কেমব্রিজে ডিরাকের কাজের ধরন খুবই নিয়মে বাঁধা। দিনে পাঁচ ঘন্টার বেশি গবেষণায় বিশ্বাসী নন ডিরাক। গরমের দিনে কাজের শেষে তিনি সাইকেল চালিয়ে চলে যান অনেক দূরে। পথে কোন বড় গাছ দেখলে হঠাৎ সাইকেল থেকে নেমে গাছে উঠে যান সুট-কোট-টাই সহ। [শীত-বসন্ত-গ্রীষ্ম-হেমন্ত সব ঋতুতেই তাঁর একই পোশাক। একটা কোট না ছেঁড়া পর্যন্ত তিনি অন্য কোন কোট কেনেন না।] গাছের ওপর কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নেমে আসেন। আবার সাইকেল চালিয়ে ফিরে আসার সময় কোন লেকের পাশে থেমে জামা-কাপড় ছেড়ে নেমে যান লেকের পানিতে, কিছুক্ষণ সাঁতার কাটেন। নোবেল পুরষ্কার পাবার পরেও তাঁর রুটিনে তেমন কোন পরিবর্তন নেই।
গণিত ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার মাঝে মাঝে তিনি পরীক্ষামূলক কাজও করেন। তিনি যে একজন ফার্স্ট ক্লাস ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তা তিনি ভুলে যাননি। নিউক্লিয়ার আইসোটোপ সেপারেশনের কাজে উৎসাহ পেলেন ডিরাক। এসময় তাঁর পরিচয় হলো রাশিয়ান নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো ও তাঁর তরুণী স্ত্রী লিনবভ ভোকমিনজেভা ওরফে রু’র সাথে।
জার্মানিতে তখন হিটলারের স্বৈরাচার শুরু হয়ে গেছে। আইনস্টাইনসহ অনেক জার্মান বিজ্ঞানী দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। ১৯৩৩ সালে আইনস্টাইন যোগ দিয়েছেন প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড স্টাডিজে। সেখানে এক বছর ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাটানোর জন্য আমন্ত্রণ এসেছে ডিরাকের কাছেও। ১৯৩৪ সালের অক্টোবরে ডিরাক প্রিন্সটনে যাবেন এরকম ঠিক হয়ে আছে।
এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিনের একনায়কত্বে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্বাধীনচেতা সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সরকারী অনুমতি ছাড়া কেউই সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে যেতে পারছেন না কোথাও। সোভিয়েত বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো সোল্ভে কনফারেন্সে যোগ দেবার নাম করে অনেক চেষ্টায় রাশিয়া থেকে বেলজিয়ামে এসে আর রাশিয়ায় ফিরে যান নি। ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে কিছুদিনের জন্য কেমব্রিজে এলেন সস্ত্রীক গ্যামো। জর্জ গ্যামো ডিরাকের চেয়ে বয়সে দু’বছরের ছোট। ডিরাকের প্রতিভা ও সাফল্যে স্বাভাবিকভাবেই মুগ্ধ গ্যামো, তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ গ্যামোর তরুণী স্ত্রী রু।
রু খুবই সুন্দরী। কয়েকদিনের মধ্যেই কেমব্রিজে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন গ্যামো দম্পতি। সবাই রু’র রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রু এরকম স্তাবকতায় অভ্যস্ত। গ্যামো ডিরাকের মনযোগ পেতে আগ্রহী। রু’র সৌন্দর্যে ডিরাকের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটছে না দেখে রু কিছুটা অবাক হন, আবার মনে মনে বেশ শ্রদ্ধাও করেন ডিরাককে। তিনি ডিরাকের মৌনতা ভাঙার ব্যাপারে সচেষ্ট হন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীদের ব্যাপারে সহমর্মিতা আছে ডিরাকের। বিজ্ঞানী কাপিৎজা তাঁর বিশেষ বন্ধু। কেমব্রিজে কাপিৎজা ‘কাপিৎজা ক্লাব’ নামে খুবই উঁচুমানের একটি বৈজ্ঞানিক ক্লাব গড়েছেন। ডিরাক সে ক্লাবের সদস্য। রু ডিরাকের সাথে অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করলেন। শুরু করলেন স্ট্যালিনের কড়া সমালোচনার মধ্য দিয়ে।
স্বভাব-নীরব ডিরাকও রু’র সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন। লাঞ্চের টেবিলে ডিরাকের পাশে বসে রু যখন একের পর এক সিগারেট টানতে থাকেন – ডিরাক কোন বিরক্তি প্রকাশ করেন না; যদিও তিনি ধূমপান পছন্দ করেন না। রু ডিরাককে রুশ ভাষা শেখানোর প্রস্তাব দিলে ডিরাক সানন্দে রাজি হয়ে যান। কিন্তু বিনিময়ে রু’কে গাড়ি চালানো শেখাতে হবে ডিরাকের। ডিরাক তাতেও রাজি।
শুরু হলো তাঁদের শিক্ষা-বিনিময়। রুশ ভাষা শেখার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস ডিরাক, কিন্তু গাড়ি চালানো শেখার ব্যাপারে ততটা সিরিয়াস নন রু। তিনি ডিরাকের সাথে কথা বলতেই আগ্রহী বেশি। ডিরাককে নীরব শ্রোতা পেয়ে মনের কথার অর্গল খুলে দেন রু। কয়েক দিনের মধ্যেই রু’র অনেক ব্যক্তিগত কথা জানা হয়ে যায় ডিরাকের।
তারুণ্যের শুরুতে আলেক্স নামে এক যুবকের প্রেমে পড়েছিলেন রু। কবিতা আর ছবির মিশ্রণে আলেক্সের সাথে একটা ফটো-এলবামও বের করেছিলেন রু। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় মারা যান আলেক্স। রাশিয়ায় ফিজিক্স নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিলেন রু।
আলেক্সের মৃত্যুর পর তাঁর বিয়ে হয় তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ গ্যামোর সাথে। স্বামী হিসেবে গ্যামো খুবই ভালোমানুষ। তবুও রু মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে যান ডিরাকের প্রতি। ডিরাকের মধ্যেও এক ধরনের দুর্বলতা দেখা দেয়। এই প্রথম ডিরাক মেয়েদের প্রতি একটা অন্যরকমের আকর্ষণ বোধ করেন – কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেন না কিছুতেই।
গ্যামো একটা স্থায়ী চাকরির সম্ভাবনা খুঁজে দেখছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পরেই কোপেনহ্যাগেনে চলে গেলেন গ্যামো দম্পতি। ডিরাক একটা নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হলেন – যার নাম বিরহ। কোপেনহ্যাগেন থেকে ডিরাককে চিঠি লেখেন রু। ডিরাক রু’র চিঠির উত্তর দেন রুশ ভাষায়। রু সেই চিঠির ভাষাগত ভুলগুলো সংশোধন করে পাঠান ডিরাককে। রু’র চিঠিতে আবেগের কথা থাকে, কিন্তু ডিরাকের চিঠির ভাষা আবেগশূন্য।
নির্ভুলভাবে রাশিয়ান ভাষায় লিখতে পারছেন না দেখে ডিরাক ভাবলেন তাঁর রাশিয়ান শেখা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তিনি আরেকজন শিক্ষকের সন্ধান করতে শুরু করলেন, এবং অচিরেই পেয়ে গেলেন লিডিয়া জ্যাকসনকে।
লিডিয়া সেন্ট জোন্স কলেজের ফেলো মেরেডিথ জ্যাকসনের স্ত্রী। লিডিয়া রাশিয়া থেকে চলে এসেছেন ইংল্যান্ডে। রাশিয়ায় থাকতে তাঁর নাম ছিল এলিজাভেটা ফেন। লিডিয়া একজন রোমান্টিক কবি। কিন্তু কেমব্রিজের বৈজ্ঞানিক আবহাওয়ায় নিজেকে খুবই বেমানান মনে করে মনোকষ্ট পাচ্ছিলেন। ডিরাকের মত বিখ্যাত মানুষকে রাশিয়ান শেখাবার সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি হলেন লিডিয়া। ডিরাকের ভেতর একজন সরল শিশুকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন লিডিয়া। রাশিয়ান ভাষা শেখানোর পাশাপাশি মেয়েদের সম্পর্কে ডিরাকের আগ্রহ বাড়াতেও সচেষ্ট হলেন লিডিয়া। চেষ্টা করলেন ডিরাকের ভেতর কিছুটা হলেও আবেগ তৈরি করতে। বললেন ডিরাকের উচিত একটি ভালো সংসারী মেয়েকে বিয়ে করা। কথায় কথায় জানালেন – স্ত্রী হিসেবে আমেরিকান মেয়েরা নিকৃষ্ট, ইংল্যান্ডের মেয়েরা একঘেঁয়ে, কিন্তু রাশিয়ান মেয়েরা তুলনাহীনা। ডিরাক শুধু বললেন, “এ তথ্য আমার মনে থাকবে।”
কয়েক মাস পর সেপ্টেম্বরে প্রিন্সটনে চলে গেলেন ডিরাক। ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড স্টাডিজের ফাইন হলে ডিরাকের অফিস। ডিরাকের পাশের রুমেই বসেন ইউজিন উইগনার এবং তাঁর পাশের রুমে আইনস্টাইন।
ডিরাক আর আইনস্টাইনকে একই সাথে প্রিন্সটনে পেয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে একটা বিরাট আশার সঞ্চার হয়েছিল যে এই দু’জন মহারথী একসাথে কাজ করবেন। কিন্তু ডিরাক আর আইনস্টাইনের মধ্যে কোন রকমের বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা গড়ে ওঠেনি। কারণ আইনস্টাইন ভালো ইংরেজি জানতেন না আর ডিরাক তাঁর স্বভাবমতো আইনস্টাইনের সাথেও কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না।
ডিরাককে প্রিন্সটনে স্বাগত জানান এবং সব ব্যাপারে সহযোগিতা করেন প্রফেসর উইগনার। হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার ডিরাকের সমবয়সী। প্রিন্সটনে যোগ দিয়েছেন ১৯২৯ সালে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ইতোমধ্যেই যথেষ্ট অবদান রেখে বৈজ্ঞানিক সমাজে মর্যাদা লাভ করেছেন। [১৯৬৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান উইগনার।]
উইগনার ডিরাককে দেখিয়ে দিলেন প্রিন্সটনের কোথায় কী পাওয়া যায়, কোন্ রেস্টুরেন্টে ভালো লাঞ্চ পাওয়া যায়, ডিনারের জন্য কোথায় গেলে ভালো ইত্যাদি।
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই টাউন সেন্টার। লাঞ্চ টাইমে একা একা হাঁটতে হাঁটতে টাউন সেন্টারে গিয়ে উইগনারের নির্দেশিত রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন ডিরাক। ঢুকতেই বেশ জোরালো হাসির শব্দ শুনে এক কোণার টেবিলের দিকে নজর গেলো।
ডিরাক দেখলেন টেবিলে বসে আছেন উইগনার এবং তাঁর সামনের চেয়ারে বসে খিলখিল করে হাসছেন এক যুবতী। তার চেহারার সাথে উইগনারের চেহারার আশ্চর্য মিল। বয়সে উইগনারের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট মনে হচ্ছে, কিন্তু মুখে লম্বা কালো পাইপ এবং পাইপের আগায় জ্বলন্ত সিগারেট। ডিরাক থমকে দাঁড়ালেন। বুঝতে পারছেন না উইগনারের দিকে এগিয়ে যাবেন, নাকি অন্য কোন টেবিলে গিয়ে বসবেন।
উইগনার বসেছিলেন দরজার দিকে পিঠ দিয়ে। তাই ডিরাককে দেখতে পাননি তিনি। কিন্তু সামনে বসা তাঁর ছোটবোন মার্গিট ডিরাককে দেখতে পেয়েছেন। লম্বা পাতলা কুঁচকানো পুরনো স্যুট পরা অতি-সাধারণ যুবকটিকে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াতে দেখে মার্গিট জিজ্ঞেস করলেন, “লোকটা অদ্ভূত না?”
“কোন্ লোকটা?”
“পেছনে দেখো। আমার দিকে তাকিয়ে আছে হা করে।”
পেছনে তাকিয়ে দেখলেন উইগনার।
“আরে কাকে কী বলছিস? ইনি পল ডিরাক। কেমব্রিজের বিরাট ফিজিসিস্ট। গতবছর নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আমাদের ভিজিটিং প্রফেসর।”
হাত তুলে ডিরাককে ডাকলেন উইগনার – “প্রফেসর ডিরাক, আমাদের টেবিলে চলে আসুন।”
ডিরাক এগিয়ে এসে বসলেন উইগনারের পাশে মার্গিটের মুখোমুখি। উইগনার পরিচয় করিয়ে দিলেন, “আমার ছোটবোন মার্গিট। বুদাপেস্টে থাকে, আমার কাছে বেড়াতে এসেছে।”
“হ্যালো প্রফেসর ডিরাক। নাইস টু মিট ইউ” – বললেন মার্গিট।
ডিরাক কিছুই বললেন না। চুপচাপ তাকিয়ে খেয়াল করলেন মার্গিটের ইংরেজিতে হাঙ্গেরিয়ান টান প্রবল।
ডিরাক কিছুই বলছেন না দেখে মার্গিট খুব অবাক হলেন, তার চেয়েও বেশি অবাক হলেন ডিরাকের পোশাক দেখে। জামাকাপড় যা পরে আছেন তা মনে হচ্ছে এক যুগ পুরনো। ডিরাককে দেখে একজন বোকা সাদামাটা মানুষ বলেই মনে হয়। না চিনলে কেউ ভাবতেই পারবেন না যে এই মানুষটা একজন নোবেল লরিয়েট।
“তারপর বলুন কেমন আছেন?” ভদ্রতার খাতিরে প্রশ্ন করেন মার্গিট। ডিরাক ভাবলেশহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলেন, “কেন জানতে চাচ্ছেন?”
মার্গিট বুঝতে পারছেন না ডিরাক কি পাগল নাকি অন্যকিছু। ডিরাক চুপচাপ দেখছেন মার্গিটকে। খুবই দামী এবং অভিজাত পোশাক তাঁর পরনে। সিগারেট টানার ভঙ্গিতেও একটা রাজকীয় ভাব আছে। আর কথায় কথায় হেসে ওঠার অভ্যাস তাঁর।
নীরবতা ভাঙার জন্য মার্গিট বললেন, “বাইরে বেশ দমকা হাওয়া আজ।”
ডিরাক কিছু না বলে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীর পায়ে চলে গেলেন রেস্টুরেন্টের বাইরে। মার্গিট বুঝতে পারলেন না কী হলো। ডিরাক কি রাগ করে চলে গেলেন?
মার্গিট তাকিয়ে দেখলেন ডিরাক রাস্তায় গিয়ে দুই হাত উপরের দিকে তুলে দাঁড়িয়ে আছেন।
কয়েক মিনিট পরে ফিরে এলেন ডিরাক। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “হ্যাঁ, বাইরে বেশ দমকা হাওয়া।”
মার্গিটের মুখ হা হয়ে গেলো। এত সরল মানুষও হয়! ডিরাকের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করলেন মার্গিট। ডিরাকের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তিনি – গভীর স্নিগ্ধ বিষন্ন একজোড়া চোখ, যেখানে তাঁর মত আকর্ষণীয়া যুবতীর জন্যও কামনার কোন ছিঁটেফোঁটা নেই।
মুনি দেখলেই ধ্যান ভাঙাতে ইচ্ছে করে মেয়েদের। মার্গিটেরও ইচ্ছে হলো ডিরাক-মুনির ধ্যান ভাঙাবার।
ডিরাক প্রিন্সটন ক্যাম্পাসের কাছে একটি বাসা ভাড়া করে একাকী থাকছেন। যতক্ষণ অফিসে থাকেন তাঁর কোয়ান্টাম মেকানিক্স বইটার দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ করেন। তারপর নতুন কিছু গাণিতিক সমস্যার কাজ। উইগনার তাঁর একাডেমিক কাজে ভীষণ ব্যস্ত। মার্গিট ডিরাককে সময় দিতে শুরু করলেন। প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই ডিরাকের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হন তিনি। ডিরাককে নিয়ে বেরিয়ে যান ডিনারে। শুরুতে ডিরাক চুপ করে শুনেই যেতেন মার্গিটের কথা। মাঝে মাঝে ‘এক ডিরাক’ বা ‘দুই ডিরাক’ কথা বলতেন।
মার্গিট বলে যান নিজের কথা। চার বছরের বড় ভাই ইউজিনের মেধার সাথে তুলনা করলে নিজেকে গাধা মনে হয় মার্গিটের। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে গাধা ভাবতে ভাবতে পড়ালেখা যেটুকু হতে পারতো তাও হয়নি। মা-বাবা সারাক্ষণই ‘পড়ো’ ‘পড়ো’ করতে করতে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ নষ্ট করে ফেলেছে মার্গিটের। মার্গিট সারাক্ষণই ভাবতো কীভাবে মা-বাবার হাত থেকে পালানো যায়। বাড়ি থেকে চলে যাবার জন্যই সে কিশোর বছর বয়স থেকেই বেছে বেছে ধনী ছেলেদের সাথে প্রেম করতে শুরু করে। উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলে রিচার্ড ব্যালাজকে।
ধনী বাপের ছেলে রিচার্ড অনেকটা প্লেবয় টাইপের। আট বছর ঘর করেছে মার্গিট রিচার্ডের সাথে। দুটো ছেলে-মেয়ে হয়েছে তাদের। আট বছর ধরে মার্গিট দেখেছে রিচার্ড দিনের পর দিন অসংখ্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরি করছে, ভাঙছে। একসময় যে প্লেবয়কে দেখে মজেছিল মার্গিট, আট বছরের মধ্যে সেই রিচার্ড অসহ্য হয়ে ওঠে। আর না পেরে রিচার্ডকে ডিভোর্স করে ছেলে গ্যাব্রিয়েল আর মেয়ে জুডিথকে নিয়ে মা-বাবার কাছে ফিরে এসেছেন দু’বছর আগে। কিন্তু এই দু’বছর ধরে কানের কাছে সারাক্ষণ মা-বাবার উপদেশ অসহ্য লাগতে শুরু করেছে মার্গিটের। তাই ছেলে-মেয়েকে বুদাপেস্টে মা-বাবার কাছে রেখে ভাইয়ের কাছে বেড়াতে এসেছেন মার্গিট। ছেলে-মেয়েকে কথা দিয়ে এসেছেন খ্রিস্টমাসের আগেই ফিরে যাবেন।
ডিরাকের স্বভাবের সাথে কোন মিল নেই মার্গিটের। ডিরাক মুখচোরা, মার্গিট মুখরা। ডিরাট অন্তর্মুখী, মার্গিট বহির্মুখী। ডিরাক আবেগশূন্য, মার্গিট আবেগপূর্ণ। ডিরাক সায়েন্টিফিক হিরো, মার্গিট ‘সায়েন্টিফিক জিরো’।
এত বৈপরীত্য সত্ত্বেও মার্গিটকে ভালো লাগতে শুরু করেছে ডিরাকের। কিন্তু বুঝতে পারছেন না এর নাম প্রেম কিনা।
মার্গিট ভাবলেন ডিরাকের ভেতর আবেগের মত সূক্ষ্ম অনুভূতি জাগাতে হলে নাটক, সংগীত ইত্যাদি শিল্পকলার প্রতি ভালোলাগা জাগিয়ে তুলতে হবে। ডিরাককে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতে শুরু করলেন মার্গিট। হলিউডে তখন ‘গন উইথ দ্যা উইন্ড’-এর মত অনেক ভালো ভালো সিনেমা তৈরি শুরু হয়ে গেছে। দেখা গেলো ডিরাক হাসির ছবি খুব পছন্দ করছেন। বিশেষ করে কার্টুন। পরবর্তীতে অনেক বয়স হবার পরেও ডিরাক একা একা বসে টিভিতে ‘টম এন্ড জেরি’ বা ‘স্লিপিং বিউটি’ দেখতে দেখতে মিটিমিটি হাসতেন।
প্রিন্সটনে সময় দ্রুত কেটে যাচ্ছে ডিরাকের এবং মার্গিটেরও সময় হয়ে আসছে বুদাপেস্টে ফিরে যাবার। খ্রিস্টমাসের সময় প্রিন্সটনে প্রচন্ড ঠান্ডা। এই মারাত্মক ঠান্ডা থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে ডিরাক ঠিক করেছেন ফ্লোরিডাতে কাটিয়ে আসবেন দু’সপ্তাহ। মার্গিটকে একথা বলতেই তিনি দেখলেন একটা অন্যরকম সুযোগ। তিনি ছেলে-মেয়েদের কাছে চিঠি লিখলেন – বিশেষ কারণে খ্রিস্টমাসের আগে তিনি বুদাপেস্টে ফিরতে পারছেন না। তারপর ডিরাকের গাড়িতে গিয়ে উঠলেন ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে।
ফ্লোরিডার- উত্তর-পূর্বে সেন্ট অগাস্টিনে একটা রিসোর্টে উঠলেন ডিরাক ও মার্গিট। পরবর্তী দু’সপ্তাহ একটা ঘোরের মধ্যে কাটলো ডিরাক ও মার্গিটের। ডিরাকের মনে হলো তিনি একটা নতুন কোর্স শিখলেন মার্গিটের কাছ থেকে – জীবনের একটা নতুন অধ্যায়। এই অধ্যায়ে যেসব ঘটনা ঘটলো তা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমীকরণে লেখা যায় না। এখানকার ‘ব্রা ফাংশান’ আসলেই অন্যরকম।
[ শেষ পর্ব ]
মুক্তমনার নিয়মিত পাঠক দাদা,মুলত বিজ্ঞানধর্মী একটাও লেখা মিস করিনা।
দারুন হচ্ছে দাদা।
শেষ পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
@সারোয়ার লস্করঃ অনেক ধন্যবাদ।
এ পর্বের সেরা লাইন,
@তানভীরুল ইসলাম, মুনিরা সম্ভবত এ কারণেই বনে চলে যেতেন :)। অনেক ধন্যবাদ।
প্রথম পর্বের ডিরাক আর দ্বীতিয় পর্বের ডিরাককে মেলাতে অনেকটা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।
এ পর্যন্ত পড়ার পর মনে শুধু একটি বাক্যই লাফালাফি করে যাচ্ছেঃ সখিগো, ভালোবাসা কারে কয়?
চমৎকার লাগছে। সমাপ্যের অপেক্ষায় রইলাম। 🙂
@বাউন্ডুলে বাতাস, অনেক ধন্যবাদ।
প্রথম পর্বটি পড়ে ভাবলাম সব পর্ব শেষে মন্তব্য করব, কিন্তু পারলাম না। বিজ্ঞানীদের গবেষণার সাথে ভালবাসার কাহিনী এমন চমৎকারভাবে মিশ্রণ ঘটানো প্রদীপ দেবের পক্ষেই সম্ভব। শেষটুকু জানার জন্য অপেক্ষায় আছি।
@গীতা দাস, অনেক ধন্যবাদ দিদি।
ঘটনাটি দুঃখজনক। জানার আগ্রহ জাগছে, আইনস্টাইন আর ডিরাকের মধ্যে কোন ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব কি গড়ে উঠেছিল বা তাদের পরিচয় পর্বের কোন বিশেষ ঘটনা রয়েছে কি ?
লেখা বরাবরের মতই চমৎকার। আপনার লেখা পড়ে মনে হয়,’ ইশ!! জীবনটা যদি আরেকটু বড় হতো এবং আরও বেশি কিছু দিন যদি বিজ্ঞান পড়তে পারতাম ! ‘
:hahahee: :hahahee: :hahahee:
@অনিক শাফী, আইনস্টাইন ও ডিরাকের মধ্যে কোন রকমের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও গড়ে ওঠেনি। কারণ আইনস্টাইন আর ডিরাকের দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য ছিল। আইনস্টাইন মাঝে মাঝে মজা করার জন্য ঈশ্বরকে টেনে আনতেন – যেমন ঈশ্বর পাশে খেলেন না – ইত্যাদি। কিন্তু ডিরাক এতটাই নাস্তিক ছিলেন যে ঈশ্বরের উল্লেখও অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন।
প্রথম পর্বটি পড়েছিলাম; আজ দ্বিতীয়টি পড়লাম। আশা করি শেষ পর্বটিও পড়বো।
@মাহফুজ, অনেক ধন্যবাদ।
চমৎকার একটা জীবন ইতিহাস। প্রথম পর্বটা থেকেই আকর্ষন বোধ করেছি। প্রদীপদার এ-ধরনের লেখার ধারই আলাদা। জীবন ইতিহাস বলে নয়, সেই ইতিহাস থেকে যে কেউ নিজের জীবনের ইতিহাসটাকেও একটু বদলে নিতে যেনো উৎসাহিত হয়! অন্ততঃ এটুকু বোধ হয় সবাই অনুভব করে যে ইস আমিও যদি ওদের মতো মানুষ হতে পারতুম! এই উৎসাহ সৃষ্টির সবটুকু কৃতিত্ত্বই মনে হয় লেখকের একার।
পরিশেষে, আজকের পর্বের শেষ বাক্যটা কি একটু চটুল হয়ে গেলো? অসংখ্য ধন্যবাদ প্রদীপ-দাকে এমন সুন্দর জীবনী গুলোকে সামনে তুলে ধরার জন্যে।
@কেশব কুমার অধিকারী,
অনেক ধন্যবাদ কেশবদা। পল ডিরাক আপাত দৃষ্টিতে এতটাই গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন যে তাঁর কার্যকলাপগুলোর অনেককিছুই আমাদের কাছে ভীষণ হাস্যকর মনে হয় – যেমন গাছে উঠে বসে থাকা। তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ব্রা ও কেট ফাংশান চালু করেছেন। অথচ মার্গিটের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয়ের আগে অনেক কিছুই জানতেন না।