টা খানেক পরে এলো আমার জন্যে বিরিয়ানী, কোপ্তা, কালিয়া। সেদিকে বার কয়েক আড় চোখে তাকিয়ে ভদ্রলোক জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে ভাসমান মেঘের সৌন্দর্য্য দেখতে লাগলো।

সবশেষে এক সময় দেশের ভিতরে ঢুকে, আরো একবার দেশের মানুষ হয়ে গেলাম। দেশপ্রেমিক হতে পারলাম কিনা বলতে পারবো না, তবে যে কাজে এসেছিলাম তা শেষ করলাম যথা সময়ে। ফিরে আসতে তখনও সপ্তাহ খানেক বাকী। কোন এক স্বজাতি ভাইকে বিদায় জানাবার জন্য মালিবাগ আন্তনগর বাস টর্মিনালে যেতে হলো। ভাই বিদায় হয়েছেন। উদ্দেশ্যহীন পায়চারি করছি ফুটপাতে। মনে হলো সময়টা কাটানোর জন্য কিছু একটা করার দরকার। জুতাটাকে একটু চকচকে করে নেবার জন্য ফুটপাথের পাশে বসা কর্মব্যস্ত এক মুচির পাশে এসে দাড়ালাম।

-এই জুতোজোড়া ভাল করে পালিশ করতে কত নেবে?
-দশ ট্যাহা লাগবো
মুচির ঝটপট উত্তর। গাড়ির টায়ারের তৈরী ভারি শতছিন্ন একজোড়া স্যান্ডেল এগিয়ে দিল সে।
-লন, এইডা পইরা জুতাডারে দ্যান।
অনেক সময় দাড়িয়ে থাকতে হবে ভেবে লোকটাকে বললাম,
-তোমার পাশের এই কাঠের বাক্সটার উপর একটু বসবো?
-বহেন।
বেশী সময় চুপচাপ ঠায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। ভাবলাম, রোদে পুড়ে কাল হয়ে যাওয়া এই লোকটার সাথে একটু আলাপ করলে কেমন হয়। একা একা ভাবটা কাটুক অন্ততঃ। ছাই ফেলতেও ভাঙ্গা কুলো লাগে।
-কয় ছেলেমেয়ে তোমার?
-দুই মাইয়া। বরোডা কেলাস ফাইবে, ছোডডায় থিরিতে। খাই না খাই পোলাপাইনেরে তো লেহাপরা করাইতে অইবো, কি কন?
-তা ঠিক। মা বাবা নেই তোমার?
-বাবা মারা গ্যাছে চার বছর। মা আছে। বাই, বইন সবই আছে। তয় অবাবের সংসার। মায়রে একা পালবার পারি না। আমরা তিন ভাই সবাই মিল্ল্যা মায়রে দেহি।
বেশ কিছু সময় উদ্দেশ্যহীন তাকিয়ে থাকি মানুষটার চক্ষু কোটরাগত পুষ্টিহীন মুখটার দিকে। যেন কত কত দিনের পরিচিত আমি তার- কত না স্বজন, সুখ দুঃক্ষের সব কথা বলতে থাকে সে বিরামহীন। বড় বেশী কাঙ্খিত এই সরলতার স্পর্শে মন পবিত্র হয়।
একসময় প্রশ্ন করে সে।
-আমনে কই থায়েন? কি করেন?
অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তির বশে, আগুপিছু না ভেবে বলে ফেলি,
-কানাডায় থাকি।
কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে যায় লোকটা, আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে অপ্রয়জনে। যে মুখে এতসময় ছিল স্বজন বাত্সল্যের ছাপ, এখন সেই মুখ মূহুর্তে ছেয়ে গেল অপরিচয়ের চাদরে। কেন হবে না তা! দীন-হীন এক মায়ের সাথে, সবার মায়ের সাথে ধনাঢ্য স্বালঙ্কারা এক মায়ের তুলনা করে ফেলেছি আমি। ক্ষমার অযোগ্য এ অপরাধ। সত্যিকারের প্রেম সব সময় অন্ধই হয়। নিজেকে বড় অপরাধি মনে হতে লাগলো। কেন যে বলতে গেলাম অমন অসুন্দর কথাটা- নিজের অমন কটমটে ঠিকানাটা।
অনেকটা কোন কারন ছাড়াই উদাস ভাবে লোকটা প্রশ্ন করলো,
-ঐহানে আয় রোজগার কেমন অয়?
-চলে কোন রকম।
উত্তর করলাম ধরাপড়া আসামীর মতন। খেটে খাওয়া মানুষটার মুখের অদ্ভুত অভিব্যক্তি বৈচি গাছের কাটার মত অন্তরে বিঁধতে লাগলো। কাজ শেষ হয়ে গেছে ততক্ষনে। কথাও শেষ হয়ে গেছে। মজুরি মিটিয়ে দ্রত প্রস্থান করলাম নিজের প্রতি মৃদু একটা অভিমান নিয়ে।

পরেরদিন পিতৃভূমি খুলনায় রওনা দিলাম। এবার বাসযাত্রা। আরামদায়ক বলা যায়, তবে দীর্ঘ বারো ঘন্টায় সেই কষ্টার্জিত আরাম যে ব্যরামে পরিনত হয়েছিল সে কথা উল্লেখ না করাই আপাততঃ আরাম দায়ক বলে মনে হচ্ছে। কেন এমন মনে হচ্ছে সেটা একটু পরিষ্কার করে বলি। দীর্ঘ বিদ্ধস্ত পথের বদৌলতে তাপানুকুল যন্ত্রযানের মুহুর্মূহু নাচন কোদনের শেষে যখন গন্তব্যে পৌছলাম তখন শরীরের বাকী শক্তিটুকু প্রানপণে সঞ্চয় করে যেটুকু কাজ করতে পারলাম তা শুধু শয়ন এবং শ্রমনিদ্রায় আত্মসমর্পন। সেদিন কিছু না পারলেও পরের দিন সকালে কিছুটা সামর্থ্য দেহে ফিরে পাবার পর যারপর নাই উত্সাহে আপন-দূর সকল সম্পর্কীয় ভ্রাতা ভগিনীদের সংগে দেখা সাক্ষাতে কাল অতিবাহিত করতে থাকলাম। এগার বছর পর পিতৃভূমে গিয়ে যতটা আশা করেছিলাম ততটা দেখলাম না। আশা করেছিলাম এত দিনের ব্যবধানে পরিচিত জনেরা উত্সাহে কৌতুহলে চারদিক থেকে ছুটে আসবে। কিন্তু আমার সব আশার গুড়ে বালি না পড়লেও কিছুটা পড়েছিল নিশ্চয়ই। আমার আশার তরীতে বাতাস দিয়েছিলেন একজন- তিনি আমার বাশার কাকা। দূর সম্পর্কের কাকা এবং নিকট প্রতিবেশী। বয়সে কমকরে হলেও আশির কোঠায়। সেই কাকা এসেছেন দেখা করতে, জীর্ন শরীর নিয়ে, লাঠিতে ভর করে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে। দেখে কষ্ট লাগলো মনে, লজ্জিত হয়ে প্রশ্ন করলামঃ

-কাকা, এই শরীর নিয়ে কি দরকার ছিল আসার, আমিই না হয় যেতাম।
-দরকার আছে, ও তুই বুঝবিনা। আজকালকের ছেলেমেয়েরা বুড়ো মানুষদের পুছতে চায় না, তা জানিস?

দেখলাম কাকার অভিযোগ একেবারে মিথ্যে নয়। মানুষের এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা বোধ বেড়েছে অনেক। একে অন্যের প্রতি আগ্রহ বেশ কমেছে। ধনতান্ত্রিক দেশের সুবিধাভোগী না হয়েও ধনবাদী সমাজের রোগলক্ষন গুলো স্পষ্ট ফুটে উঠছে প্রায় সবার মধ্যে। কি আর করা- সবই যুগের হাওয়া। বাশার কাকাকে দেখেছি সেই ছোট বেলা থেকে। দেখেছি কাকা হার্বাল মেডিসিন বা ঔষধি গাছ গাছড়া নিয়ে একেবারে পাগল ছিলেন, এগুলোর উপরে বইপত্র যা পেতেন বিপুল উত্সাহে সংগ্রহ করতেন, গোগ্রাসে গিলতেন। এগুলো নিয়ে অনেক সময় ধরে কথা বললেন। ওদিকে অনেকে আমার সংগে দেখা করার জন্য বসার ঘরে আপেক্ষা করছে, কাকাকে আর বেশী সময় দেয়া যায় না। কথা প্রসংগে জানা গেল উনি আমার সংগে দেখা করতে এসেছেন শুধু কানাডা সম্পর্কে জানতে। বাশার কাকার মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতুহল। এত অল্প সময়ে কিভাবে তা আমি মেটাবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কানাডার পোলার বেয়ার কিভাবে ঠান্ডায় বেচে থাকে, ম্যাপেল গাছের গুনাগুন কি, কারিব্যু কি ধরনের প্রানী, কালমেঘী গাছ কানডায় আছে কিনা ইত্যাদি আরও কত কি। একটা অর্ধ শিক্ষিত মানুষের মনে জানার জন্য এমন আগ্রহ, ব্যাকুলতা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। জানার জন্য জানা, এমন নিঃশর্ত অনুসন্ধিত্সু মানুষ সংসারে আরো বেশী সংখ্যায় থাকলে কী না হতে পারতো এই হতভাগা সমাজ-সংসার! মনটা ভরে যায়, বাশার কাকার কথা শুনে। যতটুকু জ্ঞান ঘটে আছে সবটুকু ঢেলে দিলাম বাশার কাকার ঝুলিতে। তারপরেও উনার জানার পিপাসা যেন মেটে না। প্রায় একমাস পার হতে চললো এমন একটা অদ্ভুত মানুষের সাক্ষাত আমার আজও মেলেনি। পুরা মাসটাই গেল ডলার-পাউন্ড, আয়-রোজগার, গাড়ী-বাড়ী, ক্রেডিট কার্ড আর ফ্যাশন ভুষনের গল্প করে করে আর শুনে শুনে। বাশার কাকার মুখে জানা অজানা জ্ঞানের অনেক বিষয় আলাপ করে মনে হলো আমার বাংলাদেশ আসাটা যেন সার্থক হলো। কারন আমিও অনেকটা তারই মতন হবার স্বপ্ন দেখি। অক্ষমের সাহিত্য চর্চা, ব্যর্থের বিজ্ঞান-দর্শন চর্চার মতনই অর্ধশিক্ষিত বাশার কাকার নিশর্ত-জ্ঞান চর্চার চেষ্টা। এই চেষ্টার কাছে মাথা নত হয় ভক্তিতে। এমন মানুষের দেখা পাওয়া তীর্থ দর্শনের মতন। তার জন্যই এবার স্বদেশ ভ্রমন আমার সার্থক হলো।

কাজ শেষে ফিরে আসি সাধের ইচ্ছা-পরবাসে। দেশী মানুষেরা জিজ্ঞেস করে- কেমন দেখে আসলেন দেশ? তাদের কাছে দেশের গল্প করি, কিন্তু বুঝাতে পারি না কেমন করে এক দখলদারের উপরে হালকা প্রতিশোধ নেই, কেমন করে এক স্বজন-বতসল মানুষ পর হয়ে যায় আমার নিজের দোষে, কেমন করে অশিতিপর এক বৃদ্ধের জ্ঞান পিপাসু মন তীর্থ হয়ে যায় আমার কাছে।