দোহাই-
আমি খুবই ইমপ্র্যাক্টিক্যাল মানুষ। সেদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম এত বছর যা কিছু বলেছি-লিখেছি যা কিছু নিয়ে চিন্তাভনা করেছি তার কোনো কিছুই কোনো প্র্যাক্টিক্যাল মানুষের কোনো কাজে আসেনি। বরং ছোঁয়াচে অসুখের মত সেসবের সংস্পর্শে এসে কেউ কেউ আরো ইম্প্যাক্টিক্যালতর হয়ে উটেছে। দেশ-জাতির তাতে কী ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে সেটা না হয় সময়ই বলুক। কিন্তু আমার তাতে খুব লাভ হয়েছে। ইমপ্র্যাক্টিক্যাল অনেক মানুষের সাথে পরিচয়-হৃদ্যতা হয়ে গেছে। নক্ষত্র-খচিত আকাশের নিচে বসে যাদের কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে এমন একটা পৃথিবীর যার সবগুলো নগর গড়ে উঠেছে একেকটা লাইব্রেরীকে কেন্দ্র করে…

এই দুঃসহ সময়ে, এটাও তেমনই একটা ইমপ্র্যাক্টিক্যাল লেখা। কারণ দেশ যাচ্ছে গোল্লায়, আর আমি লিখতে বসেছি “গরীব দেশের মহাকাশ গবেষণার কী দরকার?” এইটাইপের কথাবার্তা। যাক গিয়ে মূল লেখা শুরু করি।

—-

১)
যতই দিন যাচ্ছে একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। “জগৎ এ যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর” তার কোনোটাই নারী বা নররা করেনি। করেছে শিশুরা। (স্যরি, কাজী নজরুল ইসলাম।) কেন এই সিদ্ধান্ত? গ্রীক পণ্ডিত ইরাটোথেনিসের কথাই ধরুন। সে তখন থাকে জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্র মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া-তে। পৃথিবী যে গোলকাকৃতির সেই ধারনা ততোদিনে পিথাগোরাস, অ্যারিস্টোটলের হাত ধরে চিন্তাবিদমহলে বেশ গেড়ে বসেছে। কিন্তু এই গোলোকের মাপ কত সেটা কেউ জানে না তখনো। এমন সময় ইরাটোথেনিসের কাছে এক ব্যক্তি চিঠি লিখে জানালো যে বছরের দীর্ঘতম দিবসে, মিশরের আসওয়ান নগরীতে সূর্য একেবারে মাথার উপরে থাকে। কারণ ঐ ব্যক্তি একবার তেমন সময়ে কুয়ার নিচে তাকিয়ে সূর্য দেখতে পায়নি। কারণ সেটা এতটাই উলম্ব ভাবে ছিলো যে তার নিজের মাথাটাই কুয়ার তলানি আর সূর্যের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করি, ঐসব মরূর দেশে, কুয়া অনেক গভীর হয়, এবং পানির লেভেল হয়তো কয়েক তলা নিচে থাকে। তাই কুয়ার তলায় কোনো কিছুর বিম্ব সৃষ্টি হতে হলে জিনিশটাকে আসলেই একেবারে উলম্ববরাবর হতে হবে। যাই হোক, চিঠি পেয়ে ইরাটোথেনিস ভাবলো, মজার ব্যাপার তো! সেই থেকে সে তক্কে তক্কে রইলো, আর পরের বছরের দীর্ঘ্যতম দিনে গিয়ে হাজির হলো বাড়ির পাশের কুয়ার তলাটা ভালোমত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। ঐ চিঠিপ্রদানকারীর কথা মত, তার মাথাটাও সূর্য আর সূরযের বিম্বের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা। কিন্তু ঐ যে একটু পাশেই জলজ্যান্ত সূর্যটা দেখা যাচ্ছে! তাহলে কি ঐ চিঠি প্রদানকারী ভূল লিখলো?

কথিত আছে এরপর সে আসওয়ান নগরীতে লোক পাঠিয়ে এই কুয়া-ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়েছে। এবং সেটা চিঠির সত্যতাকেই সাপোর্ট করে। শুধু সে চিঠির সত্যতাই যাচাই করায়নি, লোকজনকে পায়ে হাটিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আসওয়ানের দুরত্বও মাপিয়েছে। বোঝাই যায় যে পৃথিবী গোল হয়ে থাকলে, বছরের একই সময়ে সব জায়গায় সূর্য মাথার উপর লম্বালম্বি থাকবে না। কিন্তু কতটুকু দূরত্বে সূর্য কত ডিগ্রি হেলে যাচ্ছে, সেটা থেকে হিসেব করে ইরাটোথেনিসই প্রথম পৃথিবীর পরিধি হিসেব করে ফেলে।

এখন এই ঘটনাকে আমার প্রথমোক্ত “শিশুতত্বের” আলোকে দেখা যাক। যেমন ধরুন যে ব্যক্তি চিঠি লিখেছে, সে পারিবারিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক-শারীরিক নানান রকম সমস্যা নিয়ে লিখতে পারতো। কিন্তু লিখেছে, কুয়ার তলায় সূর্য কেন দেখা যাচ্ছেনা তাই নিয়ে। এবং বয়সে যে সে শিশু নয় সেটা সহজেই অনুমেয়। আবার সেই চিঠি পেয়ে ইরাটোথেনিসও, নিজের কুয়ার তলাটা চেক করতে চলে গেছে। এবং সূর্যের বিম্ব কেন ঠিক মাথার উপর নাই সেই ইনভেস্টিগেশন করতে তুলকালাম বাধিয়ে ফেলেছে! এবং রীতিমত লোক-লস্কর, জ্যামিতি-ত্রিকোনোমিতি খাটিয়ে পৃথিবীর পরিধিই বের করে তারপর সে ক্ষান্ত হয়েছে। বোঝাই যায়, ইরাটোথেনিস আর তাকে চিঠিপ্রদাণকারী দুজনই, তাদের বয়সকে ফাকি দিয়ে নিজের মধ্যে একটা শিশুকেই লুকিয়ে রেখেছিলো।
(উল্লেখ্য সীভ অফ ইরাটোথেনিস নামের মৌলিক সংখ্যা বাছাই করার একটা চমৎকার পদ্ধতিও তার আবিষ্কৃত।)

মেন্ডেলের কথাই ধরুন, পাদ্রী মানুষ। ধর্মকর্ম নিয়ে থাকবে। তা না, বাবা মটরশুটি আর মা মটরশুটির ফুলের রং কেমন হলে বাচ্চা মটরশুটির ফুলের রং কি হবে তাই নিয়ে খেলাধুলা করতে করতে বংশগতিবিদ্যারই সুচনা করে ফেলল। আইনস্টাইন তো আলোর তরঙ্গমূখের উপর চেপে বসলে দুনিয়াটা কেমন দেখাবে তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে বের করে ফেললো আপেক্ষিকতার তত্ব।

সাম্প্রতিক লিওনার্দ সাসকিন্ডের ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স লেকচার সূত্রে দারুণ একটা ব্যাপার জানলাম। ক্লাসিক্যাল থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্ট্রিং তত্ত, কসমোলোজি, কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডাইনামিক্স সবকিছুর মৌলিক সমীকরণই, ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান আর হ্যামিল্টনিয়ান নামক দুই ধরণের গাণিতিক কাঠামোতে ফেলে দেওয়া যায়। সেই ষোড়শ শতাব্দীতে অয়লার আর ল্যাগ্রাঞ্জ যখন তাদের অয়লার-ল্যাগ্রাঞ্জ সমীকরণটা বের করে তখন ভবিষ্যতে এই গণিত যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আবিষ্কারে চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়াবে তা তাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব ছিল না। এমনকি তারা যখন ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের ল্যাগ্রাঞ্জিয়ান ফর্ম নিয়ে খেলাধুলা করছিলো, তখন সেটার কোনো প্যাক্টিক্যাল মোটিভেশন ছিলো না। নিউটনের তিনটে সূত্র আর তার সমীকরণ দিয়েই দুনিয়াটা দারুণ চলছিলো। তারপরেও তারা, এই চমৎকার গাণিতিক ফ্রেমওয়ার্কটা তৈরি করেছে স্রেফ খেলাচ্ছলে। সমীকরণগুলোর অপরূপ সৌন্দর্য ছাড়া বাড়তি আর কিছু পাবার আশা না করেই। (আসলে তারা টাউটক্রনে প্রবলেম নামক একটা পাজল সল্ভ করতে চেষ্টা করছিলো যেখানে এমন একটা বক্র তল খুঁজে বের করতে হবে যার যে অংশ থেকেই বল গড়িয়ে দেওয়া হোক না কেন, গড়িয়ে পড়তে একই সময় লাগে)

বিজ্ঞানের বড় যে কোনো আবিষ্কার, উদ্ভাবন, ধারণাগত বিপ্লবই দেখা যাবে খেলাচ্ছলে ঘটা। (বড় বড় শিল্পকর্মেও তাই) কোনো একজন গ্রোন-আপ মানুষ আর দশজনের মত, বাজার- আটা- তেলটা- নুনটা দিয়েই নিজের জগৎটাকে ঘিরে না ফেলে, স্রেফ শিশুসুলভ কৌতূহল মেটাতে গিয়ে এগিয়ে নিয়েছে পুরো সভ্যতাকেই।

আর এ কারণেই বিজ্ঞান গণিত এইসব জিনিসকে “ইয়ং ম্যান্স গেইম” অভিধা দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষের বয়স বাড়ে স্রেফ বছর পেরোলেই না। বরং একটা মানুষের বয়স তার জীবনের ট্রাজেডির সমানূপাতিক। ভাগ্যের ফেরে খুব কম বয়সেই কেউ কেউ তার শৈশব হারিয়ে ফেলে। আর কারো কারো ভিতরে একটা শিশু জিইয়ে থাকে আজীবন। নিজের ভিতরে একটুকরো শৈশব বেঁচে না থাকলে কারো পক্ষেই সৃষ্টিশীল হওয়া সম্ভব না। উৎপাদনশীল হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ। সৃষ্টিশীল? না।

খুব ট্রাজিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেও সৃষ্টিশীলতাকে ধরে রেখেছে দেখি আমরা যাদেরকে, তাদের জীবনী খেয়াল করলে দেখা যাবে, তারা দুঃখ-কষ্ট তেমন একটা স্পর্শিত হতো না। কিন্তু এই ধরণের মানসিক শক্তি সবার থাকে না।

আর এ জন্যই অঞ্জন দত্তের সুরে বলতে হয়, “জানালা দিয়ে আকাশ টাকে দেখ, টিভি দেখ না।” আমাদের টিভি-ফেসবুক-খবরের কাগজ সব যেন দুঃস্বপ্নের আর ট্রাজেডির ভাগাড় হয়ে পড়েছে। না উটপাখি হতে বলছি না। স্রেফ মনে করিয়ে দিতে চাইছি জানালা দিয়ে আকাশটাকে দেখার কথা। তার জন্যে নিয়ম করে খানিকটা সময় টিভি না হয় না-ই দেখলাম। আপনি হয়তো বড় হয়ে গেছেন, বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু আপনার মাঝে যে শিশুটা আছে তাকেও বাঁচতে দিন।

২)
গণিত-বিজ্ঞান তাও এদেশে ধুকে ধুকে হলেও কিছু মানুষ শেখে। ওদিকে সামাজিকবিদ্যা, ইতিহাস এইসব অনেক বেশি মানুষ পড়লেও শেখে না সম্ভবত কেউই। নইলে যেকোনো একটা বুদ্ধিমান ছেলে বা মেয়েকে জিজ্ঞেস করুণ দেখুন, সমাজ-ইতিহাস কে স্রেফ একগাদা সাল আর একই ধারনাকে নানান মুনি কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞায়িত করেছেন সেইসব জঞ্জাল মুখস্ত করে উগড়ে দেওয়ার প্র্যাক্টিস হিসাবে জানে। ব্যার্থতা কার সেটা আমরা সবাই জানি। তবে ইদানিং, সেইসব মুখস্ত করা জঞ্জালগুলোর কিছু কিছু অংশ মনে পড়ে,তখন বেশ কৃতজ্ঞতাই বোধ করি। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে নীল চাষের ব্যপারটা। ইংরেজ আমল। কৃষকরা অভাবনীয় শোষণের শিকার হচ্ছে নীলচাষকে কেন্দ্র করে। এই অখাদ্যের বাধ্যতামূলক চাষের কারণে, দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। প্রতিবাদ-মিছিল হচ্ছে, “নীলদর্পণ” নাটক লেখা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কিন্তু নীল ঘটিত এইসব শতকোটি ট্রাজেডির সুরহা হয়ে গেল কৃত্রিম নীলের আবিষ্কার আর তার বানিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবার পরে। অন্যদের কী মনে হয় জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় স্রেফ একটা বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত আবিষ্কার একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠির ভাগ্যে এবং দুর্ভাগ্যে কী পরিমান প্রভাব ফেলতে পারে, এই ঘটনা তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

বর্তমান সময়েই খেয়াল করা যাক। ফসিল ফুয়েল, মানে প্রেট্রোলিয়াম ঘটিত কারণে পৃথিবীর কতগুলো দেশ নিদারুণ যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়ছে। আমি এই লেখা লিখতে লিখতেই হয়তো কত মানুষ মারাগেলো, কতগুলো শিশু চিরতরে হারালো তাদের শৈশব। কিন্তু কাল যদি রিনিউএবল এনার্জির একটা সমাধান হয়ে যায় তাহলেই এক নিমেশে বন্ধ হয়ে যাবে এই ট্রাজেডি। (অবশ্য মানুষের [বিশেষ করে অমানুষের] উদ্ভাবন ক্ষমতা অসাধারণ, তারা হয়তো শোষণ নিপিড়নের নতুন টার্গেট ঠিকই খুঁজে নেবে।) সমাধান না হবার কিন্তু কোনো মৌলিক কারণ নেই। সূর্য প্রতিদিনই পৃথিবীকে অফুরন্ত শক্তি যোগাচ্ছে। সেই শক্তিকে ঘরে তোলার একটা স্কেলেবল উপায় কেউ না কেউ বের করে ফেললেই হবে। এবং সেটা করার ধারণাগত মৌলিক বাধাকে পার হতে হবে খেলাচ্ছলেই। শক্তিসমস্যা সমাধান করে পৃথিবী উলটে ফেলবো, এইসব মহৎ চিন্তা মাথায় নিয়ে গবেষণা করতে বসলে হবে না। ইতিহাস বলে শিশুসুলভ কৌতূহল লাগবে।

আর তাই একটা সভ্য জাতিকে (সে গরীব হোক বা বড়োলোক) কৌতূহল চালিত গবেষণার পথ রোহিত করলে চলবে না। মহাকাশ গবেষণা করা, বা ধান-পাটের জীন ম্যাপ করা, বা ফার্মার লাস্ট থিওরেম প্রমাণ করা, এইসব আপাত ইম্প্র্যাক্টিক্যাল ব্যাপারগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবজাতির ভবিষ্যত। যে কোনো তৃতীয় বিশ্বের দেশও সেই ভবিষ্যতের ভাগিদার। কারণ উচ্চতর গবেষণার বোঝাপড়াটা এখনই বুঝে না নিলে একটা দরিদ্র জনগোষ্ঠির দারিদ্র বাড়তে থাকবে ব-ই কমবে না। সামরিক গবেষণা বাদ দিলে, একটা ধুকে ধুকে চলা দেশের খরচের আর অপচয়ের তুলনায়, স্রেফ মানবকেন্দ্রীক – কৌতূহলচালিত গবেষণা প্রোগ্রামগুলোর খরচ যে কত নগন্য সেটা যদি গরীবদেশের মহাকাশগবেষণার বিরোধিতাকারীরা জানতো! অবশ্য “তুই গরীব, খবরদার তুই আকাশ দেখবি না!” যারা বলে তারা না হয় টিভি-ই দেখুক।