আগের দুটো পর্ব পড়তে নিচের লিঙ্কে একটু কষ্ট করে যান।

১. বঙ্গবন্ধু- নিশীথের মতো ব্যাপ্ত, স্বচ্ছতার মতো মহীয়ান

২. বঙ্গবন্ধু- প্রোজ্জ্বল দীপের দামে, গীতময় তীব্র বেহালায়

‘পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু’ বিষয়টিকে প্রেক্ষণে রেখে একটি ব্লগ সিরিজ শুরু করেছিলাম অনেকদিন আগে। দুটো পর্ব লিখেছিলাম; কিন্তু আর লেখা হয়নি নানা কারণে। জানি, এতে ধারাবাহিকতায় একটু ছেদ পড়বে, তারপরও সিরিজটি শেষ করার একটি নেশা হঠাৎ চেপে বসলো। সে কারণেই লিখছি আজ তৃতীয় পর্ব- বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের ক্যামেরা ট্রায়ালের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার হয়েছিলো আন্তর্জাতিক অঙ্গন এবঙ গণমাধ্যম, তা-ই মূলত এই অঙশের আলোচনার বিষয়।

সিআইএ পরিচালক হেলমস উনিশশো একাত্তর সালের ছাব্বিশে মার্চ (বাঙলাদেশ সময় সাতাশ মার্চ প্রথম প্রহরে) ওয়াশিঙটনে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে তথ্য দেন যে, মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এবঙ তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাতাশ মার্চ দুপুরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিঙকে তলব করেন এবঙ বলেন, তিনি কিছুক্ষণ আগেই রেডিও পাকিস্তানে শুনলেন, মুজিবকে আটক করা হয়েছে।

একত্রিশ মার্চ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্ট ক্লিমেন্টে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠক বসে। বৈঠকে কিসিঞ্জার প্রশ্ন করে- মুজিব কোথায়?
জবাবে সিআইএর ডেভিড বি বলেন- তাকে আটক করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে। সম্ভবত কোয়েটায়।

আট এপ্রিল, উনিশশো একাত্তর সালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফরল্যান্ড স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানান- মুজিবকে হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছে।

তেরো মে, উনিশশো একাত্তর সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন- সকল রাজনৈতিক দলসহ ভারতীয় জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে পাকিস্তানি সরকারের কাছে আপনার পাঠানো যে কোনো বার্তা আমাদের সান্ত্বনা দেবে।

বাইশ মে, উনিশশো একাত্তর সালে করাচিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ইয়াহিয়া এক চিঠিতে জানায় যে, সে মনে করে, শেখ মুজিব মহা অপরাধ করেছেন। সামরিক আদালতে তার বিচার হবে। তবে তার বিচার হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। চিঠির উত্তরে রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করে- একজন আইনজীবী হিশেবে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ শুনে আমার মনে হয়েছে মুজিব ইতোমধ্যেই ‘প্রিজাজড’। তাছাড়া শেখ মুজিবের প্রতি রয়েছে ব্যাপক মাত্রায় আন্তর্জাতিক সহানুভূতি। সুতরাঙ তাকে দণ্ড দেবার মতো একটি বিষয় বিবেচনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উচিৎ হবে, বিশ্ব জনমতকে গুরুত্ব দেয়া।

চৌদ্দ জুন, উনিশশো একাত্তর সালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের হেরাল্ড স্যান্ডার্স ও স্যামুয়েল হসকিনসন কিসিঞ্জারকে ধারণা দেন যে, ভারতীয়রা আশা করে, পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠনে ইয়াহিয়ার উচিৎ হবে মুজিবকে মুক্তি দেয়া। তাদের মতে শুধু এক মুজিবকে ছেড়ে দিলে উদ্বাস্তু প্রত্যাগমনে বিদ্যুৎ গতির প্রভাব পড়বে।

আটাশ জুন, উনিশশো একাত্তর সালে পাকিস্তান সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উদ্বাস্তু ও অভিভাষণ বিষয়ক বিশেষ সহকারী এল. কিলগকে ইয়াহিয়া বলে- মিসেস গান্ধী মুজিবের সঙ্গে বিশেষ আঁতাতের মাধ্যমে বর্তমান সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন।

সাত জুলাই, উনিশশো একাত্তর সালে দিল্লিতে মুজিবকে বাদ দিয়ে সমাধান সঙক্রান্ত কিসিঞ্জার উত্থাপিত এক প্রশ্নের জবাব ইন্দিরা গান্ধী এড়িয়ে যান। এদিনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিঙ কিসিঞ্জারকে বলেন- আটাশ জুন মুজিবের বিষয়ে ইয়াহিয়া যে মন্তব্য করেছে, তা পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়ক নয়। মি. সিঙ অবশ্য পরে একান্ত বৈঠকে উল্লেখ করেন যে, মুজিবকে অন্তর্ভুক্ত করেই সমঝোতায় পৌঁছাতে ভারতের ওপর কোনো চাপ নেই। দিল্লি শুধু এটুকু দেখতে চায় যে, সমাধানটি বেসামরিক ও অসাম্প্রদায়িক।

বাবো জুলাই, উনিশশো একাত্তর সালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল প্রণীত পর্যালোচনামূলক এক দলিলে উল্লেখ করা হয় যে, আমরা ইয়াহিয়াকে এটা স্পষ্ট করতে পারি যে, আওয়ামী লীগই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র দল, যার জনপ্রিয় ভিত্তি রয়েছে এবঙ মুজিবই একটা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমঝোতায় বাঙালিদের রাজি করাতে সক্ষম।

তেইশ জুলাই, উনিশশো একাত্তর সালে ওয়াশিঙটনের সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকে অ্যসিসট্যান্ট সেক্রেটারি যোশেফ সিসকো উল্লেখ করেন যে, মুজিবের যাতে বিচার না হয়, সে ব্যাপারে আমরা কতোটা কী করতে পারি, তা খতিয়ে দেখা উচিৎ। আমি এ নিয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হিলালীর সঙ্গে কথা বলবো।

এর আগের দিন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসএক টেলিগ্রাম বার্তায় উল্লেখ করে যে, আমরা এ মর্মে গুজব শুনছি যে, সামরিক আইন প্রশাসন শেখ মুজিবের গোপন বিচারের তোড়জোর চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, এ সময়টাতে কোলকাতায় মোশতাক-কাইউমের সঙ্গে মার্কিন মিশনের কথাবার্তা চলছিলো বলে সকল মার্কিন নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়।

এগারো আগস্ট, উনিশশো একাত্তর সালে ওয়াশিঙটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত এল. কে. ঝা নিক্সনকে লেখা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সঙক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত বার্তা পৌঁছে দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, ভারতের সরকার, জনসাধারণ, সঙবাদপত্র ও পার্লামেন্ট কোনো প্রকারের বিদেশী আইনি সহায়তা ছাড়াই শেখ মুজিবের গোপন বিচার প্রশ্নে ইয়াহিয়ার কথিত বিবৃতিতে দারুণভাবে বিচলিত বোধ করছে। আমাদের আশঙ্কা তথাকথিত এই বিচার শেখ মুজিবের ফাঁসির দণ্ডের প্রচার কার্যেই ব্যবহার করা হবে। এতে পূর্ব-বাঙলার পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। ভারতেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তান কারাগারে বন্দী, সারা বাঙলা যখন মুক্তির ভিসুভিয়াস; তখন আন্তর্জাতিক মহলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি নিয়ে চলছে নানা ঠান্ডা যুদ্ধ- যার অধিকাঙশই বিভিন্ন ফাইল ও নোটিঙ-টেলিগ্রাম ইত্যাদি পাঠের মাধ্যমে বের করে আনা সম্ভব। এ থেকে কিসিঞ্জারের ভূমিকাটি বেশ ভালো করে উপলব্ধি করা যায়। বর্বর ইয়াহিয়ার সাহস ছিলো না বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর। এর কারণ হলো, ইয়াহিয়া খুব কাছ থেকে বাঙালির উত্থান এবঙ বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাতকোটি বাঙালির ভালোবাসা দেখেছে। তাই সে জানতো- যতোই কথা বলুক, বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিলে তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। ওটা হবে রাজনৈতিক ভুল। তাই ইয়াহিয়া কিসিঞ্জারকে কাজে লাগাতে চাইলো। বস্তুত, বিভিন্ন কূটনৈতিক চিঠিপত্র, যা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত প্রচারিত হয়েছে, তা পাঠ করলে দেখা যাবে- ইয়াহিয়ার চেয়ে কিসিঞ্জারই আন্তর্জাতিক মহলে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির বিষয়ে সোচ্চার ছিলো।

প্রসঙ্গত ক্রিস্টোফার হিচেন্স- এর ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থের একটি অঙশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ক্রিস্টোফার দেখিয়েছেন, কীভাবে একাত্তরের মধ্য আগস্টে ইয়াহিয়া কিসিঞ্জারের ওপর দায়িত্ব দেয় মুজিবকে হত্যা করা হলে, আন্তর্জাতিক মহলে কী রকম উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, তা খতিয়ে দেখার। মজার ব্যাপার হলো, সময়টা মধ্য আগস্ট ছিলো না, ছিলো আট সেপ্টেম্বর, উনিশশো একাত্তর। এই সুনির্দিষ্ট তারিখটি পাওয়া যায় ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে। ওইদিনের সঙবাদপত্রে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি স্পিভাকের আলোচনা সম্পূর্ণ তুলে দেয়া হয়। সে আলোচনার উল্লেখযোগ্য অঙশ নিচে দেয়া হলো-

স্পিভাক: আপনি ওয়াশিঙটন মিটিঙ সম্বন্ধে কী জানেন?
শরণ সিঙ: তেমন কিছুই না।
স্পিভাক: তাহলে শুনুন, ওইদিন কিসিঞ্জার হঠাৎ করে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন।
শরণ সিঙ: ওখানে আর কে কে ছিলেন?
স্পিভাক: সেটা বোধ হয় আমাদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ না।

আট সেপ্টেম্বর, উনিশশো একাত্তরে ওয়াশিঙটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক বসে। এই সঙবাদ পাওয়া যায় রোয়েদাদ খান সম্পাদিত আমেরিকান পেপার্স- এর চতুর্থ খণ্ডে। সেখানকার আলোচনাটা নিচে দেয়া হলো-

কিসিঞ্জার: সিনেটর কেনেডি আজ আমার সঙ্গে দেখা করেন। তার আশঙ্কা মুজিবকে সম্ভবত ইতোমধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে। আপনাদের কী মনে হয়, এটা সম্ভব?

সিসকো: ইয়াহিয়া রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে না।

হেলমস: মুজিব মৃত, এই গুজবের স্বপক্ষে আমাদের কাছে কোনো তথ্য প্রমাণ নেই।

কিসিঞ্জার: আমি এটা কেনেডিকে বলেছি এবঙ তিনি জানতে চেয়েছেন, তার কোনো ছবি কেনো ছাপা হচ্ছে না? আমরা কি আসলেই নিশ্চিত যে, মুজিব বেঁচে আছেন?

উইলিয়ামস: এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, তিনি বেঁচে থাকবেন না, আর তারা একটি বিচারের কথা ঘোষণা করবে। তারা তো এসবও বলে বেড়াচ্ছে যে, মুজিবের জন্য খ্যাতিমান আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

কিসিঞ্জার: আমি কিন্তু কল্পনাও করতে পারি না যে, মুজিব মৃত।

উইলিয়ামস: তারা আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলো মুজিবের বিচার করা হবে। মৃত মুজিবের চেয়ে তাদের কাছে জীবিত মুজিবের অনেক মূল্য।

আলোচনা থেকে বোঝা যায়, কিসিঞ্জার অন্য কোনো প্রসঙ্গে কর্ণপাত না করে একটি বিষয়ই বিভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে- আর তা হলো মুজিব কী মৃত? বিষয়টি অন্যান্যদের মাঝে তেমন গুরুত্ব পায় না বলে, কিসিঞ্জার ইয়াহিয়াকে টেলিফোনে বলে- খোদ মার্কিন প্রশাসনই বিশ্বাস করে না, মুজিব মরতে পারে।

এ তো গেলো আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনার কয়েকছত্র। এবার দেখা যাক মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত দেশীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি কীভাবে গুরুত্ব লাভ করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যা ও বিভৎস নারী নির্যাতনের খবর যেমন ছাপা হয়েছিলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে, তেমনি পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর ক্যামেরা ট্রায়ালের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছিলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

‘জয় বাংলা’- সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়

ত্রিশ জুলাই, উনিশশো একাত্তর সালে ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা শেখ মুজিবের বিচারের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বলে-

তাঁর বিচার করার অধিকার তাদের নেই। জবরদস্তি করে এই প্রহসন করলে বাংলাদেশের মানুষ তা বরদাস্ত করবে না।

এ সঙক্রান্ত প্রকাশিত খবরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য জাতিসঙঘ মহাসচিব এবঙ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করে।

একই পত্রিকার সাতাশ আগস্ট সঙখ্যায় ইয়াহিয়া কর্তৃক শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে ইয়াহিয়ার বক্তব্য উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়-

শেখ মুজিবকে রেহাই দেয়া হবে না। বিচারে তার প্রাণদণ্ড হতে পারে।

‘জয় বাংলা’র প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়-

বিশ্ব জনতার আদালতে শেখ মুজিব একটি মাত্র অপরাধ করেছেন এবং তা হলো, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা-অনুভূতির সাথে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, ছয় দফার সাথে বেইমানি করে প্রধানমন্ত্রী পদকে বড়ো করে দেখেননি। এই অপরাধে যদি শেখ মুজিবের বিচার হয়, তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকেও বিচারের কাঠগড়ায় উঠতে হবে। কারণ শেখ মুজিব আজ ব্যক্তি নন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নাম শেখ মুজিব। মুজিব মানে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কণ্ঠ, বাঙালির প্রাণ, বাঙালির আবেগ। ক্ষমতাদর্পী সেনারা একটি জাতিকে কি নিশ্চিহ্ন করতে পারবে?

‘বাংলাদেশ’- সম্পাদকীয়তে মুজিবের মুক্তি

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ২৪ বছর শেখ মুজিবের উপর জেল, জুলুম, নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরে বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে আটক মুজিবের মুক্তি প্রসঙ্গে ষোলো আগস্ট ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়-

অতীতের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে আমরা নেতাকে ফিরিয়ে এনেছি। এবারে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অস্ত্রের হুঙ্কারে নেতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের চোখের জলকে করতে হবে বারুদ। দুর্জয় বাংলার মাটি থেকে দুর্বৃত্তদের উৎখাত ও বন্দী করে আমরা বিনিময়ে ছিনিয়ে আনবো পরম প্রিয় নেতাকে।

সম্পাদকীয়টির শেষে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়-

এই কথা সত্য যে, নেতার সামান্যতম ক্ষতি সাধিত হলে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকিয়ে রাখা দুষ্কর হবে।

‘রণাঙ্গন’- ‘মুক্তিযুদ্ধ’- ‘সোনার বাংলা’ ও ‘বাংলার বাণী’

পঁচিশ জুলাই, উনিশশো একাত্তর সালে ‘রণাঙ্গন’ পত্রিকায় শেখ মুজিবকে আটক করে ইয়াহিয়ার চক্রান্ত সম্বন্ধে বলা হয়-

বঙ্গবন্ধুর বিচার করে মুক্তিফৌজের শক্তিকে আবেগ আপ্লুত করে দিয়ে সমস্ত বিশ্বের দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে সে।

পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে আরও উল্লেখ করে-

বিশ্ব জনমতকেও আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, যদি ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর বিচার করতে চায়, তাহলে বাংলার মুক্তিফৌজ এমন জবাব দেবে যাতে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হতে পারে।

কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র বলে পরিচিত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার পঁচিশে জুলাই সঙখ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির এক মুখপাত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে-

শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার কোনো অধিকার ইয়াহিয়া চক্রের নাই। পার্টির এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়।

‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার আগস্ট মাসে প্রকাশিত ষষ্ঠ সঙখ্যায় ‘মুজিবের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি’ শিরোনামে পরিবেশিত সঙবাদে ভারতসহ পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের উদ্বেগ প্রকাশ করে তার মুক্তি দাবি করা হয়।

বারোই অক্টোবর ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার বৈদেশিক বার্তা পরিবেশকের বরাত দিয়ে পরিবেশিত সঙবাদে বলা হয়-

বৃটেনের শ্রমিক দলীয় জাতীয় কর্ম পরিষদ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে অবিলম্বে পাক সামরিক উৎপীড়নের অবসান এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানানো হয়।

এখানে একটি বিষয়ের ইঙ্গিত তুলে রাখা প্রয়োজন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি বড়ো রকমের চক্রান্তের জাল বুনেছিলো খন্দকার মোশতাক ও তার সমর্থকরা। তারা নানাভাবে মার্কিন যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে দেশে ধোঁয়া তোলে- ‘স্বাধীনতা না বঙ্গবন্ধুর মুক্তি’ এই বাক্যাঙশে। এর বিস্তারিত থাকবে আগামী পর্বে।

তথ্যসূত্র

আফসান চৌধুরী, বাংলাদেশ ১৯৭১ (দ্বিতীয় খণ্ড), মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৪৭-৪৯

১০ মাঘ, ১৪২০