বর্তমানে দেশে অনেকটা নিয়ম মেনেই সরকার শেষের পর নির্বাচন কেন্দ্র করে ব্যাপক গোলযোগ চলছে, আশা করতে দোষ নেই যে এই গোলযোগেরও আপাতঃ একটি সমাপ্তি আসবে, উতসব মূখর পরিবেশে আবারো লোকে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ন অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তি সরকার নির্বাচন করবে। যে কোন জাতীয় নির্বাচনের সময়ই সব দেশে গুরুত্বপূর্ন বা জ্বলন্ত ইস্যুগুলি সম্পর্কে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলি তাদের দৃষ্টিভংগী জানায়; সেভাবে চেষ্টা করে জনমতকে প্রভাবিত করতে। জনতার পক্ষেও তখন সহজ হয় তাদের প্রায়োরিটি অনুসারে যোগ্য দল বিবেচনা করে ভোট প্রদান করায়।

বর্তমান গোলযোগ (বলা ভাল সন্ত্রাস) এ মুহুর্তে আলোচনার সকল কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও এক সময় স্তিমিত হয়ে গেলে নির্বাচনী ইস্যুগুলি সামনে আসবে। হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা আন্দোলন এ বছর ছিল জাতীয় রাজনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ন অধ্যায়। বলাই বাহুল্য যে ধর্মীয় সংস্কৃতি প্রধান এই দেশে হেফাজতের ১৩ দফার গুরুত্ব অগ্রাহ্য করা যায় না। তার প্রমান নানান সূত্রে দেখা যায় যে গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইস্যু জনমতকে প্রভাবিত করেছে, সামনের জাতীয় নির্বাচনেও এর প্রভাব থাকবে আন্দাজ করাই যায়। তাই হেফাজতের ১৩ দফা সম্পর্কে বড় দুই দলের দৃষ্টিভংগী স্বচ্ছতার জন্যই পরিষ্কার হওয়া দরকার। সবাই মোটামুটি জানি যে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে কিছুটা আপোষের সুরে থাকলেও পরে ষ্পষ্ট ভাষায় ১৩ দফা মানা যাবে না বলে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী, জনপ্রিয়তায় আরেক অন্যতম বড় দল বিএনপি হেফাজতের বিখ্যাত ১৩ দফা সম্পর্কে কি বলে? সে নিয়েই এই লেখা। বলে রাখা ভাল যে এ লেখার সাথে হেফাজতের ১৩ দফা দাবীর যৌক্তিকতা কিংবা তত সংক্রান্ত আলোচনা ঘটনাক্রমের তেমন গুরুত্ব নেই, তাই হেফাজত/১৩ দফার আলোচনার তেমন অবকাশ এখানে নেই। আলোচনা সম্পূর্নই কেন্দ্রীভূত থাকবে ১৩ দফা সম্পর্কে বিএনপির দৃষ্টিভংগী সম্পর্কে।ে

হেফাজতের ১৩ দফা সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান বুঝতে আমাদের শাহবাগ আন্দোলনের সময়কালে হেফাজতের উত্থান পর্ব থেকে শুরু করতে হবে। তাদের অবস্থান বোঝা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর, আগেই বলে রাখছি, যে কারনে এ লেখা। হেফাজত ঢাকায় প্রথম বড় সমাবেশ করে এ বছরের ৬ই এপ্রিল। সে সমাবেশে খালেদা জিয়ার পক্ষ হতে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল যায়, তাদের সিনিয়র দুই নেতা খোন্দকার মোশারফ হোসেন এবং সাদেক হোসেন খোকা মঞ্চে আরোহন করে [হেফাজতের দাবীর সাথে ‘সংহতি’ প্রকাশ করেন]। এ থেকে সাধারন জনতা হিসেবে আমি সাদা চোখে বুঝি যে বিএনপি হেফাজতের ১৩ দফা দাবীর প্রতিই সমর্থন জানিয়েছে। হেফাজতিদেরও নিশ্চয়ই অন্তত বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের ১৩ দফা পূরন করবে এমন ধারনা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। দলের পক্ষ থেকে এভাবে মঞ্চে উঠে দাবীর প্রতি সংহতি জানানোর আর কি মানে হতে পারে? সেটা হলে আমার আপত্তির কিছুই নেই, গনতান্ত্রিক দেশে এমন একাত্মতাবোধ করাটা অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আমি একমত না হতে পারি তাতে কিছু এসে যায় না।

এরপর যাই এই অভূতপূর্ব নিঃশর্ত একাত্মতা ঘোষনার মাত্র ২ দিন পর; ৮ই এপ্রিল বিবিসির সাথে এক সাক্ষাতকারে হেফাজতের মঞ্চে উঠে সংহতি প্রকাশকারী বিএনপি নেতা খোন্দকার মোশারফ সাহেবেরই বক্তব্য যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। উনি বিবিসিকে স্পষ্ট ভাষায় দেখি বলছেন যে ওনারা ১৩ দফার সবগুলি দাবী মানেন না। সংগত কারনেই প্রশ্ন আসে যে ঠিক কোন দাবীগুলি ওনারা মানেন, আর কোনগুলি মানেন না? কোনগুলি মানেন আর কোনগুলি মানেন না সে কথা কি ওনারা ৬ই এপ্রিল হেফাজতের মঞ্চে উঠে হেফাজতি নেতাদের পরিষ্কার বলেছিলেন? না বলে থাকলে কেন বলেননি? যেখানে হেফাজতের অবস্থান অতি কঠোর এবং দৃঢ়, তাদের একটি দফার সংগেও আপোষ নেই। অর্থাৎ ১৩ দফার একটি দফাও অস্বীকার মানে সবই অস্বীকার করা। এখন পর্যন্ত কোন মিডিয়ায় ওনাদের এই মানা না মানার কোন তালিকা আমি অন্তত দেখিনি। যা ওনারা মানেন না তার প্রতি কিভাবে সশরীরে সংহতি জানানো যায়? আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হল যে হেফাজতের বর্তমান আন্দোলন মূলত যেই দাবী কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল অর্থাৎ ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড ওয়ালা ব্লাসফেমি আইন সেই ব্লাসফেমি আইনই ওনারা মানেন না বলে পরিষ্কার ইংগিত দিয়েছেন। বাকিগুলি সম্পর্কে কোন কথাই তিনি বলেননি। ওনাদের সভায় আলোচনা হয়নি বলে এড়িয়ে গেছেন, অথচ ‘আলোচনা না হওয়া’ বিষয়টিতে আরো ২ দিন আগে হেফাজতের সভায় পদধূলি দিয়ে ঠিকই একাত্মতা প্রকাশ করতে পেরেছেন। কোন বিষয়ে পূর্ব আলোচনা বা চিন্তাভাবনা ছাড়া সংহতি প্রকাশ বিবেচনাবোধ সম্পর্কে সংশয় জাগালেও সম্ভব, কিন্তু দাবী না মেনেও কিভাবে সংহতি প্রকাশ সম্ভব তা আমি বুঝতে অক্ষম।

এর একদিন পর ৯ই এপ্রিল অনেকটা একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখালেন আরেক সিনিয়র বিএনপি নেতা ও প্রাক্তন সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ (অবঃ) মাহবুবুর রহমান। হেফাজতের ১৩ দফা সম্পর্কে ওনার বক্তব্যঃ “তাদের কর্মসূচির প্রতি বিএনপি সমর্থন দিলেও দাবির ব্যাপারে অনেক কিছু বিবেচনা করবে। কারণ এ দাবি মেনে নিলে আমাদের গার্মেন্টের যে লাখ লাখ মেয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে, সেখানে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসে কাজ করতে পারবে না। ব্লাসফেমি আইন পাকিস্তানে আছে বলেই বাংলাদেশে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ব্লাসফেমি আইন কোনো মানদণ্ডেই সমর্থনযোগ্য নয়।“ অর্থাৎ সেই একই কথা, ১৩ দফার কোনটা মানেন আর কোনটা মানেন না সে নিয়ে পরিষ্কার কোন বক্তব্য নেই, তবে হেফাজতের অন্যতম দাবী ব্লাসফেমি আইন যে ওনারাও সমর্থন করেন না এটা অন্তত পরিষ্কার। এখানে আপাতত অপ্রাসংগিক হলেও উনি বেশ একটা ইন্টারেষ্টিং কথা বলে ফেলেছেন জামাতের সাথে বিএনপির মৌলিক পার্থক্য বর্ননায়। “আর জামায়াত দেশে ইসলামী শরিয়া আইন চায়। আমরা তা চাই না।“ বিএনপির মত ইসলাম ভক্ত দল কেন শরিয়া আইন চায় না কে জানে, আপাতত এই প্রশ্ন বাদ থাক।

আরো বিভ্রান্তিকর হল এরপরেও দেখা যায় যে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের সমাবেশে হাজির হয়ে ১৩ দফার সাথে সংহতি প্রকাশ করছেন, যদিও অফিশিয়ালী তারা নিজেরাও জানেন না ১৩ দফার কোনটা তারা মানেন আর কোনটা মানেন না। অদ্ভূত না? একটি উদাহরন দেখতে পারেন ফরিদপুরে প্রাক্তন মন্ত্রী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট চৌধূরী কামাল ইউসুফের এমন একাত্মতা ঘোষনার।

এরপর হেফাজত ঘটায় ৬ই মের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী। ঘাত প্রতিঘাতময় সে অবরোধ কর্মসূচীর অবসান ঘটে মধ্যরাতে সরকারী বাহিনী কর্তৃক হেফাজতিদের বলপূর্বক সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে, যা কেন্দ্র করে ছড়ায় গণহত্যার অভিযোগ সমৃদ্ধ বহু সত্য মিথ্যার মিশেল ওয়ালা কাহিনী। বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান বড় দল হিসেবে মানবিকতা এবং বেশ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সে কথিত গণহত্যায় নিহতদের (গনহত্যার দাবীদারদের ভাষায় হাজার হাজার নিহত) স্মরনে পরদিন ১৮ দলের ব্যানারে এক গায়বানা জানাযার আয়োযন করে। সেখানে জানাযার আগে শোকার্ত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা এক জ্বালাময়ী সংক্ষিপ্ত ভাষন প্রদান করেন। আমাদের আলোচনা বিষয়ক ওনার বক্তব্যঃ “আগামী দিনে একদিন না একদিন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় এনে, দাবি পূরণ করে হাসিমুখে ফেরত পাঠানো হবে।’” এ কথায় অন্তত কোন অষ্পষ্টতার প্রশ্ন নেই। অত্যন্ত পরিষ্কার কথা, ওনারা ক্ষমতায় আসলে (কারন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ১৩ দফা মানবে না বলেই দিয়েছে) হেফাজতিদের দাবী দাওয়া নিয়ে ঘেরাও অবরোধ এসব হুজ্জতেরও কোন দরকার পড়বে না, কারন বিএনপি সরকার তাদের স্ব-উদ্যোগে ঢাকায় দাওয়াত করে যাবতীয় সব দাবী পূরন করে ফেরত পাঠাবেন। বেশ, আগেই বলেছি যে হেফাজতের দাবীর প্রতি একাত্মতা প্রকাশের অধিকার যে কারোরই আছে।

শুধু বেশ বিস্ময়কর ব্যাপার হল যে সেই একই দিনে আরেক ডাকসাঁইটে বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ার হেফাজতের ১৩ দফা সম্পর্কে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও অবস্থান পরিষ্কার করেননি, আবারো পাঁকাল মাছের মতই এড়িয়ে গেছেন।

এরপর মিডিয়ায় ঝড় তোলে হেফাজতের শীর্ষ নেতা আলেমে দ্বীন আল্লামা শফি সাহেবকে কেন্দ্র করে তেতূল তত্ত্ব বিষয়ক বিতর্ক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির সেলিব্রিটি এমপি বেগম আশরাফি পাপিয়াও আল্লামা শফি সাহেবের সমর্থনে দেওয়া বক্তব্যে ১৩ দফা সম্পর্কে অনেকটা সাদেক হোসেন খোকার মতই বক্তব্য দেন, মেঠো কথার কথা নয়, খোদ সংসদে দাঁড়িয়ে (সম্ভবত জুন মাসের শেষের কোন দিনে)। এই মাননীয়া সাংসদের মতে আল্লামা শাফি সাহেবরা ১৩ দফা সম্পর্কে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে ষ্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং সেই ব্যাখ্যায় ষ্পষ্টতই উনি সন্তুষ্ট। ১৩ দফার কোন দফায় উনি বা দলের কোন সমস্যা আছে জানাননি। এ থেকেও আন্দাজ করা যেতে পারে যে ওনারা ক্ষমতায় আসলে হেফাজতের ১৩ দফা বাস্তবায়ন করবেন। বোনাস হিসেবে ওনার বক্তব্য থেকে আমরা আরো জানতে পারি যে শাহবাগে মোমবাতি জ্বালানোর (ভাষান্তরে মংগল প্রদীপ) হেফাজতি ইন্টারপ্রেটেশন; অর্থাৎ পৌত্তলিকতার ভয়াবহ অপরাধ সে বিষয়েও বিএনপি একমত।

এরপর বিএনপির মহাসচির মির্জা ফখরুল অগাষ্টের ২৫ তারিখ ঠাকুরগাঁয়ে এক সভায় আবারো ধোঁয়াশা মার্কা বক্তব্য দেন। ওনার কথা, “BNP Acting Secretary General Mirza Fakrul Islam Alamgir says his party agreed with only a few of Hefazat-e-Islami’s demands. আবারো সেই একই প্রশ্ন এসে যায়, “only a few” বলতে ওনারা ঠিক কোন কোন দাবী মানার কথা বলছেন? আরো বড় প্রশ্ন, কেনই বা বার বার এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে ওনারা এভাবে এড়িয়ে যান? পরিষ্কার জবাব দেন না? ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করার আহবান জানানো হয়েছে, এমনকি সরকারী দলের পক্ষ থেকেও তাদের এ ব্যাপারে অবস্থান পরিষ্কার করার আহবান জানানো হয়েছিল, বলাই বাহুল্য কোন লাভ হয়নি। মির্জা সাহেব এখানে আরো মজার কথা বলেছেন। “but we do not agree with their views on women’s rights”. মজার ব্যাপার হল যে ওনার নিজ দলের সেলিব্রিটি এমপি পাপিয়া সংসদে জ্বালাময়ী ভাষায় হেফাজতের দাবীনামায় নারী অধিকার হরনের মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে বলে সরকারী দল এবং মানবাধিকার কর্মী্দের তূলোধূনো করেছেন আমরা আগেই দেখলাম। তাহলে মির্জা সাহেব আবার কোথা থেকে হেফাজতের দাবীনামায় নারী অধিকার পরিপন্থী কিছু খুঁজে পান? পাপিয়া এমপি আশা করি মির্জা সাহেবকেও মিথ্যাচার, হেফাজত বিদ্বেষের কারনে সহসা এক হাত দেখে নেবেন। মির্জা সাহেবের এই বক্তব্যের পর আর বিএনপির কোন উল্লেখযোগ্য নেতার ভাষ্য এখনো আমার চোখে পড়েনি।

এখানে পয়েন্ট হতে পারে যে কারো দাবী প্রকাশের গনতান্ত্রিক অধিকারে সংহতি জানানো গনতান্ত্রিক সংস্কৃতি, তার মানেই এই নয় যে সেসব দাবীতে সংহতি প্রকাশকারীকেও একমত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে যে হেফাজতের ঠিক কোন কোন দফা বিএনপি মানে এবং কোনগুলি মানে না? সেটা তারা কেন বারংবার জিজ্ঞাসা সত্ত্বেও বলেন না? কেন তাদের নিজেদের কথাবার্তাই স্ববিরোধী? দ্বিতীয়তঃ, তাদের নেতারা হেফাজতের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে কিন্তু কোনদিন বলেন না যে আপনাদের সব দাবী আমরাও সরকারী দলের মতই মানি না, কেবল আপনাদের দাবী পেশ করার অধিকারে সমর্থন জানাই। এমন কোন কথা কি ওনারা বলেছেন? ওনারা সোজা সাপ্টা হেফাজতের মঞ্চে উঠে তাদের দাবীর সাথে সংহতি জানান, যার সরল মানে কেবল মত প্রকাশের স্বাধীনতাই নয়, হেফাজতের সব দাবী দাওয়ার প্রতিই ওনাদের সরাসরি সমর্থন আছে।

সাদেক হোসেন খোকাকে অবশ্য এ ব্যাপারে ধন্যবাদ দিতে হয়, উনি সোজা সাপ্টাই দলের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। ওনারা ক্ষমতায় গেলে হেফাজতকে ডেকে এনে সব দাবী দাওয়া পূরন করে দেবেন। তার এ বক্তব্যর ৬ মাস পরেও যখন বিএনপি থেকে কোন প্রতিবাদ আসেনি তখন ধরে নেওয়া মোটেই অসমীচিন নয় যে এটাই বিএনপির দলীয় অবস্থান। দৃশ্যটা চিন্তা করতে বেশ ভালই লাগে; হেফাজতের সব দাবী মানা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মূর্তির নামে স্থাপিত ভাষ্কর্য সরানোর কাজ চলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা ভাংগা হচ্ছে, হাসিমূখে ভাংগার কাজ তদারক করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা, পাশেই আছেন হেফাজত সম্মত শালীন পোষাক পরিহিতা বেগম পাপিয়া এমপি। এক্ষেত্রে নারী পুরুষের এক সাথে বিচরনও নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই হেফাজত সম্মত কোন উপায়েই হবে, কারন হেফাজতের সব দাবীই তো মানা হয়েছে।

পাঠকরা আশা করি এরই মধ্যে বুঝে নিয়েছেন হেফাজতের ১৩ দফা বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কি। তারা একদিকে হেফাজতকে বোঝাচ্ছেন যে তারা হেফাজতিদের দাবী দাওয়ার ব্যাপারে তারা পূর্ন সহানুভূতিশীল। আরেক দিকে নিজেদের মৌলবাদী শক্তি নয়, আধুনিক ভাবাপন্ন সেটা প্রমান করার জন্য সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হলে সব দাবীতে একমত নই, কিছুতে একমত জাতীয় ধোঁয়াশা বক্তব্য দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন। আরো মজার হল কোন কোন দাবীতে একমত এবং কোন কোন দাবীতে একমত নন তাও তারা কিছুতেই বলেন না। এ অবস্থান থেকে দুটি সিদ্ধান্তে আসা যায়, এক বিএনপির এই অতি গুরুত্বপূর্ন ১৩ দফা সম্পর্কে কোনই চিন্তাভাবনা নেই, সম্পূর্ন বিভ্রান্তিকর অবস্থায় আছে। নইলে তাদের অবস্থান পুরোপুরি প্রতারনা মূলক; তারা ভোটাদের হেফাজতের ১৩ দফা সম্পর্কে দলীয় অবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারনা দিচ্ছেন হেফাজতি আবেগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যাবহার করার জন্য এবং একই সাথে হেফাজতিদের সাথেও প্রতারনা করছেন (যদি না ১৩ দফার পুরো ব্যাপারটাই আসলে পাতানো খেলা না হয়)। কোনটা সঠিক সেটা তারাই ভাল জানেন। আগেই বলেছি যে ১৩ দফা কিংবা ১৩ দফার কিছু দফায় একমত হওয়া দোষের কিছু নয়, সেটা মৌলিক অধিকার। কিন্তু চরম দায়িত্বহীন অবস্থান কিংবা প্রতারনাপূর্ন দ্বি-মূখী অবস্থান অবশ্যই নিন্দনীয়। নানান সূত্রে জানা যায় যে হেফাজতের ১৩ দফায় সম্মত না হওয়ায় হেফাজত কর্মী সমর্থক বহু লোক আওয়ামী লীগকে শুধু ভোটই দেবে না পন করেছে তাই নয়, তারা সরাসরি স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজে করেছে। তাদের নিশ্চয়ই জানার অধিকার আছে যে যাদের তারা বিকল্প হিসেবে পছন্দ করছে ১৩ দফা সম্পর্কে তাদের ভাবনা আসলে কি।

এখানে আরো লক্ষ্যনীয় যে হেফাজত প্রথম থেকেই বলে আসছে যে তাদের ১৩ দফার একটি কোনও দফার সাথেও আপোষ তারা কোন ভাবেই মেনে নেবে না। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক বা ক্ষমতায় আসতে চায় ১৩ দফার সব দফাই মেনে নিতে হবে। এর সরল মানে হল বিএনপি সামনের বার সরকার গঠন করলে ১৩ দফার সব দফাই মেনে নিতে হবে। বিএনপি তাতে ভোটের আগেই সম্মতি জানালে আপত্তির কিছু নেই। (ততপরবর্তী একটি সম্ভাব্য চিত্র আমরা ওপরে দেখার চেষ্টা করেছি)। আর যদি তারা ১৩ দফার যে কোন একটিও দাবী না মানে (যেটা মনে হয় বাস্তব ভিত্তিক সম্ভাব্য চিত্র) তাহলে আবার নিঃসন্দেহে হেফাজত ঢাকা শহর ঘেরাও, দাবী না মানা পর্যন্ত অবরোধ, সরকার পতনের হুমকি এসব কর্মসূচী চালাতে থাকবে নিজেদের কথার মান রাখতেই। হেফাজতি নেতারা মাননীয় আলেম মানুষ, ওনারা নিশ্চয়ই মোনাফিক নন। কথা দিয়ে কথা রাখেন না বা দুই দলের জন্য দুই নিয়ম এমন নিশ্চয়ই হতে পারে না। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকতে চায় ওনারা তাদেরই ১৩ দফার সব দফা মানাতে একই গতিতে তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাবেন এটা হেফাজতের কথাতেই ধরে নেওয়াই যায়। এ মুহুর্তে বিএনপির দ্বি-মূখী অবস্থানের ব্যাপারে হেফাজতের অবস্থান কি সে নিয়েও চিন্তাভাবনা আপাতত স্থগিত থাকুক। আর ১৩ দফার কোন একটি দফা না মানার পরেও যদি হেফাজত যদি বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে একই কায়দায় ব্যাপক আন্দোলন শুরু না করে তাহলে বুঝতে হবে যে ১৩ দফার পেছনে আসলেই কোন ঘটনা আছে, সেটা নিছকই সরল ধর্মীয় দাবী দাওয়া নয়।

আমাদের সংস্কৃতিতে দায় স্বীকার করার তেমন ব্যাপার নেই। দিনে দিনে এই কুপ্রবনতা আরো বাড়ছে। কিছুদিন আগে একজন জাতীয়তাবাদী কোন এক টিভি টকশোতে বংগবন্ধুর পাকিস্তান সফরের সময় তার পাশে রাজাকার শাহ আজিজের ছবি প্রদর্শন করে হাতেনাতে ধরা খেয়ে যান (কথিত শাহ আজিজ আসলে পাকিস্তান সরকারের অফিসার)। ভদ্রলোক এহেন ধরা খাওয়ায় তেমন লজ্জিত হয়েছেন বলে মোটেই মনে হয়নি। আজ এক কথা মিডিয়ায় বলে পরে আবার আমি তেমন কথা বলিনি, মিডিয়াই আমার মুখ দিয়ে বলিয়েছে, হলুদ সাংবাদিকতা, বিকৃত করা হয়েছে…ইত্যাদী নানা বিধ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে পুরোপুরি অস্বীকার করা ডালভাত। এ তালিকায় রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, এমনকি ধর্মীয় নেতা কেউই কম যান না। হেফাজতের ১৩ দফা সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে নির্বাচনের আগে অবশ্যই উচিত পরিষ্কার অবস্থান জেনে নেওয়া যাতে ভবিষ্যতে তেমন উকিলী কায়দায় দায় অস্বীকার করা না যায়। তাদের নির্বাচনের আগে অবশ্যই নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে; ১৩ দফার ঠিক কোনগুলি তারা নির্বাচিত হয়ে সরকারে এলে কায়েম করবে এবং কোনগুলি তারা মেনে নেবে না বলতে হবে। এমন স্বচ্ছ অবস্থান সাধারন ভোটার, হেফাজত সকলের জন্যই দরকার। হেফাজত ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবীতে আবারো ২৪শে ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করবে বলে ঘোষনা দিয়েছে। আশা করি বিএনপি তার আগেই অবস্থান পরিষ্কার করবে।